অপেক্ষারা পর্ব -২২+২৩

#অপেক্ষারা
২২+২৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

নিমিষেই কেটে গেল আরও ছয়টি মাস। তাদের জীবনে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি এই সময়টাতে। আজকাল অফিসের কাজ নিয়ে সায়েমের ব্যস্ততার শেষ নেই। কদিন আগে এ বছরের তৃতীয় প্রমোশন পেয়েছে। সে এখন কোম্পানির সিইও, বড় বড় সব সিদ্ধান্তগুলো তাকেই নিতে হয়। মাসে মাসে চড়া বেতন পেলেও তার জীবনধারা সেই আগের মতোই রয়ে গেছে।

নাজ একদিন খাবার টেবিলে হাসতে হাসতে বলেছিল, “আপনার মতো কিপ্টা মানুষ আমি জীবনেও দেখিনি। প্রতিদিন কষ্ট করে সিএনজিতে যাতায়াত করবেন তবুও একটা গাড়ি কিনবেন না। সিইও সাহেব অফিসের সামনে সিএনজিতে করে নামছেন, এই দৃশ্য কী গ্রহণযোগ্য? অফিসের সকলে ভাববে যা বেতন পাচ্ছেন, সবই হওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।”

সায়েম গম্ভীর গলায় বলেছিল, “জমিয়ে রাখছি, গাড়িটাড়ি তো পরেও কেনা যাবে।”

“এখন কষ্ট করে ভবিষ্যতের জন্যে জমিয়ে রেখে লাভ কী?”

“লাভটা যে কী সেটা ভবিষ্যতেই বুঝবে। চুপচাপ খাও তো এখন!”

নাজের ব্যস্ততাও কিছুটা বেড়েছে। গত এক মাস ধরে তার বর্ষ সমাপনী পরীক্ষা চলছিল। আজই শেষ হলো। পরীক্ষা শেষে নাজ লাইব্রেরিতে বসেছে। যে লাইব্রেরি নিয়ে এত কাহিনী ঘটে গেল, সেই লাইব্রেরিতেই এখন নিয়মিত যাতায়াত তার। বদরাগী সেই লাইব্রেরিয়ান ম্যাডামও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে নাজকে পছন্দ করেন, মাঝে মধ্যেই এটা সেটা পড়তে দেন।

তবে আজ লাইব্রেরীতে বসে নাজ কিছু পড়ছে না, লিখছে। নীল রঙের একটা কাগজে গোটা গোটা অক্ষরে কী যেন লিখছে নাজ। লেখাটা প্রায় শেষের দিকে। প্রথম থেকে স্বাভাবিকভাবে লিখে এলেও শেষের দিকে এসে তার হাতটা থরথর করে কাঁপছে, অস্বাভািকভাবে ঘামছে। শেষের তিন লাইন লিখতে বেশ অনেকটা সময়ই লাগলো তার। পুরোটা লেখাটা আবার পড়ে দেখা উচিত কিন্তু সেই ইচ্ছা করছে না। কাগজটা সাবধানে ভাঁজ করে সোয়েটারের পকেটে রেখে দিল।

ছোট ছোট পা ফেলে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলো নাজ। পথেই দেখা তুষির সঙ্গে।

তুষি চিন্তিত গলায় বলল, “কীরে? লিখেছিস?”

“হুঁ।”

“কই দেখি!”

“হয়েছে, দেখতে হবে না।”

“দেখতে হবে না মানে? বানান-টানান যদি ভুল হয়?”

“হলে হবে! বুঝতে পারলেই হলো। আমি এখন প্রচন্ড টায়ার্ড! চল, আমাকে সিঙ্গারা খাওয়াবি।”

“আমি খাওয়াতে যাবো কেন? বিবাহিত মহিলা তুই, সুতরাং বিলটাও তুই দিবি।”

নাজ অসহায় গলায় বলল, “আমি বিবাহিত জানার পর থেকে দুনিয়ার সব বিল আমাকে দিয়ে দেওয়াচ্ছিস! যেন বিবাহিত হওয়াটা একটা চাকরি আর মাস গেলে আমি উনার কাছ থেকে বেতন পাই।”

“সবই তোর কিপ্টামি! ভেবেছিস কি কিছুই বুঝি না? চল, আজ কোনো অজুহাত চলবে না।”

ক্যান্টিন বলতে গেলে ফাঁকাই। নাজ আর তুষি গিয়ে ফাঁকা একটা টেবিলে বসে পড়লো আর মেতে উঠলো নিজেদের চিরাচরিত গল্পে। গল্পের ফাঁকেই নাজ লক্ষ করলো একটা ছেলে ইতস্তত ভঙ্গিতে তাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। সম্ভবত কিছু একটা বলতে চাইছে, বলতে পারছে না।

নাজ সরু গলায় বলল, “এই ছেলেটার নাম ঋজু না?”

তুষি বলল, “হুঁ।”

“চোখের সামনে ঘুরঘুর করছে কেন? এখানে কী চায়?”

“কে জানে! হয়তো তোকে।”

নাজ বিস্মিত হয়ে বলল, “আমাকে?”

“হ্যাঁ। এ হলো আমাদের কলেজের বিরাট রোমিও। দুদিন পর পর এর তার প্রেমে হাবুডুবু খায়। এমনকি আমার প্রেমেও হাবুডুবু খেয়েছিল। এখন হয়তো তোর দিকে চোখ পড়েছে।

বিরক্তি প্রবল স্রোত নাজের গা বেয়ে বয়ে গেল। কেউ তার প্রেমে পড়তে পারে ভাবতেই শিউরে উঠলো সে। পৃথিবীর কারো তার প্রেমে পড়ার অধিকার নেই, কেবল একটা মানুষ ছাড়া। কিন্তু সেই একটা মানুষ তো নিজের অধিকার সম্পর্কেই অজ্ঞাত।

নাজ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “দাঁড়া তো, আমি আসছি।”

নাহলে এগিয়ে আসতে দেখে ঋজু ছেলেটা কেমন যেন কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একবার তো মনে হলো – এই বুঝি ছুটে পালাচ্ছে।

নাজ তার কাছে গিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বলল, “কী ব্যাপার?”

ঋজু তোতলাতে তোতলাতে বলল, “কোনো ব্যাপার নেই তো।”

“তাহলে আমাদের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছো কেন? কিছু বলবে?”

ঋজু আঁতকে উঠে বলল, “না! আমি আবার কী বলবো?”

“কিছু যদি না-ই বলার থাকে তাহলে এখান থেকে যাও, না হয় চুপ করে একটা জায়গায় বসে থাকো। তোমার যন্ত্রণায় প্রাইভেসির অভাবে দুটো মেয়ে ঠিকমত গল্প করতে পারছে না।”

“স্যরি।”

ঋজু হুড়মুড় করে চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালো। বহুদূর চলে গিয়েও আবার ফিরে এলো।

ভীত গলায় বলল, “একটা কথা আসলে বলার আছে।”

“বলো!”

“তুমি আর ওই আপু কি প্রতিদিন ক্লাস শেষে রাস্তার ওপারের ফুচকার দোকান থেকে ফুচকা খাও?”

“কেন? তুমি কি ওই দোকানের মালিক যে ফুচকায় ডিসকাউন্ট দেবে?”

“না, আমি ফুচকাওয়ালা হতে যাব কেন?”

“তাহলে জিজ্ঞেস করছো কেন?”

“না মানে… আজ সকালে ক্লাসে আসার পথে মামাকে বলে এসেছি তার স্পেশাল ফুচকা বানিয়ে রাখতে।”

“ও আচ্ছা।”

ঋজু ইতস্তত করে বলল, “তো তুমি কি আজ ফুচকা খেতে যাবে?”

নাজ বিড়বিড় করে বলল, “আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে এই ছাগলটার সাথে আমি ফুচকার আলাপ করছি।”

“কিছু বললে?

নাজ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ বলেছি। তুমি যেন কী জিজ্ঞেস করছিলে?”

“তুমি ফুচকা খেতে যাবে কি-না!”

“ফুচকা খেতে তো আমরা রোজই যাই।”

ঋজু লজ্জায় বেগুনি হয়ে বলল, “না মানে… আজ না হয়… আমার সঙ্গে গেলে।”

“তোমার সঙ্গে যাব কেন? তোমার সঙ্গে গেলে ডিসকাউন্ট পেলেও একটা কথা ছিল।”

“আমি আজ সকালে মামাকে তোমার জন্যে স্পেশাল ফুচকা বানিয়ে রাখতে বলে এসেছি।”

নাজ বিরক্ত গলায় বলল, “একবার তো বললে।”

ঋজু কিছুটা সময় চুপ করে থেকে নিচু স্বরে বলল,“নাজনীন, একটা কথা।”

“বলো।”

“রাগ করবে না তো?”

বিরক্তিতে নাজের গা জ্বলে উঠলো। এধরনের মেয়েলি কথাবার্তা বলে এই ছেলে কীভাবে আশা করে যে নাজ তার প্রেমে হাবডুবু খাবে?

নাজ যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলল, “না, করবো না।”

ঋজু দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, “আমি না, তোমাকে অনেক পছন্দ করি।”

আরেকদফা গা জ্বলে উঠলো নাজের। মাঝে মাঝে তো মনে হয় ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বিয়ের খবরটা কলেজের সকলকে জানিয়ে দিলেই ভালো হতো। অন্তত এসব রোমিওদের হাত থেকে তো রক্ষা পাওয়া যেত।

নাজ বলল, “তাই না-কি? তা কবে থেকে করো?”

“তুমি প্রথম যেদিন আমদের কলেজে এসেছিলে, সেদিন থেকে।”

নাজ কৃত্রিম বিস্ময় নিয়ে বলল, “বাব্বাহ! তাই না-কি? এতদিন কিছু বলো নি কেন?”

ঋজু লজ্জা পেয়ে বলল, “সাহস করে উঠতে পারিনি।”

“ও আচ্ছা। এখন পেরেছো?”

“হ্যাঁ। নাজ, এটা তোমার জন্যে।”

ঋজু কলমের মতো দেখতে কী একটা যেন নাজের দিকে বাড়িয়ে দিল। দেখতে কলমের মতো হলেও এর ভেতরে কালি নেই, আছে পারফিউম।

নাজ মিষ্টি গলায় বলল, “থ্যাংক ইউ। তুমি আমাকে পছন্দ করো জেনে খুশি হয়েছি, পারফিউম পেয়েও খুশি হয়েছি।”

ঋজুর চোখেমুখে এই প্রথম দুশ্চিন্তার বদলে দেখা গেল ক্ষীণ আনন্দের আভাস। সে ইতস্তত করে বলল, “তাহলে আজ যাচ্ছি, তাই না?

“কোথায়?”

“ফুচকা খেতে।”

“একবার তো বললাম না।”

ঋজু বিস্ময়ে খাবি খেয়ে বলল, “আমি যে বললাম, আমি তোমাকে পছন্দ করি।”

নাজ হাসিমুখে বলল, “আমি তো করি না।”

“কিন্তু…”

“আর কোনো কিন্তু না। এবার দয়া করে একটু প্রাইভেসি দাও।”

ঋজু কিছুটা সময় স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ ভঙ্গিতে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেল।

নাজ ফিরে এসে বসতেই তুষি উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো, “কী রে? কী হলো?”

নাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোর ধারণাই ঠিক হয়েছে। নে এটা তোর।”

নাজ কলমের মতো সেই পারফিউমটা তুষির দিকে বাড়িয়ে দিল।

তুষি সেই বস্তু হাতে নিয়ে ক্রুব্ধ কণ্ঠে বলল, “কত বড় বদ! আমাকেও অবিকল এরকম একটা পারফিউম দিয়ে বলেছিল, আমি তোমাকে পছন্দ করি।”

“আর আমাকে কী জিজ্ঞেস করলো জানিস?”

“কী?”

“তুমি আর ওই আপু কি প্রতিদিন ফুচকা খাও?”

“ওরে বাটপার! আমি এখন আপু হয়ে গেলাম?”

“প্রেম করেছিলি না-কি ওর সঙ্গে?”

তুষি মুখ বিকৃত করে বলল, “তোর মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে? ওই গাধার সঙ্গে প্রেম করবো আমি? দুদিন ফুচকা-টুচকা খেতে গিয়েছিলাম এই আর কি!”

আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে দীর্ঘ শীতকালীন ছুটি। ছুটির পরেই তারা ভর্তি হবে ২য় বর্ষে। অনেকগুলো দিন দেখা হবে না, তাই শেষবারের মতো জমিয়ে আড্ডা দিলো নাজ আর তুষি। আড্ডা শেষে ক্যাম্পাসে আসতেই নাজের চোখের পড়লো তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটা। ভ্রুযুগল কুঁচকে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে সায়েম। তার গায়ের কালো রংয়ের শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। গাঢ় বাদামি রঙের একটা সানগ্লাস শার্টের কলারের সঙ্গে ঝুলছে। নাজের মনে হলো ওই মানুষটার দিকে অনন্তকাল ধরে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা কষ্টসাধ্য কোনো কাজ নয়।

সায়েমের চোখে চোখ পড়তেই তার দিকে এগিয়ে গেল নাজ।

সায়েম হালকা ধমকের সুরে বলল, “এত দেরি করে নামলে কেন?”

নাজ হতভম্ব হয়ে বলল, “দেরি করেছি? আমি আরও ভাবলাম অফিস শেষ করে আসতে আসতে আপনারই দেরি হবে।”

“অতিরিক্ত ভাবতে গেলে তো এমনই হবে। দাও, ব্যাগটা দাও।”

“আজ ব্যাগে ভারী বই-টই নেই তো। আমিই পারবো। ভালো কথা, আপনি এখানে সুটকেসটা নিয়ে এসেছেন কেন?”

“এখান থেকেই বাসস্ট্যান্ডে যাবো। নাহলে বাস ধরতে পারবো না। পরের বাস ছয় ঘণ্টা পর।”

“তাই বলে এখান থেকেই? বাসায় গিয়ে একটু ফ্রেশ তো হতে দেবেন। কলেজের ড্রেসেই বাড়িতে যাবো?”

“তোমার ফ্রেশ হওয়ার জন্যে তো ছয় ঘণ্টা পিছিয়ে থাকতে পারবো নাজ!”

বিয়ের পর এই প্রথম প্রাণের শহর ময়মনসিংহে যাচ্ছে নাজ। কতগুলো দিন পর নিজ বাড়ি, নিজ মানুষগুলোর কাছে যাচ্ছে। একটা সময় মনে হতো এগুলো ছাড়া বেঁচে থাকাই তার পক্ষে অসম্ভব। অথচ কী সহজেই যান্ত্রিক এই শহরটায় দিনের পর দিন পার করে দিল সে।

নাজ প্রথম যেদিন ঢাকায় এসেছিল সেদিন এই শহরের যানজট, ধুলোবালি, ব্যস্ততা সবই ছিল তার কাছে অচেনা। সায়েম নামের ওই মানুষটাও তো অচেনা ছিল। অথচ অচেনা জিনিসগুলো আজ তার কত কাছের। মানুষকে হয়তো এভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে। যে পরিস্থিতিই ফেলে দেওয়া হোক না কেন, মানুষ ঠিকই মানিয়ে নেবে।

তারা স্টেশনে বসে অপেক্ষা করছে বাসের জন্যে। প্রচন্ড শীত থরথর করে কাঁপছে নাজ। তার গায়ে ভারী সোয়েটার, কান পর্যন্ত ঢাকা টুপি। তবুও যেন শীত মানছে না। নাজ আড়চোখে তাকালো সায়েমের দিকে। গায়ে একটা মাত্র শার্ট, তার কি শীত-টিত করছে না?

নাজ শীতে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আপনি সোয়েটার আনেননি?”

“ভুলে গেছি।”

নাজ কিছু না বলে চেয়ার থেকে উঠে সুটকেসটা খুলতে লাগলো।

সায়েম ব্যস্ত গলায় বলল, “ওয়াট ননসেন্স নাজ! এতগুলো মানুষের সামনে সুটকেস খুলছো কেন?”

“আমার সুটকেস আমি খুলছি। তাতে এতগুলো মানুষের কী?”

নাজ সুটকেস থেকে একটা লেদার জ্যাকেট বের করে আনলো, জ্যাকেটটা সায়েমের।

সায়েম খানিকটা বিস্মিত গলায় বলল, “আমার জ্যাকেট এখানে এলো কী করে?”

নাজ রাগী গলায় বলল, “জানতাম তো আপনি আনতে ভুলে যাবেন। কেবল কাজের বেলায়ই আপনার কড়াকড়ি। নিজের দিকে খেয়াল যে রাখবেন সেই সময়টুকু পর্যন্ত নেই। নিন, জ্যাকেটটা পড়ে নিন। ঠাণ্ডা লেগে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাকে ধমকাবেন কী করে?”

সায়েম নীরবে নাজের কান্ড দেখে ঠোঁটের কোণে থাকা সূক্ষ্ম হাসিটা আড়াল করে বলল, “থ্যাংক ইউ।”

বাস যাত্রা শুরু করেছে তার গন্তব্যে। ঘড়িতে এখন কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে এগারোটা। বেলা থাকতে থাকতে পৌঁছাতে পারলে হয়। নাজ ঠিক করে রেখেছে যত রাতই হয়ে যাক, পৌঁছেই তার বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে বের হবে। কতকাল ওদের সঙ্গে ঘোরা হয় না! গত কয়েকদিন ধরে নাজ তাদের জন্যে প্রচুর শপিং করেছে। পৌঁছেই জিনিসগুলো ওদেরকে ধরিয়ে দিতে হবে।

নাজ আজ উঠবে তার মায়ের কাছে। তাদের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ির দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। একটা বাড়িতেই থাকলেই হয়! তবুও মায়ের ইচ্ছা প্রথম কয়েকটা দিন নাজ তার সঙ্গেই থাকবে।

সকাল থেকেই নাজের বুক ধুকপুক করছে, মনটা উৎসুক হয়ে আছে। অনেকদিন পর বাড়ি যাচ্ছে সে কারণে নয়। আরও এক কারণ আছে। আগামীকাল তার জন্যে একটি বিশেষ দিন। দিনটার কথা আর কারও মনে আছে কিনা কে জানে? অবশ্য এই দিনে এমন কিছু ঘটে যায়নি যে সকলে মনে রেখে উদযাপন করবে। তবুও দিনটা নাজের জন্যে বিশেষ।

আচ্ছা বিশেষ এই দিনটার কথা কি সায়েমের মনে আছে? তার কাছেও কি দিনটিকে বিশেষ বলে মনে হয়?

মনে আছে কিনা পরখ করে দেখতে নাজ কৃত্রিম কৌতূহলী গলায় বলল, “কাল কত তারিখ?”

সায়েম মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থেকে স্বাভাবিক গলায় বলল, “চৌদ্দ তারিখ।”

“চৌদ্দই জানুয়ারি?”

“হুঁ।”

মানুষটা একই ভঙ্গিতে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রইল। নাহ্! কিছুই মনে নেই ছেলেটার। নাজের ভীষণ রাগ হলো। যার এত ভালো স্মরণশক্তি, সে কেন সামান্য একটা তারিখ মনে রাখতে পারবে না? রাগ হলেও রাগটা প্রকাশ করতে পারলো না নাজ। সায়েমের ওপর রাগ করে থাকার ক্ষমতা প্রকৃতি তাকে দেয়নি।

বাড়ির সামনে এসে দুজনেই হতভম্ব বনে গেল। পুরো বাড়িটা রঙিন মরিচ বাতির আলোয় রাঙানো। আজ একট হুলস্থুল কান্ড বেঁধে গেছে। তার আর সায়েমের রাজ্যের সব আত্মীয়-স্বজন এসে উপস্থিত। সায়েমের মা যথারীতি রান্নাঘর সামলাচ্ছেন, তাকে সাহায্য করছেন নাজের ফুপুরা। মহিলাদের আরেকটি দল ঘর সাজানোতে ব্যস্ত। পুরুষেরা কোনো কাজ না পেয়ে রান্নাবান্নার কাজে তদারকি করতে যাচ্ছেন আর হাসনা বেগমের ধমক খাচ্ছেন। বাড়িজুড়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করছে। সকলের মধ্যে উৎসবের আমেজ। এমন একটা ভাব যেন আজ কারও জন্মদিন অথবা গায়ে হলুদ। কালকের বিশেষ দিন উপলক্ষে এই আয়োজন করা হয়নি তো? তা কী করে হয়? কালকের দিনটা যে ‘বিশেষ’ তাই তো কারো জানা নেই।

লোকজনের কোলাহল একেবারেই সহ্য করতে পারে না সায়েম। একসঙ্গে এতগুলো মানুষকে দেখলে তার মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা শুরু হয়, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। এর নাম হলো সোশ্যাল এনজাইটি। কোলাহল দেখেলেই ছুটে পালাতে ইচ্ছে করে তার। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। বেচারার এই অবস্থা সমন্ধে নাজ খুব ভালোভাবেই অবগত। তাই দুনিয়ার এসব আত্মীয়দের দেখে সেও খুশি হতে পারলো না।

তাদের বাড়ির সামনে দেখে সকলে ছুটে এল। নাজের মা আয়েশা বেগম বরণডালা নিয়ে এলেন তাদের বরণ করতে।

নাজ বিরক্ত গলায় বলল, “এসব কী মা? আমার বাড়িতেই আমাকেই বরণ করতে হবে কেন?”

আয়েশা বেগম কিছু বলে ওঠার আগেই থেকে নাজের এক মামি হাসৌজ্জ্বল কণ্ঠে বললেন, “বিয়ের পর বাপের বাড়ি আর নিজের বাড়ি থাকে না রে মা। তুই তো এখন এ বাড়ির অতিথি!”

নাজ প্রায় বলেই ফেলছিল, “নিজে অতিথি হয়ে আমাকেই অতিথি বলা হচ্ছে? ফাজলামি পেয়েছেন না-কি?”

বহু কষ্টে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে রাখলো। এমনিতেও আত্মীয় মহলে ‘বেয়াদব’ হিসেবে তার ভালোই খ্যাতি রয়েছে।

ঘরের ভেতরে যেতেই আত্মীয-স্বজনরা একযোগে শুরু করলো তাদের আদিখ্যেতা। সায়েম বিরক্তিতে বসার ঘরের এক কোণে বসে মোবাইলে মুখ গুজে রইল।

নাজের বড় মামি বলে উঠলেন, “কীরে নাজ, ঢাকায় গিয়ে তো বিদ্বান হয়ে গেছিস! একেবারে কলজের জামা পরে চলে এলি?”
আরেকজন আবার বললেন, “আহারে বেচারি, চেহারার কী হাল করেছিস? জামাই কি খুব বেশি ঘরের কাজ করায়?”

রাগে গা জ্বলে উঠলো নাজের। জামাই বেশি কাজ করায় মানে? সে তো তাকে ঘরের কোনো কাজে হাত পর্যন্ত দিতে দেয় না।

নাজ শেষমেশ নিজেকে সামলে না রাখতে পেরে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, “আমার পরীক্ষা ছিল, রাতে ঘুম হয়নি। সহজ ব্যাপারটা এট বাড়িয়ে বলার কী আছে?”

“দেখলি! জামাইকে মন্দ বলায় কীভাবে রেগে উঠলো!”

মহিলাদের মাঝে হাসির রোল পড়ে আর নাজের অস্বস্তি সকল ছাড়িয়ে গেল। অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেতে সকলের অগোচরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নাজ। তাদের বাড়ির পেছনে বিশাল এক পুকুর। পুকুরে বিরাট এক নৌকা বাঁধা রয়েছে। নৌকা নাজদেরই। পুকুরঘাটে বড় বড় কাঁঠাল গাছ। নাজের দাদা এ জায়গায় প্রচুর গাছগাছালি লাগিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত কোনো গাছ বাঁচলো না, কেবল এই কাঁঠালগাছ গুলো বেঁচে রইল। নাজ পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে রইল। চারিদিকে কনকনে শীত, তবুও পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে থাকার মাঝে অদ্ভুত এক প্রশান্তি কাজ করে।

নাজের মনটা ভার হয়ে আছে। মনে হচ্ছে এখানে না এলেই ভালো হতো। ওই মানুষটা ছাড়া সে কী করে থাকবে এতগুলো দিন? তার মাঝে যে নাজ ভীষণভাবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, সে কি কোনদিনও বুঝবে না? নাজ যদি তাকে একবার গিয়ে অনুরোধ করে, “আজকের রাতটা এখানেই থেকে যান।” – তবে কি সে ওই অনুরোধ রাখবে?

মোটেই না। গম্ভীর গলায় বলবে, “ইম্পসিবল! আমি ছুটি নিয়ে আসিনি। এখানে একদিন থেকে গেলে কাজের ক্ষতি হয়ে যাবে।”

আরও একটা ইচ্ছা তীব্রভাবে উঁকি দিচ্ছে নাজের মনে। সায়েম নিশ্চয়ই একটু পরে ঢাকায় ফিরতি বাসটা ধরবে। তার সঙ্গে যদি নাজও আবার ফিরে যায়? তাতে কি খুব বেশি ক্ষতি হবে? হয়তো তার আত্মীয়দের মাঝে হাসির রোল পড়ে যাবে। পড়ুক! যে মানুষগুলো সারাবছর ফোন করে একটাবার খোঁজ পর্যন্ত নেয় না, তাদের হাসাহাসিতে কীই বা আসে যায়।

নাজ হঠাৎ লক্ষ করলো সায়েম পুকুরের দিকে এগিয়ে আসছে। নিজের অজান্তেই তার ঠোঁটের প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটে উঠলো। সায়েম নিঃশব্দে এসে বসলো তার পায়ে।

কয়েক মুহূর্ত নীরবতার মাঝেই কেটে গেল। তবে এই নীরবতার একেবারেই অসহনীয় নয়। যুগের পর যুগ অনায়াসে পার করে দেওয়া যায় এই রহস্যময় নীরবতার মাঝে।

অবশেষে সায়েম নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, “মন খারাপ?”

নাজ স্বাভাবিক গলায় বলল, “না। মন খারাপ হতে যাবে কেন?”

“এখানে একা একা বসে আছো যে!”

“আপনিও তো এখানে এসে বসেছেন।”

“আমার কথা আলাদা। আমি চিরকালই আত্মীয়-স্বজনদের সহ্য করতে পারি না। কিন্তু তুমি তো এসব গ্যাদেরিং পছন্দ করো।”

“আমি মোটেও গ্যাদেরিং পছন্দ করি না। এতগুলো দিনে এই চিনলেন আমাকে? আমার পছন্দের মানুষগুলো আশেপাশে থাকলে তবেই পছন্দ করি।”

“ও।”

সায়েম চারিদিকে ভালো করে চোখ বুলিয়ে বলল, “জায়গাটা খুব সুন্দর।”

“সব আমার দাদার কাজ। আগে এখানে পুকুর ছিল না, এত বড় বড় গাছও ছিল। আমার দাদা নিজের হাতে গাছগুলো লাগিয়েছেন, পুকুর কাটিয়েছেন। দাদা চলে যাওয়ার পর যখন বাবা বাড়িটা পেল, তখন সে তেমন কিছুই করল না। শুধু পুকুরের ওপরে এই নৌকাটা রেখে দিল। তাতেই না-কি পুকুরের সৌন্দর্য বহুগুন বেড়েছে।”

“উনি নৌকা বাইতে পারতেন?”

“আমাদের চৌদ্দ গুষ্টিতে কেউ পারে না। বাবা বেঁচে থাকতে মাঝে মাঝে পূর্ণিমার রাতে আমরা নৌকার ভেতরে গিয়ে বসে থাকতাম। চাঁদটার ছায়া যখন জলের ওপর পড়ে, কী যে অদ্ভুত লাগে!”

সায়েম সামান্য হেসে বলল, “চাঁদের ছায়া না নাজ, প্রতিফলন।”

নাজ আহত গলায় বলল, “আমার ভুল না ধরে থাকতে পারেন না আপনি?”

“অভ্যাস হয়ে গেছে।”

নাজ অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “আমারও।”

“কোন অভ্যাস।”

নাজ সঙ্গে সঙ্গে সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, “না, কিছু না।”

“আমি এখন উঠি, না হলে বাস পাবো না।”

“এখনি চলে যাবেন? আরেকটু থাকুন।”

“বেশি মন খারাপ কোরো না। কদিন পরই এসে নিয়ে যাবো।”

সায়েম উঠে দাঁড়ালো, তার দেখাদেখি নাজও উঠে দাঁড়ালো। এই মুহূর্তটার জন্যে বহুকাল অপেক্ষা করে ছিল সে। অপেক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে ভেবেই প্রবল এক স্রোত তার শিরদাঁড়া প্রকম্পিত করে বয়ে গেল।

নাজ তার সোয়েটারের পকেট থেকে সেই ভাঁজ করা নীল কাগজটা বের করে সায়েমের দিকে বাড়িয়ে দিলো। সায়েম কাগজটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে।

নাজ দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে থেমে থেমে বলল, “কাগজটা এখন খুলবেন না। আজ রাত বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে খুলবেন।”

“কেন? আজ রাত বারোটায় কী?”

“কাগজটা খুললেই জানতে পারবেন।”

(চলবে)

[পরবর্তী পর্ব কালকে বিকেলের মধ্যে যাবেন ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here