অন্তরালের কথা পর্ব ৫০

#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৫০
.
.
” তুমি একা কোলে নিয়ে বসে থাকলেই চলবে? এখানে যে এতগুলো মানুষ বসে আছে তাদের কী হবে শুনি? ”
” নিবে নিবে, একে একে সবাই নিবে। আগে আমাকে তো মন ভরে দেখতে দাও।”
বলেই অতল নিজের সন্তানতুল্য ভাতিজাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে সন্তান বুকে জড়াতে না পারার আক্ষেপ ঘোঁচানোর চেষ্টা করল।
.
কোনোমতেই অফিসের কাজে আজ তিহানের মন বসছিল না। কেমন যেন এক অদ্ভুত অস্থিরতা বিরাজ করছিল তার মাঝে। তাইতো লাঞ্চের সময় লাঞ্চ না করে একেবারে ছুটি নিয়ে এসে পড়ে বাড়িতে।
বিছানার এক কোণে বসে টিভির রিমোট হাতে নিয়ে বিভিন্ন চ্যানেল পাল্টাচ্ছে নিজেকে স্থির ও স্বাভাবিক রাখতে কিন্তু, তাতেও যে স্থির হচ্ছে না তিহান। কি করবে সে! ভাবতেই মনে পড়ল, সে যে বাড়ি থেকে তার প্রিয় কিছু সংখ্যক বই এনেছিল সেগুলোর কথা। ভাবতেই তিহান বিছানা ছেড়ে এগুলো বুক সেল্ফের দিকে।
বুক সেল্ফ খুলে দেখতে পেল বছর খানেক আগে বইগুলো যেভাবে রেখেছিল আজও ঠিক সেভাবেই আছে। বইয়ের পাতা খুলে দেখা তো দূরের কথা ক’টা বই এনেছে সেটাই গুনে দেখেনি আজ অবধি। কোন বইটা পড়বে ভেবে, বুক সেল্ফে এক সারিতে সাজিয়ে রাখা সেই বইগুলো নাড়তে লাগল। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল বইগুলোর মাঝে একটি যে কালো রঙের ডায়েরির উপর। যেটা কিনা তিহানের নয়। তাহলে ডায়েরিটি কার! ভাবতেই ডায়েরিটি হাতে তুলে নিল তিহান। আর গিয়ে পা তুলে বসল বিছানার উপর।
ডায়েরিটি কার সেটা জানতেও ইচ্ছে করছে তিহানের আবার বিনা অনুমতিতে অন্যের ডায়েরি নিজ দায়িত্বে পড়তেও অস্বস্তি লাগছে। কি করবে ভেবে ভেবে একসময় ডায়েরিটি খুলেই ফেলল তিহান। কারণ এ ঘরে যে সে ব্যতীত কেউ নেই বা থাকে না, বা আজ অবধি কেউ আসেনি। তাহলে ডায়েরিটি কার সেটিই তো তাকে জানতেই হবে।
ভেবেই বেশ উৎসুকভাবে ডায়েরিটা মেলল তিহান। তবে প্রথম পৃষ্ঠার লেখাটি দেখে কেমন যেন লাগল তিহানের কাছে। একেতো লেখাটি পরিচিত লাগছে তার কাছে তার উপর আবার দুটি শব্দের বড় বড় অক্ষরে লেখার প্রতিটি টানে যেন এক গভীর গোপনীয়তা অনুভব করতে বাধ্য করছে তাকে। তবে প্রথম পৃষ্ঠার মাঝখান জুড়ে এ লেখাটির কারণ তিহান বুঝে উঠতে পারছে না।
আর সেই লেখাটি হচ্ছে, ” অন্তরালের কথা ”
লেখাটি পড়েই এক অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস অনুভব করল সে। আগ্রহ নিয়ে গেল দ্বিতীয় পৃষ্ঠায়…
.
” কখনো ভাবিনি আমার মতো চঞ্চল মেয়েকেও ডায়েরি নামক বস্তুটির সাথে জুটি বাঁধতে হবে। স্কুল লাইফে ফ্রেন্ডরা যখন ডায়েরি লিখত আমি হাসতাম। বলতাম, তোরা ডায়েরি লিখে কী মজা পাস রে? তখন ওরা মুখ চুপসে বলতো, যেদিন আমাদের মতো বহু না বলা কথা বলতে চেয়েও সহস্রবার পিছিয়ে যাবি সেদিন বুঝবি কি মজা পাই আমরা।
এ কথার অর্থ তখনও বুঝতাম না আর বুঝার চেষ্টাও করতাম না। তবে আজ সে কথাটির অর্থ বেশ ভালোভাবেই বুঝি। যেদিন থেকে তিহান নামক মানুষটির সাথে নিজেকে জড়িয়েছি সেদিন থেকেই আমি সেই কথাটির সারাংশ খুঁজে পেয়েছি। ”
.
পৃষ্ঠা জুড়ে কোত্থাও কোনো তারিখ লিখা নেই, বার লিখা নেই, এমনকি কারো নামও লিখা নেই। কেবল কয়েক লাইনের এক দীর্ঘশ্বাস লিখা। তবে ক্ষুদ্র কয়েক লাইনের অর্থ যেন বৃহৎ ধারণা প্রকাশ করছে তিহানের কাছে। কারণ সে যে বুঝে গিয়েছে ডায়েরিটি কার! আর সেটিও বুঝেছে শুধুমাত্র ছোট্ট এক “চঞ্চল” নামক শব্দটি দেখে। সেই সাথে মনের মাঝে সৃষ্টি করেছে এক উত্তেজনাময় পরিবেশ। আর উত্তেজনাময় পরিবেশ সৃষ্টি করবে নাই বা না কেন, এ ডায়েরি যে অন্য কারো নয়। এ কালো রঙের দীর্ঘশ্বাস জড়িত ডায়েরিটি যে নিদ্রার। যার প্রথম লেখার টানেই রয়েছে তিহানকে ঘিরে তার আকাশ ছোঁয়া যন্ত্রণা।
ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে তিহান গেল তৃতীয় পৃষ্ঠায়…
.
” সত্য কখনো চাপা থাকে না, সত্য সবার সামনে আসবেই। তাই হাজার চেষ্টা করলেও কিছু কিছু জিনিস লুকিয়ে রাখা যায় না, এমনকি লুকিয়ে রাখা সম্ভবও না। তেমনি উনিও লুকিয়ে রাখতে পারেনি। ভাগ্যিস সেদিন আলমারি গুছাতে গিয়ে উনার অতীতের কিছু স্মৃতি পেয়েছিলাম। তা নাহলে তো সারাজীবন ভেবেই পার করে দিতাম কেন উনার সাথে আমার সম্পর্কটি এতো দূর্বল! কেন আর পাঁচটা স্বামী-স্ত্রীর মতো আমরা দুজন না! তবে এখন আর সেই ভাবনায় আমি মশগুল থাকি না। থাকি না উনাকে কাছে পাবার আশায়। আর থাকবোই বা কেন, যে মেয়ের স্বামীর অতীতের ভালোবাসার মানুষটি সর্বক্ষণ তার চোখের সামনে থাকে সেই স্বামী কি তার স্ত্রীর স্পর্শে কাতর হতে চাইবে? চাইবে না।
আমি এখন বুঝতে পারছি উনি আর আপু সামনাসামনি হলে সেসময়টা অতল ভাইয়া কেন এতো অস্থির থাকে। হয়তো আমারই মতো সেও জানে সবটা আর আমারই মতো গোপন করে গিয়েছে। তবে তফাৎ হলো উনার মাঝে। তানহা আপু সবটা ভুলতে পারলেও সে সক্ষম হলো না ভুলতে। বলতে হবে এটা সম্পূর্ণই আমার ভাগ্য। ”
.
তিহানের মাথা ভন ভন করে ঘুরছে। সারা শরীর দিয়ে ঘাম ছুটে গিয়েছে তার। নিদ্রা কী লিখেছে এসব! তারমানে সবাই সবকিছু জানে, কেবল সেই জানাজানির রহস্যটাই তারই অজানা! ভেবেই গলা শুকিয়ে আসছে তার। এই অস্থিরতা নিয়েই তিহান ডায়েরির চতুর্থ পৃষ্ঠায় গেল।
.
” প্রতি রাতে চোখের জল ফেলা যেন এক অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে আমার। আজকালতো চোখের জল না ফেললে ঘুমই আসে না। জীবন কতটা অদ্ভুত! ”
.
হাত বাড়ালো পঞ্চম পৃষ্ঠার দিকে…
.
” সবকিছু জেনেও এই অল্প সময়ে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি উনাকে। তার কারণ আপুর প্রতি উনার ভালোবাসার গভীরতা অনুভব করে। এই জগতে যে এরকম ভালোবাসা পাওয়া তো দূরের কথা চোখের দেখাও মেলে না। আর সেখানে উনি জানে আপু এই জীবদ্দশায় তার হবার নয় তারপরও নিঃস্বার্থভাবে আপুকে ভালোবেসে গিয়েছ। আর সেই ভালোবাসার কূপটা এতটাই গভীর ছিল যে আমার মতো সুন্দরী মেয়েকে দিনের পর দিন নির্জন রাতে বদ্ধ ঘরে পেয়েও ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধটিও করেনি। আমি জানি উনি কখনো আমার হবে না, উনি আপুর ছিল আপুরই রবে। তবে কি বেশ আফসোস হয় উনাকে পাবার জন্য আবার হিংসেও হয়। আর হিংসেটা কিন্তু আপুকে ঘিরে নয়। হিংসে হয় কেন আপুর আগে উনার জীবনে আমি এলাম না এই ভেবে। অন্তত প্রাণ ভরে বেঁচে থাকার জন্য হলেও নিঁখুত ভালাবাসা টুকু পেতাম। উনি আমার না-হলেও হাল ছেড়ে দেব না আমি। আমৃত্যু অবধি নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাব উনাকে নিজের করে বাঁধার জন্য। বাকিটা আল্লাহ যা ভালো মনে করবেন তাই হবে । ”
.
কিছুটা সময় ঝিম মেরে বসে ডায়েরির ষষ্ঠ পৃষ্ঠায় গেল।
.
” আজকাল প্রায় রাতে উনার দু’হাত আমায় ঝাপটে ধরে রাখে। যার ফলে ঘুম আসে না আমার। নির্ঘুমেই কেটে যায় পুরো রাত। তবে এ নির্ঘুমের পেছনে অস্বস্তিবোধ দায়ী নয়, দায়ী হচ্ছে প্রশান্তিময় অনুভূতি। ”
.
একপলক নিজের দু’হাতের দিকে তাকালো তিহান। তারপর গেল সপ্তম পৃষ্ঠায়।
.
” খোলা ছাদে মাঝরাত অবধি আমায় বুকে জড়িয়ে জ্যোৎস্নাবিলাস করে এসে অঘোরে ঘুমোচ্ছে উনি। আর আমি সেই সুখময় অনুভূতি অনুভব করতে গিয়ে আরও একটি রাত নির্ঘুমে কাটিয়ে দিয়ে বিরাজ করছি তার ঘুমন্ত মুখটির মায়াময় দেশে। ”
.
ডায়েরির প্রতিটি পাতার, প্রতিটি লাইনের, প্রতিটি বাক্যে ছিল তিহানের প্রতি উজাড় করা নিদ্রার ভালোবাসার টান। যেটা তিহানকে নিয়ে যেতে বাধ্য করল অপরাধবোধের শেষ সীমানায়। তারপরও এগুলো অষ্টম পৃষ্ঠার দিকে…
.
” বেশ ইচ্ছে করছে উনাকে নিয়ে কিছু লিখতে। দেখি মনের ভাব ফুটিয়ে তুলতে পারি নাকি।
মেঘালয় ছুটে যাচ্ছে সীমাহীন পথে,
এই নিঃশ্বাসটিও বিচরণ করছে তোমার হৃদপথে।
যার না আছে শুরু, না আছে শেষ,
যার অনুভূতিগুলো অন্তহীন রেশ।
আকাশ ভেঙে নেমে আসে ঝুমুর ঝুমুর বৃষ্টি ,
তুমি হাজারো মানবের ভিরে এক অতুলনীয় সৃষ্টি।
ভূ-মৃত্তিকা প্রকৃতির লীলা খেলার অভ্যাসনুযায়ী বৃষ্টিবিলাসী,
মানবী মৃত্তিকা যে তোমার মাঝে মনোবিলাসী।
অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশ কোণে উঁকি দেয় উদীয়মান তপন,
জীবন নামক রঙমঞ্চে তুমি হলে কাঙ্খিত স্বপন।
কোথাও আঁধার , কোথাও আলো এটাই যে ধরনী ,
তোমারি স্বপ্নে বিভোর থেকে হতে হয় স্বপ্নচারিনী।
আকাশ যেমন মেঘের ভালোবাসায় লিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে দেয় বিজলীর আলোড়ন,
তোমার ভালোবাসার পরশে এ দেহ হয়ে উঠে শিহরণ।
চোখ না থাকা সত্ত্বেও বাতাসের বেগ অনুভবে মেতে উঠে গাছ-গাছালি হাসি-হাসি ,
তোমার ভালোবাসার মোহে চোখ বুজে এ হৃদয় বলে উঠে ভালোবাসি। ”
.
কবিতাটি পড়ে তিহানের বুকটা কেঁপে উঠল। আর অনুভব করল নিদ্রার ভালোবাসার পরিমাণ। তারপর এগুলো নবম পৃষ্ঠায়…
.
” এরকম জঘন্য বিষয় নিয়েও কিছু লিখতে হবে আমি ভাবতে পারিনি কখনো। আর না লিখেই বা কী করব মন জুড়াবার জায়াগা তো নেই, তাই এটাকেই আপন করে নিতে হচ্ছে।
গোটা সমাজের সামনে আজ আমি স্ত্রীরূপী মানবী কিন্তু, আয়নার জগতে আজ আমি ধর্ষিতা। আমার নিজের নজরে আজ আম ধর্ষিতা। আর সেই ধর্ষক হচ্ছে আমার স্বামীরূপী ব্যাক্তিটি। যার বিচার এ সমাজ কেন, গোটা পৃথিবীতেও নেই। ”
.
নিজের প্রতি ধিক্কার দিতে বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তিহান। আর চোখ ঘুরালো দশম পৃষ্ঠায় এই পৃষ্ঠাটি খুব গুছিয়ে লিখা হয়েছে , যেটা এক নজর দেখেই বুঝতে পারল তিহান। পৃষ্ঠার উপরিভাগে তারিখ, বার বসানো। এমনকি নিচে রয়েছে নিদ্রার স্বাক্ষ্যর। এত পরিপাটি দেখে তিহানের কেমন যেন মনে হলো। তাই অন্যকিছু লক্ষ্য না করে পড়তে আরম্ভ করল…
.
” আজ মাস খানেক পর আবার ডায়েরির সামনে বসলাম। শরীরের ওপর তো আর জোর চলে না। আজকাল শরীরটা একদমই ভালো ঠেকছে না আমার। মনে হচ্ছে দিন ফুরিয়ে আসছে। তা না-হলে সর্বক্ষণ এতো খারাপ লাগবেই বা কেন! তারউপর মাথা ঘুরানো, বমি তো লেগেই রয়েছে। হুট করে কেন এরকম হচ্ছে বুঝতে পারছি না। তবে হ্যাঁ, ইদানিং কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি, তাও আবার নিজের মাঝে মাত্রাতিরিক্ত টক খাওয়ার ইচ্ছে দেখে। সেদিন আপুর কাছে শুনেছিলাম এসব নাকি নতুন সদস্য আসার লক্ষণ। তাহলে কি আপুর পাশাপাশি আমাদেরও নতুন সদস্য আসছে! ”
.
.
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here