#অন্যরকম_প্রেমকাহিনী
#পর্ব_০২
#অধির_রায়
বিষন্নতা খু*ড়ে খু*ড়ে খাচ্ছে পাঁচ বন্ধকে৷ বন্ধু মহল আর্তনাদ নেমে এসেছে৷ ভয়ে সকলের মুখ চুপসে রয়েছে৷ কারো উদরে এখনও কিছু পড়েনি৷ মেঘা, অর্পি এমন অনেক রাত না খেয়েও পার করে দিয়েছে৷ ছোঁয়া বড়লোক বাবার আদরের দুলারি৷ কখনও ক্ষুধার কষ্ট করেনি। সেও না খেয়ে বন্ধুদের সঙ্গ দিচ্ছে৷ ছোঁয়ার মা বারং বার ফোন দিচ্ছেন বাসায় যাওয়ার জন্য৷ কিন্তু ছোঁয়া সাদাফকে এমন অবস্থায় রেখে কিছুতেই যাবে না৷ তাদের উশখুশ অস্থিরতা চিন্তার মাঝে ডক্টর এসে উপস্থিত হলেন৷ সবাই ডক্টরকে রাউন্ড করে দাঁড়ায়৷ পাঁচ জোড়া চোখ একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে৷ তাদের উপর আকাশ ভেঙে পড়ল। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না? চিন্তার ছাপ স্পর্শ ফুটে উঠেছে। ডক্টর মুখ কালো করে বলল,
“রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। মাথার সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট দেখে বুঝা যাচ্ছে মৃত্যুর আশংকা সর্বাধিক। বেঁচে থাকার আশা দশ শতাংশরও নেই৷”
ডক্টরের কথা তাদের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে৷ কথা বলার জন্য হাসফাস করছে৷ পেটে কথা আসলেও বাকরুদ্ধের জন্য মুখপ্রাণে কথা আসছে না৷ আরাফ কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল,
“ডক্টর যত টাকা লাগে তত টাকাই আমরা দিব৷ প্লিজ ডক্টর সাদাফকে বাঁচিয়ে দেন! আমরা কিছুতেই সাদাফকে হারাতে পারব না।”
স্ট্যাটোস্কপ গলায় ঝুলাতে ঝুলাতে বলল,
“আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন৷ তিনি চাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে৷ টাকা দিয়ে সবকিছু হয়না৷ টাকা দিয়ে জীবন বাঁচানো গেলে টাকার অনেক কদর কদর থাকত৷ মানুষের হাতে তখন পাঁচ টাকাও খুঁজে পাওয়া যেত না৷ আমাদের ডাক্তারি বিদ্যা যেখানে শেষ হয় সেখান থেকে উনার মহিমা শুরু হয়৷”
ডক্টর কথা না বাড়িয়ে চলে যেতে নিলে রঙ্গন বলল,
“স্যার কোন ভাবেই কিছু করা যায়না৷ দশ শতাংশ আমাদের হাতে আছে৷ আমরা কেন নেগেটিভ ভাবনায় ডুবে থাকব৷ সব সময় পজিটিভ চিন্তা করব৷ তাহলে আমাদের সাথে ভালো কিছু হবে৷ আমরা চেষ্টা করে যাব৷ শেষ অব্দি লড়াই করে যাব৷”
ডক্টর পিছনে ঘুরতে ঘরতে বলল,
“আমি যথেষ্ট চেষ্টা করব৷ আমার লাইফে বন্ধু ছিল না৷ আমি বন্ধুদের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অনেক পিছন পিছন ঘুরছি৷ আজ তারাই আমাকে কোন উৎসবে আগে ডাকে৷ আমি চাইনা তোমরা বন্ধুকে হারাও৷ আমি তোমাদের ভালোবাসায় মুগ্ধ। আমি যথেষ্ট চেষ্টা করব৷ আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি৷ উনার দেখানো পথ অবলম্বন করেই রোগীকে বাঁচানোর যথেষ্ট চেষ্টা করব৷”
বন্ধু মহলে নিরব ঝড় বয়ে গেল৷ ঝড়ের তান্ডবে ভেঙে গেল পাঁচটি হৃদয়। ছোঁয়া ঢুকরে কেঁদে ফেলল। ছোঁয়া সাদাফকে অনেক ভালোবাসে৷ তার সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন বুনে দুই নয়নে৷ কিন্তু মনের কথা কাউকে জানতে দেয়নি৷ বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে বলে৷ ধপাস করে সবাই বসে পড়ল৷ রঙ্গন সব বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত নেয়৷ রঙ্গন বলল,
“সাদাফের মাকে সব কিছু জানানো দরকার৷ উনি আজ অনেকবার ফোন দিয়েছেন সাদাফকে৷ আমি বাধ্য হয়ে সাদাফের ফোন বন্ধ রেখেছি৷ না জানি উনি কি করছেন? উনি কি ঠিক আছেন?”
মেঘা ভেজা গলায় বলল,
“ভদ্র মহিলা আর কতো আঘাত সহ্য করবেন৷ ছেলেকে অবলম্বন করে বেঁচে আছেন৷ অকালে ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছেন৷ নিজের মেয়েকেও হারিয়ে ফেলেছেন। ছেলেকে ভেঙে পড়তে দেখেছেন৷ অনেক কষ্টে সাদাফকে ডিপ্রেশন থেকে বের করেছেন৷ এখন যদি সাদাফের কিছু হয়ে যায় তাহলে উনি কাকে নিয়ে বাঁচবেন৷”
ছোঁয়া কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“আল্লাহ কেন উনার কাছ থেকে সবকিছু কেঁড়ে নিচ্ছেন? কেন উনাকে এতো কঠোরভাবে আঘাত করছেন৷ আল্লাহ আপনি সাদাফকে কেঁড়ে নিবেন না৷”
অর্পি ভেজা গলায় বলল,
“সাদাফের কাকা, কাকিমাগুলো একটুও ভালো নয়৷ সব সময় আন্টিকে বিরক্ত করেন৷ উঠতে বসতে বা*জে কথা শুনান৷ আ*জিব দুনিয়াতো আল্লাহ কতো মানুষ বানিয়েছেন৷”
আরাফ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“এখন এসব কথা বলা বন্ধ কর। আন্টিকে কিভাবে এ খবর দিব৷ সাদাফের বিষয় আন্টিকে না জানালেও খারাপ হয়ে যাবে৷ বলা যাচ্ছে না কখন কি হয়?”
রঙ্গন ফোন অন করে বলল,
“আমি আন্টিকে ফোন করছি৷ পাশ থেকে কেউ কোন কথা বলবি না৷ যা বলার আমিই আন্টিকে বলব৷ কোন শব্দ হলে আন্টি সবকিছু বুঝে যাবে। এদিকে কেউ যেন না আসে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।”
রঙ্গন আন্টির নাম্বারে ডায়াল করল৷ ফোনটা হাই স্পিকারে দিল রঙ্গন৷ ফোন বাজার সাথে সাথেই ভদ্র মহিলা ফোন তুললেন৷ ফোনের জন্যই অধীর আগ্রহে বসে ছিলেন৷ কখন সাদাফ একটু ফোন দিবে৷ প্রাণপ্রিয় ছেলের কন্ঠস্বর শুনতে পাবেন৷ ভদ্র মহিলা উৎফুল্লের সহিত বলল,
“আব্বু তুমি কোথায় ছিলে? আব্বু তোমার জন্য কখন থেকে অপেক্ষা করছি৷ তোমার মা এখনও না খেয়ে বসে আছে৷ তোমার জন্য তেমার আম্মুর চিন্তা হয় জানো না৷ তোমার ফোন বন্ধ ছিল বলে আমি অনেক ভয় পেয়ে গেছিলাম। আব্বু কথা বলছ না কেন?”
ভদ্র মহিলা কথা শুনে পাঁচ জোড়া চোখ থেকে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কারো মুখে কোন কথা নেই৷ রঙ্গন নিজেকে শান্ত করে আহত কন্ঠে বলল,
“আন্টি আমি রঙ্গন বলছি৷ সাদাফের বন্ধু৷”
রঙ্গনকে থামিয়ে ভদ্র মহিলা কান্না মিশ্রিত উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“আমার আব্বুর কি হয়েছে? আমার আব্বু কোথায়? আমাকে আব্বুকে তোমরা একটু দেখে রাখো। আমি এখনই আসছি ঢাকা৷ আমার আব্বুর খেয়াল রাখো তোমরা৷”
ভদ্র মহিলার কান্না দেখে ঠোঁট চেপে কান্না করেই যাচ্ছে তিন জোড়া চোখ৷ আরাফ, রঙ্গনের চোখের অশ্রু। রঙ্গন আহত ভেজা গলায় বলল,
“আন্টি সাদাফ ঠিক আছে৷ সাদাফের ভীষণ জ্বর। জ্বরের ঘোরে আপনাকে ডাকছে৷ আপনি প্লিজ আজ রাতের গাড়িতে করে ঢাকায় চলে আসেন৷”
“আমি আমার আব্বুর কাছে এখনই আসছি৷”
ভদ্র মহিলা ফোন কেটে দিলেন৷ সাদাফকে আব্বু বলেই সব সময় সম্মোধন করেন৷ শুধু সাদাফকেই না৷ সাদাফের পাঁচ বন্ধুকে নিজের ছেলের থেকে কোন অংশে কম ভালোবাসেন না৷ তিনি কখনও চাননি ছেলে ঢাকায় লেখাপড়া করুক৷ কিন্তু ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজের তৈরি করা কঠিন সিদ্ধান্ত থেকে পিছপা হয়েছেন৷
মেঘা চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“আন্টি এখানে এসে যখন সবকিছু জানতে পারবেন তখন কি হবে? একবারও ভেবে দেখেছিস?”
রঙ্গন চোখ পাকিয়ে বলল,
“এখন বলব সাদাফ এক্সিডেন করেছে৷ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা নড়ছে৷ যেখানে জীবন মরণের প্রশ্ন সেখানে এসব কথা বলতে হয়৷ তোর মনে হচ্ছে আমি মিথ্যা কথা বলে অনেক বড় ভুল করেছি৷”
আরাফ চিকন কন্ঠে জবাব দিল,
“আন্টি এখানে আসলে আমরা সবকিছু সামলিয়ে নিতে পারব৷ দেখছিস ফোনের ওপর পাশ থেকেই সাদাফের জন্য কেমন করছিল৷ এখন যদি আমরা সত্য কথা বলতাম উনার কিছু হয়ে যেত৷ স্ট্রোক করে মা*রাও যেতেন৷”
এভাবে আর চলে না৷ দেখতে দেখতে ঘড়ির কাটা তিনটে ছুঁই ছুঁই। ক্ষুধার জ্বালায় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। রঙ্গন হোটেল থেকে গরম গরম ডাল রুটি নিয়ে হাজির৷ ভেজা গলায় ছোঁয়া বলল,
“আমি খাব না৷ তোরা খেয়ে নে৷ সাদাফ যতক্ষণ ভালো না হচ্ছে ততক্ষণ কিছুই খেতে পারব না৷”
আরাফ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“থা’প্প’ড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিব৷ খাবিনা কেন? এখন না খেয়ে মারা যাবি৷ যখন সাদাফ জানতে পারবো তার জন্য আমরা না খেয়ে বসে আছি তখন সে অনেক কষ্ট পাবে৷ আমরা তাকে আর কষ্ট দিতে পারব না৷”
আরাফের রাগ দেখে চুপসে গেলে ছোঁয়া৷ বাধ্য মেয়ের মতো রুটি নিয়ে মুখে ভরে নিল৷ ছোঁয়া মা বাসা থেকে খাবার পাঠিয়েছিলেন৷ কেউ খাবে না বলে সকল খাবার পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে৷
আঁধার কেটে ভোরের আলো ফুটতেই সাদাফের মা হলে চলে আসছেন৷ রঙ্গন অপেক্ষা করছিল সাদাফের মায়ের জন্য৷ ছেলের অসুস্থের কথা কানে আসতেই এক মিনিটও দেরি করেননি ভদ্রমহিলা। সবকিছু ফেলে ছুটে এসেছেন ঢাকা৷ রঙ্গন ভালোবাসার সহিত বলল,
“আন্টি সাদাফ হলে নেই৷ আপনার ব্যাগ আমার কাছে দেন৷ আমি হলের মেনেজারের কাছে রেখে আসছি৷ আপনাকে সাদাফের কাছে নিয়ে যাচ্ছি৷”
উনাকে দেখে মনে হচ্ছে সারা রাস্তায় কান্না করতে কারতে এসেছেন। নেত্রদ্বয় ভীষণ লাল৷ পাপড়ি গুলো ভেজে একাকার। মায়ের মনে সবার আগে দাগ কাটে৷ সাদাফ রিক্সা ডেকে হসপিটালে চলে আসল৷ ভদ্রমহিলা পা*গলের মতো প্রশ্ন করল,
“আমার আব্বুর কি হয়েছে? আমার আব্বুকে হসপিটালে কেন নিয়ে এসেছো?”
মেঘা সাদাফের মাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্ঠা করল৷ মেঘাকে দূরে ঠেলে দিলেন৷ ক্ষোভ নিয়ে বলল,
“আমার আব্বু কোথায়? আমি তার কাছে যাব৷ আমাকে তার কাছে নিয়ে যাও৷”
অর্পি স্বান্তনার বাণী দিয়ে বলল,
“আন্টি আপনি শান্ত হোন৷ আপনাকে আমরা সবকিছু বলছি৷”
ছোঁয়া পানি এগিয়ে দিল৷ ঢগ ঢগ করে পানি পান করলেন৷ নিজেকে শান্ত রেখে প্রশ্ন করলেন,
“তোমরা সবাই এখানে সাদাফ কই?”
রঙ্গন হাঁটু গেড়ে বসে আন্টির দুই হাত নিজের মুষ্টির মাঝে আবদ্ধ করে নিল৷ আহত কন্ঠে জবাব দিল,
“আন্টি সাদাফ এক্সিডেন করেছে। সাদাফকে অবজারভেশনে রাখা হয়েছে৷ সাদাফ মাথায় অনেক আঘাত পেয়েছে৷ ডক্টর বলেছে ঠিক হতে সময় লাগবে৷ আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে বলেছে৷ এটাও বলেছে আটচল্লিশ ঘন্টার মাঝে জ্ঞান না ফিরলে কোমায় চলে যাবে৷”
ছেলের এমন করুন পরিস্থিতির কথা শুনেই ঘটনা স্থলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন ভদ্র মহিলা। আরাফ সাদাফের জন্য মসজিদে চলে গেছে৷ রঙ্গন কোনদিন পূজা দিত না৷ সাদাফের মঙ্গল কামনার জন্য মন্দিরে গেছে৷ একমাত্র আল্লাহ উপর ভরসা। তিনি চাইলেই মিরাক্কেল কিছু ঘটতে পারে৷
#অন্যরকম_প্রেমকাহিনী
#পর্ব_০৩
#অধির_রায়
আঁধার যতই গভীর হোক না কেন দিনের আলোকে আটকাতে পারে না৷ ভোরের আলো ফুটতেই ঘন অন্ধকার কেটে যায়৷ দুঃখ মানুষের জীবনে চিরস্থায়ী হতে পারে না। সাদাফের মাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ ডাক্তারী বিদ্যা যেখানেই শেষ সেখান থেকে শুরু হয় আল্লার মহিমা৷ হুট করেই সাদাফের জ্ঞান ফিরে আসে৷ বন্ধু মহলে হাসির হইচই উঠল৷ প্রাণ ফিরে পেল সাথে পাঁচটি অনবন্ত নিশ্চল প্রাণ৷ সকল ক্লাতি নিমিষেই উধাও। হাসির রেখা ফুটে উঠেছে৷ হাতে ফিরে পেয়েছে অমূল্য রত্ম। সকলের চোখে আনন্দের অশ্রু। কথা বলতে পারছে না৷ নেত্রের দৃষ্টিতে হাজারো কথা বলছে৷ চোখে চোখে বলা ভাষা শেষ হচ্ছে না৷ ছোঁয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“স্যার সাদাফ এখন বিপদমুক্ত৷ তার কিছু হবে না তো!”
ডক্টর মুচকি হেঁসে বলল,
“আপনাদের বন্ধুর কিছু হবে না৷ আল্লাহ আপনাদের কথা কবুল করেছেন। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন৷ আমার জীবন ধন্য হতো এমন বন্ধু আমার জীবনে থাকলে৷”
আরাফ উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“আমরা কখন দেখা করতে পারব? আমরা সাদাফের সাথে দেখা করতে চাই৷”
“সরি! এখন কাউকে দেখা করার সুযোগ দিচ্ছি না৷ উনি মাথায় অনেক আঘাত পেয়েছেন৷ আপনাদের দেখলে উত্তেজিত হয়ে যাবেন৷ বন্ধুর ভালোর জন্য দুই দিন পর কথা বলেন৷ অপেক্ষার ফল অল টাইম মিষ্টি হয়৷”
ডক্টর চলে যেতেই রঙ্গন ব্যতিত চারজন গলা ফাটিয়ে নিজের আনন্দ প্রকাশ করল৷ রঙ্গন ক্ষোভ নিয়ে রাগী কন্ঠে বলল,
“থামবি তোরা৷ এটা হসপিটাল৷ এখানে অনেক রোগী আছে৷ তোদের ডাইনিং রুম নয়। এভাবে হইচই করবি৷”
সবাই তাদের ভুল বুঝতে পেরে থেমে গেল৷ তবুও থেকে থাকল না কারো ওষ্ঠ। পাঁচ জোড়া ওষ্ঠ অনবরত উঠানামা করেই যাচ্ছে৷ কে কি বলছে জানা নেই? যখন যা বলতে ইচ্ছা করছে তখনই সব বলে ফেলছে৷ বন্ধু তো সেই যার সাথে সকল কথা শেয়ার করা যায়৷ কোন সংকোচ না করে মনের অনুভূতি প্রকাশ করা যায়৷ যার সাথে কথা বলতে কোন ভাবনা লাগে না৷ যেখানে শেষ হয় সেখান থেকে যেকোন কথা বলা৷
সাদাফের মুখে এখনও অক্সিজেন মাক্স পরিহিত৷ সাদাফের হাতের উপর হাত রেখে অশ্রু ফেলে যাচ্ছেন উনার মা৷ মায়ের ভালোবাসার কাছে সবকিছু তুচ্ছ। উনার দিকে তাকিয়ে চোখ থেকে অশ্রুর বন্যা বয়ে যাচ্ছে। একজন নার্স এসে বলল,
“আপনি এখানে কান্নাকাটি করবেন না৷ প্লিজ বুঝার চেষ্টা করেন৷ আপনি কান্না দেখে রোগী কান্না করছেন৷ এতে উনার ক্ষতি হতে পারে৷ আপনি কি চান আপনার ছেলের ক্ষতি হোক?”
সাদাফের মা কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“আমি কখনও চাইব না আমার ছেলের ক্ষতি করতে৷”
বুকে মাঝে কষ্ট লুকিয়ে রেখে মলিন হাসি দিয়ে বলল,
“আমি আর কান্না করব না৷ কখনও কান্না করব না৷”
কেটে গেল দুইদিন৷ আজ সাদাফকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে৷ সাদাফের মা ছোঁয়ার সাথে তাদের বাসায় গেছেন৷ সাদাফ এখন মোটামুটি সুস্থ। আরাফ রঙ্গনের পাশে শুয়ে বলল,
“মামা বাতাস কর। ফ্যানের বাতাস গায়ে লাগছে না৷ গরমের মাঝে গায়ে গরম বাতাস লাগছে৷”
সাদাফ চকিত দৃষ্টি মেলে তাকায় আরাফের দিকে৷ মেঘা বসতে বসতে বলল,
“মামা এভাবে তাকিয়ে থাকিস না৷ ছেলে হয়ে ছেলেদের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকলে বুঝতেই পারছিস কি ভাবতে পারে?”
রঙ্গন অন্য জনের বসতে বসতে বলল,
“তোদের রুচি দেখে আই অ্যাম অবাক৷ বিশেষ করে মেঘা কথা শুনে। তুই কিভাবে বলতে পারলি এসব কথা?”
অর্পি প্রবেশ করতে করতে বলল,
“সাদাফকে পি*টা*নোর জন্য আমি লা*ঠি নিয়ে আসছি৷ হলে জুনিয়রদের ভ*য় দেখানোর জন্য নিয়ে আসছি৷ এখন তোকে পি*টা*নোর কাজে লাগবে৷”
সাদাফ চকিত হয়ে বলল,
“আমি তোকে কি করলাম! তুই আমাকে পি*টা*বি কেন? তোর প্রেমে আমি কখন বাঁধা হয়ে দাঁড়ালাম!”
অর্পি রেগে বলল,
“কু”ত্তা তুই ক্যাম্পাসের বাহিরে দৌড়ে গেছিলি কেন? তোর কিছু হলে আমরা কাকে নিয়ে বেঁচে থাকতাম? তুই ছেড়ে যাবি ভালো কথা কিন্তু তোর ভালো থাকাটা আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
অর্পি কথাগুলো কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল। সাদাফের হাতে হাত রেখে বলল,
“এমন কখনও করবি না৷ আমরা তোকে অনেক ভালোবাসি৷ তোকে ছাড়া আমাদের বন্ধু মহল শূন্য। তুই ছাড়া খাঁ খাঁ করবে তোলপাড় ক্যাফেডিয়াম৷ খাঁ খাঁ করবে ম্যাথ ডিপার্টমেন্ট। নাজিয়া ম্যামের বকা দিয়ে অকারণে কাউকে বের করে দিবে৷ তুই থাকলে আমরা একটু সাহস পাই৷ আমাদের বের করতে পারবে না৷”
মেঘা অর্পির পীঠে থাপ্পড় বসিয়ে বলল,
“এসব ন্যাকামী বন্ধ কর৷ আমার পা ব্যথা করছে৷ পারলে তুই সাদাফকে লাথি দিয়ে বেড থেকে ফেলে দে৷ আমি একটু ঘুমাব৷”
সাদাফ মিহি কন্ঠে বলল,
“কি! তোরা এখানে থাকবি৷ তোরা কবে থেকে রোগী হলি৷ অসুস্থ ছিলাম আমি৷ তোদের ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তোরা চৌদ্দ বছর থেকে অসুস্থ৷”
মেঘা সাদাফকে বেড থেকে টেনে নামায়৷ মায়াভরা তিতু কন্ঠে বলল,
“তোমার জন্য রাতে ঘুমাতে পারিনি ভালো করে৷ চারদিন ঠিকমতো কিছুই খেতে পারিনি৷ বাহিরে দাঁড়িয়ে তোকে পাহারা দিছি৷ মশার সাথে যুদ্ধ করেছি৷ আমাদের যদি ডেঙ্গু জ্বর হয়ে যায়৷ তুই জানিস না শীতের আগে ডেঙ্গু জ্বরের উৎপাদ বেড়ে যায়৷”
সাদাফ বোকা ছেলের মতো অন্যের বেডে বসে আছে৷ পাশে বসে আছে রঙ্গন৷ মেঘা, অর্পি, আরাফ না বসে আসছে না শুয়ে আছে৷ কথায় বন্যা বসিয়ে ফেলেছে৷ বেড়ি মানুষের কথায় সায় দিলে কথা কোনদিন শেষ হয়না৷ তার একটা জ’ল’ন্ত উদাহরণ হলো আরাফ৷ একটু সাড়া দিছে মানে মেঘা, অর্পি দুনিয়ার কথা জুড়ে দিয়েছে।
কথা বলার মাঝ খানেই তিনজন সাবধানের সাথে উঠে সাদাফকে বেড়ে শুইয়ে দিল৷ এমন ঘটনায় ভেবাচেকা খেল রঙ্গন, সাদাফ৷ তাদের উদ্দেশ্য কিছুই বুঝতে পারল না৷ অর্পি এক টুকরো আপেল নিয়ে সাদাফের মুখে ভরে দিল৷ মিষ্টি মধুর স্বরে বলল,
“আহারে না খেয়ে না খেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে৷ তোকে এমন শুকনো অবস্থায় দেখে আমার খুব কষ্ট হয়৷”
মেঘা অরেঞ্জ জুস এগিয়ে দিয়ে বলল,
“একটু কষ্ট করে উঠে বস৷ জুসটা সম্পুর্ন খেয়ে নে৷ জুস না খেয়ে শক্তি পাবি কি করে?”
আরাফ ওভার ভাব দেখিয়ে বলল,
“দোস্ত কি খাবি আমাকে বল? আমি তোর জন্য সবকিছু এখনই হাজির করছি৷ বিরিয়ানি, চিংড়ি মালাইকারী, কাবাব, ইত্যাদি৷”
সাদাফ, রঙ্গনের চোখ কপালে৷ একটু আগে এসব ফল খাওয়ার জন্য এদের মাঝে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ হয়ে গেল৷ এখন নিজে থেকেই খাওয়ানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে৷ অর্পি সাদাফের পীঠে থাপ্পড় বসিয়ে ন্যাকা স্বরে বলল,
“তুই বন্ধু নামে ক’ল’ঙ্ক। একজন মৃত্যু পথযাত্রীকে সেবাযত্ন না করে এখানে বসে আছিস৷ আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া। আমার বন্ধুর কোন ক্ষতি করেননি৷ তার কিছু হয়ে আমরা কি নিয়ে বাঁচতাম?”
সাদাফের মা খাবার রাখতে রাখতে বলল,
“তোমরা পাঁচজনই সাদাফকে অনেক ভালোবাসো৷ তোমাদের মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার৷”
রঙ্গন ছয় নয় হিসাবটা এখন ঠিকমতো বুঝতে পারল। আন্টিকে দেখে তাদের এসব অভিনয়৷ স্টার জলসা এদের চোখে দেখে না৷ মেঘা বিরবির করে বলল,
“কপাল খারাপ বলেই এমন বন্ধু জুটেছে। সা*লা*গুলো বাঁশ দিতে এক মিনিটও ভাবে না৷ কিছুদিন থাকলে বুঝতে পারবেন৷”
সাদাফের মা বলল,
“মেঘা মামুনি তুমি কিছু বললে? আমি তোমার কথা বুঝতে পারলাম না৷”
মেঘা ভীতু হাসি দিয়ে বলল,
“না না আন্টি৷ এমন কিছুই বলিনি৷ আসলে আমার হাতের রান্না কবে থেকে খাইনা৷ খুব মিস করি আপনার হাতের রান্না৷”
মাথার হাত বুলাতে বুলাতে অর্পিকে ইশারা করে বলল,,
“জানতে পারলে এখনই খু*ন করে ফেলত। আল্লাহ বাঁচিয়েছেন৷ কিছু জানতে পারেননি৷”
সাদাফ এখন পুরোপুরি সুস্থ। রেগুলার ক্লাসে মন দিয়েছে সবাই৷ ইনকোর্স পরীক্ষা দুইদিন পর৷ তবুও বন্ধু মহল গোল হয়ে মাঠের মাঝে বসে আছে৷ সূর্যের তেজস্বী রশ্মি তাদের গায়ে পড়ছে৷
চলবে….