গল্প: #অপত্যাশিত_ভালোবাসা
লেখক #কাব্য_মেহেরাব
পর্ব:১৫
ব্যাগভর্তি কাপড় নিয়ে আমি আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম কেউ আছে কিনা। যদিও রামু চাচা ছাড়া এই বাড়িতে আপাতত আর কেউ নেই। কিচেনের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম রামু চাচা কিচেনে কাজ করছে। আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে মেইন দরজার সামনে এগোলাম। দরজা খুলতে যাব ঠিক তখনই কানে একটি শব্দ ভেসে আসলো রামু চাচার__
রামু চাচা: দাঁড়াও মামনি……..
বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। ধরা পড়ে গেলাম না তো? রামু চাচা আমাকে কি যেতে দিবে? ভাবতে ভাবতেই একটু ঘুরে রামু চাচার দিকে তাকালাম, মাথা নিচু করে।
রামু চাচা: পালিয়ে যেতে চাইছ মামনি…?( স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন আমাকে)
মেঘা: আসলে……..(কি বলব বুঝতে পারছি না সত্যি কথা বললে সে আমাকে যেতে দেবে কিনা চিন্তায় পড়ে গেলাম)
রামু চাচা:(কিচেন থেকে আমার সামনে এসে তিনি বললেন) তুমি পালিয়ে যেতে চাও, তবে আমি বাধা দিব না।
মেঘা: ব্যাগটা হাত থেকে নিচে রেখে রামু চাচার দিকে তাকালাম।(খুব স্বাভাবিকভাবে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন)
রামু চাচা: এত বড় বাড়িতে আমি একা থাকি। আমার সাথে একটু গল্প করবে মামনি…..?( কি অদ্ভুত আবদার করলো তিনি।)
মেঘা:………(রামু চাচা মানুষটা খারাপ নয় আমাকে নিজের মেয়ের মতন শ্রদ্ধা করে। তবে আমি পালিয়ে যাচ্ছি আর এই মুহূর্তে তিনি আমার সাথে গল্প করতে চাচ্ছেন বিষয়টা খুব আশ্চর্য্য মনে হলো আমার কাছে। চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকালাম।)
রামু চাচা: ভয় নেই মামনি প্রবীশ বাবা তিন চার দিনের জন্য গেছে। একবেলা আমার সাথে গল্প করলে তোমার তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। গল্প শেষ হলে না হয় আমি নিজে তোমাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করবো…..!
মেঘা:….…….(আমি চুপ করে তখনও দাঁড়িয়ে আছি।বলে কি লোক টা?)
রামু চাচা: আমার সাথে উপরে আসো…….(বলেই তিনি উপরের দিকে যেতে লাগলেন। একবার পিছন ঘুরে আমার দিকে তাকালেন)
মেঘা:…( কপাল ভাজ করে বিনা শব্দে জানতে চাইলাম কেন)
রামু চাচা: ভয় পেয়ো না মামনি তুমি আমার মেয়ের মতন…..
বিনা শব্দ ব্যয় করে আমি রামু চাচার পিছন পিছন উপরে উঠলাম। রামু চাচা আমার রুম এবং প্রবীশ বাবুর রুম ক্রস করে আরো দুইটা রুমের পরে একটি রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমিও তার পিছনে পিছনে এসে কপাল ভাজ করে চোখ ছোট ছোট করে দরজার দিকে তাকালাম। রামু চাচা নিজের কাছে রাখা চাবির গুচ্ছ থেকে একটি চাবি দিয়ে রুমের লক খুলে দিলেন।
দরজাটা খুলে আমাকে হাত দিয়ে ভেতরে যাওয়ার জন্য ইশারা করলেন। রামু চাচার কথা মত আমিও রুমের ভিতরে প্রবেশ করলাম। রুম টা বেশ সুন্দর পরিপাটি ভাবে গোছানো তিনটা জয়েন সোফা সেট এর সামনে রাখা একটি সেলফ তার ভিতরে সাজানো বিভিন্ন রকমের ড্রিংসের বোতল। কাউচের সামনে টেবিলে রাখা একটি বোতল পাশে একটি ড্রিংস করার গ্লাস। আমার চোখ ঘুরিয়ে দেওয়ালের দিকে তাকালাম। দেয়ালে ঝুলছে বিভিন্ন রকমের অনেক গুলো ছবি।
আমি আস্তে আস্তে সেই ছবিগুলোর সামনে যেয়ে দাঁড়ালাম। অনেক বড় নিখুঁতভাবে বাঁধানো একটি ছবি যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে প্রবীশ বাবু কাউকে পিছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে হাসছে। খুব সম্ভব এটা তার বাবা। তারপাশে কিছু ছবি আছে যেখানে প্রবীশ বাবু সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে দাঁড়িয়ে আছে এবং অন্য সবাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে ছবি তুলেছে। তার পাশেই একটি ছবি আছে প্রবীশ বাবুর কোন একজনকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ছবি তুলেছে। বুঝতে বাকি রইল না আমার, এই মেয়েটাই হয়তো মেঘা। তার পাশেও অনেকগুলো ছবি রাখা।
আমি পিছনে ফিরে রামু চাচার দিকে তাকালাম। রামু চাচা আমাকে বললো তুমি বসো। তার কথা মতন কোন শব্দ ব্যয় না করে আমি কাউচের উপর বসলাম।
রামু চাচা: মামনি তুমি হয়তো ভাবছো গল্প করতে, তোমাকে আমি এই রুমে কেন আনলাম….!
মেঘা: কয়েকবার আমি মাথা উপরনিচ করে বুঝালাম হ্যাঁ তিনি ঠিকই ধরেছেন গল্প করার জন্য তিনি আমাকে এই রুমে কেন আনলেন।
রামু চাচা: প্রবীশ বাবার সম্পর্কে তোমাকে কিছু বলতে চাই তুমি শুনবে….?
মেঘা: এতক্ষণ তার কথায় আমার কোন কিছু না মনে হলেও এখন প্রবীশ বাবুর কথা বলাতে বিরক্ত প্রকাশ করলাম….
রামু চাচা:(এক কোনায় কাপড়ে ঢাকা একটি ছবি থেকে কাপড় সরিয়ে বললেন) যে ছবিটা দেখছো এখন মামনি ,এটা প্রবীশ বাবার মা-বাবার ছবি। প্রবীশ বাবার মা ছিলেন তার বাবার অফিসের পি. এ.। ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন তারা দুজন। বেশ সুখে দিন কাটছিল তাদের। মাস তিনেক পর প্রবীশের বাবার ব্যবসা ডাউন হতে থাকে।
হঠাৎ একদিন প্রবীশের বাবা জানতে পারে তার স্ত্রীর কোন একজনের সাথে অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। সে আর কেউ নয় প্রবীশের বাবার এগেইন্সটে যাওয়া একজন সফল ব্যবসায়ী। তার সাথে হাত মিলিয়েছিলেন প্রবীশের মা। দিনের পর দিন তাদের সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। এর মধ্যেই প্রবীশের মা কনসিভ করে। তখন প্রবীশ তার গর্ভে ছিল। প্রবীশের মা তখন এই সন্তান রাখতে চান নি। প্রবীশের বাবা তখন প্রবীশের মায়ের কাছে মাথা নত করে। কিন্তু প্রবীশের মা তখন প্রবীশের বাবাকে জানাই যদি তিনি তার গ্রামের প্রপার্টি তার নামে লিখে দেয় , তাহলে সে এই সন্তান জন্ম দেবে। তা না হলে এই সন্তানটি এবরশন করে দিবে।
জীবনে প্রথম বাবা হওয়ার অনুভূতি কেমন সেটা বলে বুঝানো যাবে না । আনন্দ রং অনুভূতি শুরু হওয়ার আগে ই তার সমাপ্ত ঘটতে যাচ্ছিলো। তবে জীবনের শেষ অবলম্বন হিসেবে পেতে চাই তার সন্তান টিকে।সেদিন প্রবীশের বাবা তার স্ত্রীর কথায় রাজি হয়ে যায়।যার ফলস্বরূপ জন্ম হয় প্রবীশের।
প্রবীশ এর জন্মের পর প্রবীশের মা প্রবীশকে রেখে রাত-বেরাত পার্টি করে বেড়াতো। নিজের সন্তানের প্রতি কোন দায়িত্ব সে পালন করত না। এই নিয়ে প্রবীশের বাবার সাথে তার মায়ের তুমুল ঝগড়া শুরু হতে থাকে। এক সময় প্রবীশের মা প্রবীশের বাবা কে ডিভোর্স দিতে চাই। কিন্তু প্রবীশের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রবীশের বাবা তার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে নারাজ হয়।
এইভাবে টানাহেঁচড়ার মাঝে সংসার চলছিল তাদের। প্রবীশের বয়স যখন দুই বছর ছিল, প্রবীশের মা একদিন প্রবীশের গলায় ফল কাটা ছুড়ি ধরে বলে প্রবীশের বাবাকে, তাকে প্রবীশের বাবার নাম এর অর্ধেক প্রপার্টি তার নামে করে দিতে হবে এবং ডিভোর্স দিতে হবে ।তা না হলে এই ছুড়ি প্রবীশের। গলায় পরবে।
সেদিন নিজের সন্তানকে বাচাঁনোর তাগিদে প্রবীশের বাবার নামের অর্ধেক প্রপার্টি প্রবীশের মায়ের নামে করে দেয় এবং ডিভোর্স পেপারে সই করে দেয়। 2 বছরের দুধের বাচ্চা নিয়ে যখন প্রবীশের বাবা কোন কূল কিনারা দেখছিলেন না, কোন একজনের পরামর্শে বাড়িতে একজন মেইড রাখা হয়। প্রবীশের দেখাশোনার জন্য।(কথাটি বলে রামু চাচা থেমে গেলেন)
মেঘা:…….. একজন মেয়ে মা হবার পর নিজের সন্তানের জন্য সারা পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করে সেখানে প্রবীশের মা তার ব্যতিক্রম ।শুনতে আমার দুই হাত মুখে চলে আসে। তারপর কি হলো আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম।
রামু চাচা: একজন সার্ভেন্ট রাখা হয় প্রবীশ বাবার দেখাশোনার জন্য কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয়। প্রবীশের বাবার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একদিন নিজের অসহায়ত্ব দেখায় তার সামনে। প্রবীশ এর কথা চিন্তা করে একদিন প্রবীশের বাবা শেষে সার্ভেন্ট কে বিয়ে করে। কিছুদিন বেশ ভালই চলছিল দিন কাল। ততদিনে প্রবীশের বাবাও নিজের ব্যবসা টা আগের মতন বড় করে নিয়েছিল।
প্রবীশের ছোট মা প্রবীশের ৫ বছর বয়সে সম্পত্তির ভাগীদার বাড়াতে নিজের একটি ছেলে সন্তান জন্ম দেয়। কিন্তু কথায় বলেনা “লোভে পাপ পাপে মৃত্যু”! অপুষ্ট সন্তান জন্ম হওয়ায় মাস চারেক পর সে বাচ্চা টি মারা যায়। কিন্তু তার মাঝে এই বিশাল সম্পত্তির ভাগ বসানোর লোভটা থেকে যায়।
প্রবীশের প্রতি ততদিনে ছোট মার অনিহা তৈরি হয়ে যায়। শুরু হয় প্রবীশের প্রতি অবহেলা করা।বছরখানেক পর আবারো একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেয় প্রবীশের ছোটমা। তারপর আস্তে আস্তে প্রবীশ চোখের কাঁটা হয়ে যায় তার ছোটমার। তবে প্রবীশ তার বোন কে নিজের থেকেও বেশি ভালবাসতে শুরু করে। খেলার সাথী হিসেবে তার বোনকে বেছে নেই। ওইযে কথায় আছেনা “আম গাছের ছাল কখনো কাঠাল গাছে লাগে না”! এখানেও তাই হল!
প্রবীশের বোন প্রিতমা আস্তে আস্তে বড় হলে প্রবীশের সম্পর্কে তার মনে একটু একটু করে বিষ ঢালে তার মা। যার ফলস্বরূপ প্রবীশের পিঠে বুদ্ধির ছুরি বসায় তার বোন প্রিতমা। পুরো সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে চাই প্রবীশের ছোট মা।
একদিন প্রবীশের বাবা এই সব কিছু জানতে পারে। এতদিন তাহলে দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুসেছেন তিনি। ভাবতেই একদিন বুকে প্রচণ্ড ব্যথা করে। হসপিটালাইজড করলে জানা যায় তিনি স্ট্রোক করেছেন। কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয়। আস্তে আস্তে তিনি প্যারালাইজড হয়ে যায়। এর পিছনেও সম্পূর্ণ অবদান রয়েছে প্রবীশের ছোটমার। তার ওষুধ পাল্টিয়ে বিষাক্ত ওষুধ দিতেন তিনি। (আবারো রামু চাচা থেমে গেলেন)
মেঘা:… (আমি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম) এতকিছু করে তিনি কখনো ধরা পড়েনি তাহলে…?
রামু চাচা: ধরা তো পড়তেই হত। পাপ কাউকে ছাড়ে না। হঠাৎ একদিন সকালে প্রবীশের বাবা মারা যায় তবে তার গলায় আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া যায়। পুলিশ কেস হয় পোসমাডাম করে জানতে পারে তার শরীরে বিষাক্ত কীট প্রয়োগ করা হতো। এবং তার মৃত্যু হয়েছিল গলা চেপে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করে। আর এই কাজটা যে প্রবীশের ছোটমা করতো তার প্রমাণ প্রবীশ নিজেই ছিল।
পুলিশ এসে প্রবীশের ছোটমাকে নিয়ে যায়। যাবতজীবন কারাদণ্ড দেয় তাকে। প্রবীশের ছোটবোন প্রীতমা কে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেশের বাইরে তার ছোট মাসির কাছে। প্রবীশ একা হয়ে পড়ে। আমি দেখাশোনা করি তখন প্রবীশের। আর অমিতের বাবা সামলায় প্রবীশের বাবার ব্যবসা।
প্রবীশ বাবা ভার্সিটিতে উঠলে একদিন প্রিতমা দেশে ব্যাক করে নিজের মাসির সাথে। অবশ্যই নিজের স্বার্থের জন্যই ব্যাক করে। একটা কথা জানো কি মামনি? বাবা-মায়ের ভালো গুণ টা সন্তান কম পাই কিন্তু খারাপ গুন টা তার ভেতর পরিপূর্ণ পেয়ে যায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে। এখানেও তাই হয়েছে ,প্রিতমা নিজের ভাগের সম্পত্তি নিতে এসেছিল। নিয়ে ও গেছে কিন্তু যাওয়ার সময় প্রবীশের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে গেছে।
প্রবীশের ভার্সিটিতেই পড়তো মেঘা। সেখান থেকেই পরিচয় হয় প্রবীশের মেঘার সাথে । সিনিয়র ছিল প্রবীশ। তার থেকে দুই ক্লাস জুনিয়ার মেঘা। মেঘা প্রবীশের অ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য অনেক কিছুই করে। একাকীত্ব দূর করতে কোন এক ভাবে বন্ধুত্ব হয় প্রবীশের সাথে মেঘার। একাকীত্ব দূর হলেও তার মাঝে ভালোবাসা ছিল না ছিল শুধু ছলনা।বন্ধুত্ব থেকে ভালবাসার রুপ নেয় প্রবীশের মনে।কিন্তু মেঘার মনে ছিল অন্য কিছু। বাড়ি-গাড়ি বড় বিজনেস এই সব কিছুর লোভ জন্মায় মেঘার মনে। অমিত মেঘার ক্লাসমেট ছিল। সেই সূত্র ধরেই জানতে পারে মেঘার মনের খবর।তবে প্রবীশ অন্ধ বিশ্বাস করত মেঘাকে।
#চলবে……..