অপেক্ষারা পর্ব -১০+১১

#অপেক্ষারা
১০.
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

চারিদিকে কেমন থমথমে পরিবেশ। মাথার ওপরে ফ্যানটা যে ঘুরছে, তার ভঙ্গিমাও থমথমে। সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে! প্রিন্সিপাল ম্যাডাম সায়েমকে ডেকে পাঠিয়েছেন। নাজ ভেবে পায় না তার কী এমন অপরাধ ছিল। অপরাধ যদি হয়েই থাকে, কলেজ কর্তৃপক্ষ নিজে থেকে তাদের শাস্তি-টাস্তি দিলেই তো হয়ে যেত। শুধু শুধু গার্জিয়ান ডেকে ঝামেলা বাড়াবার কোনো মানে হয় না।

ওদিকে একটু আগে এসেছিল তুষির মাও। মা এবং প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সামনে অপরাধের কথা অকপটে স্বীকার করে সে বলেছে, “এই কলেজে আমাকে প্রতিনিয়ত অপমান করা হয়। আমাকে অপমান করলে আমি চুপ করে বসে থাকবো কেন?”

তুষিকে কোনো শাস্তি দিয়েছে কিনা কে জানে? নাজ ভেবে পায় না – একটা মেয়ে, দিনের পর দিন ফেল করে যায় আর কলেজে দিনের পর দিন তাকে করা হয় অপমান। আজকের লাইব্রেরির ঘটনা সে সকল অপমানের বিরুদ্ধে তুষির প্রতিশোধের গল্প। যদিও প্রতিশোধ নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরা পড়তে হয় তাকে। এসবের মাঝে নাজের ভূমিকাটা কী? তাকে তো আর অপমান করা হয়নি, লাইব্রেরিতে তেলাপোকা ছেড়ে দেওয়ার আইডিয়াটাও তার ছিল না। সে কেবল তুষিকে পথ দেখিয়ে সাহায্য করেছে। এর জন্যে সায়েমকে ডেকে আনতে হবে?

সায়েম গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে। চোখেমুখে যথেষ্ট স্বাভাবিকতার ছাপ ধরে রাখার চেষ্টা করলেও নাজ ঠিকই বুঝতে পারছে প্রচন্ড রাগে ভেতরে ভেতরে জ্বলে যাচ্ছে সে। নাজ প্রিন্সিপালের ঘরে এক কোণায় গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। সায়েমের সঙ্গে একবার চোখাচোখি হতেই ভয়ে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল অন্যদিকে।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “এভাবে হুট করে ডাকার জন্যে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আশা করি আপনার খুব একটা অসুবিধা হয়নি।”

সায়েম শীতল গলায় বলল, “জি না।”

“আমরা শিক্ষকরা আপনার কাজকে খুবই এপ্রিশিয়েট করি। আমাদের কলেজের বহু মেয়েদের পড়াশোনা শেষ হবার আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের পর আমরা হাজার চেষ্টা করেও তাদের লেখাপড়ায় ফেরাতে পারিনি। আর সেখানে নাজনীনের ঘটনা একেবারেই ব্যতিক্রম। বিয়ের পর আপনি নিজে এসে ওকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গেছেন। তাই আমরা চাই না ওর পড়াশোনা নিয়ে আপনাকে খুব একটা বিরক্ত করতে। কিন্তু…”

সায়েম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু ওরি অ্যাবউট দ্যাট। ও কী ঘটিয়েছে সেটা বলুন।”

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বললে বিশ্বাস করবেন না, নিজের চোখেই দেখুন!”

তিনি কম্পিউটারে একটা ভিডিও রেকর্ডিং ছেড়ে দিলেন। নাজ ভালোভাবে লক্ষ করতেই বুঝল, জিনিসটা সিসিটিভি ফুটেজ।

“ছাগল কোথাকার!” – মনে মনে তুষির উদ্দেশ্যে বলল সে। নাজ না হয় নতুন, কিন্তু তুষি? বহুকাল ধরেই তো এই কলেজে তার বিচরণ। এখানে যে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে, মেয়েটা জানে না না-কি?

সায়েম পুরো ভিডিওটা মনোযোগ দিয়েই দেখলো। তবে ওই বাক্সটার ভেতরে কী ছিল, সম্ভবত বুঝতে পারলো না। তাই লাইব্রেরি থেকে ছেলেমেয়েগুলোকে চিৎকার করে বেরিয়ে আসতে দেখে সায়েম চমকে উঠে বলল, “কী হলো?”

“তেলাপোকা।”

“মানে?”

“আজ সকালে প্রাকটিকাল পরীক্ষার জন্যে কতগুলো তেলাপোকা আমাদের ল্যাবে আনা হয়। তারা দুজন সেই তেলাপোকাগুলোকে লাইব্রেরিতে ছেড়ে দিয়ে আসে।”

সায়েম চরমভাবে হকচকিয়ে গিয়ে নাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন?”

নাজ সঙ্গে সঙ্গে চোখদুটো নিক্ষেপ করলো মাটির দিকে। তার খুব বলতে ইচ্ছা করছে, “আমি তো শুধু তুষিকে সাহায্য করেছি। আমার কোনো দোষ নেই।” – কিন্তু সাহসের অভাবে মুখটা বন্ধই করে রাখলো।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “দোষটা সম্পূর্ণ ওর একার না। খারাপ সঙ্গ, তাছাড়া নতুন হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব ছিল ওর দিকে আরেকটু মনোযোগ দেওয়া। হয়তো আমরাই সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু ওর যে দোষ নেই তাও নয়। আচ্ছা আপনি বলুন তো, আপনার প্রিয় একজন বন্ধু যদি পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেয়, তবে আপনিও কি তার দেখাদেখি ঝাঁপ দেবেন?”

সায়েম চুপ করে রইলো। প্রচন্ড বিস্ময়ে যেন বাকশক্তিই হারিয়ে ফেলেছে। তার চোখদুটো এখনো কম্পিউটারের দিকেই স্থির হয়ে আছে।

“মিস্টার সায়েম?”

সায়েম সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, “জি?”

“আমি মনে করি নাজনীনের একটা শাস্তি হওয়া উচিৎ। শাস্তি পেলে এমন দুঃসাহস আর দ্বিতীয়বার করতে পারবে না।”

সায়েম গম্ভীর গলায় বলল, “অবশ্যই। আপনার যা ভালো মনে হয়, তাই শাস্তি দিন।”

“আমরা শিক্ষকরা আলোচনা করে দুজনের শাস্তি ঠিক করেছি। ওর বান্ধবীকে ত্রিশ দিনের জন্যে সাসপেন্ড করা হয়েছে, নাজনীনের শাস্তি অতটা দীর্ঘ না হলেও পনেরো দিনের হবে। সাসপেনশন শেষ হবার দুদিন আগে পরীক্ষা শুরু হবে। সেই হিসাবে প্রথম দুটো পরীক্ষায় তাকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না।”

নাজ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। তার ভেতর দিয়ে যে কী সাংঘাতিক ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তার টের এরা কেউ পেল না।

বারান্দার দোলনাটার ওপরে গম্ভীরভাবে বসে আছে সায়েম। তাকে দেখে মনে যেন পাথরের কোনো মূর্তি। এ জীবনে কোনদিন নড়াচড়া করেনি, ভবিষ্যতে করবে সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তার সামনে কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে নাজ। এই মুহূর্তে মানুষটাকে প্রচন্ড ভয় লাগছে তার। ভয়টা কিছুক্ষণ আগেও ছিল না। বাসায় পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঝেঁকে ধরেছে তীব্র এই ভয়।

সায়েম শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “লাইরেরিতে তেলাপোকা?”

শান্ত ভঙ্গিতে কথাটা বললেও তার গলার স্বরে কোথাও যেন একটা থমথমে ভাব ছিল। সেটা আর কেউ না বুঝলেও নাজ বেশ বুঝতে পারছে।

নাজ ইতস্তত করে বলল, “শুনুন…”

সায়েম ধমক দিয়ে বলল, “কী আর শোনাবে? কম কথা তো শুনতে হলো না তোমার জন্যে।”

নাজ চুপ করে রইলো। ভয়ে তার গলার থাকে আওয়াজ পর্যন্ত বের হচ্ছে না। এই মানুষটাকে হুট করে এত ভয় কবে থেকে পেতে শুরু করলো সে?

সায়েম বলল, “ওয়াট ডিড আই টেল ইউ? বলেছিলাম না তোমার ছোট থেকে বড় সব প্রয়োজনগুলোর খেয়াল আমি রাখবো, তোমার যা যা ইচ্ছা সব আমি পূরণ করবো? তুমি শুধু মনোযোগ দিয়ে লেখা পড়া করবে!”

“জি।”

“তাহলে? অবশ্য আমি জিজ্ঞেসই বা করছি কাকে? আগেই বোঝা উচিত ছিল পৃথিবীতে কাউকে তুমি তোয়াক্কা করো না। একটা ব্যাপারই আমার মাথায় ঢুকছে না, এত বড় দুঃসাহস কোথা থেকে আসে তোমার।”

নাজ ভীত গলায় বলল, “বিশ্বাস করুন আমি বুঝতে পারিনি এত বড় ঝামেলা বেঁধে যাবে।”

সায়েম ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “হোয়াট ডু ইউ মিন? এতে বোঝারই বা কী আছে? একটা মানুষের বিবেকেই তো থাকে, এমন কাজ করা উচিত কি উচিত না। ওহ! তোমার মধ্যে তো আবার বিবেক বলতে কিছু নেই। থাকলে কেউ কলেজের লাইব্রেরিতে তেলাপোকা ছেড়ে দেয়? তুমি কী ভেবেছিলে? চুপচাপ তেলাপোকা ছেড়ে দিয়ে আসবে আর কেউ কিচ্ছু টের পাবে না?”

সায়েম তাকিয়ে রয়েছে নাজের দিকে। তার চোখে জিজ্ঞেসা। যে উত্তরের আশা সে করছে সেই উত্তর নাজ দিতে চাইছে, তবে পারছে না। গলা ভেঙে কান্না আসছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রেখেছে সে। এই মুহূর্তে কিছুতেই ওই মানুষটাকে তার চোখের জল দেখতে দেওয়া যাবে না।

সায়েম আবারও বলল, “খুব ফুর্তি হয়েছে তাই না? কিন্তু তাতে কী? শেষ রক্ষা তো আর কোনো না। পুরো কলেজের সামনে মুখ দেখাতে পারবে এর পরে? আমার মতে, পনের দিনের সাসপেনশনে তোমার মতো মানুষের কিছুই হবে না। তোমার জন্যে দরকার ছিল কঠিন কোনো শাস্তির।”

প্রাণপণ চেষ্টা করেও কান্নাটা আর চেপে রাখতে পারলো না নাজ। তার চোখদুটো বেয়ে নিঃশব্দে বেয়ে পড়ছে অশ্রুধারা।

সায়েম প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বলল, “এই মেয়ে! ন্যাকামি বন্ধ করো। খবরদার কাঁদবে না!”

নাজ দুই হাত দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “আপনি সব সময় আমার সঙ্গে এমন করেন। আমি কী ক্ষতি করেছিলাম আপনার? আমাকে যদি একেবারেই সহ্য না করতে পারেন তাহলে বাড়িতে রেখে আসুন। আমি থাকবো না এখানে।”

“চুপ ব্লাডি ইডিয়ট! কিছু বললেই একটাই কথা – বাড়িতে দিয়ে আসুন। শোনো, বিয়ে করেছি। তোমার সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই করার অধিকার আমার আছে। কোথাও যাচ্ছ না তুমি। এখানেই থাকবে আর আমার ইচ্ছা অনুযায়ী চলবে।”

কথাগুলো বলেই সায়েম লম্বা লম্বা পা ফেলে ফেলে চলে গেল। নাজ বসে পড়লো দোলনায়। তার শিশুসুলভ অসংখ্য স্বভাবের একটি হলো, বকাঝকা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। কেউ একজন কঠিন গলায় বকলেই তার সারা শরীর কাঁপতে থাকে, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হয়।

নাজ দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। কেন যে এই মানুষটার সঙ্গে তার বিয়ে হতে গেল! ইচ্ছা করছে ছুটে পালিয়ে যেতে। তা কি একেবারেই অসম্ভব?

বেশ কয়েকদিন কেটে গেল ওই ঘটনার। নাজের বেশির ভাগ সময় এখন কাটছে বাড়িতে বসে লেখাপড়া করেই। এক সপ্তাহ পর সাসপেনশন কেটে গেলেই পরীক্ষা। নাজ ঠিক করে রেখেছে, এই পরীক্ষায় ভালো করে সায়েমের মুখ বন্ধ করে দেবে।

মানুষটা ভয়ানক রেগে গেছে। এই কয়েকদিনেও তার রাগের লেশমাত্র কমেনি। নাজের সঙ্গে কথা বলছে না, নাজ নিজে থেকে কথা বলতে গেলেও এড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষটার অবহেলা প্রচন্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে। কয়েকদিন আগেও সায়েমকে সহ্য হতো না নাজের। একটু পর পর তার রাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যেত। তবে এখন কেন সেই একই মানুষের অবহেলা সহ্য করতে পারছে না নাজ?

আজ সকালে অফিসে যাওয়ার আগে সায়েম যখন জুতার ফিতা বাঁধছে, তখন নাজ তার সামনে গিয়ে অসহায় গলায় বলল, “আপনি এখনো আমার ওপরে রেগে আছেন?”

সায়েম তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “রেগে আছি তোমাকে কে বলল?”

“তাহলে কথা বলছেন না কেন আমার সঙ্গে?”

“তোমার সঙ্গে খেজুরে আলাপ করার তো কিছু নেই! যাও, নিজের কাজে যাও।”

আবারও গলা পর্যন্ত কান্না এসে গেল। নাজ বহুকষ্টে চোখের জল চেপে রেখে আড়ালে চলে এল। আচ্ছা এই মানুষটা কি জানে না, তার এই রাগ কতটা কষ্ট দিচ্ছে নাজকে। নির্ঘাত জানে, জানে বলেই এতটা কষ্ট দিচ্ছে তাকে।

নাজদের বারান্দা থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায়। আজ বহু বছর পর নাজ সূর্যাস্ত দেখল। কী অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য! মানুষ প্রকৃতির কাছাকাছি থেকেও প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ্যগুলোকে দূরে ঠেলে দেয়।

চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসতেই ঘরের ভেতরে চলে এল নাজ। আর ঠিক তখনি এমন এক ঘটনা ঘটলো, যা তার সমস্ত অন্তরাত্মাকে
কাপিয়ে তুলল। প্রচন্ড ভয়ে পাথরের মতো জমে দাঁড়িয়ে আছে নাজ। এক চুল নড়ার ক্ষমতা তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে, অনবরত ঘামছে সে। এতটা ভয় এ জীবনে কোনদিন পায়নি সে।

সামনে এগিয়ে যাওয়ার মতো সাহস নেই তার মাঝে। তবুও বহুকষ্টে এগিয়ে গিয়ে সোফা থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিল। কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়াল করলো সায়েমের নম্বর।

দুটো রিং বাজতেই অপরপ্রান্ত থেকে ফোনটা কেটে দিল সায়েম। কোনো মানে হয়? যত রাগ সব এই মুহূর্তেই প্রকাশ করতে হবে মানুষটাকে?

নাজ আবারও ডায়াল করলো। এবার ফোনটা রিসিভ করে বিরক্ত গলায় সায়েম বলল, “কী সমস্যা তোমার?”

নাজ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “আপনি এক্ষুনি বাসায় আসুন! আপনি না এলে আমি মরেই যাবো।”

(চলবে)#অপেক্ষারা
১১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

পুরো বাসাটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে। অন্ধকারে এগোতে গিয়ে চেয়ারের সঙ্গে ধাক্কা খেল সায়েম। নাজকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তার ফোন পেয়েই দশ মিনিটের মাথায় বাসায় ছুটে আসে সায়েম। না জানি আবার কোন অঘনটন ঘটিয়েছে মেয়েটা।

ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে নাজের ঘরে গেল সায়েম। বিছানার এক কোণে গুটিসুটি মেরে, চোখদুটো বন্ধ করে বসে আছে সে।

সায়েম উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “এই নাজ! কী হয়েছে তোমার?”

নাজ চমকে তাকালো তার দিকে। সায়মকে দেখে যেন প্রাণশক্তি ফিরে পেল মেয়েটা। চট উঠে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। নাজের এমন আকস্মিকভাবে জড়িয়ে ধরায় বেশ হকচকিয়ে উঠল সায়েম।

নাজ কাঁদতে কাঁদতে বলল, “এত দেরি করলেন কেন আপনি?”

সায়েম নাজের মাথায় হাত রেখে বলল, “ওয়াট হ্যাপেনেড নাজ?”

“আমি অন্ধকারে ভয় পাই।”

এই জবাব শুনে সায়েম হাসবে না কাঁদবে তাই ভেবে পাচ্ছে না। অন্ধকারে ভয় পাবার মতো এমন তুচ্ছ কারণে তাকে অফিস থেকে ডেকে আনতে হয়?

সায়েম কঠিন গলায় কিছু একটা বলতে যাবে, তখনই তার মনে হলো – মেয়েটার ভয় কোনো তুচ্ছ বিষয় না। কেউ প্রচন্ড ভয় না পেলে এমন থরথর করে কাঁপতে পারে না।

সায়েম কোমল স্বরে বলল, “আচ্ছা, ছাড়ো আমাকে। আমি ক্যান্ডেল জ্বালাচ্ছি।”

নাজ আঁতকে উঠে বলল, “না! না আপনি কোথাও যাবেন না। প্লিজ!”

“ঠিক আছে, যাচ্ছি না তো! শান্ত হও তুমি।”

নাজ আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সায়েমকে। হুট করে মানুষটার হৃদস্পন্দন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। ঊর্ধ্বমুখী এই হৃদস্পন্দনের মাঝেও অচেনা এক প্রশান্তি খুঁজে পেল নাজ। মনে হচ্ছে যেন এই ধ্বনি শোনার জন্যেই সারাটাজীবন অপেক্ষা করে ছিল সে। সায়েমের বুকে মুখ গুজে চোখদুটো বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে নাজ। যেন এক চুল সরে গেলেও অতল অন্ধকারে হারিয়ে যাবে সে। এই বুকটার থেকে বেশি নিরাপদ সে আর পৃথিবীর কোথাও নেই।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ইলেকট্রিসিটি চলে এল। চারিদিকে আলোর উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে পড়তেই ঘোর কেটে গেল নাজের। কী সর্বনাশ! এতক্ষণ সে ওভাবে জড়িয়ে ধরেছিল লোকটাকে? মারাত্মক লজ্জায় কুকড়ে গিয়ে সায়েমের কাছ থেকে সরে এলো নাজ। চুপচাপ গিয়ে বসে পড়লো বিছানায়। তবে সেই তীব্র ভয়ের রেশ এখনো তার মধ্যে আছে, সামান্য কেঁপে উঠছে একটু পর পর।

সায়েম খাবার টেবিল থেকে পানির গ্লাস এনে নাজের হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বলল, “কী ঘটে গেল একটু আগে?”

নাজ এক চুমুকে পানির গ্লাস শেষ করে বলল, “আমার একটা রোগ আছে। আমি অন্ধকার সহ্য করতে পারি না, অন্ধকারে প্রচন্ড ভয় পাই।”

“কবে থেকে?”

“ছোটবেলা থেকে। তখন অন্ধকারে কী সব জন্তু-জানোয়ারও দেখতে পেতাম, এখন আর পাই না। তবে ভয়টা রয়ে গেছে।”

সায়েম কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বলল, “আমাকে আগে জানাওনি কেন?”

“আপনি যদি রাগ করেন, তাই ভেবে আর বলিনি।”

সায়েম ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী আশ্চর্য! রাগ করবো কেন?”

“আপনাকে ভরসা নেই। যেকোনো সময়ে রেগে যেতে পারেন।”

সায়েম ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। ইলেকট্রিশিয়ানকে খবর দিতে হবে। বাড়িতে আইপিএস আছে, তবে সেটা দীর্ঘদিন যাবত নষ্ট। আজই সারিয়ে না ফেললে, যখন তখন কারেন্ট চলে যাবে আর মেয়েটা আবারও ভয় পেয়ে বসবে।

ইলেকট্রিশিয়ান মিনিট দশেকের মধ্যেই চলে এল। সায়েম তার কাজের তদারকি করছে। নাজ মোহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। মানুষটা ক্রমশই তাকে মুগ্ধ করে যাচ্ছে। নাজ তো চায় না তার প্রতি মুগ্ধ হতে। তবুও সামলে রাখতে পারে না শেষমেশ নিজেকে। এই মানুষটার মধ্যে কী যে আছে?

সায়েমের দিক থেকে চোখদুটো সরিয়ে নাজ তাকালো আয়নার দিকে। সে কি দেখতে এতটাই অসুন্দর? কই না তো! ময়নসিংহে থাকতে কত-শত ছেলেকে যে রিজেক্ট করেছে তার হিসাব নেই। যেই মেয়েটার প্রতি ছেলেদের এত আগ্রহ, এত আকর্ষণ – সেই মেয়েটাকে সারাক্ষণ দূরে সরিয়ে রাখে কেন সায়েম?

আসলে কিছু কিছু ছেলে আছে যারা রূপে নয়, গুণে আকৃষ্ট হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী মেয়েটিও যদি তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় তাহলেও তার অবচেতন মন খুঁজতে থাকবে মেয়েটার গুণগুলো। সায়েমও কি তাদের মধ্যে একজন? তাই যদি হয়ে থেকে তাহলে তো ভারী মুশকিল! নাজের তো উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো গুণই নেই।

আচ্ছা, নাজ হঠাৎ করে সায়েমকে আকৃষ্ট করতে আগ্রহী হয়ে উঠলো কেন? তার কী দায় পড়েছে ওই ছেলেটাকে আকৃষ্ট করার? পরিস্থিতির চাপে পড়ে মতের বিরুদ্ধে দুজন দুজনকে বিয়ে করেছে, তাই বাধ্য হয়ে একসঙ্গে থাকতে হচ্ছে। ব্যস এতটুকুই! এর থেকে বেশি কিছুই তাদের সম্পর্কে নেই।

নাজ বাথরুম থেকে চোখে মুখে পানি দিয়ে ফিরে এসে দেখল ইলেকট্রিশিয়ান লোকটা চলে গেছে।

সায়েম স্বাভাবিক স্বরে বলল, “কিছু খেয়েছ সারাদিন?”

নাজ না-সূচক মাথা নাড়ল।

“কেন?”

“ইচ্ছা করেনি।”

সায়েম কড়া গলায় বলল, “ইচ্ছা করেনি মানে? সবই তোমার চালাকি তাই না?”

“আমি আবার কী চালাকি করলাম?”

“এই যে, না খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়বে যাতে পড়তে না হয়।”

নাজ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সায়েমের দিকে। এই করলার মতো তিতা লোকটার মুখে পড়াশোনা ছাড়া কোনো কথাই শোনা যায় না।

সায়েম বলল, “রেডি হয়ে এসো।”

“রেডি হবো কেন?”

সায়েম বিরক্ত গলায় বলল, “আমি বলেছি তাই। এত প্রশ্ন করো কেন?”

নাজ রেডি হয়ে আসতেই সায়েম তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। বিশাল এক রেস্টুরেন্টে এসেছে তারা। নাজ চোখ বড় বড় করে আশেপাশে তাকাচ্ছে। নিঃসন্দেহে অনেক দামি রেস্টুরেন্ট এটি। নাজ লক্ষ করেছে সায়েমের খুব অল্পসংখ্যক শখের একটি হলো টাকা খরচ করা।

সায়েম শান্ত গলায় বলল, “এখানের সেকেন্ড ফ্লোরে অনেক সুন্দর একটা বসার জায়গা আছে। চলো সেখানেই যাই।”

“কী দরকার ছিল শুধু শুধু এত দামি রেস্টুরেন্টে আসবার?”

সায়েম সিড়িতে পা রেখে বলল, “না এসে উপায় আছে? জরিনার রান্না খেতে খেতে অতিষ্ট হয়ে গেছি!”

সায়েম নিঃশব্দে সিড়ি বেয়ে উঠছে, নাজ তার পিছু পিছু। তারা যখন উঠছে, একই সময় একটা মেয়ে নামছিল সিড়ি বেয়ে। আচমকা সায়েমকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো সে।

মেয়েটা উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, “আরে সায়েম, কী অবস্থা!”

মেয়েটার ডাক শুনে এবার সায়েমও দাঁড়িয়ে পড়লো। সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বলল, “সেঁজুতি! কতদিন পর দেখা।”

নাজ সরু চোখে তাকিয়ে রইল সেঁজুতি নামের মেয়েটার দিকে। মেয়েটা অতিরিক্ত সুন্দরী। মাথাভর্তি কোকড়ানো চুল, চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা আর পরনে জিন্স-টপস। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! সায়েমের সঙ্গে এমন রূপবতী একটা মেয়েটার জানাশোনা থাকবে কেন?

সেঁজুতি বলল, “কী অবস্থা করেছিস নিজের? আগের থেকে কতো শুকিয়ে গেছিস। এত কাজ করতে করতে মরে যাবি তো!”

“কোথায় কাজ করলাম?”

“ভেবেছিস কী? কিছুই খবর রাখি না? শুনলাম এ বছর না-কি দুইবার প্রমোশন পেয়েছিস। এতগুলো টাকা যে কামাচ্ছিস, সবই কি ধরে ধরে ব্যাংকে রেখে দিচ্ছিস? একবারও দেখলাম না আমাদের ট্রিট দিতে।”

“অবশ্যই দিব। বাই দ্য ওয়ে, তুই এখানে কী করছিস?”

সেঁজুতি ইতস্তত করে বলল, “আমার ফিয়ন্সের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম।”

সায়েম অবাক গলায় বলল, “ফিয়ন্সে? বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে না-কি?”

“হুঁ, এই তো কিছুদিন আগেই কথাবার্তা ঠিক হলো। তোর বিয়ে কবে খাবো বল তো?”

বিয়ের প্রসঙ্গ আসতেই সায়েম খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। নাজের সঙ্গে তার বিয়ের ব্যাপারটা কাউকে জানানো হয়নি, জানানোর ইচ্ছাও আপাতত নেই।

সায়েম ব্যস্ততার ভান করে বলল, “আমার না অফিস থেকে একটা জরুরি কল আসছে। একদিন চলে আয় আমাদের অফিসে।”

“যাবোই তো, বিয়ের কার্ড নিয়ে। শোন কার্ড তো পাবিই তবুও আগেভাগে বলে রাখছি, তোকে কিন্তু আমার বিয়েতে আসতেই হবে। তুই না এলে আমি বিয়েই করবো না।”

“অফকোর্স যাবো, তুই সারাজীবন সিঙ্গেল থাকবি সেটা তো হতে দেওয়া যায় না।”

সেঁজুতি খানিকটা হেসে বলল, “আল্লাহহাফেজ।”

“আল্লাহহাফেজ।”

সেঁজুতি হড়বড় করে সিড়ি বেয়ে নেমে গেল। নাজ সায়েমের থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল বলে হয়তো তাকে লক্ষ করেনি। মেয়েটা নিচে নেমে কাকে যেন ফোন করছে। নাজ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে মেয়েটার কর্মকাণ্ড।

সায়েম ধমকের সুরে বলল, “চলো।”

এই মানুষটা সবসময়ই ধমকের সুরে কথা বলে তার সঙ্গে। সেঁজুতি নামের ওই মেয়েটার সঙ্গে তো ওভাবে কথা বলল না। সায়েম যে এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে, তা ছিল নাজের কল্পনারও বাইরে। নাজের ধারণা ছিল মানুষটা গম্ভীর প্রকৃতির। কিন্তু এখন দেখছে শুধু তার বেলাতেই সকল গাম্ভীর্য।

দোতলার এই জায়গাটা আসলেই সুন্দর। মূল রেস্টুরেন্টের বাইরে এই জায়গাটা বারান্দার মতো, তবে ঠিক বারান্দা বললে ভুল হবে। খানিকটা ছাদের মতো বলা যায়। মাথার ওপরে খোলা আকাশ, আর পায়ের তলায় ঘাসের ছড়াছড়ি। যদিও সে ঘাস প্লাস্টিকের। পুরোটা ছাদজুড়ে অসংখ্য মোমবাতির ছড়াছড়ি। এমন একটা জায়গায় মানুষ আসে তার প্রেমিকাকে নিয়ে। সায়েম নাজকে নিয়ে এল কেন কে জানে?

সায়েম মেনুটা নাজের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “দেখো কী খাবে!”

নাজ কিছুক্ষণ অভিজ্ঞ ভঙ্গিতে মেনুটা নাড়াচাড়া করল। মেনুতে লেখা খাবারের নামগুলোর সঙ্গে সে মোটেও পরিচিত নয়। কী অদ্ভুত ব্যাপার! এদেশের রেস্টুরেন্টে একটাও বাঙালি খাবার থাকবে না? পুরো মেনুটা জুড়েই হাবিজাবি বিদেশি খাবার। আর লোকজন সেসব হাবিজাবি খাবার চড়া দাম দিয়ে খাচ্ছেও। কোনো মানে হয়?

নাজ বলল, “বুঝতে পারছি না।”

“স্টেক খাবে?”

এই স্টেক জিনিসটা আবার কী? যাই হয়ে থাকুক না কেন সেটা পরে দেখা যাবে। হারাম কিছু তো আর হবে না!

নাজ বলল, “হুঁ।”

এমনভাবে বলল যেন স্টেক জিনিসটার সঙ্গে বহুকাল ধরে পরিচিত সে। জন্মের পর থেকে সকাল-বিকেল শুধু স্টেকই খেয়ে আসছে।
সায়েম ওয়েটারকে ডেকে দুটো স্টেক, আরও কী কি যেন অর্ডার করলো।

কিছুক্ষণ বাদেই চলে এলো খাবার-দাবার। নাহ্! একটা কথা স্বীকার করতেই হয়। এসব বিদেশি খাবারের এক বৈচিতময় স্বাদ আছে।

নাজ অন্যরকম গলায় বলল, “মেয়েটা কে ছিল?”

“তোমার কী মনে হয়?”

“ভাব তো এমন করে গেল যেন আপনার বিয়ে করা বউ।”

সায়েম খানিকটা হেসে বিড়বিড় করে বলল, “বিয়ে করা বউ কেমন ভাব করে ওর কাছ থেকে শিখলেও তো পারো।”

“কিছু বললেন?”

“কিছু বলিনি। কী আবার বলবো?”

“বলবেন মেয়েটা কে ছিল!”

সায়েম উদাস গলায় বলল, “ছোটবেলার বন্ধু।”

নাজ ভ্রু কপালে তুলে বলল, “সেকি? ছোটবেলার বন্ধু? আপনার এত সুন্দর ছোটবেলার বন্ধু থাকতে আপনি মা-বাবার পছন্দে বিয়ে করতে রাজি হলেন কেন?”

“কারণ ও আমার ছোটবেলার বন্ধু, বান্ধবী নয়।”

নাজ আক্ষেপজড়িত কণ্ঠে বলল, “আহারে! একটু কষ্ট করে যদি মেয়েটার সঙ্গে প্রেম করতেন তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না।”

“এই মেয়ে! কী দিন দেখতে হচ্ছে তোমাকে?”

“দুর্দিন! তেজপাতা বানিয়ে রেখেছেন আমার জীবনটাকে আপনি। পড়াশোনা নিয়ে আমার মাও এত জোরাজুরি করতো না।”

“চুপ করে খাও তো! বেশি কথা বললে অন্ধকার ঘরের মধ্যে তালাবদ্ধ করে রাখবো।”

বুকের ভেতর ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেল নাজ। এই মানুষকে ভরসা নেই। দেখা গেল বাড়ি গিয়ে সত্যি সত্যিই অন্ধকার ঘরে আটকে রেখেছে তাকে। তবুও চুপ করে রইল না নাজ। সায়েমের সঙ্গে তর্কে তাকে জিততেই হবে।

“করে দেখুন না এমনটা! আমি চুপ করে বসে থাকবো না-কি? ফেসবুকে পোস্ট করে পৃথিবীর সবাইকে জানিয়ে দেব, যার সঙ্গে আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছিল সে বিয়ের রাতেই পালিয়ে গেছে।”

সায়েম তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “এখন তুমি যদি নিজের ইচ্ছায় সবাইকে জানাতে চাও যে বিয়ের জন্যে তুমি ছিলে আমার সেকেন্ড অপশন, তাহলে আমার কী-ই বা আপত্তি থাকতে পারে?”

নাহ্! এই মানুষটার সঙ্গে তর্কে জেতা নাজের পক্ষে সম্ভব নয়।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here