অবুঝ বেলার তুমি পর্ব ৯

#অবুঝ বেলার তুমি
পর্ব ৯
নিলান্তিকা ইসলাম

বাড়িতে পৌছাতেই আর একটুর জন্য সৌমিক সেনের নজরে পড়তে পড়তে বাঁচলো দুজন।গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসতেই সৌমিক সেন কড়া গলায় বলে দিলেন,
_____আজ থেকে বিয়ের দিন অবদি দুই ভাইয়ের বাড়ি থেকে বেরোনো নিষেধ।দুজনে মুখে খাওয়ার পুরতে গিয়ে একে অপরের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে রইলো।
বিহান বললো,
____বাবা বিয়েতো ওর পালানোর ভয় ও দা ভাইয়ের তাহলে আমাকে কেনো বন্ধি থাকতে হবে?
____সেটা আরেকটু আগে ভেবে দেখলেই পারতে।আমি ও তখন সেটাই বুঝাতে চেয়েছিলাম।বিয়েতো অঙ্কুরের তাহলে তুমি কেনো ও বাড়িতে যেতে নিষেধ করেছিলে?একে অপরকে তখন সাপোর্ট করেছিলে তবে এখন কেনো নয়?আফটার অল রাম লক্ষণ কি জোড়ি!

বিহানের মুখটা চুপসে এতখানি হয়ে গেলো।সে অঙ্কুরকে বললো,
____দিস ইজ নট ফেয়ার দা ভাই!একেতো তোমার কারণে আমাকে তুলতুলদির সেই বিভীষিকাময় কিক টা খেতে হয়েছে তার বেলায় পেলাম কি! কাতরানো ব্যাথা আর তোমার অবহেলা।আর এখন তুমি ঠিক তোমার তুলতুল কে পেতে যাচ্ছো আর আমি পাচ্ছি কি বাবার কারাবাস!

অঙ্কুর বিহানের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো,আর বললো,
____বাহ রে অমনি তুলতুল আমার হয়ে গেলো কেনো তুই বুঝি খুজিস নি!সেদিন যে দৌড়ানি খেতে খেতে বাচলি সেটা ও কি আমার জন্য! আমি না পেলে তুই বুঝি খুজতিস না!
বিহান আর কিছু না বলে ঘোমড়া মুখে উপরে চলে গেলো।

পরদিন ই তত্ত্ব নিয়ে বিহানকে ও বাড়িতে পাঠানো হলো।গুঞ্জন বিহানকে দেখেই অবাক হলো।বিহান!ও এ বাড়িতে কি করছে।সেদিন ও রেস্টুরেন্টে বিহানকে দেখলো।আর আজও তত্ত্ব নিয়ে বিহান ই এলো তবে কি তার শ্বশুর বাড়ির লোকদের সাথে বিহানদের কোন ও কানেকশান আছে?
গুঞ্জন বিহানের সাথে কথা বলার প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে সেই কখন থেকে কিন্তু তার বাবার জন্য পারছেই না।কড়া নজর রেখেছেন অভিক রায় যাতে গুঞ্জন কোন ও গন্ডগোল না পাকাতে পারে।

গুঞ্জন মনে মনে ফন্দি আঁটতে লাগলো কিভাবে সে একবার বিহানের সাথে কথা বলবে। গুঞ্জন পানি খাওয়ার বাহানায় আস্তে আস্তে ডাইনিং এর কাছাকাছি গেলো।বিহানরা সেখানেই গায়ে হলুদ আর বিয়ের সব জিনিস রাখছিলো।লোকগুলো সব জিনিস ঠিকভাবে এনে রাখছে কিনা সেগুলো খেয়াল করছে বিহান।অন্তত এ বাড়িতে আসার বাহানায় হলেও বন্ধিজীবন থেকে মুক্তি পেলো।

গুঞ্জনকে দেখেই বিহান বুঝে ফেললো সে কিছু বলতে চায়।কেমন অস্থির অস্থির লাগছিলো।বারবার ওড়না দিয়ে মুখ আর গলা মুছতে লাগলো।আর এতো মানুষের ভিড়ে তার মার খাওয়ার ও কোন ও সম্ভাবনা নেই।তাই নিজেই এগিয়ে গিয়ে বললো,
____আসলে স্যরি আপু। আমি আপনাকে আমার খুব কাছের একটা দি ভেবে ওইদিন পিছু নিয়েছিলাম।আমি খুবই দুঃখিত তার জন্য প্লীজ আমাকে আর তাড়া করবেন না।আমার খুব ভয় হয় এখন আপনাকে দেখলে।
গুঞ্জন মুখে এক চিলতে ফিকে হাসি ধরে রেখেছে।কারণ উপর থেকে অভিক রায় সব খেয়াল করছেন।তাই যা জিজ্ঞেস করবার গুঞ্জনকে তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করতে হবে বেশী সময় নেয়া যাবে না।কিন্তু গুঞ্জনের খুব ইচ্ছে করছিলো বকে দিক গুঞ্জন তার সেই দি। তার তুলতুল দি। কিন্তু বাবার জন্য আর হলো না।গুঞ্জন বললো,
___ইটস ওকে।আমার ও সেদিন ভুল হয়ে গিয়েছিলো বুঝোই তো রাস্তায় বাজে স্বভাবের ছেলেদের অভাব পড়ে না।তাই নিজের প্রটেকশন নিজেকেই নিতে হয়।আচ্ছা!তোমরা কয় ভাই বোন?
___দুই ভাই।দা ভাই আর আমি।
____এই বিয়েটার সাথে তোমাদের কানেকশান কি!মানে আত্মীয়তা।
____আমার দা ভাই।মানে অঙ্কুর দা আর কি।বিয়ের বর।আর আমরা পাত্রপক্ষ।
____গুঞ্জনের মনে কিছুটা হলেও আশার আলো জাগলো।তাহলে সে ঠিক ছিলো অঙ্কুর স্যার ই তার বাবুন দা।ওহ গড এতো কাছে থেকেও সে এতোদিন চিনতে পারেনি।মনে মনে তার কি যে খুশি লাগছে তা এ মুহুর্তে বলে বোঝানোর মতো না।কিন্তু সেটা প্রকাশ ও করতে পারছে না।কারণ অভিক রায়!খেয়াল করছেন সব।তাই আপাতত স্বাভাবিক থাকতে হবে।গুঞ্জনের অশ্রুময় ঝাপসা চোখের সাথে মুখের হাসিটা আরো চওড়া হতে লাগলো।ঠোঁট কামড়ে ধরে সুখের কান্না টাকে চেপে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

___কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
তবে কি বিয়েটা আজ তোমার দা ভাইয়ের?মনে মনে খুশিতে ফেটে পড়ছে গুঞ্জন।
এরপর যে কথাটা বিহান বলল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না গুঞ্জন।
____না আমার দা ভাইয়ের তো দুটো টুইন বেবি ও আছে।অঙ্কুর দা তো আমার কাকাতো ভাই।মানে আমার কাকাই আর কাকিমার ছেলে।
মুহুর্তেই গুঞ্জনের হাসি মাখা মুখে মেঘ নেমে আধার ঘনিয়ে এলো।এখনো অভিক রায় তাদের উপর নজর রাখছে।চাইতে ও গুঞ্জন কাঁদতে পারছে না আর নাইবা পারছে কান্না টাকে আটকে রাখতে।

গুঞ্জন ধীরে ধীরে পা ফেলে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলো।ঠিক যতক্ষন না অভিক রায়ের নজরের বাইরে যেতে পেরেছে।এরপর এক দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেললো গুঞ্জন।তার এই মুহুর্তে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।তার বাবুন দা বিয়ে করে ফেলেছে!আবার বাচ্ছা ও আছে!কি করে পারলে তুমি বাবুন দা!কি করে?

আর আমি যে এতকাল তোমার অপেক্ষা করে গেছি!পাগল পাগল লাগছে গুঞ্জনের। আর এখন কি না তাকে তার ভাইয়ের বউ হয়ে থাকতে হবে।আর তারা যদি একই ফ্যামিলির মেম্বার হয় তবে? কি করে সে বাবুন দার সামনে অন্যের স্ত্রী হয়ে থাকবে।কি করে অন্যের নামে মাথায় সিঁদুর দিয়ে বাবুন দার সামনে হাটবে।ঠাকুর এর আগে আমার মরণ হলেও না কেনো!সবাই বলে মৃত্যু চাওয়া নাকি পাপ।যেটা গুঞ্জন নিজে ও মানতো।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কম কষ্টে মানুষ নিজের মৃত্যু কামনা করে না।এ কষ্ট সহ্য করার চেয়ে যে মৃত্যুই শ্রেয় মনে হচ্ছে তার।

কি করে অন্য কোন ও মেয়ের সিঁথিতে বাবুন দার নামে সিঁদুর দিতে দেখে নিজেকে সামলে রাখিবে সে!মুখে কাপড় গুজে দিতে দিতে চিৎকার করে যাচ্ছে গুঞ্জন।আওয়াজ বেরোবে বলে পুরো একটা ওড়না মুখে গুজে দিলো সে।এখন শুধু একটা নিঃশব্দ গোঙানির আওয়াজ আসছে।আর কারো বুক ফাটা আর্তনাদের চাপা কান্না ঝরছে।বাইরে থেকে ডাক পড়েছে।এক নাগাড়ে দরজায় কড়া নেড়ে যাচ্ছে।গুঞ্জন চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতে লাগলো।কান্না লুকানোর জন্য।চোখের কান্না না হয় আড়াল করা যাবে।কিন্তু মন থেকে ভেসে আসা উত্তাল সাগরের গর্জে উঠা এক একেক টা ঢেউ কি করে থামাবে সে?

তার মনটা যে ভেঙে এতটুকু হয়ে গেছে।আদৌ কি তা জোড়া লাগাতে পারবে সে।কি করে কাউকে ভাঙাচুরা একটা মন উপহার দেয়া যায়।অঙ্কুর স্যারের তো কোন ও দোষ নেই।সে কি করে তার লাইফের সাথে অঙ্কুর স্যারকে জড়াবে!
না না!সে বলে দেবে অঙ্কুর স্যার কে,
____এই দেহের সম্পূর্ণ আধিপত্য আপনার নামে আমি করে দিতে পারিলেও এই মনের রাজ্যের আধিপত্য আমি আপনাকে দিতে পারবোনা।চাইলেই আপনার যখন ইচ্ছে এই দেহে আপনার হুকুম জারি করতে পারবেন।কিন্তু আমার মনের রাজ্যে যাকে বসিয়ে রেখেছি আপনি চাইলেও আমি সেখান থেকে তাকে সরাতে পারবোনা।!

“দেহের ভাগ হয়তো কাউকে দেয়া যায়,কিন্তু মনের ভাগ!সত্যিই কি মনের ভাগ একসাথে দুজনকে দেয়া যায় !”

যায় না বাবুন দা।দেয়া যায় না!এই দেহে আপনি স্পর্শ করবেন বলে অবদি কেউ ছুয়েও দেখতে পারেনি।যে হাত বাড়িয়ে ছিলো লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকে উচিত শিক্ষা ও দিয়ে দিয়েছি।যাক কাউকে পবিত্র মন টা না দিতে পারলে অন্তত পবিত্র দেহ টা তো দিতে পারবো।

ওসিকে আবারো দরজায় কড়াঘাতের আওয়াজে চমকে উঠে গুঞ্জন।নিজেকে কিছুটা শক্ত করে দরজা খুলে দেয় গুঞ্জন।পার্লার থেকে মেয়েরা এসেছে।কিছুক্ষন পরই গায়ে হলুদ দেয়া হবে।মেহেদি পরিয়ে হাত রাঙানো হবে।অথচ তার নিজের জীবন টাই ধূসর আর মনটা বড্ড বেরঙিন।দেহের সাজই বুঝি সব!তাহলে মন কেনো দেহের সাজে সেজে উঠে না!

দরজা খুলে দিতেই গৌতম এসে জড়িয়ে ধরে গুঞ্জনকে।গুঞ্জন ও হাটু গেড়ে বসে গৌতমকে জড়িয়ে ধরে।গৌতম বেশ কিছুক্ষন ওভাবে থাকার পর বললো,
____তুমি কেঁদেছিলে গুঞ্জন দি?
____গুঞ্জন নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললো,আরে না পাগল আমি কেনো কাঁদতে যাবো।
___গৌতম মুখটাকে নিচের দিকে রেখে বলল,
আমি বুঝি দি!কান্না মুছে ফেলেছো বলে ভেবে নিয়েছো আমি বুঝবো না!তুমি প্রত্যেকবার কান্নার করার পর যখন আমাকে জড়িয়ে ধরতে তোমার হার্টবিট শুনেই আমি বুঝে নিতাম।আমি যখন ভয় পেয়ে দৌড়াতাম তখন আমার বুকের মাঝে ও ঠিক এইভাবে খুব দ্রুত হার্টবিট হতো।তখনি আমি বুঝে নিয়ে ছিলাম তুমি কিছু একটা নিয়ে ভয়ে থাকো আর ভয় পেয়েই কাঁদো।তাইতো তোমার ও এমন হয়।কিন্তু পরে এটা ও বুঝে গেছি।দিস ইজ লাভ কেইস দি।

স্যরি দি তোমার লাভ কেইসে আমি তোমাকে কোন ও হেল্প করতে পারিনি বলে।তুমি জানো সেজুতি দোলের দিন তার দি আর বিমল স্যারকে ভাগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।আর আমি কিছুই করতে পারিনি।

গুঞ্জন আর নিজের কান্নাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি।হাউমাউ করে গৌতম কে জড়িয়ে ধরেকেঁদে ফেললো সে।

ওদিকে বিহানের ও খুব কষ্ট লাগছে।সে চায়নি তার তুলতুল দি এভাবে কষ্ট পাক।ইশ!বেচারি কতটা কষ্ট পেয়েছে কথাটা শুনে।দা ভাই এর জন্যই তাকে এভাবে তুলতুলের দিকে কষ্ট দিতে হয়েছে।কিব হতো বলে দিলে খুশি মনে বিয়েতে সামিল হতে পারতো।আরে নিজের বিয়েতে নিজে খুশি না হতে পারলে মজা আছে নাকি।কি এক আদিখ্যেতা সারপ্রাইজ দেবে।কাউকে কষ্ট দিয়ে এ রকম সারপ্রাইজ দেয়ার কোন ও মানে খুজে পায় না বিহান।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here