অন্যরকম প্রেমকাহিনী পর্ব -০৬+৭

#অন্যরকম_প্রেমকাহিনী
#পর্ব_০৬
#অধির_রায়

ভোরের আলো ফুটতেই ছোঁয়া চোখ মেলে তাকায়। ছোঁয়াকে ঘিরে বসে আছে মেঘা, অর্পি, রঙ্গন, আরাফ৷ রাত যতই গভীর হোক না কেন? দিনের আলো অন্ধকার কিছুতেই আটকাতে পারে না৷ ছোঁয়ার নেত্রদ্বয় খুঁজে যাচ্ছে সাদাফ নামের ভালোবাসার মানুষটাকে৷ যাকে ভালোবেসে জীবন যুদ্ধে হেরে গেছে তবুও বে*হায়া নেত্রদ্বয় তাকে খুঁজে যাচ্ছে৷ সাদাফকে দেখতে না পেয়ে নয়ন জলে ভরে উঠল৷ মেঘা ছোঁয়ার হাতের উপর হাত রেখে বলল,

“ছোঁয়া তোর চোখে পানি মানায় না৷ আমি তোর চোখে আগুন দেখতে চাই৷ মেয়েরা কি ফেলনা? ভালোবাসার জন্য দোয়ারে দোয়ারে ঘুরবে৷ আমি চাই তুই এমন একজন নারী হবি তোর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য সাদাফ তোর পিছন পিছন ঘুরবে৷”

আরাফ ক্ষোভ নিয়ে সামান্য হুংকার দিয়ে বলল,

“মেঘা প্রে*ত্নী*কে জিজ্ঞাসা কর, সুইসাইড কেন করতে গিয়েছিল? সাদাফ তার জীবনে বড় হয়ে গেলে৷ তিন বছরের বন্ধুত্বের কোনই মূল্য দিল না৷ আমাদের কথা একবারও ভাবল না৷ আমরা কার জন্য রাতের ঘুম হারাম করে দাঁড়িয়ে আছি৷”

অর্পির ওষ্ঠ কথা বলার জন্য কাঁপছে৷ আগ বাড়িয়ে বলল,

“আরাফ দোস্ত তুই একদম ঠিক বলেছিস৷ আমাকে দেখ, আমি যাকে দেখি তাকেই ভালো লাগে৷ হোক সে নেইমার, হোক সে মেসি৷”

রঙ্গন ধমকের স্বরে বলল,

“থামবি অর্পি৷ কোথায় কি বলতে হয় জানিস না? তুই হলে টিকে আছিস কিভাবে? মাঝে মাঝে আমি তোর চিন্তায় ডিপ্রেশনে চলে যায়৷ অন্য কোথাও এভাবে মুখ খোলার জন্য তোকে পি*টা*নি খেতে হবে৷”

অর্পি গোমড়া মুখ করে বলল,

“কু*ত্তা তুই আমার সাথে কথা বলবি না৷ তোর এতো বড় সাহস তুই আমার ক্রাশদের ইনসাল্ট করিস৷ দোয়া করে দিলাম কোনদিন বিয়ে করতে পারবি না। সন্ন্যাসী হয়ে বেঁচে থাকবি৷”

আরাফ বিরক্তি নিয়ে বলল,

“দোস্ত থাম এবার৷ তোরা এখানেও ঝ’গ’ড়া করবি৷ বারং বার ভুলে যাস কেন আমরা হসপিটালে আছি? এখানে মাদুর্য বজায় রেখে কথা বল।”

অর্পি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

“আমি ঝ’গ’ড়া করিনি৷ শুরু করেছে রঙ্গন৷ আমি আর কোন কথায় বলব না৷”

ছোঁয়ার নেত্রদ্বয়ে বার বার জল ভরে উঠছে৷ না চাওয়া সত্ত্বেও নেত্রদ্বয় ভিজে উঠে৷ মেঘা ছোঁয়ার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,

“ছোঁয়া তোর চোখে জল মানায় না৷ তুই কিছুই জানিস না৷ তোর চিন্তায় আন্টির ভিপি বেড়ে গেছে। উনাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে৷ তোর কিছু হলে আন্টি মা’রা যাবে৷ তোর সাথে তিনটি প্রাণ জড়িয়ে আছে৷ তুই মা-রা গেলে আন্টি মা’রা যাবে৷ মেয়ে, স্ত্রীকে হারিয়ে আঙ্কেল বেঁচে থাকার আশা হারিয়ে ফেলবে৷ মা-রা গেলে আদৌ কি সব গুছিয়ে নেওয়া যায়৷”

ছোঁয়ার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে৷ স্টোমাক ওয়াসের সময় গলা ছিঁলে গেছে৷ তবুও কষ্ট করে বলল,

“মেঘা! মম ঠিক আছে৷ আরাফ আমাকে আমাকে মমের কাছে নিয়ে যা ভাই৷ আমি মমের কাছে যাব৷”

আরাফ চোখ পাকিয়ে বলল,

“এক থা”প্প”ড় দিয়ে চাপার ২৪ দাঁত ফেলে দিব৷ সুইসাইড করার আগে মনে ছিল না৷ আন্টির সাথে তুই দেখা করতে পারবি না৷ তোর কাছে সাদাফ বড় হয়ে গেছে৷ মা বাবার থেকে আপন দ্বিতীয় কেউ নেই৷ সাদাফের সাথে তোর বিয়ে হলে আপন হতো৷ তোর কাছে সাদাফ একজন পর পুরুষ৷ কখনও তোর আপন নয়৷”

বন্ধু মহলে আরাফ সব থেকে দুষ্টু এবং বন্ধু প্রকৃতির লোক৷ তার কাছে বন্ধুত্ব সব থেকে দামী৷ কারোর কিছু হলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না৷ পাঁচ জনকে কেউ কোন ক*টু কথা বললে আরাফ তার জিহ্ব ছিঁড়ে ফেলতেও পারে৷ আরাফের মতো বন্ধু পেয়ে বন্ধু মহল ধন্য৷ ছোঁয়া বিনয়ী স্বরে বলল,

“প্লিজ দোস্ত। আমি একবার মমের সাথে দেখা করতে চাই৷ আমাকে একটু মমের কেবিনে নিয়ে যা৷ বাবা কেমন আছেন? বাবার কিছু হয়নি তো৷”

আরাফ রঙ্গনকে চোখের ইশারায় ছোঁয়ার মমকে ডাকতে পাঠায়৷ ছোঁয়ার বাবা বর্তমানে হসপিটালে নেই৷ ক্ষোভ নিয়ে বলল,

“মরতে মরতে বেঁচে আছেন৷ উনি কার জন্য বেঁচে থাকবেন? কার জন্য কষ্ট করে এতো কিছু করেছেন? কার সুখের জন্য নিজের সকল ক্লান্তি ভুলে সাফল্যের পিছনে ছুঁটে চলছেন৷”

মেঘা কঠিন স্বরে বলল,

“আরাফ এবার থামবি৷ আর কতো কথা শুনাবি৷ তোর একাই খারাপ লাগছে৷ আমাদের খারাপ লাগে না৷ আমাদেরও কষ্ট হয়৷ ছোঁয়া যে বড্ড ভালোবাসার পাগল৷”

আরাফ আর কিছু বলল না৷ অর্পিকে সাথে নিয়ে ছোঁয়ার মমের কেবিনে চলে গেল৷ কেবিনে প্রবেশ করে দেখতে পেল রঙ্গন দাঁড়িয়ে আছে। ছোঁয়া মম ঘুমের দেশে৷ ছোঁয়ার বাবা বাড়িতে চলে গেছেন একটু আগে৷ অর্পি কোমল স্বরে ছোঁয়ার মায়ের ঘুম ভাঙায়৷ ছোঁয়ার মা আঁখি মেলে তাকিয়ে তিনজনকে দেখতে পান৷ তিন জনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“ছোঁয়া ঠিক আছে৷ আমার ছোঁয়ার কিছু হয়নি তো৷”

রঙ্গন আশ্বাসের স্বরে বলল,

“আন্টি কোন চিন্তা নেই৷ ছোঁয়া একদম ঠিক আছে৷ তার জ্ঞান ফিরেছে। জ্ঞান ফিরার পর বারবার আপনার কথা জিঙ্গেস করছে৷ তাই বাধ্য হয়ে আপনার ঘুম ভাঙালাম।”

ছোঁয়ার মম উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

“আমি ছোঁয়ার কাছে যাব৷ আমি ছোঁয়ার সাথে দেখা করতে চাই৷ আমার মেয়ে কোথায়? আমার মেয়েকে দুই নয়ন ভরে দেখতে চাই৷ আর কখন তাকে বকা দিব না৷”

অর্পি ছোঁয়ার মমের হাত ধরে বলল,

“আন্টি উত্তেজিত হবেন না৷ উত্তেজিত হলে আপনার শরীর আবারও খারাপ করবে৷ আপনি আমাদের সাথে আসুন৷”

মেয়েকে দুই নয়ন ভরে দেখে নিলেন৷ নিজের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে৷ ছোঁয়াকে ঝা*পড়ে ধরে রেখেছিলেন অনেকক্ষণ এখন কান্না করেই যাচ্ছেন৷ থামার কোন নামগন্ধ নেই৷ মায়ের ভালোবাসা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা। কোন স্বার্থ ছাড়াই ভালোবেসে যান সারা জীবন৷

সাদাফের ঘুম ভাঙে সকাল দশটার দিকে৷ ফোন বন্ধ রাখার জন্য এলার্ম বেজে উঠেনি৷ যার জন্য গভীর ঘুমে তলিয়ে ছিল৷ ঘুম ঘুম চোখে ফোন হাতে নিল৷ ফোন অন করতেই একের পর এক মিসকল আসতে শুরু করল৷ ফোন বন্ধ থাকার কারণে মিসকল হয়ে গেছে৷ তাছাড়া মেসেজ আসছে একের পর এক। নাম ভেসে উঠছে রঙ্গন, আরাফ, অর্পি, মেঘা৷ সাদাফ তড়িঘড়ি করে মেসেজ চেক করে৷ মেসেজ পড়েই চোখের পাতা থেকে ঘুম চলে যায়৷ চারজনের একটাই মেসেজ ছোঁয়ার করবে মাটি দিতে চাইলে চলে আসতে পারিস৷ ছোঁয়া নামে কেউ তোকে বিরক্ত করবে না৷ সাদাফ ফোন ফেলে তড়িঘড়ি করে শার্ট গায়ে জড়িয়ে দৌড় দেয়৷ সিএনজি নিয়ে ছোঁয়াদের বাসার সামনে চলে আসে৷ দারোয়ান সাদাফকে ভিতরে ঢুকতে দেন৷ সাদাফকে সে আগে থেকেই চিনেন। মেইন গেটে পেরিয়ে ভিতরে আসতেই দেখা মিলে ছোঁয়ার ড্রাইভারের সাথে৷ ছোঁয়া ড্রাইভার রাগী গলায় বলল,

“কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিতে আসছেন৷ প্লিজ ছোঁয়ার জীবন থেকে দূরে চলে যান৷ আপনার জন্য ছোঁয়া মৃত্যুকে বেঁছে নিয়েছে৷ আমাদের মাঝে নেই ছোঁয়া।”

সাদাফের নেত্রদ্বয় টলমল করছে৷ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ ছোঁয়া তাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেল৷ রাগের মাথায় কি বলছে? যার জন্য রাগ করে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে৷ সাদাফ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল৷ আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ছোঁয়া ছোঁয়া ডাকতে থাকল৷ ড্রাইভার আঙ্কেল রাগী গলায় বলল,

“এভাবে ছোঁয়া ছোঁয়া করছো কেন? মনে হচ্ছে ছোঁয়া ম*রে গেছে৷ আল্লাহ তায়ালা অসীম কৃপায় এখনও ছোঁয়া বেঁচে আছে। ছোঁয়াকে হসপিটালের নিয়ে যাওয়া হয়৷”

সাদাফ ড্রাইভার আঙ্কেলের হাত ধরে ফেলে। উত্তেজিত আহত কন্ঠে বলল,

“ছোঁয়াকে কোন হসপিটালে নেওয়া হয়েছে৷ আমি ছোঁয়ার সাথে দেখা করতে চাই৷ প্লিজ ছোঁয়ার ঠিকানা দেন৷”

ড্রাইভার আঙ্কেল না জানার ভান করে বলল,

“আমি জানি না৷ আমি বাড়িতে চলে গেছিলাম৷ আমি আজ জানতে পেরেছি। ছোঁয়া আপনার জন্য সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে৷”

ড্রাইভার আঙ্কেল ইচ্ছা করেই ঠিকানা দিলেন না৷ তিনি চান সাদাফের শাস্তি চান৷ ছোঁয়াকে ছোট থেকে নিজের মেয়ের মতো করে দেখে যাচ্ছে৷ আজ তার জন্য মৃত্যুর পথযাত্রী৷ সাদাফ দৌড়ে দারোয়ানের কাছে যায়৷ দারোয়ানের কাছ থেকে জানতে পারে ছোঁয়াকে সিটি হসপিটালের এডমিট করা হয়েছে৷ এক মুহুর্ত দেরি না করে হসপিটালের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে৷

সাদাফ হসপিটালের অর্পিকে দেখতে পেল৷ অর্পি সাদাফকে ছোঁয়ার কেবিনে নিয়ে আসে৷ সাদাফকে দেখে ছোঁয়ার বাবা রেগে যান৷ তিনি হসপিটালে কোন সিনক্রিয়েট করতে চান না৷ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল,

“ছোঁয়া আমি তোমার চারজন ফ্রেন্ড ছাড়া অন্য কাউকে চিনি না৷ এই পা*গল লোকটাও কি তোমার ফ্রেন্ড? আশা করি জ্ঞানীদের ইশারায় যথেষ্ট।”

ছোঁয়ার বাবা কথা বা বাড়িয়ে সবাইকে বাহিরে পাঠিয়ে দেন৷ সাদাফকে রুমে একা রেখে সবাই চলে যায়৷ সাদাফকে দেখে মনে হচ্ছে মানসিক হসপিটাল থেকে পালিয়ে এসেছে৷ চুলগুলো উসকো খুশকো। পাখির বাসার মতো হয়ে গেছে৷ চোখ দুটো ভীষণ ফোলা৷ দেখে মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমাতে পারেনি৷ ধীর পায়ে সাদাফ ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে যায়৷ ছোঁয়ার হাতের উপর হাত রাখে৷ কিছু বলার আগেই….
#অন্যরকম_প্রেমকাহিনী
#পর্ব_০৭
#অধির_রায়

বিপদে সব সময় পাশে থাকাই বন্ধুত্বের পরিচয়। বন্ধুত্বের পরিচয় পাওয়া যায় যখন বিপদ ঘরে এসে হানা দেয়৷ যারা ভালোবাসা বিপদ দেখে জানালা দিয়ে পালাই তাদের ভালোবাসা লোভ দেখানো৷ যারা বিপদের সময় পাশে থেকে সকল সমস্যার সাথে মোকাবেলা করে তারাই প্রকৃত বন্ধু৷ সাদাফ ছোঁয়ার হাতের উপর হাত রাখে৷ ছোঁয়ার সারা দেহ ভূমিকম্পের মতো কম্পন হলো৷ ছোঁয়া অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছে৷ কিন্তু সৃষ্টি কর্তা তাকে সেই শক্তি দেননি৷ সাদাফের মনে অপরাধ বোধ কাজ করছে৷ অসহায়, ভয়ে কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না৷ ছোঁয়া নিজে থেকে বলল,

“মাথা ঠান্ডা হয়েছে৷ বরফ নিয়ে আসতে বলব! কি অবস্থা করেছিস? মাথা তো পাখির বাসা বানিয়ে রেখেছিস? দেখে মনে হচ্ছে গতকাল থেকে উদরে কিছু পড়েনি৷”

সাদাফ কি বলবে বুঝতে পারছে না৷ ভেবেছিল ভালোবাসার কথা বলবে, উল্টো সাদাফের খুঁজ নিচ্ছে৷ সাদাফ আহত কন্ঠে আমতা আমতা করে বলল,

“তুই সু*ই*সা*ই*ড করার চেষ্টা করছিলি কেন? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে৷ আমার উপর রাগ করে সু”ই”সা”ই”ড করতে চেয়েছিলি৷ আমাকে বাঁ”দ’র নাচ নাচানোর জন্য এমন করেছিস৷”

ছোঁয়া মুচকি হেঁসে বলল,

“আরে মামা প্যারা নিস না৷ চিল কর! অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এমন করেছি৷ তুই কি ভাবছিস? আমি তোর জন্য সু”ই”সা”ই”ড করছি৷ তোর ধারণা ভুল৷ আমার কাছে আমার জীবনের মূল্য অনেক৷ আমি কিছুতেই নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পারব না৷”

ছোঁয়া কষ্ট পেতে পেতে পাথর হয়ে গেছে৷ কষ্ট গুলো বুকে চাপা রেখে অনবরত হাসিমুখে কথা বলে যাচ্ছে স্টোমাক ওয়াসের কথা ভুলে গেছে৷ কথা বলতে যদিও কষ্ট হচ্ছে তবুও কথা বলেই যাচ্ছে৷ সাদাফ অসহায় কন্ঠে বলল,

“আমার উপর তোর এতো রাগ জমে আছে৷ আমার কাছ থেকে মনের কথাগুলো লুকিয়ে যাচ্ছিস৷ আমি তোর কাছে ক্ষমা.. ”

সাদাফ কিছু বলতে পারল না। তার আগেই কেবিনে নার্স প্রবেশ করল৷ স্ট্যাটোস্কেপ বেডে রাখতে রাখতে বলল,

“স্যার আপনি বাহিরে যান৷ আমরা এখানে এখন কাউকে এলাও করব না৷ বিশেষ করে পুরুষ মানুষ। রোগীর চেক আপ করানো হবে৷”

সাদাফ আগ বাড়িয়ে কোন কথা বলল না৷ ছোঁয়ার দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল৷ ছোঁয়া সাদাফের দৃষ্টি উপেক্ষা করে অন্য দিকে দৃষ্টি মেলে তাকায়। ছোঁয়ার উপেক্ষায় সাদাফের মনের সূক্ষ্ম ব্যথাগুলো তীব্র আকারে বাড়তে থাকল৷ উদাসীন মন নিয়ে কেবিন থেকে প্রস্থান করল সাদাফ৷ বাহিরে আসতেই সাদাফকে ঘিরে ধরল চার জোড়া চোখ। চার জোড়া দৃষ্টি সাদাফকে আপাদমস্তক দেখে যাচ্ছে৷ সাদাফ তাদের উপেক্ষা করে হসপিটালের বাহিরে চলে আসল৷ সাদাফের পিছন পিছন তারাও চলে আসল৷ আরাফ সাদাফের পথ আটকিয়ে বলল,

“তোর মন খারাপ কেন? তোর মুখে হাসির রেখা দেখা যাচ্ছে না কেন? অ ছোঁয়া এখনও বেঁচে আছে! কি করবি ছোঁয়ার প্রাণ কৈ মাছের৷ সেজন্য পৃথিবীর নিশ্বাস নিচ্ছে৷”

আরাফের কথায় সাদাফের মাথায় রক্ত উঠে বসে৷ সাদাফ চোখ পাকিয়ে কিছু বলতে চাইলেও থেমে গেল৷ মিহি কন্ঠে বলল,

“আরাফ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা কর৷ অল টাইম ভু”ল”ভা”ল ব”কে যাচ্ছিস৷”

মেঘা মুচকি হেঁসে বলল,

“তুই ভুল কাজ করলেও মানে সাত খু’ন করলেও মাফ৷ আমরা একটু উ’চি’ত কথা বললে দোষ৷”

রঙ্গন সব সময় বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে আসছে৷ আজও তার ব্যতিক্রম হলো না৷ সবাই মিলে সাদাফকে চেপে ধরেছে৷ কেউ সাদাফের দিক বুঝার চেষ্টা করছে না৷ সব দিক বিবেচনা করেই কথা বলি৷ অপরদিকের মানুষটা কি মনে করবে সেদিকে খেয়াল রাখিনা৷ রঙ্গন সাদাফের কাঁধে হাত রেখে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেঘা, আরাফের দিকে৷ অনুতপ্ত স্বরে বলল,

“তোরা শুধু ছোঁয়ার দিকটাই দেখলি৷ একবারও সাদাফের দিকটা দেখলি না৷ একবার জানতে চেয়েছিস, কেন সাদাফ এমন করল? ঠান্ডা মাথার মানুষ সাদাফ কেন এতো রেগে গেল৷”

অর্পি বাঁচাল স্বভাবের মেয়ে হলেও এখন নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে৷ সাদাফ একজনকে নিজের পাশে একটু ভরসা পেল৷ সাদাফ কিছু বলার আগেই রঙ্গন বলল,

“এখানে এসব নিয়ে কোন কথা বলতে চাইনা৷ যা কথা হবে ছোঁয়ার সামনে৷ ছোঁয়া সুস্থ হয়ে ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু করলে এসব নিয়ে কথা হবে৷”

রঙ্গনের কথার সম্মতি জানাল সবাই৷ সাদাফি মানসিকভাবে নিজেকে ঠিক করার কিছু সময় পাবে৷ সাদাফকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে বলা হলো৷

ছয় দিন পর ছোঁয়ার দেখা মিলল ভার্সিটিতে৷ ক্লাসে টুকটাক কথা বললেও মনটা বিষন্নতার ভরপুর। ক্লাস শেষে চিরপরিচিত ক্যাফেডিয়ামে আড্ডায় বসল তিন জোড়া প্রাণ৷ সকল প্রসঙ্গ পাল্টে ছোঁয়া নিজে থেকে বলল,

“কি হলো? তোরা এভাবে চুপচাপ বসে আছিস কেন? রোকসানা ম্যামের ২৮ পৃষ্ঠা এসাইনমেন্ট করে জীবন শেষ৷ এখন চা সিঙ্গারা খেয়ে একটু জীবনটাকে সতেজ করতে চাই৷ তোরা গোমড়া মুখ করে বসে আছিস কেন?”

কেউ ছোঁয়া সাদাফের কথা তুলল না৷ ভালোই ভালোই কেটে গেল পড়ন্ত দুপুর। আড্ডা শেষে সাদাফ নিজে থেকে ছোঁয়ার সাথে কথা বলতে আসল৷ ছোঁয়াকে পিছন থেকে মায়াভরা কন্ঠে ডাক দেয় সাদাফ৷ সাদাফের ডাকে ছোঁয়া পিছন ফিরে তাকায়৷ ছোঁয়া মুচকি হেঁসে জবাব দিল,

“দোস্ত তোর আজ টিউশনি নেই৷ একটু আগেই তো বললি টিউশনিতে যাবি৷ কোন দরকার?”

সাদাফ এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে ঠিক করে নিল৷ বুকের মাঝে সাহস জুগিয়ে বলল,

“তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে৷ তোর যদি কোন আপত্তি না থাকে আমরা কোথাও বসে কথা বলতে পারি৷”

“তুই আমার সাথে যেভাবে কথা বলছিস মনে হচ্ছে আজ তোর সাথে প্রথম কথা হচ্ছে৷ চল আমরা ঘাসের উপর বসে কথা বলি৷”

ছোঁয়ার সম্মতি পেয়ে সাদাফ খুব খুশি হলো৷ ছোঁয়া বসতে বসতে বলল,

“কি বলবি দোস্ত? আগে এটা বল তুই টিউশনিতে গেলিনা কেন?”

“সাদাফ ঘাসের উপর কাঁধ থেকে ব্যাগ রাখল৷ ছোঁয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল,

” তুই আমার উপর রেগে আছিস! আমার সাথে ঠিকমতো কথা বলিস না৷ ফোন দিলে রিসিভ করিস না৷ সমস্যা কি তোর?”

“তেমন কিছু নয়৷ মনকে বুঝানোর চেষ্টা করছি৷ তোকে তো খবর দেওয়া হয়নি বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে৷ ছেলে ইউ এস এ থাকেন৷ বিয়ের পর সেখানে চলে যাব৷”

ছোঁয়ার কথাগুলো সাদাফের বুকে তীরের মতো লাগল৷ বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করল৷ ইচ্ছা করছে ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরে বলতে, আমি তোকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু কোন এক সংকোচে তোকে কিছুই বলতে পারছি না। সাদাফ মুখ কালো করে বলল,

“অভিনন্দন ছোঁয়া৷ নিজের জীবনে এগিয়ে যা৷ আমি সব সময় চাই তুই ভালো থাক৷”

ছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

“আমি জানি তুই আমার জন্য অনেক ভাবিস৷ কখনও আমার খারাপ চাইতে পারিস না৷”

“তুই সেদিনের বিষয় নিয়ে আমার উপর রেগে নেয় তো৷ আমি ইচ্ছা করে কিছু করেছি৷ বিশ্বাস কর আমার মাথা হ্যাং হয়ে গেছিল৷ আমি যা করেছি নিজের অজান্তেই করেছি৷”

“দূর মামা৷ আমি এসব নিয়ে রেগে নেই৷ আমি সেগুলো কবে ভুলে গেছি৷”

“তুই সুইসাইড করেছিলি কেন? আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। আগেই তো শাস্তি দিয়ে দিছিস নীতির নাম বলে৷ তুই জানিস না আমি এই নামটা শুনতে পারিনা৷”

“আমি অজানার বসে এমন কাজ করেছিলাম৷ একজনকে মন থেকে খুব ভালোবাসি। আজও তাকে খুব ভালোবাসি। তাকে পাবো না বলে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি৷ আর তাকে নিয়ে ভাবতে চাইনা৷ সেজন্য বিয়ে করতে চাচ্ছি৷”

সাদাফ আগ্রহ নিয়ে বলল,

“আজও তুই আমাকে ভালোবাসিস৷”

সাদাফকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“ওয়েট ওয়েট। আমি কখন বললাম তোকে জীবন সঙ্গী হিসেবে ভালোবাসি? আমি তোকে আমার বন্ধু ভাবি৷ আমি বন্ধু হয়ে তোর পাশে সব সময় থাকব৷”

কথাগুলো বলার সময় ছোঁয়ার নেত্রদ্বয় টলমল করছিল৷ অনেক কষ্টে চোখের অশ্রু লুকিয়ে রাখল ছোঁয়া। নিরবে দুই জনের মনে বয়ে গেল কষ্টের হাহাকার। কেউ প্রকাশ করতে পারল না৷ ছোঁয়া পুনরায় বলল,

“তোর জন্য সুইসাইড করিনি৷ যাকে ভালোবাসতাম সে আমার কাছে মা’রা গেছে৷ তার জন্য নিজেকে কখনও কষ্ট দিব না৷”

সাদাফের কথাগুলো মনেই রয়ে গেল৷

চলবে….
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here