“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“বিয়ে করতে।”
আচমকাই আরশি তার মামাতো ভাই রিদের মুখে এমন কথা শুনে ক্ষনিকটা চমকে গেল। তাও উত্তরটা কি সোজাসাপটা। দুষ্টুমি বা মজা এমন কিছুই মনে হচ্ছে না। কিছুটা চমকে পূনরায় বলে,
“কোথায় যাচ্ছি!”
রিদ এবার তার দিকে বরাবর চেয়ে বলে,
“একবার বললাম না, বিয়ে করতে।”
মুহুর্তেই বিষম উঠে গেল আরশির। স্বাভাবিক ভাবে রিদ একটা পানির বোতল এগিয়ে দিল তার দিকে। কিছু না ভেবেই বোতলের অর্ধেক পানি শেষ করে নিল সে। আচমকাই যেন বুকটায় ধুকপুক শুরু হয়ে গেলো। শিউর হয়ে নিতে আবারও প্রশ্ন করে,
“সত্যি বলছেন নাকি মজা করছেন?”
রিদ হটাৎই গাড়ির ব্রেক চেপে বলে,
“এতো কিছুর পরও এখন তোর কাছে মনে হচ্ছে আমি এমন একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে মজা করছি?”
এবার অনেকটাই চুপসে গেল আরশি। ভয়ার্ত গলায় বলে,
“হটাৎ এমন ডিসিশন নিলেন কেন?”
“এতে তোর কোনো আপত্তি আছে?”
“না, তবে ভয় হচ্ছে আমার। আমাদের এই সিদ্ধান্তের জন্য যদি এবার খারাপ কিছু হয়ে যায়?”
“এতো ভিতু হলে হলে এখনই নেমে যা গাড়ি থেকে। আমি তোকে জোর করবো না। তবে এই মুহুর্তে সরে গেলে সারা জীবনের জন্য হারাতে হবে আমাকে। পারবি?”
আরশি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল গাড়িতে। নরম স্বরে বলে,
“আজ এমন কঠোর ভাষায় কথা বলছেন কেন?”
রিদ চোখ বুজে ক্ষনিকটা নিশ্চুপ থেকে বলে,
“আচ্ছা স্যরি। এতো কিছুর পর নিজেকে কিভাবে স্বাভাবিক রাখবো বল?”
আরশি আবারও চুপ করে রইল। রিদ স্বাভাবিক ভাবে বলে,
“নিজেই বলেছিলি কোনো পরিস্থিতিতেই যেন তোর হাতটা না ছাড়ি। সারা জীবন একসাথে কাটিয়ে দিব। তাহলে এখন ভয় পাচ্ছিস কেন? এখনই ডিসিশন নে, বিয়ে করবি আমায়?”
আরশি কিছুক্ষণ চুপ থেকে উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। কিছুটা মৃদু হাসলো রিদ। পূনরায় গাড়ি স্টার্ড দিয়ে চললো কাজি অফিসের দিকে।
সানভি ও ফয়সাল আগে থেকেই সেখানে সামনে অপেক্ষা করছিল। গাড়ি সেখানে পৌছাতেই সানভি সামনে এগিয়ে এসে বলে,
“এতোক্ষণ লাগে তোদের আসতে? তোর জায়গায় আমার বিয়ে হলে আমি তোর থেকে এক ঘন্টা আগে বৌ নিয়ে এখানে উপস্থিত থাকতাম।”
রিদ কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,
“কাজের সময় ফালতু বকিস না। সব রেডি করে রেখেছিস?”
“হুম সবই রেডি আছে স্যার। এখন শুধু দুজন যাবেন আর আজিবনের জন্য গিট্টু বেধে বের হয়ে আসবেন।”
পাশ থেকে ফয়সাল ফোন টিপতে টিপতে তাদের দিকে চেয়ে বলে,
“ভাবিকে যেভাবে বিষণ্ন দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে আজ বিয়ে না, অন্য কারো হাতে তুলে দিচ্ছিস তাকে। আহারে আমার ভাবিটা। নিশ্চই বকে-ঝকে পুরা রাস্তা নিয়ে এসেছিস।”
আরশির এক হাত শক্ত করে চেপে রিদ তাদের দিকে চেয়ে বলে,
“তোরা এখানে বকবক করবি নাকি ভেতরে যাবি?”
সানভি হেসে বলে,
“তোর দেখি বিয়ে করার জন্য আর ধৈর্যই কুলাচ্ছে না।”
পাশ থেকে ফয়সাল বলে,
“বাদ দে ভাই আজকে ছেড়ে দে। আজ ওর বিয়ের দিন।”
কিছুক্ষণের মাঝে বিয়েটা সম্পন্ন হলো তাদের। মুহুর্তেই জীবনটা পাল্টে গেল তাদের। যেন নতুন একটা জীবন। সব কিছু পরিপূর্ণ মনে হলে ভয়টা ক্রমশ বেড়েই চলছে আরশির। সাইন করার সময় হাতের কাঁপা-কাঁপি দেখে সানভিও হেসে উঠেছিল।
রিদ হাত ধরতেই পুনরায় হুশ ফিরে আসে তার। দুজন গাড়ির দিকে হেটে যাচ্ছিল। হাটছে আর এক দৃষ্টিতে রিদের দিকে চেয়ে আছে সে। এই মানুষটা এখন তার স্বামী। ভাবতে ভাবতে পেছনের সিটে গিয়ে বসলো দুজন। সানভি ড্রাইবিং সিটে আর ফায়সাল এখনো গার্লফ্রেন্ড এর সাথে চ্যাটিং করতে ব্যাস্ত।
একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে গাড়ি থামলো। তাদের সাথে চুপচাপ ভেতরে গেল আরশিও। ভয় তাকে এতটাই গ্রাস করে নিচ্ছে, কোনো কিছুই সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে না। কেকে নাম লেখা সব, কিছু আগে থেকেই রেডি করে রাখা হয়েছে। গোপনিয়তা বজায় রেখে ছোটখাটো একটা সেলিব্রেশনে নতুন জীবন শুরু করবে বলে।
আরশি’র মনটা এখনো বিষণ্ন। চোখ দিয়ে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। রিদ এক হাতে আলতো করে তা মুছে দিয়ে অন্য হাতে এক পিস কেক তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“বিষণ্নতায় নয়, হাসি মুখেই আমাদের নতুন জীবন শুরু হোক। আর এই হাসি আজীবনের জন্য তোমায় বরণ করে নিক।”
খাওয়া দাওয়া শেষে শুভ কামনা জানিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল সানভি ও ফায়সাল। প্রায় সন্ধা হয়ে এলো। গাড়ি নিয়ে একটা নির্জন জায়গায় গিয়ে থামে রিদ। আরশি পাশেই নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। নিরবতা ভেঙে রিদ বলে,
“এভাবেই নিশ্চুপ হয়েই থাকবি?”
আরশি তার দিকে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল। শান্ত গলায় বলে,
“সবার অমত থাকার স্বত্বেও আমরা এমনটা কেন করেছি?”
রিদ সোজাসুজি ভাবেই বলে,
“তো কি করতাম? তোকে অন্য কারো হাতে তুলে দিয়ে ফুল ছিটাতাম? আমার মানুষটা অন্য কারো ঘরে বৌ হয়ে যাবে তা সহ্য করতাম?”
“তবুও আমাদের সুখের জন্য তাদের মনে কষ্ট দেওয়া কি ঠিক হয়েছে? আমি আদৌ বুঝতে পারছি না আমাদের সম্পর্কটা দুই পরিবার কখনো মেনে নিবে কি না।”
আরশির হাত শক্ত করে মুঠো করে নিল রিদ। অন্য হাত গালে আলতো করে বুলিয়ে বলে,
“না আমি তোকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারবো, আর না ফ্যামিলিকে ছারা থাকতে পারবো। আমার দুটোই চাই। বিশ্বাস রাখ, এক সময় সবই ঠিক হয়ে যাবে। হোক না একটু ঝামেলা, বয়ে যাক না একটা ঝড়, বিনিময়ে এক সাথে তো থাকতে পারবো। এটা কি যথেষ্ট নয়?”
আরশি নিশ্চুপ হয়ে বাইরের দিকে তাকালো। মনটা খুবই বিষণ্ন হয়ে আছে। রিদ কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেল। আরশি পূনরায় রিদের দিকে চেয়ে বলে,
“বাসায় যাব আমি। বাসায় কাউকে বলে আসিনি। রাত হয়ে গেলে বাসায় ঝামেলা শুরু হয়ে যাবে।”
বিপরীতে কিছু বললো না রিদ। আরো কিছুক্ষণ দুজন একসাথে থাকতে ইচ্ছে হলেও তা প্রকাশ করলো না। চুপচাপ গাড়ি স্টার্ট দিল সে। পুরো পথ বাইরের দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে ছিল আরশি। একটু পর পরই যেন বুকটা কেঁপে উঠছে তার। বাবার ভয়ে। সে কখনোই এই বিয়ে মেনে নিবে না।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই আরশি বলে উঠে,
“এবার গাড়ি থামান। আর সামনে গেলেই সবাই আপনাকে দেখে ফেলবে।”
নিজেকে নিয়ে চিন্তিত নয় রিদ। তবে সে চাইছে না এই বিষয়টা আরশির উপর এখনই কোনো সমস্যা সৃষ্টি করুক। রাস্তার এক পাশে গাড়ি থামিয়ে আরশির দিকে তাকালো। ভয়ের সাথে কিছুটা লজ্জায় চোখ সরিয়ে নেয় আরশি। শান্ত ভাবে রিদ তার হাতে হাত রেখে মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,
“শুনো, আজ এই বিষণ্নতা তোমায় একদমই মানাচ্ছে না। শুধু আমার হয়ে থেকে যাবে চিরকাল। যত্ন করে আগলে রাখার দায়িত্বটা আমার।”
রিদের হুটহাট তুমি স্বম্মোধন টা অন্য রকম একটা পরিস্থিতিতে ফেলে দেয় তাকে। কেমন পরিস্থিতি তা জানা নেই তার। তবে অবাক হওয়া, ভালো লাগা, লজ্জা সব মিলিয়ে টক-ঝাল-মিষ্টির মতো এই অনুভূতি।
বাসার দিকে হাটার পথে কয়েক বার পেছন ফিরলো আরশি। রিদ এখনো একই ভাবে দাড়িয়ে আছে গাড়ি নিয়ে। বাসায় পৌছানো অব্দি এভাবেই দাড়িয়ে থাকবে এটা তার অজানা নয়।
বাসায় পৌছে দেখে বাবা সোফায় বসে আছে। বুকটা ধুক করে উঠলো তার। এই সময়ে বাবা বাইরে থাকার কথা। তাই ভয়টা খুব গাঢ় ভাবে গ্রাস করে নিল মুহুর্তেই। বাবার সামনে মিথ্যা বলার সাহস নেই তার। আর সত্যটা জানলেও অনেক বড়ো ঝড় শুরু হয়ে যাবে আজ। যা হয়তো জন্মের পর কখনো দেখেনি সে।
এর মাঝেই বাবা কর্কশ গলায় প্রশ্ন করে,
“কোথায় গিয়েছিলি?”
ভয়ে চুপ কারে আছে আরশি। কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছেনা সে। হুটহাট কথা বানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাটাও হয়তো কম তার। বাবা এবার আরো তেজস্ক গলায় বলে,
“রিদের সাথে এখনো কোনো যোগাযোগ আছে তোর? তার সাথেই কি দেখা করতে গিয়েছিলি?”
আরশি নিচের দিকে চেয়ে থাকা অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবে বলে,
“আরিশা আপুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।”
জীবনে এই প্রথম বাবার সামনে দাড়িয়ে মিথ্যা বলার দুঃসাহস দেখিয়েছে সে। বাবার রাগ মনে হচ্ছে মুহুর্তেই কমে গেল। আর কিছু না বলে ফোনটা হাতে নিয়ে তার সামনেই আরিশার নাম্বারে ফোন দিল বাবা।
ভয়ে এবার যেন হার্ট বেড়িয়ে আসবে তার। আরিশা আপু তো এই বিষয়ে কিছু জানেনা। তাকে ফোন দেওয়ার পর বাবা নিশ্চই বুঝে যাবে সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকা হচ্ছে আজ। যা কেউ বাবার সামনে দাড়িয়ে করার সাহস পায়নি। সব যেন এলোমেলো মনে হচ্ছে তার। তার ভয়টা কি সত্যি হয়ে যাবে? দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় নিশ্চুপ হয়ে চোখ দুটু বুজে নিল সে।
To be continue…………
#অবাধ্য_প্রেমের_গল্প (পর্ব ১)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
~ আসসালামু আলাইকুম। অনেকদিন পর আবার লেখালেখির জগতে আশা। আশা করি পূর্বের মতোই সকলকে পাশে পাবো। ভালোবাসা অবিরাম সকলের প্রতি।