অব্যক্ত ভালোবাসা পর্ব -০৬

#অব্যক্ত_ভালোবাসা
#লেখনীঃআরভি_আহিয়াদ_তিহু
#প্রথম_পরিচ্ছেদ
#পর্বঃ6

ফোন স্ক্রল করতে করতে ডাইনিং রুমে এসে দাড়াল শান। আশেপাশে ভালো করে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে মিসেস রাহেলা রায়জাদাকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে প্রশ্ন ছুড়ল,
–“সুজি কোথায় আম্মু? ডিনার করতে আসেনি?”

মিসের রাহেলা রায়জাদা ওনার হাজবেন্ট কে খাবার সার্ভ করতে করতে গম্ভীর স্বরে বললেন,
–“সন্ধ‍্যা থেকে নিজের রুম আটকে বসে আছে। ডিনারের জন‍্যে ডাকতে গিয়েছিলাম, বলেছে রাতে কিছু খাবে না।”

শান কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
–“কেন খাবে না?”

শানের প্রশ্ন কানে যেতেই মিসেস রাহেলার রাগটা এবার বেড়িয়ে আসলো। উনি হাতে থাকা ভেজিটেবলের কাচের বোল টা শব্দ করে টেবিলের উপর রাখলেন। তারপর শানের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

–“সেটা আমি কীভাবে বলব? তোমরা দুজন কখনো আমাকে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করো? ব‍্যস নিজেদের যা মনে আসে তোমরা সেটাই করে বেড়াও। তোমাদের মা নামক মানুষটা এখনো যে এই পৃথিবীতে বেঁচে আছে সেটা কি আদৌ তোমাদের দুজনের মনে আছে?”

শান বিরক্তিতে কপাল কুচকে বলল,
–“উফফ আম্মু, এরকম ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা না বলে, যেটা বলতে চাইছো সরাসরি বলে দেও।”

ছেলের এমন গাঁ ছাড়া ভাবের কথা শুনে মিসেস রাহেলা ক্ষেপে গিয়ে বললেন,
–“সরাসরি বলার কি আছে, হ‍্যাঁ? তোমরা বাইরে যেসব করে বেড়াও সেগুলো কি মুখে বলার মতো কথা?”

–“ওফ’ফো আম্মু, বাইরে আমরা কি এমন করে বেড়াই যেটা তুমি মুখে বলতে পারছো না?”

শানের কথা শুনেমিসেস রাহেলা ক্রোধান্বিত স্বরে বললেন,
–“কি করে বেড়াও জানতে চাও? তাহলে শোনো, তোমার বোন ভালো গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে যাওয়ার জন‍্যে বিকেলে বের হয়েছিল। কিন্তু সন্ধ‍্যায় যখন গাড়ি নিয়ে বাড়িতে ফিরেছে তখন সেটা আর গাড়ি ছিল না, ভাঙা-ফাটা একটা ঠ‍্যালা গাড়ি হয়ে গিয়েছিল। আর তুমি? তুমি তো সবকিছুর উধ্বে চলে গেছো। সকালে সেজে গুজে সুট পড়ে বের হচ্ছো। আর রাত হলেই ভিজে জুবুথুবু হয়ে বাসায় ফিরছো। তোমরা দুই ভাই-বোন মিলে কি শুরু করেছো বলো তো?”

শান ওর আম্মুর দিকে তাকিয়ে ফোশ করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
–“এই সামান‍্য ব‍্যাপার গুলো নিয়ে এত রেগে থাকার কি আছে আম্মু? সুজির ড্রাইভিং স্কেল তেমন ভালো না, সেটা তো তুমি জানো। হয়ত কোথাও অ‍্যাক্সিডেন্ট করেছে। আর আমি তো আমার কেবিনের ওয়াশরুমে গিয়ে ভুল করে শাওয়ার ট‍্যাপ অন করে ফেলেছিলাম, তাই এরকম ভিজে গেছি। এইগুলো নিয়ে এত রিয়‍্যাক্ট করার কি আছে?”

–“ঠিকআছে, করলাম না রিয়‍্যাক্ট। তোমাদের যা ইচ্ছা তোমরা সেটাই করো। দরকার পড়লে অ‍্যাক্সিডেন্ট করে এই বাড়ি-ঘরও ভেঙে ফেল। তোমাদের দুজনকে দিয়ে তো আর কোনো কিছুই অসম্ভব না।”

মিসেস রাহেলা এসব বলতে বলতে চেয়ারে বসে পড়লেন। শান ওনার কথায় পাত্তা না দিয়ে “আমি সুজিকে ডাকতে যাচ্ছি” বলে ডাইনিং রুম ছেড়ে বের হয়ে গেল।

শান একটা রুমের সামনে এসে দরজার উপর দুইবার নক করল। ওপাশ থেকে কোনো রেসপন্স না আসায় ‘ও’ এইবার একটু জোরেই রুমের দরজার উপরে ধাক্কা দিল। দরজা আলগা থাকায় ধাক্কা দেওয়ার সাথে সাথে সেটা খুলে গেল। শান কোনো বিলম্ব না করেই ট‍্রাউজারের পকেটে দু-হাত ঢুকিয়ে রুমের মধ‍্যে ঢুকে গেল। কিন্তু ভিতরে ঢুকতেই ‘ও’ একদম হতবাক হয়ে গেল। কারন পুরো রুমটা ধোয়ায় ভরে উঠেছে। রুমের রেড কালারের ড্রিম লাইটের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রুমের ঠিক মাঝ বরাবর একটা কালো শাড়ি পড়িহিতা মেয়ে বসে আছে। মেয়েটার সামনে মার্কার দিয়ে টাইলসের উপর একটা স্টারের মতো আঁকা। স্টার টার পাঁচ কোনায় পাঁচটা ক‍্যান্ডেল জ্বালানো। আর ওটার মাঝখানে একটা ফোন রাখা। যেটাতে কারো ফটো ভেষে উঠেছে। মেয়েটার কোকড়া চুলগুলো পিঠের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। সে হাতে একটা পুতুল নিয়ে, পুতুলটার মধ‍্যে বারবার সুই গাঁথছে, আর বিরবির করে কিছু একটা বলছে। এসব দেখে শান ধারাল কণ্ঠে মেয়েটাকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে বলল,
–“এসব কি করছিস সুজি?”

পাশ থেকে কারো গলার স্বর কানে ভেষে আসতেই মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাল। শান এগিয়ে গিয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল মেয়েটার উপর। মেয়েটা ফিসফিসিয়ে ভৌতিক কণ্ঠে বলল,
–“জাদু করছি জাদু। কিন্তু তুমি এখানে কেন এসেছো বালক?”

শান চোখ ছোট ছোট করে মেয়েটাকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে বলল,
–“কিসের জাদু করছিস?”

মেয়েটা আগের ভঙ্গিতেই বলল,
–“তোমার জানার দরকার নেই। তুমি যাও এখান থেকে। নাহলে তোমার আত্মাকে আমি কাচের বোতলে বন্ধি করে রাখব।”

–“তারআগে আমি তোকে এক থাপ্প*র মে*রে সোজা উপরে পাঠিয়ে দিব।”

কথাটা বলেই শান আরেকটু এগিয়ে এসে ঝুকে মেয়েটার সামনে থেকে ফোনটা তুলে নিল। মেয়েটা এতে রাগি চোখে শানের দিকে তাকাল। শান একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ফোনের স্কিনের দিকে তাকাল। ফোনের স্কিনে রুশা আর আয়াশের সেই সন্ধ‍্যা বেলার ফুসকার দোকানের ভিডিওর একটা স্কিনশর্ট দেখা যাচ্ছে। যেখানে আয়াশ রুশার হাত ধরে দৌড় দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শান ফোন থেকে চোখ সরিয়ে মেয়েটাকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে বলল,
–“হোয়াট ননসেন্স ইজ দিস সুজি? এটা দিয়ে কি করছিস? আর এভাবে সেজেছিস কেন?”

শান প্রশ্ন করার সাথে সাথে মেয়েটা ফ্লোর থেকে উঠে দাড়িয়ে যায়। রাগে ফুসতে ফুসতে হাত দিকে ফোনের স্কিনের দিকে ইশারা করে বলে,

–“এই মেয়েটাকে আমি মে*রে ফেলব। ওর এত বড় সাহস ‘ও’ আমার আয়াশের দিকে নজর দেয়! ওর নজর বের করে আমি বাস্কেট বল খেলব। ওকে আমি গরম তৈলে ভাজব। পেত্নি, ভুতনি, রাক্ষসী মেয়ে কোথাকার। আমার আয়াশের হাত ধরে ফুচকা খেতে যাওয়া? ওর পেট কে*টে আমি সব ফুচকা ওর পেট থেকে টেনে বের করব।”

কথাটা বলে মেয়েটা শানের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে আবারও ফ্লোরে বসে পড়ল। তারপর ফোনটাকে আবারও আগের জায়গায় রেখে পুতুলটাকে হাতে নিয়ে বলতে লাগল,

–“ইড়িং বিড়িং চিড়িং চা, ওই পেত্নির আত্মা এই পুতুলের মধ‍্যে ঢুকে যা। ফুচকা আর টকপানি, ওই রাক্ষুসি মেয়েটা আয়াশের নানি। চাউ মাউ টাউ মেয়েটার জান বের করে তৈলে ভেজে খাউ।”

মেয়েটার এসব উদ্ভট মন্ত্র শুনে শান হা হয়ে গেল। ‘ও’ বেশ ভালো করেই জানে ওর বোন আয়াশের বিশাল বড় ফ‍্যান। এই রুমের পুরো দেয়াল জুড়ে শুধু আয়াশের পিক দিয়ে ভর্তি করা। আয়াশের প্রতি ওর এই পাগলামো সম্পর্কে বাসার সবারই বেশ ভালো ভাবেই অবগত। কিন্তু সেই পাগলামির জন‍্যে ‘ও’ যে একেবারে কালো জাদুকারী সন‍্যাসী হয়ে যাবে, সেটা শান স্বপ্নেও ভাবেনি। মেয়েটা একটার পর একটা অদ্ভুত মন্ত্র বলেই যাচ্ছে। শান এতক্ষন শান্ত থাকলেও এবার মেয়েটাকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে ধমক দিয়ে বলল,

–“স্টপ দিস ননসেন্স সুজি। চুপচাপ উঠে এসব চেইঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়। আমি তোর জন‍্যে অপেক্ষা করছি।”

শানের এক ধমক শুনে মেয়েটা মুহূর্তের মধ‍্যে বাঘিনী থেকে ভেজা বিড়াল হয়ে গেল। কিন্তু জায়গা থেকে উঠল না। ভয়ে চুপটি করে আগের জায়গাই বসে রইল। শান আবারও আগের ভঙ্গিতে বলল,
–“কি বলেছি কানে যায়নি? এখনো ওখানে বসে আছিস কেন?”

শানের এবারের ধমকে মেয়েটা বসা থেকে উঠে হুড়মুড় করে দাড়িয়ে গেল। শান শাসানোর ভঙ্গিতে বলল,
–“ফাস্ট এন্ড লাস্ট বারের মতো ওয়ানিং দিচ্ছি সৃজনী, এই ধরনের ফালতু কাজ যেন আমি কখনো তোকে করতে না দেখি। ইউ নো ভেরি ওয়েল, আই ডোন্ট লাইক আয়াশ। তাই এমন কোনো কাজ করিস না, যার জন‍্যে ওকে পরে ঝামেলায় পড়তে হয়।”

কথাটা বলে শান হনহন করে ওখান থেকে বের হয়ে গেল। সৃজনী শানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা ভ‍‍েংচি কেটে বলল,

–“এ‍্যাহহহহ, আই ডোন্ট লাইক আয়াশ! তোর লাইক করায় আর না করায় আমার কচু হবে কচু। বিয়ে তো আমি আয়াশকেই করব। পারিস তো আমার আয়াশের কিছু করে দেখাস।”

বিরবির করে কথাটা বলে সৃজনী ওয়াশরুমে চলে গেল। সুপারস্টার আয়াশ দেওয়ান! এই নামটা শুনলেই হার্টবিট বেড়ে যায় সৃজনীর। গত দুই বছরে আয়াশ কোনদিন কোথায় গেছে, কি করেছে, সেই সব খবর আছে সৃজনীর কাছে। আয়াশের পছন্দ-অপছন্দ সবকিছুই প্রায় ওর নখদর্পণে। ওর কিশোরী বয়সের প্রথম ভালোলাগা ছিল আয়াশ। যেই ভালোলাগা এখন সৃজনীর পাগলামো ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়েছে।

আজকে সন্ধ‍্যায় সৃজনী ওর ফ্রেন্ডদের নিয়ে ঘুড়তে বেড় হয়েছিল। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর ওরা সবাই রাস্তার পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে স্ট্রিট ফুড খাচ্ছিল। তখনই ওরা দেখতে পায় কিছু ছেলে-মেয়েরা মিলে কাউকে একটা ঘিরে রেখে আয়াশ-আয়াশ বলে চিৎকার করছে। কৌতূহলবশত ওরাও সেদিকে এগিয়ে যায়। গিয়ে দেখে আয়াশ একটা মেয়ের হাত ধরে দাড়িয়ে মেয়েটাকে কিছু বলছে। বলা শেষ হলেই চোখের পলকের মধ‍্যে দুজন দৌড়ে সেখান থেকে চলে যায়। সবটা দেখে সবাই মজা পেলেও, রেগে যায় সৃজনী। রাগে ফুসতে ফুসতে নিজের গাড়ির কাছে এসে ডিকি থেকে একটা রডের স্টিক বের করে। তারপর রডটা দিয়ে গাড়ির জানালার, ফ্রন্ট সাইডের, ব‍্যাক সাইডের কাচ সবগুলো ভেঙে গুড়া গুড়া করে ফেলে। সৃজনীর ফ্রেন্ডরা অনেক চেষ্টা করেও ওকে আটকাতে পারেনি। আতঙ্কিত হয়ে সবাই ওর দিকে তাকিয়ে ছিল।

আরাফ রায়জাদা এবং রাহেলা রায়জাদার দুইমাত্র সন্তান হচ্ছে শান এবং সৃজনী। সৃজনী শানের থেকে গুনে গুনে একদম আট বছরের ছোট। শানের জন্মের পরে মিসের রাহেলার কিছু কমপ্লিকেশন হয়। যার কারনে উনি বেশ অনেকটা সময় কনসিভ করতে পারেন নি। বহু ট্রিটমেন্ট এবং মেডিসিন খাওয়ার পরে ওনি সুস্থ হয়ে উঠেন। এবং আবারও কনসিভ করতে সক্ষম হন। যার কারনে শান আর সৃজনীর বয়সের মধ‍্যে এতটা গ‍্যাপ হয়েছে। ওদের দুজনের বয়সে যেমন গ‍্যাপ রয়েছে, তেমন স্বভাবেও অনেক ডিফারেন্স রয়েছে। শান একদম শান্ত স্বভাবের এবং ভিষন স্ট্রং পার্সনালিটির একজন মানুষ। ইমোশন নামক শব্দটার সাথে যার দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোনো সম্পর্ক নেই। রাগটা একটু বেশি। কিন্তু সহজে কারো সামনে সেটা প্রকাশ করে না। কথা খুব কম বলে। যতটুকু বলে তাতে অপ্রয়োজনীয় একটা শব্দও থাকে না। দেখতে যেমন সুদর্শন, তেমনি হাঁটাচলা, কথা বলা স্টাইল, পার্সনালিটি, অ‍্যাটিটিউড, সবকিছুই নজর কাড়ার মতো। একবার কারো নজর শানের উপর পড়লে নিঃসন্দেহে কিছু সময়ের জন‍্যে তার নজর শানের উপরেই আটকে যাবে।

সৃজনী একদম উল্টো ধাচের মানুষ। শান যেখানে সারাদিন নিজের কাজের মধ‍্যে ঢুবে থাকে। সৃজনী সেখানে সারাদিন ফ্রেন্ডদের নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে ব‍্যস্ত থাকে। শান যতটা গোছানো, সৃজনী ঠিক ততটাই অগোছালো। স্বভাবত সৃজনী বেশ চঞ্চল আর মিষ্টি টাইপ হলেও, রাগ উঠলে ভয়ংকর হয়ে যায়। তবে রাগ নামক জিনিসটা ওর সহজে উঠে না। শুধু আয়াশের পাশে কাউকে দেখলেই ওর মেজাজ সপ্তম আকাশে চড়ে বসে থাকে। এছাড়া দুনিয়ার অন‍্যকিছু নিয়ে ওর মোটেও মাথা ব‍্যথা নেই। ফ‍্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে স্টাডি করছে। খুব একটা ভালো স্টুডেন্ট না হলেও, নিজের লেখাপড়া নিয়ে সে যথেষ্ট সিরিয়াস।
________________________

মাঝে কেটে গেছে প্রায় চারদিন। রুশা সেই ফ্লাট টা ছেড়ে দিয়ে নতুন একটা ফ্লাটে শিফট হয়েছে। যাতে সেদিনের মতো শান আর কখনো ওর সাথে এরকম অসভ‍্যতা করতে না পারে সেইজন‍্যে। সেদিন যখন রুশা অতিরিক্ত ঝালে শানের গায়ে বমি করে দিয়ে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল। তখন শান নাক মুখ কুচকে রেগে হনহন করে রুশার ওয়াশরুমে চলে যায়। তারপর সেখানে গিয়ে শাওয়ার ট‍্যাপের নিচে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে ভেজা অবস্থায়ই রাগে গজগজ করতে করতে রুশার ফ্লাট থেকে বের হয়ে যায়। শান আর ওর লোকেরা বের হয়ে যেতেই রুশা ফ্লোর থেকে উঠে দাড়ায়। শানকে ভাগানোর জন‍্যেই ‘ও’ মূলত সেন্সলেস হওয়ার নাটক টা করেছিল। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে পানি খেয়ে রুশা নিজেকে শান্ত করে। তারপর কিচেনটা ক্লিন করে চলে যায় ওয়াশরুমে। এক ঘন্টা সময় ধরে শাওয়ার নিয়ে বের আসে ‘ও’। তারপর ভেবে চিন্তে ওই বাসা থেকে চলে আসার ডিসিশন নেয়। ওখানে তেমন কোনো সিকিউরিটির সিস্টেম ছিল না। চাইলেই বাইরের যেকেউ খুব সহজেই ওই বাসাটার মধ‍্যে ঢুকে পড়তে পারত। রুশা যখন স্টাডির পাশাপাশি পার্ট টাইম জব করত, তখন ‘ও’ হোস্টেল ছেড়ে এসে অল্প টাকার মধ‍্যে ওখানে একটা ফ্লাট ভাড়া নিয়েছিল। তারপর আর ওটা চেইঞ্জ করার কখনো প্রয়োজন বোধ করেনি। ডাক্তার হওয়ার পর প্রতি মাসে বেশ মোটা অংকের টাকা ইনকাম করা শর্তেও ওখানেই রয়ে গেছে। ভেবেছে, অতিরিক্ত টাকা নষ্ট করে একা মানুষের থাকার জন‍্যে বিশাল একটা ফ্লাট কিনে কি হবে? শুধু নিজের ফালতু বিলাশিতার জন‍্যে অযথা টাকা অপচয় হবে। তাই আয়াশ অনেকবার রুশাকে ফ্লাট কেনার জন‍্যে বললেও রুশা ওর কোনো কথা কানে তুলেনি। কিন্তু সেদিনের ইন্সিডেন্টটার পর ওর মনে একটা আতঙ্ক ঢুকে গেছে। তাই ‘ও’ দ্রুত ওর একজন কলিগের সাথে কথা বলে দুই দিনের মধ‍্যেই নতুন একটা ফ্লাটের ব‍্যবস্থা করে ফেলেছে। আয়াশের কিছু গার্ড আর রুহানের সাহয‍্যে নিয়ে ওর সব জিনিসপত্র ওই ফ্লাট থেকে এই ফ্লাটে শিফট করে ফেলেছে। আয়াশ অবশ‍্য রুশার কাছে আচমকা ওর বাসা চেইঞ্জ করার কারন জানতে চেয়েছিল। কিন্তু রুশা ওই বাসার সাধারণ কিছু সমস‍্যার কথা বলে শানের ব‍্যাপারটা একদম এড়িয়ে গেছে।

এখন রুশা যে অ‍্যাপার্টমেন্টায় আছে সেটা মোট টুয়েলভ ফ্লোরের বিল্ডিং। প্রত‍্যেকটা ফ্লোরে তিনটা করে ফ্লাট। রুশা 10th ফ্লোরের তিন নম্বর ফ্লাটে থাকে। এই অ‍্যাপার্টমেন্টের ফ্লাট ভাড়াটা একটু বেশি হলেও সিকিউরিটি বেশ কড়া। বাড়িটার চারপাশ থেকে বড় উঁচু প্রাচীর দিয়ে বাউন্ডারি দেওয়া। গেটের সামনে দুজন করে গার্ড সব সময় পাহাড়ায় থাকে। তাছাড়া অ‍্যাপার্টমেন্টার আশেপাশে, সিড়িতে, ছাদে, ফ্লাটের দরজার সামনে, সব জায়গাতেই সিসি ক‍্যামেরা লাগানো রয়েছে। রুশার ধারনা এই বাসার ভিতরে ঢোকার পারমিশন শান কখনোই পাবে না।
_________________________

রাত প্রায় দশটা বাজে। সারা দিনের ক্লান্ত শরীর নিয়ে এক মনে ড্রাইভ করে যাচ্ছে সৃজনী। আজ প্রায় দুদিন ধরে ‘ও’ আয়াশকে ফলো করছে। উদ্দ‍্যেশ‍্য একটাই আয়াশের গার্লফ্রেন্ডকে খুঁজে বের করা। সৃজনী ধরেই নিয়েছে সবাই ফুচকা স্টলের সামনে আয়াশের সাথে যে মেয়েটাকে দেখেছিল সেই মেয়েটা আসলে আয়াশের গার্লফ্রেন্ড। তাই ‘ও’ সকাল থেকে রাত পযর্ন্ত নিজের গাড়ি নিয়ে আয়াশকে স্টক করছে। আয়াশ গতকাল সকাল থেকে গাড়ি নিয়ে যেখানে যেখানে গেছে, সৃজনীও ওকে ফলো করে ঠিক সেখানে সেখানে পৌছে গিয়েছে। কিন্তু এখন পযর্ন্ত আয়াশ এমন কোনো মেয়ের সাথে দেখা করেনি যাকে ওই মেয়েটার মতো দেখতে। তবে সৃজনীর ধারনা আয়াশ ঠিক কোনো না কোনো সময় ওর গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করবেই। আর তখনই সৃজনী সেই মেয়েকে দেখে ফেলবে।

একটা শূনশান রাস্তা দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটছে আয়াশের গাড়ি। আয়াশের গাড়ির পিছনে সেম গতিতে ছুটছে আরেকটা গাড়ি। যেটার মধ‍্যে আয়াশের বডি-গার্ডরা আছে। ওদের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখেই এতক্ষন সৃজা ড্রাইভ করছিল। কিন্তু হঠাৎ আয়াশের গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেওয়ায় ‘ও’ নিজেও ওর গাড়ির স্পিড একটু বাড়িয়ে দিল। কিছুটা দূর আসতেই আচমকা আয়াশদের দুটো গাড়ি পিছনে ঘুরে এসে সৃজার গাড়ির দুপাশে ব্রেক করল। আকষ্মিক ঘটনায় সৃজা নিজেও দ্রুত গাড়ি ব্রেক করল। ওর মাথা গিয়ে ঠেকল স্টিয়ারিংয়ের সাথে।

আয়াশ রাগি মুড নিয়ে ওর গাড়ির দরজা খুলে এগিয়ে এসে সৃজার গাড়ির ফ্রন্ট সিটের জানালায় নক করল। সৃজা আস্তে আস্তে নিজের মাথা উঠিয়ে হাত দিয়ে কপাল ঘশতে ঘশতে জানালার কাচের দিকে তাকাল। বাইরে আয়াশকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ওর চোখ জোড়া গোল গোল হয়ে গেল। আয়াশ বাইরে থেকে জানালায় কয়েকবার নক করে সৃজাকে বের হওয়ার জন‍্যে বলল। কিন্তু আয়াশের একটা কথাও সৃজার কানে ঢুকল না। ‘ও’ হা করে শুধু আয়াশের দিকেই তাকিয়ে আছে। আয়াশ বিরক্ত হয়ে ওর গার্ডদের ইশারা করে কিছু একটা নিয়ে আসতে বলল। একজন গিয়ে আয়াশের গাড়ির ডিকি খুলে একটা হাতুরি টাইপ ভারি জিনিস নিয়ে এসে আয়াশের হাতে ধরিয়ে দিল। আয়াশ হাতুরিটা দিয়ে জোরে সৃজার গাড়ির জানালার কাচের উপর আঘাত করল। চোখের পলকের মধ‍্যে ঝরঝর করে গাড়ির কাচগুলো ভেঙে পড়ল। সৃজা ভয় পেয়ে বসা অবস্থায়ই খানিকটা পিছিয়ে গেল। আয়াশ ভাঙা জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে গাড়ির দরজার লকটা খুলে ফেলল। সৃজা কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে দ্রুত গাড়ি স্টার্ড দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু গাড়ি স্টার্ড হওয়ার আগেই আয়াশ ওর হাত টেনে ধরে ওকে বাইরে বের করে নিয়ে আসলো। সৃজার হার্ট জোরে জোরে বিট করতে লাগল। এই প্রথমবার আয়াশকে এতটা কাছ থেকে দেখছে ‘ও’। আয়াশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বারবার সৃজার ঘোর লেগে যাচ্ছে।

আয়াশ রাগি দৃষ্টিতে সৃজার দিকে তাকিয়ে থেকে কর্কশ কণ্ঠে বলল,
–“এই মেয়ে কে তুমি? আমাকে ফলো করছিলে কেন?”

আয়াশের কথায় সৃজার হুশ আসলো। ‘ও’ নিজেকে যথা সম্ভব সামলে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
–“কি বলছেন স‍্যার? আমি আপনাকে কেন ফলো করতে যাব? আমি তো আমার বাসায় ফিরছিলাম।”

আয়াশ সৃজার হাত ছেড়ে দিয়ে ওর সামনে তর্জনী আঙুল উঠিয়ে ধমকের স্বরে বলল,
–“শাটআপ! যাস্ট শাটআপ। আমাকে মিথ‍্যা বলার চেষ্টাও করবে না। আ’ম নট ফুল ওকে?”

সৃজা ভিতরে ভিতরে ভয় পেলেও উচ্চ স্বরে আয়াশকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে বলল,
–“আরেহ আজব তো। আমি বললাম না আমি নিজের বাড়িতে ফিরছিলাম। তারপরেও আপনি আমার সাথে রুড বিহেব কেন করছেন? এতবড় একজন সেলিব্রিটি হয়ে রাস্তায় দাড়িয়ে একটা মেয়ের সাথে এরকম অসভ‍্যতা করতে আপনার লজ্জা করছে না?”

–“হেই ইউ, একদম আমার সাথে এই টোনে কথা বলবে না। আমি তোমাকে যেটা যেটা প্রশ্ন করব। তুমি ঠিক সেটার সঠিক অ‍্যান্সার দিবে। এর বাইরে একটা এক্সটা শব্দও বললে তোমাকে পস্তাতে হবে। বুঝেছো?”

সৃজা বলল,
–“না বুঝিনি। আর বুঝলেও আপনার কোনো প্রশ্নের অ‍্যান্সার আমি দিব না।”

বলেই সৃজা গিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ির দরজা আটকানোর জন‍্যে হাত বাড়াতে নিলেই আয়াশ আবারও ওর হাত ধরে টেনে ওকে বাইরে বের করল। আয়াশের এমন কান্ডে সৃজা নিজেও এবার ভিষন রেগে গেল। কপালে বিরক্তির ভাজ ফেলে বলল,

–“এসবের মানে কি মিঃ আয়াশ? অযথা আপনি আমার সাথে এরকম ম‍্যানারলেস মানুষের মতো বিহেব কেন করছেন? আমি তো আপনাকে বলছি যে আমি আপনাকে ফলো করছিলাম না। আমি আমার একটা কাজে যাচ্ছিলাম।”

শেষের কথাটা বলে সৃজা জিব কাঁটল। রাগের বশে বাড়িতে যাওয়ার কথা না বলে ‘ও’ কাজে যাওয়ার কথা বলে ফেলেছে। মনে মনে নিজেকে হাজারটা বকা দিয়ে চোরা চোখে ‘ও’ আয়াশের দিকে তাকাল। আয়াশ ক্রদ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে হুট করে ওর হাত ছেড়ে দিয়ে ওর গলা চেপে ধরল। আচমকা আক্রমনে সৃজা কিছুটা পিছিয়ে গেল। আয়াশ সৃজাকে ধাক্কা দিয়ে আরো পিছনে গাড়ির কাছে নিয়ে গেল। তারপর গাড়ির সাথে সৃজার পিঠ ঠেকিয়ে শক্ত করে ওর গলা চেপে ধরল। সৃজা দু-হাত দিয়ে আয়াশের হাত ওর গলা থেকে সরানোর চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যেই ওর দম আটকে আসছে।

আয়াশ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“আজকে সারাদিন ধরে তুমি কেন আমার পিছু নিচ্ছিলে? কে পাঠিয়েছে তোমাকে? আমাকে পিছু করার পিছনে তোমার মটিভ কি ছিল? তাড়াতাড়ি বলে ফেল। নাহলে তোমাকে মে*রে এই শূনশান রাস্তার পাশের বিলের মধ‍্যে ফেলে রেখে যাব। সকালের আগেই জংলি শে*য়ালরা তোমার এই সুন্দর বডিটাকে ছিড়ে ছিড়ে খাবে। সেটা নিশ্চয়ই তুমি চাইবে না? তাই ভালোয় ভালোয় আমার প্রশ্ন গুলোর অ‍্যান্সার দিয়ে দাও।”

আয়াশ কথাটা শেষ করতে না করতেই সৃজা ওর শরীরের সব ভার শূন‍্যে ছেড়ে দিল। সৃজাকে চোখ বন্ধ করে নেতিয়ে পড়তে দেখে আয়াশ ওর গলা থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে আনলো। এতে সৃজা ব‍্যালেন্সলেস হয়ে ধপাস করে রাস্তার উপরে পড়ে গেল। রাস্তার পিচ ঢালাইয়ের উপর কপালে বারি খাওয়ায় ওর কপালের এক সাইড কে*টে ব্লিডিং হতে লাগল। গাড়ির হেড লাইটের আলোতে আয়াশ সেটা স্পষ্ট দেখতে পেল। কিন্তু সৃজনীর জন‍্যে ওর মোটেও মায়া হল না। ‘ও’ ফোশ করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের গাড়ির দিকে যেতে যেতে গার্ডদের উদ্দ‍্যেশ‍্য করে বলল,
–“এটাকে হাত পাঁ বেধে তোমাদের গাড়িতে করে নিয়ে আসো। বাড়িতে গিয়ে একটু খাতির যত্ন করলেই গড়গড় করে সব সত‍্যি কথা মুখ থেকে বের করে দিবে।”

#চলবে….

[বিঃদ্রঃ ব‍্যস্ততার কারনে এতদিন গল্প লিখতে পারিনি। দুঃখিত!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here