#অব্যক্ত_ভালোবাসা
#লেখনীঃআরভি_আহিয়াদ_তিহু
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্বঃ24
সিকদার ভিলার সামনে এসে আয়াশ গাড়ি থামিয়ে হো হো করে হেঁসে দিল। শানের তখনকার ফেস রিয়্যাকশনের কথা মনে পড়তেই ওর হাঁসির মাত্রাটা আগের তুলনায় আরো বেড়ে গেল। এই প্রথমবার শানকে বোকা বানাতে পেরে আয়াশের ভিষণ শান্তি-শান্তি অনুভব হচ্ছে। ওর মনে হচ্ছে ‘ও’ বিশাল বড় কোনো যুদ্ধ জয় করে ফিরে এসেছে। হঠাৎ একটা চিৎকারের শব্দ কানে ভেসে আসতেই আয়াশের হাঁসি থেমে গেল। ‘ও’ ভ্রু কুচকে জানালার কাচ নামিয়ে মাথাটা জানালা দিয়ে বাইরে বের করল। অনবরত আসা চিৎকারের শব্দ শুনে বুঝতে পারল চিৎকার টা বাড়ির ভিতর থেকে আসছে। আয়াশ ঝটফট করে গাড়ি থেকে নেমে কোনো বিলম্ব না করেই বাড়ির ভিতরে যাওয়ার জন্যে দৌড় দিল। দরজা ঠেলে ড্রইংরুমে ঢুকতেই ওর কলিজা উল্টে গেল। পুরো ফ্লোর জুড়ে শুধু র”ক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। ফ্লোরে পড়ে জোভান সহ চার/পাঁচ জন গার্ড গলা কা*টা মুরগির মতো ছটফট করে যাচ্ছে। আয়াশ আতঙ্কগ্রস্ত গলায় অস্ফুট স্বরে বলল,
–“ওহ মাই গড।”
তখনই উপর থেকে আবারও চিৎকারের শব্দ ভেসে আসা শুরু করল। আয়াশ বুঝতে পারল এটা সৃজার কণ্ঠস্বর। ‘ও’ আর এক মিনিটও ওখানে না দাড়িয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে আসার জন্যে দৌড় দিল। পুরো সিড়িতে আয়াশের জুতোর নিচে লেগে যাওয়া র”ক্তে”র ছোপ ছোপ দাগ বসে গেল। চিৎকারের উৎস খুজতে খুজতে একটা রুমের সামনে এসে আয়াশের পাঁ জোড়া থেমে গেল। সামনে তাকিয়ে এমন জঘন্য দৃশ্য দেখে ওর চোখ জোড়া মুহূর্তের মধ্যে ভয়ংকর লাল বর্ণ ধারন করল। সামনেই তিনটা ছেলে সৃজার উপরে হামলে পড়েছে। ওরা তিনজন মিলে সৃজার গাঁ থেকে ব্লাউজ আর লেহেঙ্গা টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করছে। আর সৃজা ওদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে ওদের গায়ে হাত-পাঁ দিয়ে লাথি, ঘুশি, খামচি যা পারছে দিয়ে যাচ্ছে। আঘাত পেয়ে ছেলেগুলো একটুর জন্যে সৃজার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পরক্ষণেই আবার এসে ওর উপরে হামলে পড়ছে। সৃজা ইনজুরড হওয়া শর্তেও দূর্বল শরীর নিয়ে নিজেকে বাঁচানোর আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে।
চোখের সামনে এসব দেখে আয়াশ নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। দুনিয়ার সব রাগ কোথা থেকে উড়ে এসে ওর মধ্যে ভর করল। রাগে, জেদে মুহূর্তের মধ্যে ‘ও’ একটা ভয়ানক হিংস্র মানবে রূপান্তরিত হলো। আশেপাশে না তাকিয়ে আয়াশ গিয়ে ছেলেগুলোকে বেধড়ক মা”রতে শুরু করল। ছেলে গুলোও আয়াশের উপর আঘাত করার চেষ্টা করল। কিন্তু আয়াশের এই অগ্নিমূর্তির কাছে তিনজনই যেন নিমিষে পরাস্ত্র হয়ে গেল। মিনিট পাঁচেক সময় আয়াশের হাতের উত্তম মাধ্যম পে’টা’নি খেয়ে ছেলে তিনটা কোনো মতে নিজেদের জান নিয়ে ওখান থেকে দৌড়ে পালালো। ওদের ধরার জন্যে আয়াশও ওদের পিছনে দৌড়ে যাওয়ার জন্যে উদ্যত হলো। কিন্তু একটা মায়াবী কণ্ঠের ফোপানো কান্নার শব্দ ওর কানে ভেসে আসতেই ওর পাঁ জোড়া থেমে গেল। আয়াশ ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখল সৃজা উপুর হয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরে শব্দ করে কাঁদছে। ওর মাথার এক সাইড থেকে গলগল করে রক্ত বের হয়ে ওর পুরো মুখে গড়িয়ে পড়ছে। কোমড়, ঘাড়সহ শরীরের যেটুকু অংশ দেখা যাচ্ছে তার সব জায়গায়ই নখের আচড় আর খামচির থাবার দাগগুলো স্পষ্ট। সৃজার এমন অবস্থা দেখে আয়াশের মাথায় বাজ পড়ল। ‘ও’ স্তব্দ হয়ে সেখানেই ঠায় দাড়িয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ড পর ওর যখন হুশ আসলো তখন ‘ও’ ধীর পাঁয়ে সৃজার দিকে এগিয়ে গেল। ধপ করে সৃজার পাশে বেডের উপর বসে কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
–“এ-এসব ক-কীভাবে হলো?”
আয়াশের প্রশ্নের প্রতিউত্তরে সৃজা কিছু বলল না। পাগলের মতো হাউমাউ করে কান্না শুরু করল। সৃজাকে এভাবে কাঁদতে দেখে আয়াশের বুকের মধ্যে যেন ঝড় শুরু হয়ে গেল। ‘ও’ হাতের আঙুল গুলো মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু সৃজার এমন করুন অবস্থা দেখে বেশিক্ষণ নিজেকে শক্ত রাখতে পারল না। সৃজার কান্নার শব্দগুলো ওর কানে এত সাংঘাতিক ভাবে আচড়ে পড়তে লাগল যে ওর সবকিছু মুহূর্তের মধ্যে যেন উলট-পালট হয়ে গেল। আয়াশ সৃজার হাত ধরে একটা হেচকা টান দিয়ে ওকে শোয়া থেকে উঠে বসিয়ে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল। সৃজাও আয়াশকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। সৃজার চোখের পানির ফোটাগুলো আয়াশের বুকে গড়িয়ে পড়তেই আয়াশের মনে হলো ওর বুকে কেউ এসিড ঢেলে দিয়েছে। সৃজার কান্নার শব্দে ওর দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। আয়াশ বুঝতে পারল না একদিন যাকে অমানবিক ভাবে আঘাত করতে গিয়েও ওর বুক কাঁপেনি, আজকে তার এইটুকু কান্নার শব্দে ওর এত অস্থির লাগছে কেন।
_________________________
কমিউনিটি সেন্টারের সামনে এসে শান দ্রুত গাড়ি ব্রেক করল। গাড়িটা ওর ফ্যাক্টরির ম্যানেজারের। আয়াশ যখন ওকে ওখানে একা ফেলে চলে এসেছিল, তখন ‘ও’ আর কোনো উপায় না পেয়ে ফ্যাক্টরির ম্যানেজারের থেকে দ্রুত গাড়িটা নিয়ে সরাসরি এখানে চলে এসেছে। শান গাড়ি থেকে নেমে কমিউনিটি সেন্টারের ভিতরে যাওয়ার জন্যে পাঁ বাড়াতেই ওর নজর গেল রাস্তার অপর পাশ থেকে আসা হৃদানের গাড়ির দিকে। হৃদানের গাড়ি আসতে দেখে শান আর ভিতরে না গিয়ে ওখানেই দাড়িয়ে রইল। গাড়িটা এসে শানের থেকে কিছুটা দূরে ব্রেক করল। শান ওদের দিকে দু-পাঁ এগিয়ে যেতে নিতেই আচমকা ওর পাঁ জোড়া থেমে গেল। ‘ও’ হতবম্ভ হয়ে অবাক দৃষ্টিতে সামনের দিকেই তাকিয়ে রইল। হৃদান রুশার হাত ধরে ওকে টেনে হিচড়ে গাড়ি থেকে নামাচ্ছে। আর রুশা ক্লান্ত-আহত শরীরে হৃদানের থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করে যাচ্ছে। রুশার সারা শরীরে কাটা-ছেড়া আঘাতের চিহ্ন। গলা থেকে চুইয়ে চুইয়ে র’ক্ত বের হচ্ছে। দোপাট্টা গাঁয়ে না থাকায় পেট ও পিঠের উন্মুক্ত অংশগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রুশার এমন অবস্থা দেখে আর হৃদান বিহেইবিয়ার দেখে শান তাজ্জব বনে গেল। ‘ও’ সেখানেই ঠায় দাড়িয়ে অবিশ্বাস্য চোখে হৃদানের দিকে তাকিয়ে রইল।
হৃদান রুশাকে নিয়ে কমিউনিটির সেন্টারের ভিতরে ঢুকতে যাবে তখনই শানকে দেখে ‘ও’ দাড়িয়ে গেল। শানের চোখে চোখ পড়তেই অজানা কারনে ওর হাতের বাঁধন আলগা হয়ে এলো। হৃদান রুশার হাত আলগা করে দেওয়ায় রুশা হৃদানের দৃষ্টি অনুসরণ করে নিভু নিভু চোখে সামনে তাকাল। সামনে শানকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ওর দেহে যেন প্রান ফিরে আসলো। ‘ও’ আর কোনো কিছু না ভেবে এক ঝটকায় হৃদানের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে গিয়ে শানের গলা জড়িয়ে ধরল। শান ঠায় দাড়িয়ে রইল। ওর শরীরের প্রত্যেকটা মাংসপেশি দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করল। অতিরিক্ত রাগে চোখ জোড়া আগুনের লাভার মতো দগদগে হয়ে গেল। হাতের আঙুল গুলো মুষ্টিবদ্ধ করে ‘ও’ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে লাগল। হৃদান এগিয়ে এসে রুশাকে উদ্দ্যেশ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“রুশা ভালোয় ভালোয় বলছি এদিকে এসো। নাহলে কিন্তু তোমার কপালে দুঃখ আছে।”
হৃদান কথাটা বলার সাথে সাথে রুশা শানকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। হৃদান এগিয়ে এসে শানের একদম মুখোমুখি দাড়িয়ে রুশাকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ওর দিকে হাত বাড়াল। কিন্তু ওর হাত রুশার শরীর স্পর্শ করার আগেই শান শক্ত করে ওর হাতের কব্জি চেপে ধরল। হৃদান শানের দিকে তাকিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলল,
–“হাতটা ছাড়ো শান। আর রুশাকেও ছেড়ে দেও। অযথা তুমি আমাদের মধ্যে নাক গলাতে এসো না।”
হৃদান কথাটা বলার সাথে সাথে শান এক হাত রুশার কোমড়ে রেখে ওকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। শানের এমন কাণ্ডে হৃদান তৈলে বেগুনে জ্বলে উঠল। রাগে খানিকটা চেচিয়ে শানকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
–“শান এসব তুমি কি করছো? আমি কি বলছি তুমি শুনতে পারছো না? জানো, এই মেয়েটা আজকে কি করেছে? আশুকে বাসা থেকে পালাতে সাহায্য করেছে। সমস্ত গেস্টদের সামনে আমার মান-সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। আর তুমি এই মেয়েটাকে কিছু না বলে ওকে এখানে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে আছো?”
হৃদানের কথায় শানের বিন্দুমাত্রও নড়চড় হলো না। ‘ও’ আগের থেকেও আরো শক্ত করে হৃদানের হাত চেপে ধরল। হৃদান হাতে ভিষণ ব্যাথা পেলেও সেটা কাউকে বুঝতে দিল না। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে নমনীয় স্বরে বলল,
–“দেখো শান, ভিতরে সব গেস্টরা অপেক্ষা করছে। এখন যদি বিয়েটা না হয় তাহলে তোমার আর আমার দুজনেরই মান-সম্মান সব শেষ হয়ে যাবে। সমস্ত ইনভেস্টটারদের সামনে আমাদের নাক কাটা যাবে। তাই প্লিজ তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো। এই মুহূর্তে আমাদের সবার সম্মান বাঁচানোর জন্যে হলেও আমার আর রুশার বিয়েটা দিতে তুমি সাহায্য করো।”
এতক্ষণ অগ্নিমূর্তি হয়ে ঠায় দাড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটা হৃদানের এবারের কথা শুনে নিজের সমস্ত ধৈর্য শক্তি হারিয়ে ফেলল। হৃদান মুখ থেকে আরেকটা সিজ্ঞেল শব্দ উচ্চারণ করার আগেই শান ওর হাতে বন্ধি থাকা হৃদানের হাতটাকে উল্টোদিকে পরপর দুটো মোচড় দিয়ে ছেড়ে দিল। সাথে সাথে হৃদান ভূবন কাঁপানো একটা চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। হৃদানের চিৎকারের শব্দে ভিতর থেকে সব গেস্ট’রা একে একে দৌড়ে বাইরে বেড়িয়ে আসতে লাগল। হৃদান ওর মুচড়ে যাওয়া হাতটা চেপে ধরে গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে লাগল। শান হিংস্র সিংহের ন্যায় বিকট শব্দে গর্জে উঠে বলল,
–“সি ইজ মাই লিগেলি ম্যারেড ওয়াইফ। তোর এত বড় কলিজা তুই শেষ পযর্ন্ত কিনা আমার ওয়াইফের দিকে হাত বাড়ালি? একবারও ভাবলি না, আমি জানতে পারলে তোর এই স্পর্ধার পরিনাম কতোটা ভয়ংকর হবে?”
শানের কথায় হৃদান চারশো চল্লিশ বোল্টের শকড খেলো। ওর চোখে মুখে মুহূর্তের মধ্যে যেন ভয় এবং আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠল। শান আর রুশার ফ্যামিলির লোকেরা সবাই টাস্কি খেয়ে দাড়িয়ে রইল। ওরা কাহিনীর আগা মাথা কিছু বুঝতে না পারলেও শানের বলা কথাটা স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে। যেটা ওদের মস্তিষ্ক পযর্ন্ত পৌছাতেই ওরা সবাই হতবম্ভ হয়ে গেছে। শান হৃদানকে আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুশা সেন্সলেস হয়ে নিজের সব ভর শানের উপর ছেড়ে দিল। শান পরম যত্নে নিজের এক হাত রুশার মাথার পিছনে দিয়ে ওকে বুকের সাথে আগলে নিল। আশেপাশে একবার তাকিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিজের রাগটাকে সংবরন করে নিল। তারপর হৃদানের দিকে হিংস্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঠান্ডা গলায় শাসানোর ভঙ্গিতে বলল,
–“দশ মিনিটের মধ্যে তোর চৌদ্দ গুষ্ঠি নিয়ে এখান থেকে গায়েব হয়ে যাবি। দশ মিনিট পরে তোর ফ্যামিলির একটা মানুষের ছায়াও যদি এখানে দেখা যায়, তাহলে আজকেই সেটার শেষ দিন হবে। রিমেম্বার ইট।”
কথাটা বলে শান রুশাকে কোলে তুলে নিল। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পকেট থেকে চাবি বের করে গাড়ির দরজার লক খুলে রুশাকে ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে দিল। তারপর নিজেও গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে রুশার মাথাটা কাধের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে গাড়ি নিয়ে বাড়ির উদ্দ্যেশ্য রওনা দিল।
_________________________
সকাল 07:00
শান ওর রুমের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই একজন লেডি ডাক্তার ওর দিকে এগিয়ে আসলো। ‘ও’ বেডের উপরে শুয়ে থাকা রুশাকে দেখিয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল,
–“ওর এখন কি অবস্থা ম্যাম?”
ডাক্তার হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন। ব্যাথাতুর গলায় বললেন,
–“আঘাতপ্রাপ্ত জায়গা গুলোতে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি। আর একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছি, আপাতত ঘুমাচ্ছে। কিন্তু ওনার এমন অবস্থা হলো কীভাবে মিঃ রায়জাদা?”
ডাক্তারের প্রশ্নে শানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। ‘ও’ দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
–“একটা কাল সাপ পুষেছিলাম ডাঃ, তারই ফল এটা। আমার খেয়ে আমারই পিঠে ছু’ড়ি ঢুকিয়ে দিয়েছে।”
–“কাল সাপ না মিঃ রায়জাদা, জানোয়ার বলুন। কারন কোনো জানোয়ার ছাড়া এমন নির্দয়ের মতো আচরন কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কখনো করতে পারে না।”
কথাটা বলে ডাক্তার মেয়েটা রুশার দিকে এগিয়ে গেল। শান প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা রুশার গায়ে থাকা কাঁথা টা সরিয়ে ওর হাঁটুর কাছে নামিয়ে রাখল। তারপর রুশার গায়ে পড়ে থাকা শর্ট টপ্স টা ওর পেটের উপর থেকে খানিকটা উপরে উঠিয়ে সরিয়ে দিল। শান ডাক্তারের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে রুশার উন্মুক্ত পেটের দিকে তাকাল। ডাক্তার চোখ-মুখ কুচকে বলল,
–“দেখুন তো কি অবস্থা করেছে। জানোয়ার ছাড়া কোনো মানুষ এভাবে কাউকে আঘাত করতে পারে?”
শান দেখল রুশার পেটে অনেকগুলো নখের আচড়ের দাগ। আচড়গুলো এতটাই গভীর যে দেখে মনে হচ্ছে কেউ ওর পেট থেকে মাংস খুবলে নিয়েছে। রুশাকে যখন শান এখানে নিয়ে এসেছিল তখনও ‘ও’ এই দাগগুলো দেখেছিল। কিন্তু ওই সময় রুশার মাথা আর গলার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে তখন এটা ওর অতোটা নজরে আসেনি। তবে এখন শুকনো র’ক্ত গুলো মুছে ফেলায় কালসিটে পড়ে যাওয়া নখের আচড় গুলো সাংঘাতিক দেখাচ্ছে। শান চোখ জোড়া বন্ধ করে অন্যদিকে ঘুরে গেল। রাগে ওর কপালের রগ ফুলে উঠল। ডাক্তার মেয়েটা রুশার জামাটা নামিয়ে দিয়ে। ওর গায়ে আবারও পাতলা কাঁথা টা জড়িয়ে দিলেন। শান নিজের রাগটাকে সংযত করে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে রুশার পাশে বসল। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে রুশার ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
–“আই প্রমিস রুশা, তুমি যতটা না কষ্ট পেয়েছো তার থেকে হাজারগুন বেশি কষ্ট আমি ওই জানোয়ারটাকে দিব। ‘ও’ তোমার থেকেও বেশি ছটফট করবে। ওকে আমি রাস্তায় নামিয়ে আনব।”
কথাটা বলে রুশার কপালের ব্যান্ডেজের উপর থেকেই শান ওর কপালে গভীর ভাবে ঠোঁট ছোয়াল। এতক্ষণ রুশার বেডের অন্যপাশে দাড়িয়ে থাকা নার্স দুজন লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে ঘুরে গেল। ডাক্তার মুচকি একটা হাঁসি দিয়ে ঔষধ গুলো হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলেন। শান রুশার কানের সাইডে পড়ে থাকা ছোট্ট চুলগুলো ওর কানের পিছনে আলতো করে গুজে দিয়ে ওখান থেকে উঠে বাইরে চলে গেল।
_________________________
সকাল আটটার দিকে শান আবারও ওর রুমে এসে কাবার্ড খুলে নিজের জামা-কাপড় নিয়ে বের হয়ে পাশের গেস্ট রুমে চলে গেল। গতকাল রাত থেকে ‘ও’ এখনো সেইম জামা-কাপড়ই পড়ে আছে। এত এত ঝামেলার মধ্যে চেইঞ্জ করারই সুযোগ পায়নি। সারা রাত ধরে যখন রুশার ট্রিটমেন্ট করা হচ্ছিল তখন ‘ও’ রুমের বাইরেই ঠায় দাড়িয়ে ছিল। টেনশনে কোথাও একদন্ড সময় বসতে অবদি পারেনি। বাড়িতে আসার পরপরই ‘ও’ বাড়ির ল্যান্ডলাইন থেকে ওর পরিচিত একজন ডাক্তারকে কল করে। সবটা শুনে ডাক্তার দ্রুত ওনার মেডিকেল টিম নিয়ে এই বাড়িতে চলে আসেন। তারপর শানের থেকে সৃজার এক সেট ড্রেস নিয়ে রুশাকে চেইঞ্জ করিয়ে দ্রুত ওনারা ট্রিটমেন্ট শুরু করেন। রুশার অবস্থা খানিকটা কন্ট্রোলে আসলে দুজন নার্স আর ডাক্তার মেয়েটাকে ওর দ্বায়ীত্ব দিয়ে ওনারা সবাই হসপিটালে ফিরে যান।
শান শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে দ্রুত নিচে আসলো। টেবিলের উপরে গার্ডের রেখে যাওয়া নতুন ফোনটার দিকে নজর যেতেই ‘ও’ এগিয়ে গিয়ে ফোনটা হাতে নিল। আনপ্যাক করে ফোনটা প্যাকেট থেকে বের করে টেবিলের উপর রেখে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে পুরনো থেতলে যাওয়া ফোনটা বের করল। তারপর পুরনো ফোনের মধ্য থেকে সিমকার্ড টা বের করে নতুন ফোনে ঢুকিয়ে তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়ল।
হসপিটালের সামনে এসে গাড়ি থামতেই শান দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে ফোনে কথা বলতে বলতে হসপিটালের ভিতরে আসলো। রিসিভশন থেকে সবকিছু জেনে তিন তলায় এসে 305 নম্বর কেবিনের দিকে পাঁ বাড়াল। শান কেবিনের সামনে এসে দু-বার নক করে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেল সৃজা বেডের উপর শুয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। তার পাশেই রাখা একটা টু-বেড সোফার উপরে বসে আয়াশ ভ্রু কুচকে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। শানকে ভিতরে ঢুকতে দেখে আয়াশ বসা থেকে উঠে এসে শানের সামনে দাড়াল। শান গম্ভীর কণ্ঠে আয়াশকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
–“বাকিদের কি অবস্থা? কোথায় আছে ওরা এখন?”
আয়াশ ক্লান্ত স্বরে বলল,
–“জোভান ছাড়া বাকি সবাই-ই ডেঞ্জারের বাইরে আছে। ওদেরকে কেবিনে সিফ্ট করা হয়েছে। আর জোভানকে ডাক্তারেরা 48 ঘন্টার জন্যে ওনাদের অবজারবেশনে নিয়ে গেছেন। এরমধ্যে ওর হুশ আসলে ওকেও কেবিনে সিফ্ট করে দিবেন।”
শান ফোশ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে কতোকিছু হয়ে গেল। আরেকটু এদিক ওদিক হলে এর থেকেও হয়ত ভয়ংকর কিছু একটা হয়ে যেত। তবে এ্যাট লাস্ট আল্লাহর রহমতে সবাই-ই যে ঠিকঠাক আছে এটা ভেবেই শান একটা সস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। শানের ভাবনার মধ্যে আয়াশ ভ্রু কুচকে বলল,
–“আচ্ছা সৃজার সাথে তো রুশাও ওই বাড়িতে ছিল। তাহলে ‘ও’ কোথায় গেল? আমি যখন ওখানে গিয়ে পৌছালাম তখন তো ‘ও’ ওখানে ছিল না?”
শান নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
–“থাকবে কীভাবে? হৃদান ওকে মে’রে আগেই বস্তা ভরে পানিতে ফেলে দিয়েছিল।”
শানের কথায় আয়াশ চমকে উঠল। চেচিয়ে উঠে বলল,
–“হোয়াট? আর ইউ কিডিং উইথ মি শান?”
শান চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
–“ইয়াহ, তবে তোমাদের এসব স্টুপিড প্লানের জন্যে এমন কিছু হলেও হতে পারতো। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া যে উনি ওই জানোয়ারটার থেকে সবাইকে প্রানে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।”
শানের কথায় আয়াশ মুখ বাঁকাল। বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বলল,
–“আমাদের স্টুপিড প্লানের জন্যেই তোমার আরেক বোনের প্রান বেঁচে গেছে। নাহলে ওই অসভ্যটা ওকে বিয়ে করে নিয়ে গিয়ে সারাজীবন ওকে কষ্ট দিতে দিতে তিলে তিলে শেষ করে দিত।”
আয়াশের কথার প্রতিউত্তরে শান কি বলবে কিছু বুঝতে পারল না। তাই কোমড়ে হাত দিয়ে বিরক্তির দৃষ্টিতে আয়াশের দিকে তাকিয়ে রইল। আয়াশ সেসবে তোয়াক্কা না করে আবারও গিয়ে সোফার উপরে বসে চুপচাপ ফোন স্ক্রল করায় মনোযোগ দিল। শান কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে নিজেও একটা চেয়ার টেনে সৃজার বেডের পাশে বসে পড়ল।
#চলবে….