অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব -বোনার্স

#অপ্রিয়_সেই_প্রিয়জন

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

#বোনাস পর্ব

মীরা একধ্যানে ইশানের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে সেই ছোট ইশানের সাথে কোন মিল সে পাচ্ছে না। জোরে মিউজিক বাজছে আর এতসব মানুষের শোরগোলের মধ্যে মীরার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। তারপর আবার ইশান। সব মিলিয়ে মীরার অবস্থা করুণ। হঠাৎ ওর পাশে দাঁড়ানো মেয়েটা ওর গাল চেপে ধরে নিজের দিকে ঘোরালো। মীরা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই মেয়েটা বলে উঠলো,’ওদিকে এতো দেখো না তাহলে তোমার মাথার চুল আর মুখের দাঁত একটাও থাকবে না।’

মীরা কোন জবাব দিলো না সবটাই ওর কাছে ধোঁয়াশা। মেয়েটা হেসে বলল,’ক্রাশ খেলে নাকি ইশানের উপর??’
মীরা মাথা নাড়িয়ে না বলতেই মেয়েটা অবাক হয়ে বলে,’সেকি লন্ডনের সব মেয়েরা উঠতে বসতে ইশানের উপর ক্রাশ খায় আর তুমি??বাই দা ওয়ে তুমি কি লন্ডনে নতুন??’

মীরা ছোট করে উওর দিলো,’হুম’

‘ওহ তাই এখানকার মানুষ সম্পর্কে তুমি কিছু জানো না।’

মীরা আবার ইশানের দিকে তাকালো তারপর আবার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল,’ওই ছেলেটাকে তোমরা এতো ভয় পাও কেন??’

মেয়েটা মুখে হতাশ ভাব ফুটিয়ে বলল,’তুমি দেখছি সবটাই জেনে ছাড়বে। তবে জেনে রাখা ভালো।চলো বসে কথা বলি। তুমিও বাঙালি আর আমিও বাঙালি।’

মীরা মেয়েটার সাথে একটা টেবিলে গিয়ে বসে তবে ওর মনটা শুধু ইশানের দিকে। যদি এটাই সেই ইশান হয়?? মেয়েটার থেকে সব জানতে হবে। ওর ভাবার মাঝখানে মেয়েটা বলে উঠলো,’আমি শ্রাবনি আর তুমি??’

মীরা মুচকি হেসে বলল,’আমি মীরা।’

শ্রাবনি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,’নাইস নেইম। আমি এখানে ফ্যামেলি সহ থাকি। এখানেই পড়াশোনা করছি। তবে অবাক করা বিষয় হলো এই শহরে পদে পদে তুমি বাঙালি পাবে।বলতে গেলে বাঙালিতে লন্ডন শহর ভরে গেছে। বাংলাদেশ অনেক উন্নত করেছে দেখছি।’

বলেই শ্রাবনি হেসে ফেললো। মীরার এখন এসব শুনতে বিরক্ত লাগছে। বারবার সে ইশানের দিকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। শ্রাবনি মীরার সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,’হ্যালো এতো দেখো না পরে বিপদে পড়বে।’

মীরা এবার সত্যি বিরক্ত হলো। তারপর বলল,’ওই ছেলেটা সম্পর্কে একটু ক্লিয়ার করে বললে ভালো হতো। তোমার কথা আমি বুঝতেছি না।’
শ্রাবনি এক চুমুকে বিয়ারের বোতল শেষ করে টেবিলের উপর রেখে বলা শুরু করলো,’ওই ছেলেটা হচ্ছে ইশান। মেয়েদের একদম সহ্য করতে পারে না। বলতে পারো মেয়ে মানুষে তার এলার্জি। মনে হয় ওর রক্তে সমস্যা আছে। কিন্তু ইশান কেন যে মেয়েদের পছন্দ করে না তা কেউ জানে না। এমনকি ওর বন্ধুদের কেউও না। বখাটে ছেলে একটা।যাকে বলে বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া ছেলে। প্রতিদিন বারে এসে মদ গেলা আর পার্টি করাই তার স্বভাব। যদি কোন মেয়ে ওকে পাঁচ মিনিটের বেশি দেখেছে তো তার লাইফ শেষ।এর আগে তো পাঁচজন মেয়ের চুল কেটে দিয়েছিল। ইশানের ফ্রেন্ড জিনিয়া ঠিক ওর মতো করে। জিনিয়া মেয়েটাও ঠিক ওইরকম ই। আমরা তো সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার বারে আসি কিন্তু জিনিয়া প্রতিদিন আসে। সারারাত পার্টি করে মাতাল হয়ে বাড়িতে ফেরে। জিনিয়াকে বাইরে থেকে দেখলে সবাই মেয়ে ভাববে তবে ওর ভেতরের ইঞ্জিন পুরো ছেলেদের।’

বলেই শ্রাবনি হাসতে লাগলো। মীরার অস্বস্তি হচ্ছে। ইশান এতোটা বিগড়ে গেছে??মনি’মা জানতে পারলে তো খুব কষ্ট পাবে। তৎক্ষণাৎ মীরা নিজেকে বলল,’ছিঃ মীরা এসব কি ভাবছিস??এটা ইশান না ও হতে পারে। লন্ডনে কি একটাই ইশান??আরো অনেক ইশান ও তো থাকতে পারে।’
মীরা শ্রাবনির দিকে তাকিয়ে বলল,’তুমি কি জানো যে ইশান আগে কোথায় থাকতো??আই মিন এটাই কি ওর জন্মভূমি??’

শ্রাবনি একটু ভেবে বলল,’সেটা জানি না তবে এদেশের ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় ওকে কখনোই কথা বলতে দেখিনি তাহলে কি করে বুঝবো??’
মীরা ভাবলো একবার ইশানের বাবার কথা জিজ্ঞেস করে দেখি। মীরা কিছু বলার আগেই একদল মেয়ে এসে শ্রাবনিকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। শ্রাবনি ওদের সাথে ডান্স করতে চলে গেল। মীরার কেমন যেন লাগছে। বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে। শ্রাবনির কথা শুনে কেমন যেন লাগছে। এ কোন জায়গায় এসে পড়লো মীরা। তবে যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে যেতে পারবে ততই ভালো। মীরা বিড়বিড় করে সাবরিনকে বকছে কেন সে মীরাকে জিনিয়ার কাছে ছেড়ে গেলো??

মীরা উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলো। ইশান পেগের পর পেগ গিলেই যাচ্ছে যা দেখে মীরার বমি পাচ্ছে। গরুর মতো কিভাবে গিলছে দেখো?? হঠাৎ জিনিয়া মীরাকে ডেকে উঠলো,’হানিইইইই কাম হেয়ার।’

জিনিয়ার ডাক শুনেই মীরার কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো। কারণ ইশানও ওর দিকে চেয়ে আছে। সাথে ওর সব ফ্রেন্ডসরাও তাকিয়ে আছে মীরার দিকে। মীরা এগোতে চেয়েও পারছে না। ইশান সম্পর্কে ধারণা পেয়ে ওর ভয় হচ্ছে। সত্যি যদি ওর চুল কেটে দেয়??এসব ভাবতেই মীরা নিজের চুলে হাত বুলায়। এমনিতেই কালকে ইশানের সাথে ঝগড়া করেছে। ওকে তো কাঁচা গিলে খাবে। বাংলাদেশ হলে মীরা ভয় পেতো না। কিন্তু এটা যে লন্ডন। তাছাড়া ওর চেনা জানাও কেউ নেই যে ওকে বাঁচাবে। জিনিয়া মাতাল হয়ে ঢুলছে আর মীরাকে হানি হানি বলে ডাকছে। মীরা তার পরনের জামাটা হালকা টানলো। গায়ের ওড়না টেনে ঠিক করলো। যদিও ঠিক আছে তবুও। আস্তে আস্তে করে জিনিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। জিনিয়া সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ফ্রেন্ডস দিস ইজ হানি,মাই হোম পার্টনার।এন্ড হানি দে আর মাই ফ্রেন্ডস এ্যালেক্স,হার্স, জ্যাক,হ্যারি এন্ড ইশান।’
মীরা এক এক করে সবার দিকে তাকালো।ইশানের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলল সে। কিন্তু আশ্চর্য ইশান ওর দিকে তাকালো না। তবে একবার তাকিয়েছিল। তাহলে কি ইশান মীরাকে চেনেনি??কালকে তো এতো ঝগড়া করলো। মীরা এতে অবাক হলো। ভয়ে ভয়ে সে আড়চোখে ইশানের দিকে তাকাতে লাগল। পরক্ষণে শ্রাবনির কথা মনে পড়ে আর তাকালো না। ওর এত সাধের চুলগুলো খোয়াতে চায় না। তাই ওখান থেকে সরে পড়লো।

মীরার আর ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে লাঠি দিয়ে সব কটাকে পিটাতে। এরকম পাওয়ার যদি ওর থাকতো তাহলে আজকে এই বারের সবকটা হসপিটালে থাকতো। একা একটা টেবিলে বসে সে বিড়বিড় করেই যাচ্ছে। এভাবে মীরা টেবিলের উপর মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মীরার ঘুম ভাঙল জিনিয়ার ডাকে। আড়মোড়া ভেঙে মীরা তাকিয়ে দেখলো জিনিয়া ঢুলঢুলু চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। মীরা উঠে দাড়াতেই জিনিয়া বলল,’লেটস গো হোম হানিইই।’
এই হানি ডাক শুনলে মীরার গা গুলিয়ে আসে। অসভ্য মেয়ে, এমন মেয়ে সে জীবনেও দেখেনি। জিনিয়া ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। মীরার কাঁধে হাত রেখে হাঁটছে সে। জিনিয়ার গা থেকে মদের গন্ধ আসছে। মীরার সহ্য হচ্ছে না। তবুও জিনিয়াকে নিয়ে সে হাটছে। রাস্তাঘাট কিছুই চেনে না মীরা। ফোনটা হাতে নিয়ে ম্যাপ দেখছে। একহাতে ফোন আরেক হাতে জিনিয়াকে ধরে রেখেছে। এভাবে হাঁটা যায় নাকি??জিনিয়া তো পুরো ভর মীরার উপর ছেড়ে দিয়েছে। তাল সামলাতে না পেরে জিনিয়াকে নিয়ে রাস্তায় উল্টে পড়ে। মীরা দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। বেশি ব্যথা পায়নি। কিন্তু সমস্যা হলো জিনিয়াকে সে তুলতেই পারছে না। কিছুক্ষণ টানাটানি করার পর একজোড়া বলিষ্ঠ হাত এসে মীরার হাতের উপর দিয়ে জিনিয়ার হাত ধরলো। মীরা চমকে তাকালো। ইশান জিনিয়ার হাত ধরেছে। মীরা কি করবে বুঝতে পারছে না। ইশান জিনিয়াকে নিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে বসিয়ে দিল। মীরা ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। ইশান মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,’হে গার্ল কাম অন।’
মীরা দ্রুত গিয়ে জিনিয়ার পাশে বসে পড়ল।
ইশান গাড়ি স্টার্ট দিলো। জিনিয়ার বাড়ির সামনে এসে ইশান গাড়ি থামায়। জিনিয়াকে ধরে নিয়ে ওর রুমে নিয়ে যায়। এর মধ্যে মীরার সাথে ইশান একটুও কথা বলেনি।শুধু জিনিয়ার জন্য এক গ্লাস লেবুর শরবত আনতে বলেছে। মীরা শরবত নিয়ে রুমে গিয়ে দেখলো ইশান এখনও যায়নি। মীরা রুমে যেতেই ইশান বেরিয়ে যেতে নিলো। কিন্তু কিছু একটা ভেবে আবার ফিরে এসে মীরার সামনে দাঁড়ালো। ভ্রু যুগল কুঁচকে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,’আই থিংক,আই স ইউ সামহোয়্যার!!’

মীরা শরবতের গ্লাস শক্ত করে ধরলো। তবে কি ইশান ওকে চিনে ফেলল??মীরা শুকনো ঢোক গিলে বলল,’বাট আই সি ইউ দ্যা ফার্স টাইম টু ডে।’

ইশান কেমন করে যেন মীরার দিকে তাকালো। মীরার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। ইশান তাতে পাত্তা দিলো না। চলে গেল। মীরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। জিনিয়াকে শরবত খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নিজের রুমে গেলো। খুব ক্লান্ত সে। ঘড়ি না দেখেই শুয়ে পড়লো মীরা। মীরা ভাবতে লাগলো যে এটা কিছুতেই ইশান হতে পারে না। ইশান তো এরকম ছেলে হতেই পারে না। আবার ভাবলো হতেও পারে। বিদেশে এসে ইশান বদলে যেতেও পারে।

মীরা চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো। এই ছেলেটা যদি ইশান হয় তাহলে তো ভালো। তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবে ইফাজকে। আর যদি না হয় তাহলে তো আরো কাঠখড় পোড়াতে হবে মীরার।এসব ভাবতে ভাবতে মীরা ঘুমিয়ে পড়লো।

ইশান নিজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো। হাতের আংগুলে চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বাড়িতে ঢুকলো। রুমে যাওয়ার আগে একবার ইফাজের রুমে উঁকি দিলো। ইফাজ ঘুমাচ্ছে ইশান তাই নিজের রুমে গিয়ে জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হলো। তারপর নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো। ইশানের কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। মীরাকে সে আগে কোথাও দেখেছে কিন্তু কোথায় দেখেছে তা মনে করতে পারছে না।

মেয়েদের দিকে বেশিক্ষণ ইশান তাকায় না।তাই সবার চেহারা মনে রাখতে পারে না। মনে থাকবে কি ইশান মনে রাখার চেষ্টা করে না। ইশান তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লো।

ইশান যেতেই ইফাজ চোখ মেলে তাকায়। ছেলেটা তার উচ্ছন্নে উঠেছে। কোন কথা শুনছে না। যখন যা ইচ্ছা তাই করে। এতরাত করে বাড়িতে ফিরেছে না জানি কোথায় কোথায় থেকেছে??ইফাজের এখন মনে হচ্ছে ইশানকে পিহুর কাছে রেখে এলেই ভালো হতো। অনন্ত ছেলেটা ভালোর পথে চলতো।রাত দুপুরে বাড়িও ফিরত না। ইফাজের এখন খুব চিন্তা হয় ইশানকে নিয়ে। কখন যে কি করে বসে কে জানে?? আবার বায়না ধরেছে বাংলাদেশ যাওয়ার। ইফাজ নিজেও যাবে ইশানের সাথে। কারণ সে কিছুতেই ইশানকে পিহুর মুখোমুখি হতে দেবে না। ইশান যদি পিহুকে অপমান করে তাহলে পিহু কষ্ট পাবে। তার থেকে বেশি ইফাজ কষ্ট পাবে। যতোই সে পিহুকে ঘৃণা করুক। একটা সময় তো ও পিহুকে ভালোবাসতো। তবে এখনো সে পিহুকে আগের মতোই ভালোবাসে। সেজন্যই তো বাবা মায়ের হাজার চাওয়া সত্ত্বেও ইফাজ বিয়ে করেনি। পিহুর জায়গায় ইফাজ কোনদিন কাউকে বসাতে পারবে না। কখনোই না। তাই এখন ও ইফাজ পিহুর দেওয়া কষ্টগুলো আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে।
ইফাজ বড় একটা শ্বাস ফেলে ঘুমিয়ে পড়ে।

#চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here