অন্যরকম প্রেমকাহিনী পর্ব -০৮+৯

#অন্যরকম_প্রেমকাহিনী
#পর্ব_০৮
#অধির_রায়

ভাঙা মনে কেটে গেল পড়ন্ত দুপুর। সাদাফকে একা করে সবাই কেন চলে যায়? সাদাফের কিছুই ভালো লাগছে না৷ ভারী আহত কন্ঠে বলল,

“ছোঁয়া আমার অনেক কাজ আছে। টিউশনি আছে আরও দুইটা৷ সকালে মায়ের সাথে কথা হয়েছে৷ উনি অনেক অসুস্থ। উনাকে ঢাকায় এনে ভালো ডাক্তার দেখাবো৷”

ছোঁয়া সাদাফের মনের মাঝে লুকিয়ে থাকার কষ্টটা বুঝতে পারল৷ সাদাফের প্রতিটি কথা গলায় আটকে পড়ছিল৷ কিছুতেই কথা আসছিল না৷ ছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

“আন্টিকে ফোন করে কালই ঢাকায় আসতে বল৷ আন্টির থাকার ব্যবস্থা নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না৷ আন্টি আমার সাথে আমার বাসায় থাকবে৷”

সাদাফ মলিন কন্ঠে বলল,

“ধন্যবাদ দোস্ত৷ তার কোন প্রয়োজন পড়বে না৷ আমি ছেলে হয়ে যতটুকু পারব তাই করব৷ মাকে সুখে রাখার জন্য আল্লাহ তায়ালা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন৷ আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া। কোন দরকার পড়লে তোদের বলব৷”

সাদাফ কথা না বাড়িয়ে দ্রুত গতিতে প্রস্থান করে৷ নিজেকে আটকিয়ে রাখতে পারলেও রাতে আটকিয়ে রাখতে পারল না৷ রাতের বেলা দূর আকাশে তাকিয়ে আছে ছোঁয়া৷ আকাশটাও ভীষণ ভারী৷ আকাশ জুড়ে কালো মেঘের আনাগোনা। সাদাফের কথাগুলো মনে পড়তেই নিজেকে আটকিয়ে রাখতে পারছে না ছোঁয়া৷ কান্না করেই যাচ্ছে৷ অন্য দিকে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিকোটিনের ধোঁয়া ত্যাগ করছে সাদাফ৷ মনের কষ্টগুলো ধোঁয়ার সাথে উড়ে যাচ্ছে৷ সিগারেট তার কাছে ভীষণ প্রিয় মনে হচ্ছে৷ ঘুমহীন চোখে কেটে গেলে দুইটি প্রাণ৷

যথাসময়ে ছোঁয়া কলেজে চলে আসলেও সাদাফ চলে আসতে পারল না৷ ছেলেদের মধ্যে সাদাফ একাই হলে থাকে৷ তিন বছর থেকে হলে থাকার ফলে নিজেরই একটা নিজস্ব রুম হয়ে গেছে৷ প্রথম দিকে একটু জায়গার জন্য অনেক লড়াই করতে হয়েছে৷ সিনিয়ররা জায়গা দিতে চাইনি৷ আজ সাদাফের হলে জায়গার অভাব নেই। ক্লাসগুলো কেটে গেল খুব দ্রুত গতিতে। প্রথম ক্লাস করার সবাই বেরিয়ে আসে৷ সাদাফকে ছাড়া কেউ ক্লাস করবে না৷

একের পর এক ফোন দিয়ে যাচ্ছে সাদাফকে। সাদাফ কারোর ফোন তুলছে না৷ বিরক্ত হয়ে সাদাফ ফোন বন্ধ করে রাখে৷ এদিকে চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ল বন্ধু মহল৷ সাদাফ সহজেই ফোন বন্ধ রাখে না৷ সাদাফের মা ফোন দিয়ে বন্ধ পেলে অনেক চিন্তা করেন৷ সেজন্য সাদাফ ফোন বন্ধ রাখেন না৷ আরাফ উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

“ছোঁয়া তুই সাদাফকে কি বলছিস? আমার মন বলছে তুই সাদাফকে কিছু না কিছুই করছিস৷”

ছোঁয়া বিষ্ময় চোখে আরাফের দিকে তাকাল৷ ভয়ে ভয়ে বলল,

“তুই জানিস? আমি সাদাফকে কিছু বলিনি৷ আমাকে এখানে টেনে আনছিস কেন? সত্যি বলছি আমি সাদাফকে কিছু বলিনি৷”

ছোঁয়ায় কথায় চারটি প্রাণ আরও চিন্তায় পড়ে গেল। সাদাফের কিছু হয়নি তো৷ ছোঁয়ার মনে অনেক ভয় হচ্ছে৷ গতকাল সে নিজেই বলেছে তার বিয়ে হয়ে যাবে৷ সাদাফকে চলে দূরে কোথাও চলে যাবে৷ চোখের কোণে অশ্রু জমিয়ে রেখেছে সাদাফ হাসিমুখে অভিনন্দন জানিয়েছিল। ভয়ে রীতিমতো হাতপা ঠান্ডা হয়ে আসছে৷ রঙ্গন চিন্তিত গলায় বলল,

“আমি সাদাফের হলে যাচ্ছি৷ আশা করি সাদাফর কিছু হয়নি৷”

আরাফ উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

“আমিও সাদাফের হলে যাব৷ আমি এখনই বাইক নিয়ে আসছি৷ তুই একটু অপেক্ষা কর৷”

ছোঁয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

“আমরাও তিনজন যাব৷ আমরা বাহিরে অপেক্ষা করব সাদাফের জন্য। তোরা দুই জন হলে যাবি।”

ছোঁয়ার কথার সাথে তাল মেলাল মেঘা অর্পি। ইদানীং অর্পিও খুব কথা বলে না৷ প্রয়োজন হলে এক দুইটা কথা বলে৷ রাতে মেঘা অর্পির চুপচাপ থাকার কথা জানতে চাইলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে৷ মেঘা জোর করে সব কিছু জেনেছে৷

আল-আমিন স্যারের প্যাক্টিকেল করছে দু’জন মিলে৷ মেঘার মুখে কেন কথা নেই৷ যে মেয়ে প্যাক্টিকেল করতে বসলে স্যারদের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ফেলে৷ মেঘা অর্পির দিকে কর্নিশ চোখে তাকায়৷ স্বাভাবিকভাবেই বলল,

“অর্পি তুই এখন কথা বলা বন্ধ করে দিলি কেন? আমি খেয়াল করছি তোকে কিছুদিন থেকে৷ তুই কারোর সাথে তেমন কথা বলিস না৷”

অর্পি মলিন কন্ঠে জবাব দিল,

“এটা কোন কথা৷ আমি সারারাত বকবক করেই যাচ্ছি৷ তোর মাথা খারাপ হয়েছে৷”

মেঘা রাগী গলায় বলল,

“কু”ত্তা তুই ভালা কথার মানুষ নয়৷ তোর সাথে তিন বছর থেকে আছি৷ তুই আমার কাছ থেকে সবকিছু লুকিয়ে যাবি৷ তুই মনে হয় ভুলে গেছিস আমি তোর মনের খবর রাখি৷”

“মেঘা তুই বেশি বেশি বকবক করছিস৷ আল-আমিন স্যারের প্যাক্টিকেল কর মন দিয়ে৷ না হলে কাল ক্লাস থেকে লা*থী দিয়ে বের করে দিবে৷”

“অর্পি তোর মনে কি চলছে? তুই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বল।”

“আমি কি চোখ বন্ধ করে কথা বলছি? আমি তো তাকিয়েই কথা বলছি৷ তুই তোর কাজ কর৷ আমাকে আমার কাজ করতে দেয়৷ ডিস্টার্ব করবি না একদম৷ আমার ভালো লাগে না কথা বলতে৷ তাইতো নিজেকে সংযত রাখছি৷ দেখিস না সবাই আমার কথা নিয়ে বিরক্ত হয়৷”

“এখন আমি বিরক্ত হচ্ছি। ইচ্ছা করছে তোকে খু”ন করতে। তুই কবে থেকে এমন মেয়ে হলি? তুই তো খুব ভালো মেয়ে ছিলি৷ সবকিছু শেয়ার করতি৷”

মেঘা অর্পির কাঁধে হাত রাখে৷ অর্পির মুখ নিজের দিকে ঘুরাইতে মেঘা চকিত হয়ে যায়৷ মেঘার চোখের অশ্রু জমে আছে৷ ভয়ে কান্নাও করতে পারছে না৷ কিছু বুঝার আগেই অর্পি মেঘার কোমর জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল৷ কি বলবে বুঝতে পারছে না৷ অর্পি ভেজা গলায় বলল,

“আমি একজনকে খুব ভালোবাসতাম৷ গতকাল আমাকে রেখে সে বিয়ে করে ফেলেছে৷ তার পরিবার আমাকে মেনে নিতে পারেনি৷ আমি একটু মোটা বলে৷ সেও কিছু বলেনি৷ তুই বল মো’টা কি মানুষ নয়? আজ মো’টা বলেই ভালোবাসার মানুষকে হারাতে হলো৷ আল্লাহকে কেন আমায় মো’টা বানালেন?”

মেঘা আকাশ থেকে পড়ল৷ অর্পি কাউকে ভালোবাসতো কোনদিন বলেনি৷ চকিত হয়ে বলল,

“তোদের রিলেশন কতোদিনের ছিল?”

“আমাদের রিলেশন প্রায় চার বছর হতে চলল৷ আমি তাকে খুব ভালোবাসি৷ আমার ভালোবাসায় কোন কমতি ছিল নিশ্চয়৷ যার জন্য সে আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করল৷”

মেঘা আরও এক দফা ধাক্কা খেলো৷ অর্পি চার বছর থেকে প্রেম করে৷ বন্ধু মহলে কোনদিন বলেনি৷ এতোদিন কিভাবে লুকিয়ে কথা বলছে৷ আমি তার সাথে এতো বছর থাকার পরও জানতে পারলাম না৷ বাড়িতে কথা বলতো শুধু৷

মেঘা বিষ্ময় কন্ঠে বলল,

“তোর ফোনে কি নাম দিয়ে সেভ ছিল৷ তোর ফোন নিয়ে আমি কতো ঘাটাঘাটি করছি৷ মেসেজ দেখেছি৷ কিছুই তো পাইনি৷”

“মম দিয়ে সেভ করা৷ আমার মা তো ফোন উইস করেন না৷ বাবা যখন ফোন দেন তখনই কথা হয়৷ আর মেসেজ করার পরই ডিলিট করে দেয়৷ তাকে বলা আছে আমি মেসেজ দিলে রিপ্লাই দিবে৷ তার আগে মেসেজ যেন না দেওয়া হয়৷ মনে পড়লে ফোন দিবে৷”

মেঘা অর্পির প্রেমকাহিনী শুনে তবো বলে রয়ে গেল৷ অর্পিকে অনেক সান্ত্বনা দিল৷ অর্পি কান্না করতে করতে ছোট বাচ্চার মতো মেঘাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল৷

আরাফ আর রঙ্গন সাদাফের হলে ঢুকল৷ সাদাফের ঘর বাহির থেকে তালা ঝুলানো৷ দারোয়ানের কাছে জানতে পেল আজ সকালে তাড়াহুড়ো করে সাদাফ গ্রামের বাড়ি আটপাড়ায় চলে গেছে৷ সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল৷ কেউ বুঝতে পারছে না কি কবরে?

আরাফ চায়ের কাপে চুমু দিয়ে বলল,

“আমি আজই আটপাড়া গ্রামে চলে যাব৷ সাদাফের জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে৷”

ছোঁয়া আহত কন্ঠে বলল,

“তুই সাদাফদের বাসা চিনিস৷ আমাকেও নিয়ে চল৷ আমিও সাদাফকে একটা নজর দেখতে চাই৷”

আরাফ রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে বলল,

“রঙ্গন কিছু মনে করিস না৷ আমি সাদাফের সাথে তাদের গ্রামে ঘুরতে গিয়েছিলাম একবার৷ আমি সেখান থেকেই চিনি৷ তোকে সাথে নিতে চেয়েছিল৷ কিন্তু বলার সাহস হয়নি৷”

রঙ্গন মুচকি হেঁসে বলল,

“দূর সা*লা৷ আমি কিছুই মনে করিনি৷ মেঘা, অর্পি তোরা আমাদের সাথে যাবি৷ আটপাড়া গ্রামের অনেক নাম শুনেছি৷ ঘুরাঘুরি করতে পারব দুইদিন।”

মেঘা এক জবাবে উত্তর দিল,

“আমরা রাজি আছি৷ ছোঁয়া যদি বাড়ি থেকে পারমিশন নিতে পারে তাহলে আমাদের কোন সমস্যা নেই।”

ছোঁয়া বলল,

“তোরা আমাকে একদিন বলেছিলি আমি গাড়ি চালাতে পারিনা৷ আমি অনেক ভালো ড্রাইভ করতে পারি৷ কলেজে থাকা অবস্থায় একটা এক্সিডেন হয়৷ তারপর থেকে মম চালাতে দেয়না৷ আজ আমি তোদের ড্রাইভ করে নিয়ে যাব৷ সাথে তোদের সকল খরচ আমার৷”

গাড়ি চলতে শুরু করল আটপাড়ার উদ্দেশ্যে৷ আরাফের দেখানো পথ ধরে গাড়ি আটপাড়া গ্রামে চলে আসল৷ সাদাফের বাড়ি ভর্তি লোকজন। শোকের বন্যা বয়ে গেছে সাদফের বাড়িতে৷ মা, বোনেরা কান্না করে যাচ্ছে৷ ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে আসল৷ আরাফ একটা বৃদ্ধ লোককে জিজ্ঞাসা করল,

“চাচা এখানে কি হয়েছে? সাদাফ কই? আমরা ঢাকা থেকে আসছি৷ সাদাফ আমাদের কিছু বলে আসেনি৷ তার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল৷”

বৃদ্ধ লোকটি ভাঙা গলায় বলল,

“ও তোমরাই সাদাফের বন্ধু৷ সাদাফের মা তোমাদের সবার কথা বলল৷ তোমরা সাদাফের সাথে দেখা করতে চাও৷”

ছোঁয়া উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

“প্লিজ আমাদের সাদাফের কাছে নিয়ে যান৷ সাদাফকে এক পলক দেখার জন্য আমরা ঢাকা থেকে ছুঁটে আসছি৷”

বৃদ্ধ লোকটি ভেজা গলায় বলল,

“আসো আমার সাথে৷”

বৃদ্ধ লোকটি আগে আগে যাচ্ছে৷ আমরা পিছন পিছন যাচ্ছি৷ বাড়ি থেকে নদীর ঘাটের দিকে আসল৷ এদিকে বাঁশ বাগান৷ বাঁশ বাগানে একপাশে বৈদ্যুতিক লাইটের আলোয় আলোকিত করছে৷ একটু এগিয়ে যেতেই সবার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল৷ সাদাফ কবরের উপর শুয়ে আছে৷ বৃদ্ধ লোকটির কাছ থেকে জানতে পারলাম সাদাফের মা ফরজের আজানের সময় দুনিয়ায় মায়া ত্যাগ করেছেন৷ সবাই ছুটে সাদাফের কাছে গেল৷ সাদাফ তাদের কাছে পেয়ে দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে মা বলে চিৎকার করে উঠল৷

চলবে…. #অন্যরকম_প্রেমকাহিনী
#পর্ব_০৯
#অধির_রায়

পৃথিবীতে কোন সৃষ্টিই অমর নয়৷ সৃষ্টিতে যার জন্ম আছে মৃত্যু তার অবধারিত। জন্মের উপর যেমন কারো হাত নেই৷ মৃত্যুর উপর তেমন কারো হাত নেই৷ সাদাফকে একা করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন সাদাফের প্রাণ ভ্রুমরা। যাকে কেন্দ্র করে সাদাফ এতোদিন বেঁচে ছিল৷ মহান আল্লাহ তায়ালা যাকে কষ্ট দেন তাকে কষ্ট দিয়েই যান৷ আসলে দুনিয়া হলো পরীক্ষার ক্ষেত্র। আল্লাহ আমাদের প্রতিটি পদে পদে পরীক্ষা নেন৷ আমরা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই জীবনে সুখের দিন খুঁজে পাওয়া যায়৷ আরাফকে কাছে পেয়ে সাদাফ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল৷ বাচ্চাদের মতো কান্না করে যাচ্ছে৷ সাদাফের কষ্ট আমরা কেউ উপভোগ করতে পারছি না৷ যার প্রিয়জন হারায় সে বুঝে তার কষ্ট। ছয় জোড়া চোখ থেকে অনবরত অশ্রু ঝড়ে যাচ্ছে৷ তাদেরকে ঘুরে রেখেছে আটপাড়া গ্রামের লোকজন। আরাফ ভেজা গলায় বলল,

“সাদাফ তুই ভেঙে পড়লে আন্টির আত্মা কষ্ট পাবে৷ আন্টি তোকে কখনও এমন অবস্থায় দেখতে পারবেন না৷ তোকে শক্ত হতে হবে। আন্টিকে তুই আগে যেমন ভালোবাসতি৷ এখন তোকে হাজার গুণ ভালোবাসতে হবে৷”

সাদাফ কোন কথা বলতে পারছে না৷ সাদাফ আরাফকে এখনও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে৷ বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু৷ বন্ধুর বিপদের আভাস পেয়ে দূর দিগন্ত পাড়ি দিয়ে চলে এসেছে৷ আরাফ রঙ্গনকে চোখের ইশারায় সাদাফকে ধরতে বলল। রঙ্গন এগিয়ে এসে সাদাফকে তুলে বসায়৷ সাদাফকে বাড়ির দিকে নিয়ে আসতে নিলে সাদাফ চিৎকার করে ভেজা গলায় বলল,

“আমি আমার মাকে ছেড়ে কোথায় যাব না৷ আমি আমার মায়ের পাশে থাকব৷ আমি কোথাও যাব না৷ আমাকে ছেড়ে দে৷”

সাদাফের দেহে আগের তুলনায় অনেক শক্তি। আরাফ রঙ্গন সাদাফকে আটকিয়ে রাখতে পারছেনা৷ তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসল গ্রামের দামাল ছেলেরা৷ সাদাফকে ধ’রা’ধ’রি করে বাড়ির পাশের নদীর ঘাটে নিয়ে আসল৷ সাদাফ মা মা বলে চিৎকার করে যাচ্ছে৷ মা ছাড়া পৃথিবী অন্ধকার। সাদাফকে ঘুরে বসে আছে পাঁচ জোড়া চোখ৷ পাঁচ জোড়া চোখই সাদাফের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ। মেঘা ভেজা গলায় বলল,

“আমরা বাহির থেকে কতো কষ্টের পরিমাণ বুঝতে পারব না৷ কিন্তু বিশ্বাস কর আমরা তোকে সব সময় হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করব৷ আমরা আন্টির জন্য সালাত আদায়ের শেষে মুনাজাতে দোয়া করব৷ আল্লাহ আন্টিকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তর দান করবেন৷”

ছোঁয়া সাদাফকে হাত চেপে ধরে বলল,

“আমি তোর হাত ধরে বাকি জীবন পার করে দিব৷ আমি আন্টির চাওয়াকে সত্যিতে পরিণত করব৷ তুই নিজেকে শক্ত কর৷ জানি পাথর চেপে দুঃখ ভুলা যায়না৷”

সাদাফ ভেজা গলায় বলল,

“কিভাবে মায়ের স্মৃতিগুলো ভুলে যাব৷ আমি সারাজীবন মায়ের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকব৷ জানিস এই ঘাটের সাথেও জড়িয়ে আছে আমাদের হাজারটা কথা৷ আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি৷
!
“বাঁদর ছেলেটা শুধু সারাদিন কড়া রোদে ঘুরে বেড়ায়৷ আজ বাড়িতে আসুক৷ তার একদিন কি আমার একদিন? আজ বাড়িতে আসুক একবার৷”

সাদাফের মা সাদাফকে দুই তিন গ্রাম ঘুরেরও খুঁজে পেলেন না৷ গ্রীষ্মের কড়া রোদ ফসলের মাঠ পানির অভাবে ফেটে গেছে৷ প্রাণ হারিয়ে ফেলছে গাছপালা৷ কড়া রোদের তান্ডবে অনেক সময় দক্ষিণা বাতাসে লেগে যাচ্ছে আগুন৷ সেদিন রায় বাড়ি অগুনে পুড়ে ছা’ড়’খা’র হয়ে গেছে। সাদাফ বাড়িতে পা রাখতেই মায়ের অগ্নি দৃষ্টির সম্মুখীন হয়৷ সাদাফের কান ধরতেই বলল,

“মা আমি নদীর ওপারে ছিলাম৷ তুমি ওপারে গেলে আমাকে দেখতে পেতে৷ তুমি সারা গ্রাম ঘুরতে গেছো কেন?”

সাদাফের কথায় রাগ দিগুণ হয়ে যায়৷ তিনি সাদাফের কান ধরে ঘাটের কাছে নিয়ে আসেন৷ হাতে বাঁশের কঞ্চি। সাদাফের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। সাদাফ আকুতি মিনতি করে বলল,

“মা আমাকে ছেড়ে দাও৷ আমি তার নদীর ওপারে যাব না৷ কোনদিন তোমাকে না বলে ক্রিকেট খেলতেও যাব না৷”

“কেন যাবি না৷ তুই বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটার আকরাম হোসেন হবি তো৷”

“না মা আমি আর ক্রিকেট বেড হাতেই নিব না৷ আমাকে আজ মারবে না৷ আমি কোনদিন খেলার কথা মাথায় নিয়ে আসব না৷ আজ থেকে লেখাপড়া ছাড়া কিছুই করব না৷”

সাদাফের কান ছেড়ে দিতেই সাদাফ দ্রুত গতিতে একটু দূরত্বে দাঁড়ায়৷ মা আঘাত করলে নিলে যেন দৌড়ে পালাতে পারে৷ সাদাফের মা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

“নদীতে গোসল করে আয়৷ আজ ছেড়ে দিলাম৷ এরপর তোর পা ভেঙে তিন রাস্তার সড়কে ফেলে রাখব৷ ভিক্ষা করে খাবি৷”

সাদাফ খুশি হয়ে নদীতে ঝাপ দেয়৷ মায়ের কথামতো নদীতে গোসল করে আসে৷ সাদাফের মা সাদাফের জন্য ঘাটের খাবার নিয়ে আসে৷ টিনের ঘরে গরমের কারণে থাকা যাচ্ছে না৷ সাদাফ গোসল করে ঘাটের ২ সারিতে বসে৷ ঘাটের উপর রয়েছে বিশাল বড় বট গাছ৷ এখানে সবাই এসে বসে থাকে দুপুর বেলা৷ এমনি গরম সহ্য করতে না পেরে অনেক গরু ছাগল এখানে এসে রেস্ট নেয়৷ সাদাফের মুখে এক লোকমা খাবার ভরে দিয়ে বলল,

“খেলায় তোকে ভাত দেয়না৷ ভাত খেতে চলে আসলি কেন? ক্রিকেট খেলাকে বল ‘আমাকে ভাত দাও৷’ কেউ ভাত দিবে না৷ ঘুরে ঘুরে এখানেই আসতে হবে৷”

সাদাফ আপন মনে খেয়ে যাচ্ছে৷ এখন কথা বলা মানেই বিপদ৷ ভালো ভালোই খেয়ে নিলেই ভালো৷ বিকাল বেলা নদীর ওপারের পোলাপানের সাথে খেলা আছে৷ আজ আটপাড়া গ্রামের ছেলেরাই জিতবে। সাদাফ খাবার খাচ্ছে আর এসব চিন্তা করে যাচ্ছে৷ বিকাল বেলা বাড়ি থেকে কিভাবে বের হবে৷ সাদাফ আস্তে করে বলল,

“মা তুমি নৌকা চালাতে পারো৷ না মানে তোমাকে নৌকা চালাতে দেখি নাই৷”

“আমাকে দেখে তোর কি মনে হয়? আগে অনেক বন্যা হতো৷ ঘর বাড়ি ভেঙে নিয়ে যেত৷ তখন আমরা নৌকায় থাকতাম৷ আর তুই বলছিস আমি নৌকা চালাতে পারিনা৷”

হাজারটা কথা শুনতে শুনতে খাবার শেষ করল সাদাফ৷ বিকেল বেলা নদীর ওপারে খেলতে যেতে হবে৷ মায়ের চোখে ভালাে সাজার জন্য বই নিয়ে পড়তে বসল৷

সাদাফ কান্না করেই বলল,

“মা তুমি ফিরে আসো৷ আমি আর কখনও তোমার কথার অমান্য হবো না৷ আমাকে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পিটাবে না৷ আমি আর নদীর ওপারে যাব না৷”

সাদাফকে কি বলে শান্তনা দিবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না৷ সাদাফ তার মাকে কতোটা ভালোবাসতো সাদাফকে দেখে বুঝা যাচ্ছে৷ সাদাফ বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল,

“তোরা কান্না করিস কেন? তোদের কি হলো? ছোঁয়া তুই কান্না করছিস কেন? দুইদিন পর তো তোর বিয়ে৷ এখন কান্না করলে শরীর খারাপ করবে৷”

বিয়ের কথা শুনে চার জোড়া চোখ সাদাফের দিকে দৃষ্টি মেলে তাকায়। সাদাফ ছোঁয়ার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,

“কান্না করিস না৷ মা সব সময় তোর কথা বলতো৷ তুই খুব ভালো মেয়ে৷ রাতেও তোর কথা বলেছে৷ তোকে দেখতে চেয়েছিল৷ জানিস আমি আমার মায়ের খারাপ ছেলে৷ আমি আমার মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পারিনি৷”

“ছোঁয়া এতোক্ষণ নিজেকে আটকিয়ে রাখার অনেক চেষ্টা করেছে৷ হাউমাউ করে কান্না করতে পারেনি৷ শুধু চোখ বুঝে সবকিছু উপলব্ধি করে গেছে৷ এখন আর নিজেকে আটকিয়ে রাখতে পারল না। পাশে থাকা মেঘাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দিল৷ সবাই জানে ছোঁয়া সাদাফের ভালোবাসা। এখন কেউ কিছু বলল না৷”

বেদনাময়ের মাঝে কেটে গেল পাঁচ দিন৷ কেউ ঢাকায় যায়নি৷ সবাই এখানেই রয়ে গেছে৷ সাদাফের কাকা তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন৷ আজ সবাই ঢাকায় চলে যাচ্ছে৷ সাদাফ কিছুতেই ঢাকা যাবে না৷ সে তার মাকে একা ফেলে যাবে না৷ বন্ধ মহল জোর করে সাদাফকে ঢাকায় নিয়ে আসেন৷

চলবে….

ব্যস্ততার মাঝে এতোটুকুই লিখতে পরেছি৷ ভুল ত্রুটিগুলো মার্জনীয় দৃষ্টিতে দেখবেন।

ভুল ত্রুটিগুলো মার্জনীয় দৃষ্টিতে দেখবেন গতকাল না দেওয়ার জন্য দুঃখিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here