#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৫ (প্রেম-বসন্ত)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
“অলকানন্দা,
কেউ একজন বলেছিল, একটি চিঠি দিতে। সময়ে-অসময়ে একটি করে চিঠি দিতে। সেই চিঠিতে অপ্রকাশিত সব আবেগ ঝাড়তে। গলায় শব্দ করে তো কত কথাই হয়! সে চেয়েছিল, তাকে নিয়ে লিখে যেতে। সে বলেছিল, মুখে ভালোবাসি বলার চেয়ে চিঠিতে তার নাম লিখে একটা স্মাইলি ইমোজি দিলেও সে ভালোবাসার চেয়ে গভীর অনুভূতি পাবে। আফসোস! পত্রপ্রিয়া কোনোদিন পত্র পেল না। সে বলেছিল, ‘চিঠিগুলো রঙচটা হবে, সেই চিঠিগুলোর ভাঁজে শুকিয়ে যাওয়া বেলী ফুলের মালা দেবে’। বেলী ফুল তো নেই, আপাতত এটাই না হয় রাখুন। আপনার না-পাওয়া সব সুখ পূরণের দায়িত্ব আমি নিলাম।
ইতি
আপনার শুদ্ধ-পুরুষ।”
তনুজা কয়েকবার পড়ল। খারাপ লাগল না। উলটো হাসতে লাগল। হাসতে হাসতেই মনে পড়ল—সে এক সমাজে বাস করে। তৎক্ষণাৎ কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে দিলো।
_____
তারপর কেটে গেল আরও কতগুলো সময়। শুদ্ধদের ইয়ার চেঞ্জও হয়ে গেল। তার সাথে তনুজার প্রায়ই দেখা হয়। ক্লাসে, ক্যাম্পাসে, রাস্তায়—সবেতেই শুদ্ধ তনুজাকে জ্বালাতে ভোলে না। জ্বালানো বিভিন্ন ধরণের। এই যেমন হুট হাট তনুজার ঠিকানায় চিঠি পাঠানো, রাস্তাঘাটে পিছু নেওয়া, বিভিন্ন ধরণের ফুল দিয়ে চমকে দেওয়া, এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকা, আর সব চেয়ে উপরে আছে তনুজাকে দেখলেই প্রাণভরে হাসাটা। এসব তনুজার কাছে জ্বালানো ছাড়া কিছুই লাগে না।
এর মাঝে অনেক কাহিনি-টাহিনির পর দিশার ফ্যামিলি সবটা মেনে নিয়েছে। শাওন পরিবারকে জানানোর পর, তারাও কিছু বলেনি; যেটা সবচেয়ে বেশি আশ্চর্যের ছিল। তার বাবা কেবল বলেছে, “রিজিকের মালিক আল্লাহ!”
শাওন একটা পার্ট টাইম জবও খুঁজে নিয়েছে। শুদ্ধর পাশের ফ্ল্যাটটাতেই দিশাকে নিয়ে থাকে এখন। এদিক দিয়ে শুদ্ধ এখন প্রায় একাই হয়ে গিয়েছে। আগে যেমন সারাটাক্ষণ শাওন শুদ্ধর সাথে থাকত, এখন তা পারে না। ভার্সিটিতেও সচরাচর যায় না।
এভাবেই কেটে গেল পরের বসন্ত। ওরা সবাই কেমন যেন বড়ো বড়ো হয়ে গিয়েছে। বছর ঘুরলেই স্নাতক শেষ হবে। অথচ, এরা মাস কিছু আগেও কত বাচ্চামো করত! বহমান সময়ের সাথে সবাই এগিয়েছে। থেমে আছে কেবল শুদ্ধ। সেই তনুজাতেই।
তনুজা শুদ্ধকে আর কিছু বলে না এখন। সে ক্লান্ত। ক্লান্ত ভঙ্গিতেই ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। ক’দিন বাদেই, আবার সিদ্দিকের ঠিকানায় চিঠি পাঠাতে হবে তনুজার। গতবার তো নিজেই চলে গিয়েছিল! ভাবতেই গা শিরশির করে উঠল। সে না গেলেও পারত! কেন যে গেল!
চোখ দুটো বন্ধ করে গ্রিলে মাথা ঠেকাতেই মনে পড়ল, গতবছর সিদ্দিককে দেওয়া সেই চিঠিটা। প্রতি বছরের ওই নির্দিষ্ট মাসের কোনো এক দিনে তনুজা সিদ্দিককে একটা চিঠি পাঠায়। এ-বছরও চিঠি পাঠানোর সময় এসে গিয়েছে। এবার আর গতবারের মতো ভুল করবে না; নিজে যাবে না। গতবার সিদ্দিককে একটু দেখার নেশায় সে গিয়েছিল। তারপর দেখল একটা হ্যাপি ফ্যামিলি! মনের এই ব্যথাটা স্বীয় মন ছাড়া কেউ বুঝতেও পারবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে চলে এলো। অনেকটা সময় চুপ থেকে কাগজ কলম তুলে এ-বছরের চিঠিটা লেখা শুরু করল—
“সিদ্দিক,
জীবনটা সন্ধ্যেয় বাবার ফেরার সময় হাতে করে নিয়ে আসা আমাদের জন্য সেই খেলনাটি না; যে পছন্দ হলে বুকে জড়িয়ে নেব, না হলে ছুঁড়ে ফেলে কাঁদতে থাকব। জীবন হচ্ছে একটা অফার, ওয়ান টাইম অফার! পেতেই, সাদরে গ্রহণ করে নিতে হয়। অতঃপর সুন্দর মতো সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে হয়। এই সাজানোতে কোথায় দুঃখ রাখব, কোথায় সুখ রাখব—সবটাই আমাদের ইচ্ছানুসারে। কষ্ট পাওয়া মানে একান্তই আমার সাজানোর ভুল; আর কিছু না। তবুও চলতে হবে। এভাবেই চলতে হবে।
আমার জীবনের সুখ-দুঃখটা গুছিয়ে দিয়েছিল আমার মা। তার চলে যাওয়ার পর, সেই গোছানো জীবনকে নষ্ট হতে দেয়নি আমার বাবা। বাবারা ম্যাজিশিয়ান! তবে আমার বাবা ছিল সুপার ম্যাজেশিয়ান। আমার সব সমস্যা এই এক চুটকিতে বুঝে যেত। আমার গোছানো জীবনটা এলোমেলো হতে লাগল তার যাবার পর। মা-বাবা দুজনেই বড্ড খারাপ। আমার সাথে থাকেনি। কথা ছিল—কখনই একা ছাড়বে না। আর বাবা! সে আমাকে চিরতরে একা করে দিয়ে গেল। যখন গেল, আমি শোক কাটিয়ে উঠতেই নিজেকে খেয়াল করলাম আবদ্ধ দুঃখে। এই দুঃখ সরানোর জো নেই; আমার বাবা নেই যে! ধীরে ধীরে জেনে গেলাম, ‘যার বাবা নেই, তার তিন কূলে কেউ নেই’। সেই সময়টায় প্রার্থনা করতে লাগলাম তোমাকে পাবার। সৃষ্টিকর্তা আমাকে ফেরাননি। খুব শিগগিরই তোমাকে পাইয়ে দিয়েছিল। বিশ্বাস করো, তারপর আমার রংহীন জীবনটা ধীরে ধীরে রঙিন হতে লাগল, তোমায় ছোঁয়ায়। আমি আবারও বেঁচে থাকার একটা সম্বল পেলাম। সেই সম্বলকে পুঁজি করে, স্বপ্ন গড়তে লাগলাম। ছোট্টো একটা সংসার হবে, তুমি-আমি আর আমাদের সোনাই; আমাদের তিনজনের সংসার! যতবার ভাবতাম, ততবার সমস্ত শরীরে অজানা শিহরণ বয়ে যেত। মনে হতো কী জানো? এর চেয়ে সুখের কিছুই নেই।
কিন্তু, আমি যে পোড়া কপালি; সুখ তো মরেছে সেই বাবা মরার সাথেই। আমার আর তিনজনের সংসারটা হলো না। সেই না হওয়াটা আমাকে কেমন যেন রগচটা, জেদি, খিটখিটে মেজাজের বানিয়ে দিয়েছিল। এভাবেই! ঠিক এভাবেই আমরা দু’জন থেকে তিনজন হবার বদলে আমি একা হয়ে গেলাম।
আমার রংহীন জীবনে তুমি না হয়, রঙ নিয়ে এলে। এবার যে গুমোট অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল! আর তো কারো রঙ মিশবে না। জান! আমার সব সুখ আমি তোমার নামে লিখে দিলাম। অর্ষাকে ভালো রেখো। সেদিন তোমাকে আর অর্ষাকে দেখলাম। বেশ দেখতে লাগে তোমাদের একসাথে; চেহারাতেই একদম বাবা-মেয়ে! তোমাদের বন্ডিংটাও দারুণ! অর্ষাকে না, লাল ফ্রকে মানায় খুব। আমার তরফ থেকে ওকে একটা সুন্দর দেখে লাল ফ্রক কিনে দিয়ো।
আর শোনো! তুমি দেখতে দিন দিন এত ইয়াং হচ্ছ কেন? এখনকার বাচ্চা-কাচ্চারা আবার হুটহাট পিছলা খায়। এত ফিট থেকো না। পরে মেয়েরা পিছু পড়লে, তোমার বউ তোমাকে ঝাটাপেটা করবে। ক’দিনের ডিনারটাও বন্ধ করে দিতে পারে। তোমার বউকেও খুব সুন্দর লাগে। সেদিন তিনজনকেই একসাথে দেখেছিলাম। তোমার বউয়ের দিকে তাকাইনি অবশ্য। একবার দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। কেমন যেন লাগে তাকে দেখতে, বুকের ভেতরটা জ্বলে। সব ঠিক থাকলে, তার জায়গায় তো আমার হওয়ার কথা ছিল, তাই-না?
জানো, ইদানিং একটা ছেলে খুব জ্বালাচ্ছে আমায়। কত বোঝানোর চেষ্টা করেছি, বোঝেই না। আচ্ছা বিষাদের কালোতে কি ভালোবাসার রঙ লাগে? লাগে না তো! বাচ্চা ছেলেটা বুঝতেই চাইছে না। কী অবুঝ ও! ওর নাম শুদ্ধ। আমার ডিপার্টমেন্টের একটা স্টুডেন্ট। বয়সে আ-ট বছরের ছোটো! ভাবতে পারছ? কী পাগলামিই না করে! বিগত তিন বছর ধরে নজরে নজরে রাখছে। দেড় বছর হলো, সরাসরি প্রপোজালও দিয়েছে। ওর মতে, আমাকে সুখী দেখতে চায়। তুমিই বলো, সুখ কি সবার জন্য? সবার জন্য না তো। কিছু মানুষের কপালের দুঃখ বই কিছুই থাকে না। আমি সেই ‘কিছু মানুষের’ মধ্যে পড়ি।
ওকে বোঝাতেই পারি না—সমাজ বলেও কিছু একটা আছে। আর তাছাড়া আমি তো কেবল তোমাকে ভালোবাসি, তাই-না? নির্দিষ্ট পুরুষের প্রেমে আকৃষ্ট রমনী কী করে অন্যত্র সুখ খুঁজবে?
সিদ্দিক, ভালো থেকো। আমি জানি, ভালো থাকবে তুমি। আজ না, আমার আর কথা আসছে না। ধীরে ধীরে সব ফুরিয়ে যায়, দেখেছ? তবে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা ফুরোবে না আমৃত্যু, জান।
আচ্ছা! একটা সিক্রেট বলে যাই, হুঁ?
আজও তোমাকে দেখলে মনের সাথে শরীরও ছুটতে থাকে। খুব করে তোমার বুকে মিশে, প্রাণ ভরে তোমার গন্ধ শুষে নিতে ইচ্ছে করে। পার্ফিউম চেঞ্জ করে ফেলো তো, প্লিজ। এজন্যও তোমার বউয়ের প্রতি খুব হিংসে হয় আমার।
আচ্ছা? সে-ও কি আমার মতোই তোমার কোলে বসে, তোমার গলায় গান শোনে? গান শোনাও তুমি তাকে? আচ্ছা, আমার মতোই সে তোমাকে গান গাওয়ার সময় জ্বালায়? গলায়-বুকে উষ্ণ চুমুর সাথে আলতো করে কামড় দিয়ে তোমাকে জ্বালায়? আচ্ছা, তাকেও কি তুমি আমার মতোই ভালোবাসো, সিদ্দিক? আমার মতোই জড়িয়ে ধরো, চুমু খাও?
ইতি
তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন তনু”
চিঠিটা লিখে খামে ভরে নিল। প্রেরকের ঠিকানা দিলো না, প্রাপকের ঠিকানায় সিদ্দিকের অফিস দিলো। সেই খামের ভেতরে তিনটা শুকিয়া যাওয়া বকুল ফুল দিলো। তারপর টেবিলের উপর রেখে, সেখানটায় তাকিয়ে রইল।
খানিকক্ষণ বাদেই তনুজা খামের উপরেই ডান হাত ভাঁজ করে রাখল, সেই হাতের উপর ডান কাৎ করে মাথা ঠেকাল। খোলা দু’চোখের পাতায় ভেসে এলো পুরোনো সময়ের সেই খুনসুটিগুলো, ভালোবাসার মুহূর্তগুলো। কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল, একটা-দুটো করে অসংখ্য জল। আর ওষ্ঠে লেপ্টে গেল এক স্নিগ্ধ হাসি।
______
পরদিন চিঠিটা পোস্ট করে ফেরার সময় রাস্তায় শুদ্ধর সাথে দেখা হলো। তনুজা না দেখার ভান করে কেটে পড়তে চাইল। শুদ্ধ হেসে সেদিকটায় এগিয়ে গেল। গুনগুন করে গান ধরল,
“আজ মন চেয়েছে, আমি হারিয়ে যাব।
হারিয়ে যাব, আমি তোমার সাথে!”
তনুজা পিছু মুড়ল না। বাঁ দিকে শুদ্ধ এগিয়ে এলে তনুজা ডান দিয়ে মাথা ঘুরিয়ে ঠোঁট চেপে হাসল। শুদ্ধর দৃষ্টিগোচর সেই হাসি। শুদ্ধ তনুজার থেকে এক হাত দূরত্ব রেখে বাঁ পাশটায় একটু পিছে পিছে হাঁটতে লাগল।
হাঁটতে হাঁটতে বলল, “ম্যাম, বসন্তের শুভেচ্ছা নিন!”
তনুজা হাসি সম্পূর্ণ চেপে ওর দিকে তাকাল। কণ্ঠে স্বাভাবিকত্ব রেখে বলল, “এটা শরৎ চলছে। বসন্ত বহুদূর!”
শুদ্ধ অধর প্রসারিত করে হেসে বলল, “এই বসন্ত মনের বসন্ত। এখানে বসন্ত আসার জন্য গাছে নতুন পাতা-ফুলের প্রয়োজন নেই; প্রয়োজন কেবল প্রেম।”
“আজ এলো বুঝি?”
“এসেছে অনেক আগে। তবে কমছে না, কিংবা থামছে না; ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। আপনিই বলুন, এমন প্রেমময়ী বসন্তটা কী চমৎকার না?”
তনুজা দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল, “হুম, চমৎকার তো বটেই!”
শুদ্ধ হাসতে হাসতে বুকের বাঁ পাশটায় ডলল। দু’চোখের পাতা শক্ত করে বুঁজে বলে উঠল, “আমার জীবনে আপনার আগমন এমনই এক বসন্তে হয়েছিল। সেই বসন্তে আমি ফল করেছিলাম এক অলকানন্দার উপর। তাকে বসন্তের শুভেচ্ছা। উঁহু! তাকে প্রেমের শুভেচ্ছা!”
তনুজা হেসে বলল, “পড়াশোনায় মন দাও।”
“মন তো আপনাকে দিয়ে রেখেছি।”
তনুজা ঠোঁট চেপে হেসে রিকশা ডেকে উঠে পড়ল। শুদ্ধ ওখানে দাঁড়িয়ে বলল, “ম্যাম, জীবনটা সুন্দর! আরেকটা সুযোগ দিন!”
চলবে?
শব্দসংখ্যা- ১৪০০
[টানা তিন দিন দিলাম। পরের পর্ব সোমবার দিলে চলবে?]