অন্যরকম প্রেমকাহিনী পর্ব -০৪+৫

#অন্যরকম_প্রেমকাহিনী
#পর্ব_০৪
#অধির_রায়

তোলপাড় ক্যাফেডিয়ামে ক্ষোভ নিয়ে বসে আছে আরাফ৷ মাথা গরম চোখে অগ্নি৷ যে কাউকে পুড়িয়ে ফেলবে৷ দৃষ্টিতে খেলা করছে সেই ইনকোর্স পরীক্ষার দৃশ্য। সর্বশেষ পরীক্ষা ছিল৷ সাদাফের কাছ থেকে আজ কোন প্রকার সাহায্য পাইনি আরাফ৷ মেঘা বেসুরা গলায় গান ধরল,

“আরে আরাফ করেছে রাগ, দেখাইনি সাদাফ৷
আরাফ করিবে ফেল, টানিবে ঠেলা,
ম্যামের কাছে হয়ে যাবে সিল৷”

অর্পি হু হা করে হেঁসে উঠল৷ মেঘার এমন অদ্ভুত গান শুনে আশেপাশে অনেক জুনিয়ররাই হেঁসে উঠল৷ অর্পি হাসি থামিয়ে বলল,

“দোস্ত তোকে আজ ৭১ এর টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হবে৷ তুই এতো সুন্দর কাকের মতো গান পারিস আগে জানিনি৷ আগে জানলে আমি তোর অটোগ্রাফ নিতাম৷

মেঘা শক্তপোক্ত ভাষায় জবাব দিল,

“মানা করছে কে? অটোগ্রাফ এখনও নিতে পারিস৷ আমার কোন অ*হং*কার নেই৷ আমার কন্ঠের কাছে বাংলাদেশের কন্ঠের রানী রুনা লায়লা ফেল৷ উনাকে আমি গান শেখায়৷”

ছোঁয়া রাগ নিয়ে বলল,

“থামবি তোরা৷ তোদের এসব ড্রামা আমার কাছে ভালো লাগছে না৷ দুই সপ্তাহ কষ্ট করে সব পরীক্ষা শেষ করলাম৷ এখানে একজন রাগ করে বসে আছে৷ অন্য দুইজন বিশ্ব বিখ্যাত শিল্পী হয়ে যাচ্ছেন৷ সাদাফ রঙ্গন এখনও আসল না৷ তাদের দুইটাকে ধরে নিয়ে যায়৷”

অর্পি আরাফের কাঁধে হাত রেখে বলল,

“মামা প্যারা নিস না৷ ইনকর্সো পরীক্ষা তো অনেকে দেয়ই না৷”

আরাফ ক্ষোভ নিয়ে বলল,

“সা* সাদাফের বাচ্চার উপর আমার কোন রাগ নেই৷ আমার তো একটাই রাগ, সে আমাকে না দেখিয়ে অন্য মেয়েকে দেখাল৷ ভাবতে পারিস আমাকে ভুলে গেছে৷”

মেঘা আহ্লাদী স্বরে বলল,

“আহারে ছোট বাবুটাকে ভুলে গেছে৷ তোর অবস্থা দেখে আমি ভাবছিলাম কি না কি হয়ে গেছে। এখন দেখি এ ব্যাপার৷ একটু হলেও ভেবে নিয়েছিলাম তোর সাথে তোর জি এফের ব্রেকআপ হয়েছে৷”

অর্পি মেঘাকে থামিয়ে বলল,

“মেঘা, ছোঁয়া মনে আছে আমরা আরাফের প্রাণপ্রিয় প্রিয়তমাকে কিভাবে র‍্যাগ দিছিলাম৷ মনে পড়লেই আমার খুব হাসি পায়৷”

ছোঁয়া মুচকি হেঁসে বলল,

“আর বলিস না৷ মেয়েটাকে চাপকলের পানির জন্য কতোই না দৌড় পাঠানো হয়েছে৷ কতো গাধা ছিল৷ পানি নিয়ে আসতে পারেনি বলে শাস্তি হিসেবে দেওয়া হয়েছিল, ‘আরাফের জি এফ এক পায়ে দাঁড়িয়ে ব্যায়াম করে৷’ তখন থেকেই আমাদের আরাফ বাবু প্রেমে পড়ে যায়৷”

ছোঁয়ার কথার মাঝে সাদাফ, রঙ্গন ক্যাফেডিয়ামে প্রবেশ করে৷ সাদাফ প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,

“সরি দোস্ত। আম্মার সাথে কথা বলতে বলতে লেট হয়ে গেছে৷”

ছোঁয়া সাদাফের কাঁধে মাথা রেখে বলল,

“আমি তোর জন্য সব সময় অপেক্ষা করতে পারব৷ তুই আরও লেট করে আসলে কোন সমস্যা হতো না৷”

সাদাফ বিরক্তি নিয়ে বলল,

“দূরে সর৷ আমার কাঁধে মাথার রাখার কি হলো? বাড়িতে ঘুমাতে পারিস না৷ আমার কাঁধে তোকে ঘুমাতে হবে৷”

ছোঁয়া অভিমানী স্বরে বলল,

“আমি তোর কাঁধে মাথা রাখলে সমস্যা কি? বন্ধুর কাঁধে মাথা রাখতেই তো পারি৷”

সাদাফ বিরক্তি স্বরে বলল,

“গরমে ভেজে একাকার। তার উপর তুই কাঁধে মাথা রাখিস৷ তোর কি গরম লাগে না৷ দূরে সর৷”
ক্যাফেডিয়ামের ফ্যানগুলোও পুরান হয়ে গেছে৷ টু জি নেটের মতো হয়ে গেছে৷”

ছোঁয়া চুপিচুপি বলল,

“আমার কাছে তোর ঘাম মাখা শার্টের গন্ধ ভালো লাগে৷ মিশে একাকার হতে ইচ্ছা করে৷ আমার কাছে তোর প্রতিটি জিনিসই ভালো লাগে৷”

আরাফ কাউকে পাত্তা না দিয়ে বলল,

“পরীক্ষার ঝা*মে*লা*য় তেঁতু হয়ে গেছি৷ চল আমরা বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঘুরে আসি৷”

ছোঁয়া খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,

“আরাফ তুই আমার মনের কথা বলেছিস৷ বুকে আয় মামা বুকে আয়৷”

অর্পি খোঁ*চা মেরে বলল,

“আরাফ ছোঁয়ার বুকে ল্যাপ্টে পড়৷ অনেক ভালোবাসা দিবে তোকে৷ আহারে তোকে দুই হাত বাড়িয়ে বুকে টানছে৷”

অর্পির কথায় ছোঁয়ার রাগ আকাশপ্রাণে৷ ছোঁয়া পারছে না কিছু করতে৷ ইচ্ছা করছে অর্পির যত্নে তৈরি করা কেশগুলো একটা একটা করে তুলতে৷ পরিস্থিতি সামলিয়ে নিতে রঙ্গন বলল,

“এখানে বসে থাকবি নাকি বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাবি৷ সন্ধ্যার পর গার্ডেনে থাকা যাবে না৷ চল তাড়াতাড়ি। নাহলে আড্ডা দেওয়া হবে না৷ যাবি আর আসবি। কোন কিছুই হবে না৷”

ছোঁয়া উৎফুল্ল হয়ে বলল,

“আজ সবাই আমার গাড়িতে যাবি৷ আমি ড্রাইভারকে ফোন দিচ্ছি৷ এখনই চলে আসবে৷ সময়ও লাগবে না৷ সিএনজি দিয়ে গেলে অনেক লেট হয়৷ গতবার ধানমন্ডির লেগের কথা মনে আছে৷ অনেকটাই লেট হয়েছে৷”

“আরাফ খুশিতে বলল আফসোসের সাথে বলল,

“মামা তোর গাড়ি হলে তো ভালোই হয়৷ কিন্তু তুই এখনও গাড়ি চালানো শিখলি না৷ আজ তুই গাড়ি ড্রাইভ করতে পারলে আলাদা ড্রাইভার লাগত না৷”

আরাফের আফসোসের কথা সবার মন ছুঁয়ে গেল৷ খুশিতে কারোর চোখে জল আসল না৷ বেচারার অনেক দুঃখ৷ ছোঁয়া ফোন দিয়ে গাড়ি আসতে বলে৷ সবাইকে তাড়া দিয়ে বলল,

“চল চল দেরি হয়ে যাচ্ছে৷”

রঙ্গন, আরাফ দৌড়ে চলল৷ তাদের পিছন পিছন দৌড় দিল মেঘা, অর্পি৷ সাদাফ এখনও চেয়ারে বসে আছে৷ যাওয়ার কোন নাম গন্ধ নেই৷ ছোয়া সাদাফের হাত ধরে বলল,

“তুই এখানে বসে আছিস কেন? তুই আমাদের সাথে যাবি না৷”

“না যেতে ইচ্ছা করছে না৷ তোরা ঘুরে আয়৷ আমি হলে যাচ্ছি৷ আমি একটি ঘুমাব।”

সাদাফের কথা শুনে ছোঁয়ার রাগ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়৷ ইচ্ছা করছে সাদাফকে টেনে হি*জড়ে নিয়ে যেতে৷ কিন্তু এমন কিছুই করতে পারবে না৷ ছোঁয়া ক্ষোভ নিয়ে বলল,

“তোর সমস্যা কি? আমি তোর সমস্যার মূল কারণ৷ আমি যাচ্ছি বলে তুই যাবি না৷ আমাকে তুই সহ্যই করতে পারিস না৷ আমি কি দোষ করেছি? কেন তুই বার বার আমার সাথে এমন করিস?”

“ছোঁয়া তুই সব সময় দুই লাইন বেশি বুঝিস৷ আমরা কেন তোর গাড়ি দিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাব৷ আমাদের তুই দয়া করিস৷ আমরা একটা সিএনজি ভাড়া করে যেতে পারতাম না৷ একটু লেট হলে সমস্যা কি?””

“তারমানে তোর মূল সমস্যা হচ্ছে আমার গাড়ি৷ এখন আমার গাড়িকেও তোর সহ্য হয়না৷ তাকে তুই প্রতি’দ্ব’ন্ধী মনে করিস৷ এখন সিএনজি দিয়ে গেলে লেট হবে তুইও জানিস৷ তবুও কেন এসব বলছিস?”

“হুম জানি৷ কিন্তু আমাদের জন্য আন্টি তোকে সব সময় ব*কা দেন। কেন তুই আমাদের জন্য বারবার ব’কা খাবি?”

“আমি তোদের জন্য বারবার ব’কা খেতে রাজি৷ আমাদের কাছে তোরা অমূল্য। তোদের ভালোবাসার মূল্য কখনও দিতে পারব না৷ আমার এলোমেলো জীবনটা তোরা সাজিয়ে দিয়েছিস৷ মা যতই বকা দেন তিনি জানেন আমি তোদের সাথে থাকলে ভালো থাকি৷”

“আমার খারাপ লাগে তোকে কেউ বকা দিলে৷ শুধু তোকে নয়৷ মেঘা, অর্পিকেও কেউ বকা দিলে আমার খারাপ লাগে৷ আমি তোদের তিনজনকে খুব ভালোবাসি।”

ছোঁয়ার মন খারাপ হয়ে গেল৷ সাদাফ তার জন্য ভাবে না৷ মেঘা, অর্পির জন্য যেমন ভাবনা তার জন্যও তেমন ভাবনা৷ ছোঁয়া মুখ কালো করে বলল,

“ওকে যেতে হবে না৷ পায়ে হেঁটে যাব৷ আমি মানা করে দিচ্ছি৷ আমার কিছু যায় আসে না৷ অন্যরা কি ভাববে সেটা তুই জবাব দিবি৷ আমি বলব, ‘তুই যেতে মানা করেছিস।’ আমার এতে কোন দোষ নেই৷”

“এমন কিছুই করবি না৷ চল যাচ্ছি৷”

এদিকে আরাফ, রঙ্গন ড্রাইভারের সাথে বসেছে৷ সাদাফ ছোঁয়া লেট করছে বলে তারা আকাশপাতাল ভেবে যাচ্ছে৷ তাদের মাঝে কুচ কুচ হুতাহে৷ একেক জনের ভাবনা একের রকম৷ মুখে মুখে তো বাসর পর্যন্ত চলে গেছে৷ সাদাফ, ছোঁয়া আসতেই সবাই চুপ হয়ে যায়৷ কোন কথা নেই৷ ঝড়ের পর প্রকৃতি যেমন শান্ত ঠিক তেমনই সবার মাঝে নিরবতা বিরাজ করছে৷ সাদাফ বাধ্য হয়ে ছোঁয়ার সাথে বসল৷
.
চারিদিকে জোড়ায় জোড়ায় কবুতরের বসবাস। বোটানিক্যাল গার্ডেন হয়ে গেছে প্রেম গার্ডেন। গোধূলী বেলায় পড়ন্ত দুপুরে সবাই চলে আসে৷ ভালোবাসার মানুষের সাথে একান্ত কিছু সময় কাটানোর জন্য৷ সবাই শাপলা পুকুর পাড়ে গোল হয়ে বসল৷ আরাফ গিটারে টুংটাং শব্দ তুলে৷ অর্পির কন্ঠে ধ্বনিত্ব হয় রবীন্দ্রনাথের গান৷ অর্পির গলার সাথে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে সবাই৷ বন্ধু মহলে কোলাহল শুরু হয়ে গেল৷ বেসুরা সুরও এখন অনেক মধুর। কখন সন্ধ্যার আভাস পৃথিবীর বুকে হানা দিছে জানা নেই৷ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে পিক তুলতে৷

সন্ধ্যার গোধূলি বেলায় কনে দেখার তোড়জোর চলছে৷ এমন সময় মায়াভরা মুখ দেখা যায়৷ ভালোবাসার এক অনন্য বৈশিষ্ট ফুটে উঠেছে। ফুটে উঠে দিগন্ত প্রহরের অবসান। ছোঁয়া উচ্ছাসের সাথে বলল,

“সাদাফের সাথে আমার কিছু পিক তুলে দে!”

অবাক চারজোড়া দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত করে ছোঁয়ার উপর৷ আরাফ চোখ টিপল দিয়ে বলল,

“মামা মাইয়া তো তোর প্রেমে পড়ে গেছে৷ হাজারটা পিক তোলার পরও তোর সাথে একান্ত পিক তুলছে চাচ্ছে৷”

ছোঁয়া রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আরাফের উপর৷ কেউ কিছু বলার আগে আরাফকে মা”রা’র জন্য দৌড় দেয়৷ আরাফ নিজেকে বাঁচানোর জন্য দৌড় দেয়৷ আরাফের পিছন পিছন দৌড়ে যাচ্ছে ছোঁয়া৷
#অন্যরকম_প্রেমকাহিনী
#পর্ব_০৫
#অধির_রায়

ছোঁয়া মম মরা হয়ে বসে আছে৷ ওষ্ঠ দ্বয় কা’ম’ড়ে নিজের চোখের অশ্রু আটকানোর চেষ্টা করছে৷ চোখ মুখ ফোলা৷ সারারাত কান্না করেছে দেখেই বুঝা যায়৷ এক তরফা ভালোবাসাগুলো এভাবেই কষ্ট দেয়৷ কখনও অপর পক্ষের লোক ভালোবাসা বুঝতে পারে না৷ শিমুল গাছের অর্কিডের বসে বসে প্রহর গুনছে৷ ক্লাস করবে না মন স্থির করেছে৷ মেঘা ছোঁয়ার কাঁধে হাত রাখতেই ছোঁয়া কেঁপে উঠল৷ ছোঁয়া আহত কন্ঠে প্রশ্ন করল,

“এখানে কি চাই? ক্লাসের সময় হয়ে গেছে৷ ক্লাস না করে এখানে আসলি কেন?”

মেঘা ছোঁয়ার গা ঘেঁষে বসতে বসতে বলল,

“গতকালের ঘটনায় ভেঙে পড়লে চলবে৷ সাদাফের ভালোবাসা পেতে হলে তোকে স্টং হতে হবে৷ সাদাফের প্রথম ভালোবাসা সাদাফকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেছে৷ এখন সাদাফ তাকে মন থেকে সরাতে পারেনি৷ সে মনে তোকে কিভাবে জায়গা দিবে? তোকে জায়গা বানিয়ে নিতে হবে৷”

ছোঁয়া মেঘার হাতের উপর হাত রেখে বলল,

“আমি গতকাল শুধু বললাম সাদাফের সাথে আমাকে কয়েকটা পিক তুলে দিতে৷ তোরা সবাইতো সাদাফের সাথে সিঙ্গেল পিক তুলছিস৷ আমি তুললে সমস্যা কি? আমাকে কেন এভয়েড করে?”

“জানি না। আজ তোকে নিজের বোন হিসেবে বলছি৷ সাদাফকে তোর মনের কথা বলে দে৷ আমরা দেখেছি সাদাফ তোর প্রতি অনেক দুর্বল। আমরা আন্টিকে পটিয়ে নিয়েছি৷ আমরা আন্টির সাথে তোর বিষয় শেয়ার করেছি৷”

ছোঁয়া চকিত হয়ে বি’ষ্ম’য় কন্ঠে বলল,

“আন্টিকে এসব কবে বললি তোরা৷ আন্টিকে কেন বলতে গেলি? আন্টি কি মনে করবেন?”

“চোখ দু’টো ছোট কর৷ আমি জানি, সাদাফ তোর ভালোবাসা বুঝতে পারে৷ কিন্তু মুখে প্রকাশ করে না৷ তোকে নিজের জীবনের চেয়েও অনেক ভালোবাসে৷ তোর জন্য সাদাফের অনেক চিন্তা হয়৷ তুই তোর মনের কথা সাদাফকে জানিয়ে দে৷”

ছোঁয়ার মনে পড়ে যায় সাদাফের কথাগুলো৷ আন্টি তোকে বকা ছিলে আমার খারাপ লাগে৷ ছোঁয়া জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

“আমার ভীষণ ভয় হয়৷ সাদাফ যদি আমায় ফিরিয়ে দেয়৷ আমি সাদাফকে ছাড়া বাঁচতে পারব না৷ সাদাফের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হবে না৷ আমি বাবার সাথে সাদাফের কথা শেয়ার করেছি৷ সাদাফ আমাদের অফিসে কাজ করবে৷”

“আমার মনে হয়না সাদাফ এমন কিছু করবে না৷ সাদাফের আত্মসম্মান অনেক৷ কিছুতেই মাথা নিচু করবে না৷ এসব পরে ভাবা যাবে৷ তুই আজই সাদাফকে প্রপোজ করবি৷”

“আমি মেয়ে হয়ে কিভাবে সাদাফকে প্রপোজ করব? সাদাফ নিজে থেকে প্রপোজ কি করবে না কোনদিন?”

“এ স্বপ্ন নিয়েই বসে থাক৷ যেদিন সাদাফ হাত থেকে বেরিয়ে যাবে সেদিন বুঝবি৷ তুই এখানে বসে বসে ভাবতে থাক৷ সাদাফকে হারাবি নাকি সময়ের মধ্যে মনের কথা জানাবি৷”

ছোঁয়া পিছন থেকে মেঘাকে ডেকে যাচ্ছে৷ মেঘা কোন রিপ্লাই দিচ্ছে না৷ হনহনিয়ে নিজ গন্তব্যে এগিয়ে যাচ্ছে৷ ছোঁয়ার কথার কোন মূল্য দিল না৷ যেন নিজেকে প্রস্তুত করে সাদাফের সামনে উপস্থাপন করতে পারে৷

নিরবে নিভৃতে বসে আছে ছয় ছোড়া চোখ৷ কারো মুখে কোন কথা নেই৷ হাহাকার অনুভূতি সাড়া দিচ্ছে সকলের মনে৷ ছয় জোড়া ওষ্ঠ কথা বলার জন্য হাসফাস করছে৷ নিরন মাঠের ঘাস সাক্ষী দিচ্ছে গভীর শ্বাস প্রশ্বাসগুলো৷ নিরবতা ভেঙে চঞ্চল অর্পি বলল,

“মামা তোরা এভাবে শোক দিবস পালন করবি! আমার মনে কোন শোক নেই৷ কারো মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না৷ বাংলার পাঁচ করে বসে আছে৷”

অর্পির কথা কেউ গায়ে মাখল না৷ সেই আগের মতো নিরবতা পালন করে যাচ্ছে৷ যে হাস্য উজ্জ্বল গ্রুপে অনবরত কথা হতো৷ টুংটাং গিটারের শব্দ শোনা যেত৷ এক সাথে যেকোন গানে ওষ্ঠ মেলাতো সবাই৷ মেঘা বলল,

“আমি সবাইকে উদ্দেশ্য করে একটা কথা বলতে চাই৷ আমার কথাগুলো সবাই সিরিয়াসলি নিবি৷ আমি চাইনা আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে কোন ফাটল ধরুক৷”

সাদাফ মোটা ফ্রেমের চশমা খুলে বলল,

“সামান্য ঝড়ে আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হবে না৷ আমি সকল পরিস্থিতিতে তোদের পাশে ছিলাম, আছি আর চিরকাল তোদের পাশে থাকব৷”

সাদাফের জবাবে ছোঁয়ার মনে আশার আলো ফুটে উঠল৷ মেঘা চোখ টিপল দিয়ে সবকিছু বুঝিয়ে দিল৷ সাদাফ আর অর্পি ছাড়া সবাই জানে৷ অর্পিকে তাদের সিদ্ধান্তে নেওয়া হয়নি৷ পেট পাতলা মেয়ে৷ পেটে কোন কথা চেপে রাখতে পারে না। আরাফ কাঁধে গিটার তুলে নিয়ে বলল,

“চল লাইব্রেরিতে৷ আমার লাইব্রেরিতে কিছু কাজ আছে৷”

তিন জোড়া প্রাণ বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে৷ সামনের দিকে পা বাড়াতেই ছোঁয়া সাদাফের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। সাদাফের দিকে একটা রিং এগিয়ে দিয়ে মধুর স্বরে বলল,

“আমি তোর ভালোবাসার সঙ্গী হতে চাই৷ সারাজীবন পাশে থাকতে চাই৷ তোর দুঃখ ভাগ করে নিতে চাই৷ সুখটা একান্ত তোরই থাকবে৷ তোর সুখের ভাগ নিব না৷ আমি তোর সবকিছু জেনেই তোর কাছে আসতে চাই৷ আমি কখনও তোকে নীতিকে ভুলে যেতে বলব না৷ নীতির জায়গায় তোর মনে সারাজীবন থাকবে৷ আমি নীতির জায়গা নিব না৷ আমি তোর মনের গহীন কোণের একটা অংশ হতে চাই৷ সমস্ত অংশ জুড়ে থাকবে নীতি৷”

অর্পির চোখ আকাশ প্রাণে৷ অর্পি কোনদিন কল্পনা করতেও পারেনি৷ ছোঁয়ার আজ সাদাফকে প্রপোজ করবে৷ বাকি তিন জোড়া চোখ নিবন্ধ সাদাফ ছোঁয়ার দিকে৷ সাদাফের উত্তরের আশায় আছে সবাই৷ রঙ্গন বলল,

“সাদাফ তুই বাস্তবতার সাথে নিজেকে তুলনা করে দেখ। সবদিক বিবেচনা করে দেখ৷ তোকে ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ছোঁয়া তোর জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ছোঁয়ার ভালোবাসা তোর জীবনে সব থেকে বেশি৷ সব সময় তোকে ভালোবেসে গেছে৷ বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়ে কখনও মুখ ফুটিয়ে বলতে পারেনি৷ আজ তোর কাছে বন্ধুত্বের জবাব পেয়ে নিজের মনে সাহস পেয়েছে৷ তাকে তুই ফিরিয়ে দিবি না প্লিজ৷”

সাদাফের মুখে কোন কথা নেই৷ মেঘা, আরাফ কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল৷ ছোঁয়া হাঁটু গেড়ে উত্তরের আশায় আছে৷ সাদাফের চোখ দুটো লাল বর্ণের ন্যায় ধারণ করেছে৷ সাদাফ ছোঁয়ার কাঁধ করে ছোঁয়াকে দাঁড় করায়৷ ছোঁয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷ সাদাফ রাগের মাথায় খুব জোড়ে কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল৷ অতিরিক্ত কিছু করার আগেই সবাই সাদাফকে ধরে ফেলে৷ সাদাফ হুংকার দিয়ে বলল,

“তোর কতো বড় সাহস তুই আমার সামনে নীতির নাম তুলছিস৷ আমি পৃথিবীতে একটা নামকে সব থেকে বেশি ঘৃনা করি৷ সে নামটা হতো নীতি৷ ইচ্ছা করছে তোকে খু*ন করতে৷ আজ থেকে নীতির নামের পাশে ছোঁয়া নামটাও এড হলো৷ কেউ ছোঁয়া নামটা আমার সামনে নিলে তোদের সাথে আমার সম্পর্ক চলে যাবে৷”

সাদাফের রাগ দেখে রীতিমতো সবাই আশ্চর্য। সাদাফ এর আগে কোনদিন এতোটা রাগ করেনি। সাদাফকে আটকিয়ে রাখা যাচ্ছে না৷ অনেক কথা শুনিয়ে যাচ্ছে ছোঁয়াকে৷ ছোঁয়া নিজেকে আটকিয়ে রাখতে পারল না৷ ছোঁয়া দৌড়ে নিজের গাড়িতে চলে আসে৷ ছোঁয়ার পিছন পিছন মেঘা অর্পিও দৌড়ে আসে৷ তারা আসার আগেই ছোঁয়া গাড়ির দ্বার আটকে দেয়৷ ড্রাইভারকে কড়া নির্দেশ দেওয়াতেই ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে চলে গেলেন৷ মেঘা, অর্পির কথায় কোন পাত্তা দিল না৷

হসপিটালের করিডরে একমাত্র মেয়েকে হারানোর প্রহর গুনে যাচ্ছে। ছোঁয়া সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে৷ বাসায় যাওয়ার পর ছোঁয়ার বাবার রাখা ঘুমের মেডিসিন সবগুলো খেয়ে নিয়েছে৷ কাজের মহিলা দেখে নিয়েছিল৷ সেজন্য সাথে সাথে ছোঁয়াকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়৷ ছোঁয়ার পেট থেকে ঘুমের মেডিসিন প্রভাব দুর করার জন্য ডক্টর স্টমাক ওয়াস করে যাচ্ছেন৷ ছোঁয়ার বাবাকে এক জায়গায় ঝু*প*ড়ি মে*রে বসে আছে৷ ছোঁয়ার মা অনবরত কান্না করেই যাচ্ছে৷ ছোঁয়ার ফ্রেন্ডদের কাউকে এই খবর দেওয়া হয়নি৷ ছোঁয়ার ফোনে একের পর ট্রাই করে যাচ্ছে আরাফ, রঙ্গন, মেঘা, অর্পি৷ কিন্তু কারো ফোন তুলছে না৷ ছোঁয়ার রুমে অবহেলায় অনাদরে ফোনটা পড়ে আছে৷ সবাই সিদ্ধান্ত নিল ছোঁয়াদের বাড়িতে আসবে৷ সকল ভাবনা এক পাশে রেখে চল আসল ছোঁয়াদের বাসায়৷ দারোয়ানের কাছ থেকে জানতে পারে ছোঁয়া সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে৷

রঙ্গন সাদাফকে ফোন দিল৷ সাদাফ ফোন তুলে কড়া জবাব দিল,

“রঙ্গন তুই আমাকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করবি না৷ আমাকে আজ একা থাকতে দে৷ আমি ম”রে যাব না৷ আমি ততটা দূর্বল নয়৷ ম’রা”র হলে হসপিটালে ম*রে যেতাম৷”

রঙ্গনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিল৷ পরবর্তীতে ফোন ডায়াল করলে সুইচ অফ দেখাল৷ কোন উপায় না পেয়ে সাদাফকে মেসেজ করে জানিয়ে দিল,

“তোর জন্য ছোঁয়া সুইসাইড করেছে৷ পারলে ছোঁয়াকে মাটি দিতে আসিস৷”

মেসেজ ভেসে উঠেছে হাজার হৃদয় ভাঙা কষ্ট। রঙ্গন আর আরাফ বাইকে করে হসপিটালে চলে গেল৷ অর্পি, মেঘা একটা রিক্সা নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করল৷ এদিকে ছোঁয়ার অবস্থা ধীরে ধীরে অবনতির দিকে যাচ্ছে৷ ছোঁয়ার মাকে হসপিটালের অন্য কেবিনে এডমিন করানো হয়েছে৷ একমাত্র মেয়ের এমন অবস্থা দেখে ভিপি বেড়ে যায়৷ ঘটনা স্থালে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন৷ ছোঁয়ার বাবার দিকে তাকানো যাচ্ছে না৷ মানুষটা জীবিত থাকলেও মেয়ের শোকে মনটা ম*রে গেছে৷

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here