অবন্তর আসক্তি পর্ব ২৯+৩০

#অবন্তর_আসক্তি
#পর্ব_২৯
#sharmin_akter_borsha ( লেখিকা)

কারো কোলাহলের কারণে ঘুম ভেঙে গেলো। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ গষে উঠে বসলাম। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি তার ঠিক নেই। বাড়ির সামনে থেকে আওয়াজ আসছে বিছানা থেকে নেমে সোজা হাঁটা দিয়ে বারান্দায় চলে আসলাম। নিচে তাকিয়ে দেখি আমার যত ছোট বড় ভাই-বোন আছে সবগুলো অভ্র ভাইয়া কে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আর চেচামেচি করছে৷ ভালো ভাবে তাকিয়ে দেখলাম উনার কাছে আইসক্রিমের এক কাটুন। বুঝলাম আইসক্রিম নেওয়ার জন্যই সকলে এমন করছে। আমারও চাই আইসক্রিম কেননা আইসক্রিম তো আমারও ফেভারিট। রুমে চলে আসলাম গায়ে ওড়না জড়িয়ে রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলাম। অভ্র ভাইয়া কাটুন থেকে একটা একটা আইসক্রিম বের করে সকলকে দিচ্ছে। আমিও তার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটিয়ে আহ্লাদী স্বরে বলে উঠি, “ আমারও চাই, আমাকেও দাও। ”

নিমিষেই তার বলা একটা কথা আমার উজ্জ্বল হাসিটা কে মলিন করে দিলো দূর আকাশের ওই কালো মেঘটার মতো। সে বিমর্ষ কন্ঠে বলল, “ আমি বার্তি কোনো মানুষের জন্য আইসক্রিম আনিনি। আমি সবার জন্য হিসাব করে এনেছি। এখান থেকে অন্য কাউকে দেওয়া যাবে না। কারো খেতে ইচ্ছে করলে সে জেনো দোকান থেকে কিনে এনে খায়। ”

বলে সে আমার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। অপমানবোধ হয়েছে কিন্তু তার থেকে বেশি কান্না পাচ্ছে। খুব কষ্ট করে অশ্রু আঁটকে রেখেছি। কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না এই চোখের অবাধ্য অশ্রুকণা গুলো জেনো কোনো বাঁধাই মানতে চাচ্ছে না। উল্টো দিকে ঘুরে দৌঁড় দিলাম। বাড়ির সামনে কে জেনো একটা ইট রেখে দিয়েছে। অন্ধ্যের মতো ছুটছিলাম বলে ইটের সাথে পা লেগে ধুপ করে পরে গেলাম মাটিতে মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বের হয়ে আসল, “ আম্মু গো ”

পেছনের সকলে আমার দিকে বিষ্ময় নিয়ে তাকালো। পেছন থেকে কেউ একজন ‘ বর্ষা ’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠল। পেছনে ঘুরে তাকাতে পারবো না কারণ পেছনে তাকালে সকলে দেখে নিবে আমি যে কাঁদছি তাই আর পেছনে তাকাচ্ছি না। কিন্তুওই কন্ঠস্বর আমার চেনা মানুষের। সে ছুটে এসে হন্তদন্ত হয়ে আমার পাশে এক হাঁটু মাটিতে গেঁড়ে বসল। আমার এক হাত ধরে বিস্মিত স্বরে বলে উঠল, “ কিভাবে পরে গেলি? কোথাও লাগেনি তো? ”
বলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সে স্বস্ত হয়ে গেলো। আমার দুই চোখের কার্নিশ বেয়ে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পরছে।

আমি তার হাত শক্ত করে ধরে মলিনকন্ঠে বললাম, ‘ নিভ প্লিজ আমাকে রুমে নিয়ে চল। আমি উঠে দাঁড়াতে পারছি না। ”

মুখে কোনো কথা বললো না নিভ শুধু উপর নিচ মাথা দুলিয়ে আমাকে পাঁজা কোলে তুলে নিলো। আকস্মিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পেছনের সকলে রাগে দাঁত কটমট করছে পেছনের একজন। আমি নিভের গলা জড়িয়ে ধরি তা দেখে সে একজন একটা আইসক্রিম হাতের মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরল। এতে অবশ্য আইসক্রিম টার তেরো চৌদ্দটা বেজে গেছে। আইসক্রিমের কাটুন পুতুল আপুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে হনহনিয়ে চলে গেলো।

বাম পায়ের হাঁটুর গোড়ালি তে অনেক জ্বলছে হয়তো ওখানে ছিলে টিলে গেছে। নিভ আমাকে কোলে করে নিয়ে আসছে দেখে আম্মু, চাচি ও ফুপিরা সকলে সামনে আসলো। রুম পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় সকলে ঘিরে ধরেছে। সেজন্য নিভ বর্ষাকে হল রুমের সোফার উপর বসিয়ে দেয়। বর্ষার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে এখনও সে দেখেই নানান প্রশ্ন করছে ওর আম্মু। বর্ষা বলে, ও বাড়ির সামনে পরে গেছে। তখন ওর ফুপি চেচিয়ে বলে উঠল, “ দেখো ভাবি ওর তো সাদা সালওয়ার লাল হয়ে গেছে হাঁটুর স্থানে, দেখো দেখো কেটে গেছে বোধ হয়। ”

বর্ষার আম্মু দেখতে চাইলো কিন্তু বর্ষা ইতস্তত বোধ করছে নিভ এখানে উপস্থিত থাকায়। নিভ বুঝতে পেরে সেখান থেকে অন্য দিকে চলে যায়।
বর্ষা সালওয়ার হাঁটুর উপরে উঠালো, অনেকটা জায়গা কেটে গেছে দেখে ভয় পেয়ে যায় বর্ষার আম্মু। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ একটু সাবধানে চলাফেরা করতে পারিস তো সোনা মা। দেখ এখন ব্যাথাটা ও তো তোরই লেগেছে। কষ্ট টাও তুই পাবি। দেখে চলাচল করলে তো আর এমন আঘাত পেতি না মা। ”

বর্ষা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল, “ আমার কিছু হয়নি আম্মু আমি ঠিক আছি। ”

‘ আমার চোখে ফাঁকি দিতে পারবি ভেবেছিস? ভুলে যাচ্ছিস আমি তোর মা। আমি তোকে জন্ম দিয়েছি তুই আমাকে দেসনি। ”

বর্ষার বড় চাচি অর্থাৎ অভ্রর মা ফাস্টএইড বক্স এনে দেয়। মুন্নি ডিপ্লোমা স্টাডি করছে সেজন্য ও নার্সের সবকিছু পারে যাবতীয় একজন নার্সের সব মুন্নি পারে। আরও একবছর পর সে তার পড়া কমপ্লিট করবে তখন সে পরিপূর্ণ একজন নার্স হবে। বর্ষার পায়ে ব্যান্ডেজ মুন্নী নিজে হাতে করে দেয়। এরইমধ্যে সকলে ভেতরে চলে আসে। সাথে বর্ষার বান্ধবী গুলো ও এসেছে সকলে বর্ষার পায়ে ব্যান্ডেজ দেখে উত্তেজিত হয়ে যায়। বর্ষার তাদের কুল হতে বলে। বর্ষার আম্মু সকলের জন্য কিছু স্ন্যাকস বানিয়ে টেবিলের উপর রেখে যায়। এবং বলে যায় সবগুলো সকলকে শেষ করতে হবে। হল রুমের বড় এলইডি টিভি অন করে তাতে টম এ্যন্ড জেরি দেখছে বর্ষা। ওর কার্টুন দেখাতে বাকিরা বিরক্ত হচ্ছে কিন্তু মুরাদ ও ওর মতো খেয়ে যাচ্ছে। ওর খাওয়া দেখে মনে হচ্ছে এই টেবিলের উপর যত খাবার আছে আজ ও সব একাই খাবে। ওর খাওয়া দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘ নয় মাস ধরে কিছুই খায়নি।
ভ্রু কুঁচকে নিভ প্রশ্ন ছুঁড়ল, “ তোর নাকি বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়ে গেছে? ”
বর্ষা কিছু বলতে যাবে তার আগেই টিভির পর্দায় খেয়াল করল অভ্র বাড়ির দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে আর এদিকেই আসছে।
বর্ষা অভ্রকে দেখেও না দেখার ভান করে বলে উঠল, “ তোরা যে কি বলিস না। বিয়ে তো জীবনে একবারই হয়। আনন্দ উল্লাস তো করবোই সাথে নিজের বিয়ের মার্কেট আমি নিজেই করবো। ”

বর্ষার কথা কানে আসতে কিছুক্ষণের জন্যে থেমে যায় অভ্রর পা পরক্ষণে তীক্ষ্ণ মেজাজে এলোপাথাড়ি পা ফেলে সিঁড়ির দিকে চলে গেলো।
অভ্রর যাওয়ার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে সশব্দে হেসে উঠল বর্ষা। বেআক্কেলের মতো বাকিরা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নিভ আশ্চর্য হলেও বর্ষার উত্তরের আশায় তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ মিয়া প্রশ্ন করলো কি? বর্ষা উত্তর দিলো কি? তার উপরে আবার পাগলের মতো হাসছেই বা কেনো?
কারো মাথায়ই ঢুকছে না, বর্ষা হাসি থামিয়ে বলল, “ বিয়ে ঠিক হইছে। হয়ে তো যায় নাই। তাছাড়া হলেও তোরা দাওয়াত পাবি। আমার বিয়ে বলে কথা খালি হাতে একটাও আসবি না। গিফট না নিয়ে আসলে রোস্ট দিবো না। ”

নিভ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল, “ মানে হচ্ছে তুই ওই আদ্রিককে বিয়ে করতে রাজি? ”

বর্ষা কোনো প্রত্যত্তর করলো না সকলের দিকে তাকিয়ে এক দুষ্ট হাসি দিয়ে চোখ টিপ মারল।
________________
রাতে বিছানার উপর পা সোজা করে রেখে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে ছিল বর্ষা। কোলের উপর একটা বালিশ পিঠে হেলান দেওয়ায় ছিল একটা বালিশ৷ কোলের বালিশের উপর একটা বই রেখে মন দিয়ে পড়ছে। এমন সময় দরজার পর্দার আড়াল থেকে একটা ছায়ামূর্তির ছায়া দেখা গেলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে চলে গেলো। বর্ষার পুরো ধ্যান বইয়ের দিকে থাকায় সে খেয়াল করেনি।
বর্ষার পায়ের অবস্থা জানার জন্য এসেছিলো অভ্র কিন্তু ভেতরে না গিয়ে দরজার সামনে থেকেই চলে যায়।

বর্ষার পা পুরোপুরি ঠিক হতে দু’দিন লেগে যায়। এই দুইদিন সম্পূর্ণ বেড রেস্টে ছিলো। বর্ষাও এই দুদিনে বুঝে গেছে সবটাই তার ভুল ধারণা ও যা কিছু অনুভব করতো যার জন্য তার কোনো অনূভুতি নেই ওর প্রতি সে জন্য নিজের বিয়ে টাকে মেনে নিয়েছে শুধু মানতে পারছে না তার জায়গায় আদ্রিককে।

হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠল, বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল বর্ষা। ফোন বাজছে শুনে রুমে চলতি আসল। বিছানার উপর থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল মেসেঞ্জারে কল এসেছে।
ফোন কল রিসিভ করে কানে লাগাতে অপরপাশ থেকে আহিতা চেচিয়ে উঠল, “ কোথায় আছিস তুই? ”

বর্ষা শাণিতকন্ঠে বলল, “ রুমে ”

আহিতা বলল, “ তারাতাড়ি রেডি হয়ে নে। তোকে নিতে নিভ তোর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ”

ফোন কানে লাগিয়েই ছুটে গেলাম বেলকনিতে একটু আগে তো আমি এখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন তো নিভ কে দেখিনি তো এখন কোথা থেকে আসলো নাকি আমি ওকে খেয়াল করিনি আজব। একটা জলজ্যান্ত ছেলে চোখের সামনে থাকতে আমি তাকে দেখিনি। আহিতার কথায় হুঁশশ ফিরল। ফোন রেখে রেডি হতে চলে গেলাম রুমে। কাভার্ড থেকে একটা জলপাই রঙের থ্রিপিস বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। নিভ আমাকে দেখে একটু বিরক্ত হলো। অভিমানী কন্ঠে বলে উঠল, ‘ সেই কখন থেকে তোর জন্য অপেক্ষা করছি এখানে। কতবার হাতের ইশারায় ডেকেছি কিন্তু তুই দেখিসইনি। হয়েছিলো টা কি তোর? ”

আমি ভ্রু কুঞ্চিত করে রাগী গলায় বলে উঠলাম, “ বেশি বাজে না বকে বাইক স্টার্ট দে ”

কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসলাম আমাদের গন্তব্যে, জায়গাটা অচেনা তবে সুন্দর। চারপাশে চোখ বুলাতে লাগলাম। দুইপাশ দিয়ে নানান ফুলের বাগান মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা সামনে একটা বড় বিল্ডিং ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো বাতিগুলো জ্বলছে ও নিভছে। নিভ এর দিকে তাকালে সে চোখের ইশারায় সামনে এগিয়ে যেতে বলে। সামনে যত এগিয়ে যাচ্ছি ততই জেনো জায়গার সৌন্দর্য বিপুল হয়। কিছুদূর সামনে যেতে নজরে পরল একটা গাছের নিচে এক বড় টেবিল ও তার চারপাশে চেয়ার সাজানো। টেবিলের উপরে নানান রকমের ফাস্টফুড ও বাঙালি খাবার রাখা। চোখ পাকিয়ে অন্য দিকে তাকালে নজরে পরল আদ্রিক ও অভ্র ভাইয়াকে দু’জনে একসাথে দাঁড়িয়ে আছে। আর বাকিরা কিছুটা দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে আদ্রিক এগিয়ে আসল। তার এক হাত বাড়িয়ে দিলো আমাকে দিকে, আমি ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে তার সামনে থেকে চলে গেলাম।

আহিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ সবাই একসাথে এখানে কেন? ”

আহিতা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু একে দিলো। তার সীমাহীন খুশি তার চোখে মুখে জ্বলজ্বল করছে। আহিতা আহ্লাদী কন্ঠে বলল, ‘ আমার আম্মু আব্বু আমার আর মুরাদের সম্পর্ক টা মেনে নিয়েছেন। আগামী মাসে সবকিছু ঠিকঠাক করা হবে। মুরাদের বাবা দেশে ফিরলে তারপর দুই পরিবার একসাথে বসে ডেট ফিক্সড করবে। আজ আমি অনেক খুশি সেজন্যই তো আজকে আমার আর মুরাদের তরফ থেকে তোদের সকলকে ট্রিট দিচ্ছি। ”

আহিতার খুশি দেখে আমার কেনো জানি কষ্ট লাগছে। এক নজর তাকিয়ে ছিলাম মানুষটার দিকে সে ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে ফোনে কারো সাথে কথা বলছে।

সকলে একসাথে চেয়ার টেনে বসলাম। আমার ঠিক পাশে বসেছে আদ্রিক প্রচুর রাগ হচ্ছে কিন্তু নিজেকে সামলে বসে আছি। যথাযথ রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছি।
টেবিলের উপর থেকে একগ্লাস জুস নিলাম। তখন পাশ থেকে আদ্রিক বলে উঠল, ” বর্ষা তোমার প্রিয় ফুল কোনটা? ”

আদ্রিকের প্রশ্নে ঘুরে তার দিকে তাকালাম। নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, ‘ আমি নির্দিষ্ট কোনো এক ফুলের নাম বলতে পারবো না। কারণ, আমার কম বেশি সব ফুলই পছন্দ। কেননা প্রত্যেকটা ফুলের নিজের এক মুগ্ধতা থাকে। প্রতিটা ফুলের গুণ অপরিসীম। আমি যখন যে ফুল দেখি তখন আমি সে ফুলের প্রেমে পরি। তার সৌন্দর্যের মোহে ডুবে যাই। একেকটা ফুল একেক রকম কোনোটার সাথেই কোনটার তুলনা চলে না। নির্দিষ্ট একটা ফুলের মায়ায় নিজেকে আবদ্ধ করে রাখলে বাকি ফুলগুলোর মোহন্তা কারো হৃদয় কে স্পর্শ করতে পারবে না। আমি প্রতিটি ফুলে আসক্ত, প্রতিটি ফুল আমার প্রিয়। প্রতিটি ফুলের শুভ্রতা আমাকে মুগ্ধ করে। এক কথায় প্রতিটা ফুলই আমার ফেভারিট! ”

“ আর ফল? ” আকস্মিক প্রশ্ন ছুঁড়ল আদ্রিক।

” সেম ” বলল বর্ষা।

“ কি গাছ প্রিয়? ”

“ গাছও কারো পছন্দ হয় নাকি? ” সামনে থেকে শাণিতকন্ঠে বলল তিন্নি।

তিন্নির পাশ থেকে হুট করে নিভ বলে উঠল, “ লজ্জাবতী গাছ। ”

ভ্রু কুঞ্চিত করে বিমূঢ় কন্ঠে বলল আদ্রিক, “ লজ্জাবতী গাছ-ই পছন্দ কেনো? ”

“ লজ্জাবতী গাছ হচ্ছে একমাত্র গাছ যেটাকে স্পর্শ করার পরক্ষণে লজ্জা পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। আর তার সে লজ্জা আমার কাছে মোহনীয় লাগে। তাই পছন্দ। ”

বলে তৎক্ষনাৎ জুসের গ্লাসে চুমুক দিলাম। গ্লাস টা টেবিলের উপর রেখে আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে কর্কশকন্ঠে বললাম, ‘ আর একটাও প্রশ্ন করবেন না। তাহলে ফল ভালো হবে না। ’

কিন্তু আদ্রিক নাছোরবান্দা উল্টো আরও প্রশ্ন করে বসে, “ কি রং পছন্দ? ”

মাত্রারিতিক্ত রাগ উঠায় টেবিলের উপরের জুসের গ্লাস টা নিয়ে তার মাথার উপর ঢেলে দিয়ে রাগী গলায় বলে উঠলাম, ‘ বলে ছিলাম তো ফল ভালো হবে না। ’

বলে তার পাশ থেকে উঠে চলে গেলাম।

স্তব্ধ প্রায় সকলের দৃষ্টি বর্ষার উপর স্থির। মনে মনে প্রচুর হাসছে অভ্র ও বিড়বিড় করে বলে উঠল, “ এই পানি এখন আর আমার উপর নির্দিষ্ট নয়। অন্য এক জনের উপরেও পরেছে ইয়াহ আল্লাহ কি যে খুশি লাগছে। ”

সন্ধ্যা গনিয়ে আসছে বাড়ি ফিরতে হবে। আদ্রিকের ঘন্টাখানিক আগে ইমার্জেন্সি কল এসেছিল সে তখনই চলেগেছে। এত সুন্দর জায়গা ও বাঁধিয়ে রাখার মতো মূহুর্ত। সব কিছু হয়েছে আহিতার জন্য ওকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানালাম। আমার ভাইবোন কত গুলো বাইক দিয়ে চলে গেছে। তাদের বাইকের পেছনে কয়েকজন বোন ও চলে গেছে। যারা বাকি ছিল তারা অভ্র ভাইয়ার গাড়িতে উঠে বসে আছে। আহিতা ও মুরাদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। তখন হঠাৎ অভ্র ভাইয়া সামনে এসে পরল। আমি হঠাৎ তাকে সামনে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম। নীরবতা বেধ করে তিনিই আগে বললেন, “ গাড়িতে সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে চল। ”

আমি তার কথা শুনেও না শোনার মতো করে পাশ কেটে চলে যাচ্ছিলাম। তখন তিনি আমাকে পিছু ডেকে বললেন, “ বর্ষা শোন। ”

আমি পেছনে ঘুরে তাকালাম শুধু। তখন সে তার একহাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ এটা তোর জন্য। ”

আমি উনার হাতের উপর লক্ষ্য করে করে মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম। ঠোঁটের কোণে মৃদু হেসে মলিনকন্ঠে বললাম, “ প্রয়োজন নেই আর আইসক্রিম খাওয়া সেদিনই ছেড়ে দিয়েছি। তাছাড়া আমি যার সাথে এসেছি তার সাথেই ফিরবো। বলার জন্য ধন্যবাদ। ”

বলে চলে আসলাম তার সামনে থেকে হেঁটে কিছুদূর সামনে গেলেই নিভকে দেখতে পাই বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে ও বাইকে উঠে বসল। আর আমিও পেছনে উঠে বসলাম দূর থেকে সে আমাদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। ভুলিনি আমি সেদিন আইসক্রিম চেয়েছিলাম উল্টো সে আমাকে সকলের সামনে অপমান করেছিল। ছুটতে গেলে পরে পায়ে ব্যাথা পেয়ে দুদিন বিছানায় শুয়ে ছিলাম অথচ একবারও দেখতে যায়নি। আর আজ আইসক্রিম সাধছে ভাবলেই তাচ্ছিল্যের হাসি চলে আসছে।

চলবে?#অবন্তর_আসক্তি
#পর্ব_৩০
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_______
“তুই কি সত্যিই মেনে নিয়েছিস বিয়ে টা? তুই না বলেছিলি ”
সামনে থেকে জিজ্ঞেস করল রিয়া। তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রতিত্তোরে মৃদু হেসে বর্ষা বলল,“ হুম! কেউ একজন মেনে নিয়েছে। সে এসে সামনে থেকে না করলে আমি বিয়ে ভেঙে দিতাম। কিন্তু সে তার মতো আগায়নি তাই আমিও পিছাতে পারবো না। যা হচ্ছে হতে দে। ”
বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল বর্ষা। পাশ থেকে রাগি গলায় বৃষ্টি বলল,“ হতে দেবো মানে কি? আগামীকাল তোর গায়ে হলুদ। আর আমরা তোর মনের কথা জেনেও চুপ থাকবো? ”

“ হ্যাঁ থাকবি। কেননা থাকতে হবে আমাকে এই নিয়ে আর কেউ কোনো প্রশ্ন করবি না। যা তোরা আমার এখন ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাব ”
রাত এগারোটা বাজে রিয়া, রিমা, বৃষ্টি এতক্ষণ বর্ষার রুমেই ছিলো বোঝাচ্ছিলো ওকে। বিয়েটা ভেঙে দিতে এখনো সময় আছে কিন্তু বর্ষার কোনো হেলদোল নেই। তিনজনে মাথা নিচু করে রুম থেকে চলে যায়। ধপ করে বিছানার উপর বসে বর্ষা। চোখ কার্নিশ অশ্রুসিক্ত হচ্ছে বার বার। খুব ইচ্ছে করছে ওর এখন দৌঁড়ে মানুষটার কাছে যেতে তাকে জড়িয়ে ধরে বলতে, “ ভালোবাসি। ”

বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে পরল বর্ষা। এখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে সে। বার বার শুধু মানুষটার কথাই মনে পরছে। মানুষটার দুষ্টামি, ফাজলামি, ওকে বিরক্ত করা, জ্বালানো সব কিছু মিস করছে সে।

ঝাপসা চোখে আবছা আবছা দেখছে, একটা বড় কাঠের বেঞ্চের উপরে একটা মেয়ে বসে আছে। তার ঠিক বা পাশেই একটা ছেলে বসে আছে। সামনে একটা চেয়ারে একজন লোক পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। তাকে ঘিরে চারপাশে অনেকজন লোক লাঠি ভড় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা ছেলেটার হাত খুব শক্ত করে ধরে বসে আছে। সামনে বসে থাকা লোকটার সাথে ছেলেটার বেশ কথা কাটাকাটি হচ্ছে। এমন সময় লোকটা তার পেছন থেকে দু’জন লোককে হাতের সাহায্যে ইশারা করল। দু’জন লোক সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলো। খোপ করে মেয়েটার হাত ধরে টান দিলো। ছেলেটা বাঁধা দিতে নিলে অন্য পাশ থেকে আরেকজন লাঠি হাতে লোক ছেলেটার দিকে তেড়ে আসল। লোকটা তার হাতের লাঠি মাথার উপরে তুলে ছেলেটার মাথায় মারতে নেয়।

“ নাহহহ ” বলে চিৎকার দিয়ে উঠে বসে বর্ষা। বিছানার চাদর দুই হাত দিয়ে মুঠ করে বসে আছে৷ কপাল বেয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জড়ছে। সামনের দিকে দৃষ্টি সংযত রেখে ভারী ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে বর্ষা। দরজা চাপানো থাকে আপদ বিপদের কথা বলা যায় না। রুমে একা ঘুমালে দরজা ভেতর থেকে লাগানো নিষিদ্ধ করেছেন মনোয়ারা বেগম। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল বর্ষার মা ও কিছু আত্মীয় স্বজন ও তার বোনেরা। বর্ষাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলেন বর্ষার মা। দোয়া পড়ে বুকে ফু দিয়ে বললেন, “ কি হয়েছে সোনা মা? ভয় পাইছিস? ”

বর্ষা স্তব্ধ বসে বসে কাঁপছে। টেবিলের উপর থেকে এক গ্লাস পানি বাড়িয়ে দিলো বর্ষার দিকে সে এক ঢোকে পানি টুকু পান করল। নিজেকে সামলে নিলো পরক্ষণে সকলের উদ্দেশ্য বলল, “ একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। রাতে ভূতের এফএম রেডিও শুনে ঘুমিয়েছিলাম তো সেজন্য ওইগুলো স্বপ্নে দেখেই ভয় পেয়ে যাই। ”

কথা বলার সময় বর্ষা তোতলাচ্ছিল সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বৃষ্টি ও রিয়া। সকলে বর্ষার কথা মেনে নিয়ে চলে যায়। যাওয়ার আগে বর্ষার আম্মু বলেন, “ এইসব দেখা বন্ধ কর মা। ”

উনারা চলে যেতে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো রিমা। তিনজনে বর্ষাকে ঘেরাও করে বসে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রিয়া তোড় সইতে না পেরে বলেই উঠল, “ স্বপ্নে কিছু একটা দেখেছিস কনফার্ম। কিন্তু চাচি আম্মুকে যা বলছিস সেটা তুই মিথ্যা বলছিস। তোর তখন কথা বলার স্টাইলে আমরা বুঝেছি এখন সত্যি করে বল কি দেখেছিস। ”

বর্ষা ইতস্তত হয়ে স্বপ্নের কথা ওদের জানালো। ওরা অবাক না হয়ে পারল না, কারো চেহারা দেখেনি। শুধু মানুষের শরীরের ঘটন পর্যবেক্ষণ করেছে আর তাতেই সে এমন ভয় পেয়েছে না জানি চেহারা দেখলে কি হতো? রিয়া, রিমা, বৃষ্টি মনে মনে ভাবছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বর্ষাকে নিয়ে রুম থেকে বের হলো ওরা। রুম থেকে বের হতেই অভ্র হঠাৎ বর্ষার সামনে চলে আসল। বর্ষা মনে মনে ভেবে নেয়, হয়তো এখন কিছু একটা বলবে। কিন্তু বর্ষাকে ভুল প্রমাণিত করে অভ্র চলে যায়।

বাড়িতে আজ সকলে খুব ব্যস্ত প্রত্যেকে তাদের নিজের কাজ বুঝে নিয়েছে আর সে অনুযায়ী কাজ করছে। রুমের মধ্যে একা বসে শুধু স্বপ্নের কথাই চিন্তা করে চলছে বর্ষা। কারা ছিলো তার স্বপ্নে স্পষ্ট না দেখা ছেলে মেয়ে দু’জন?
রুমে তখন প্রবেশ করল বর্ষার বাবা। মেয়ের পাশে বসে মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন কোনো কিছু বলেননি। হয়তো বলতে চেয়েছিলেন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারেনি। ঘন্টাখানেক পর তিন্নি আসে সাথে দু’জন মহিলা। তাদের দেখে অচেনা লাগছে বর্ষার কাছে। ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন ছুঁড়ে, “ উনারা কারা আপু? ”

তিন্নি বর্ষার পাশে বসে বলল, “ তোর মেক-আপ আর্টিস্ট অ্যান্ড তারা তোকে হলুদের জন্য তৈরি করতে আসছে। সময় খুব কম আপনারা তারাতাড়ি করুন। ”
বলে তিন্নি চলে যায়। হলুদের জন্য সকলে হলুদ শাড়ি পরে কিন্তু বর্ষা শাড়ি পরবে না বলেছিল তাই ওর জন্য হলুদ রঙের সারারা কিনে আনা হয়েছে। সারারা অবশ্য অভ্র নিজে চয়েস করে নিয়ে আসছে। সারারার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “ সত্যিই কি? না চাইতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়েটা হয়ে যাচ্ছে? ”

হলুদের জন্য খুব একটা গরজিয়াছ লুকে সাজানো হয়নি। বর্ষাই বলেছিল সিমসাম সাজানোর কথা সে অনুযায়ী তারা সাজিয়ে চলে গেছেন। বিছানার উপর বসে আছে পুরো রুমে বর্ষার ছোট বড় ভাইবোন তাকে ঘেরাও করে বসে আছে। অনেকে অনেক কথা বলছে। নির্বাক বসে রয়েছে বর্ষা না আছে কোনো উল্লাস না আছে মুখে হাসি। সে জেনো অন্য দুনিয়ার বসবাসকারী। বর্ষাকে এভাবে বসে থাকতে দেখতে মোটেও ভালো লাগছে রিয়া, রিমা ও বৃষ্টির। ওরাই বা কি করবে ওদের তো করার মতো কিছুই নেই। পাশ থেকে মলিনকন্ঠে রিয়া বলল, “ আমি একটু আগে অভ্র ভাইয়া কে দেখে আসছি উনার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। মুখটা গম্ভীর, চোখ দুটো লাল হয়ে রক্তবর্ণ হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো কালো দাগ পরেছে। চুলগুলো অগোছালো হয়ে আছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে রুমের দিকে চলে যায়। আমি কতবার ডেকেছি কিন্তু সাড়া দিলো না। নিজের মতো চলে গেলো। ”

“ আমরা এখন কি করতে পারি? সব কিছুই তো হাতের বাহিরে চলে গেছে রাত পোহালে বিয়ে। ” বৃষ্টি করুণ দৃষ্টিতে বর্ষার দিকে তাকিয়ে বলল।

“ সব কিছু হাতের বাহিরে চলে গেছে। ” বলল রিমা।

ছেলের বাড়ি থেকে লোকজন আসলে বর্ষাকে নিয়ে স্টেজে বসানো হয়। বাড়ির ছাঁদে স্টেজ সাজানো হয়েছে। খুবই সুন্দর করে শুধু ফুল দিয়ে। ক্যামেরা ম্যান ভিডিও করছে। বর্ষার পাশে একজন একজন করে গিয়ে বসছে গালে কপালে গাধা ফুল দিয়ে হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে চলে আসছে। কেউ কেউ আবার সামনে বড় মাঝারি সাইজের টেবিলের উপর থেকে ফলমূল দিয়ে সাজানো সামগ্রী একটু একটু খাইয়ে দিচ্ছে। অনেকে বর্ষার সাথে বসে সেলফিও তুলছে। বর্ষার দু-চোখ এদিক সেদিক ছুঁই ছুঁই করছে। এত মানুষের ভিড়ে কোনো একজনকে খুঁজে চলেছে সে চক্ষুজোড়া। কিন্তু সে মানুষটার হদিস নেই।

চলবে?

)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here