অব্যক্ত ভালোবাসা পর্ব -২৯

#অব্যক্ত_ভালোবাসা
#লেখনীঃআরভি_আহিয়াদ_তিহু
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্বঃ২৯

রাত মোটামুটি এগারোটা বাজে। ব‍্যস্ত রাস্তা দিয়ে ড্রাইভ করে রুশা বাসায় ফিরছে। চোখের সামনে বারবার ভিডিওর সেই দৃশ‍্য গুলো ভেষে উঠছে। চেষ্টা করেও কিছুতেই ওসব ভুলতে পারছে না। কীভাবেই বা ভুলবে? এত ভয়ংকর, লোমহর্ষক একটা ঘটনা, চাইলেই কি এত সহজে সেটা ভোলা যায়?

রুশা বাসার সামনে আসতেই সিকিউরিটি গার্ড গেট খুলে দিল। ‘ও’ গাড়ি নিয়ে ভিতরে ঢুকে পার্কিংজোনে গাড়িটা রেখে পাঁ বাড়াল লিফটের দিকে। লিফটে উঠে উপরে এসে নিজের ফ্লাটের সামনে গিয়ে দাড়াল। সাইড ব‍্যাগের চেইন খুলে ব‍্যাগের পকেট থেকে চাবি বের করে দরজার লক খুলল। কিন্তু বাসার ভিতরে পাঁ রাখতে যাবে তার আগেই ওর মনে হলো ওর পিছনে কেউ দাড়িয়ে আছে। রুশা এক হাত দরজার লকের উপর রেখেই ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। পিছনে তাকিয়ে ‘ও’ চমকে উঠল। রুশার ফ্লাটের বিপরীতে যে ফ্লাট’টা আছে সেটার দরজার সাথে কাৎ হয়ে হেলান দিয়ে বুঁকের সাথে দু-হাত গুজে পাঁ ক্রস করে দাড়িয়ে আছে শান। শানের পলকহীন সুক্ষ দৃষ্টি রুশার দিকেই নিবদ্ধ। রুশা গোল গোল চোখে কয়েক সেকেন্ড শানের দিকে তাকিয়ে রইল। দেখল, শানের মধ‍্যে কোনো ভাবান্তর নেই। তার পুরো শরীর কেমন স্থিতাবস্থায় আছে। রুশা ঘাবড়ে গেল। ‘ও’ কয়েকবার চোখের পলক ফেলে আশেপাশে তাকাল। নাহ, এখানে কোনো মানুষ জনের নাম-গন্ধও নেই। সবাই সবার ফ্লাটের ভিতরে আছে। আর এত রাতে শানেরও এখানে থাকার কথা না। তাহলে কি এসব রুশার চোখের ভ্রম? না-কি ‘ও’ আজকে যেই ঘটনাটা চোখের সামনে দেখেছে সেটার জন‍্যেই অতিরিক্ত ভয়ে চোখের সামনে এসব দেখতে পাচ্ছে? ওখানে দাড়িয়ে আর বেশি কিছু ভাবতে পারল না রুশা। দ্রুত পাঁয়ে বাসার ভিতরে ঢুকে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিল। অনুভব করল হাত-পাঁ অসম্ভব কাঁপছে। চোখের সামনে সবকিছু কেমন আবছা হয়ে আসছে। রুশা এলোমেলো পাঁয়ে এগিয়ে গিয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে বেডের উপরে এলিয়ে দিল। সারাটা জীবন তো একা-একাই কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজকের মতো এত ভয় তো কখনো পায়নি। তাহলে আজকে হঠাৎ কি হলো ওর? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রুশার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসলো। শরীর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে হতে একেবারে নির্জীব হয়ে গেল।
_________________________

সকালবেলা অনবরত কলিংবেল বাজার শব্দে ধরফর করে উঠে বসল রুশা। আশেপাশে তাকিয়ে ভালো করে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে ফোশ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ব‍েডের সাইডে পড়ে থাকা ব‍্যাগটা ঝটফট হাতে নিয়ে তারথেকে ফোনটা বের করে ফোনের স্কিনে তাকিয়ে একবার সময়টা দেখে নিল। 9:40 বাজে। রুশা বিরবির করে বলল,
–“ওহ শিট! এতক্ষণ ঘুমিয়েছি?”

কলিংবেল এখনো অনবরত বেজে চলছে। রুশা তড়িৎ গতিতে উঠে দরজার দিকে এক প্রকার ছুটে এগিয়ে গেল। তারপর দ্রুত হাতে দরজার লক খুলে দিয়ে সামনে তাকাল। সামনে তাকানোর সাথে সাথে ওর ফোনটা ঠাস করে ফ্লোরে পড়ে গেল। ‘ও’ হতবিহ্বল দৃষ্টিতে সামনে দাড়িয়ে থাকা ব‍্যাক্তিটির দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করল,
–“শ-শ-শান!”

শান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুশার দিকেই তাকিয়ে আছে। রুশা ফ‍্যালফ‍্যাল করে শানের দিকে তাকিয়ে ওর পাঁ থেকে মাথা পযর্ন্ত পর্যবেক্ষণ করে বোঝার চেষ্টা করছে শান সত‍্যিই ওর চোখের সামনে দাড়িয়ে আছে, না-কি ‘ও’ আবারও ভ্রম দেখছে। রুশাকে চুপ করে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শান ধমকের স্বরে বলে উঠল,

–“রাতে ঘুমানোর সময় কি কানের মধ‍্যে তুলো গুজে ঘুমাও? আমি অলমোস্ট তিন মিনিট ধরে একটানা কলিংবেল বাজিয়ে যাচ্ছি। আর তোমার এখন উঠে এসে দরজা খোলার সময় হলো?”

শানের ধমকে রুশার হুশ আসলো। ‘ও’ বুঝল শান সত‍্যিই ওর সামনে দাড়িয়ে আছে। কিন্তু কীভাবে? শান এখানের এড্রেস কোথায় পেল? আর হঠাৎ করে এখানে এলোই বা কেন? মনে মনে নিজেকে নিজে প্রশ্নটা করে, খানিকটা স্বাভাবিক গলায় ভ্রু কুচকে শানকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে জিজ্ঞেস করল,

–“হঠাৎ আপনি এখানে? কীভাবে? আর কেন?”

শান রুশার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। থমথমে কণ্ঠে বলে উঠল,
–“আম্মু তোমাকে ব্রেকফাস্ট করার জন‍্যে ডাকছে।”

শানের কথা রুশা শুনল ঠিকই। কিন্তু মানেটা বুঝতে পারল না। ‘ও’ কনফিউজড হয়ে জিজ্ঞেস করল,
–“বড়-মা ডাকছে মানে? কোথায় ডাকছে?”

শান কিছু বলতে যাবে। তার আগেই সামনের ফ্লাটের হালকা ভিড়িয়ে রাখা দরজাটা খুলে সৃজা মাথা বের করে হাসিমুখে বলে উঠল,
–“এইযে, এখানে ডাকছে। চলে এসো তাড়াতাড়ি।”

রুশা এতক্ষণ শুধু অবাকের মধ‍্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এইবার ‘ও’ কয়েক-শো বোল্টের শকড খেয়ে স্টাচু হয়ে গেল। শান আর কিছু না বলে গটগট করে পাঁ ফেলে সামনের ফ্লাটের মধ‍্যে ঢুকে গেল। সৃজা হাঁসতে হাঁসতে বাইরে বের হয়ে এসে রুশাকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে বলে উঠল,

–“এত শকড হওয়ার কিছু নেই। আমাদের বাড়ি থেকে আসার পর তুমি তো একবারও আর আমাদের বাড়িতে ফিরে গেলে না। ফোন দিয়ে আমাদের কারো একটু খোঁজ-খবরও নিলে না। তাই আমরাই তোমার খোঁজ-খবর নিতে চলে এলাম। তাও আবার একদম পার্মানেন্টলি।”

–“কিহ?”

–“হ‍্যাঁ। এখন এখানে দাড়িয়ে, দাড়িয়ে মুখ হা করে হাওয়া বাতাস না খেয়ে ভিতরে চলো। আম্মু অনেকক্ষণ যাবৎ তোমার জন‍্যে অপেক্ষা করে বসে আছে।”

কথাটা বলে সৃজা রুশার হাত ধরে টেনে সামনের ফ্লাট’টার ভিতরে নিয়ে গেল। ভিতরে ঢুকতেই রুশার চোখ গেল শানের দিকে। শান এক পাশের সোফার উপরে বসে বসে কফি খাচ্ছে আর ফোন স্ক্রল করছে। তার পাশেই রাহেলা রায়জাদা বসে বসে স্নাক্সের প্লেট সাজাচ্ছে। রুশাকে ভিতরে আসতে দেখে রাহেলা রায়জাদা উঠে এসে রুশাকে বুঁকে টেনে নিলেন। তারপর ওকে ছেড়ে দিয়ে এক হাত ওর গালে রেখে নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
–“কেমন আছিস মা? তোর শরীরের এখন কি অবস্থা?”

–“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি বড়-মা। কিন্তু তোমরা সবাই এখানে কীভাবে?”

রাহেলা রায়জাদা রুশার গাল থেকে হাত নামিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন,
–“আর বলিস না, সুজির ভার্সিটি থেকে সিলেক্টিভ কিছু স্টুডেন্ট’রা একজন ফেমাস ডিজাইনারের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। তাদের মধ‍্যে সুজিও আছে। কিন্তু আমাদের বাসা থেকে ওনার অফিস’টা অনেক দূরে। একে তো মেয়েটা অসুস্থ, তার-উপর ট্রেনিংয়ের জন‍্যে সেখানে রেগুলার যাতায়াত করতে হবে। তাই অনেক ভেবে-চিন্তে আমি আর সুজির বাবা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যে-যতদিন পযর্ন্ত না ওর ট্রেনিং শেষ হচ্ছে, ততদিন পযর্ন্ত ‘ও’ এই বাসায় রেন্টে থেকেই সেখানে যাতায়াত করবে। আর আমাদের কপালটাও দেখ, এখানে এসে আমরা তোকেও পেয়ে গেলাম। এইবার আমি তোর ভরসায় ওকে রেখে নিশ্চিন্তে বাড়িতে যেতে পারব।”

রাহেলা রায়জাদার কথাটা রুশার তেমন একটা হজম হলো না। তাই ‘ও’ কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,

–“তোমরা কীভাবে জানলে সামনের ফ্লাট’টায় আমি থাকি? গতকাল থেকে তোমাদের সাথে তো আমার একবারও দেখা হয়নি। আর তাছাড়া তোমাদের কাছে আমার বাসার এড্রেসও ছিল না, তাহলে?”

রুশার প্রশ্নে রাহেলা রায়জাদা মোটেও বিচলিত হলেন না। আগে থেকেই সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা কথার মতো কণ্ঠে বেশ স্বাভাবিকতা রেখেই বলে উঠলেন,

–“আমরা কেউই জানতাম না তুই এখানে থাকিস। জানলে তো তোকে কল করে জানিয়েই এখানে আসতাম। কালকে রাতে শান ছাঁদে যাওয়ার জন‍্যে বের হয়েছিল। তখনই না-কি ‘ও’ তোকে ওই বাসায় ঢুকতে দেখেছে। সকালে উঠে আমাকে সবটা বলল। তাই আমি ওকে বললাম তোকে ডেকে নিয়ে আসার জন‍্যে।”

এতটা কনফিডেন্ট নিয়ে বলার পরেও কথাটা রুশার মোটেও বিশ্বাসযোগ‍্য মনে হলো না। কিন্তু তাও ‘ও’ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। মুখভঙ্গি বেশ স্বাভাবিক রেখেই কথাটা চুপচাপ শুনে গেল। রাহেলা রায়জাদা গিয়ে আবারও সোফায় বসতে বসতে বলে উঠলেন,

–“যা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি তোর জন‍্যেও ব্রেকফাস্ট রেডি করেছি। প্রতিদিন তো একা একাই ব্রেকফাস্ট করিস। আজকের ব্রেকফাস্ট টা নাহয় আমাদের সাথেই করলি।”

রুশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই শান ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখে কটাক্ষ করে বলে উঠল,
–“ফ্রেশ হওয়ার কি দরকার? যে মেয়ে সারাদিন হসপিটালে ডিউটি করে বাসায় এসে ড্রেস চেইঞ্জ না করেই নাক ডেকে ঘুমোতে পারে। সে হাত-মুখ না ধুয়ে ব্রেকফাস্টও করতে পারবে। নোংরা মানুষদের ফ্রেশ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না আম্মু।”

শানের কথায় রাহেলা রায়জাদা কঠিন দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকালেন। কিন্তু শান তাতে বিন্দুমাত্রও ভ্রুক্ষেপ দেখাল না। অপমানে রুশার সারা-শরীর জ্বলে গেল। ‘ও’ অগ্নি দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
–“ঘুমিয়ে পড়িনি, সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম। আর সেন্সলেস হওয়া মানুষ কখনো নিজের ড্রেস নিজে চেইঞ্জ করতে পারে না, সেইটুকু বোধ আপনার মধ‍্যে নিশ্চয়ই আছে মিঃ রায়জাদা?”

শান এতক্ষণে ফোন থেকে দৃষ্টি উঠিয়ে রুশার দিকে তাকাল। খানিকটা অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
–“সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে মানে? কীভাবে সেন্সলেস হলে? যখন বাসায় ঢুকছিলে তখনও তো ঠিকঠাক-ই ছিলে। তাহলে হঠাৎ সেন্সলেস হয়ে গেলে কী-কারনে?”

রুশা শানের প্রশ্নের প্রতিউত্তরে ওর দিকে একটা কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তারপর রাহেলা রায়জাদাকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে বলল,
–“অলরেডি আমার অনেকটা লেইট হয়ে গেছে বড়-মা। এখন আর ব্রেকফাস্ট করার সময় হবে না। আমাকে এখনই ফ্রেশ হয়ে হসপিটালের উদ্দ‍্যেশে বের হয়ে যেতে হবে। আর তাছাড়া তোমার ছেলেও নিশ্চয়ই চাইবে না কোনো নোংরা মানুষের সাথে একসাথে বসে ব্রেকফাস্ট করতে? তাই আজকে থাক। আমরা নাহয় অন‍্য একদিন একসাথে বসে ব্রেকফাস্ট করব?”

কথাটা বলে রুশা আর এক মুহূর্তও ওখানে দাড়াল না। বড় বড় পাঁ ফেলে ওই ফ্লাট থেকে বের হয়ে আসলো। রুশা যেতেই রাহেলা রায়জাদা কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠলেন,
–“দিস ইজ টু মাচ শান। তোমার এরকম খাপছাড়া কথা বলার কারনে তোমাদের মধ‍্যের জটিলতা আরো বেড়ে যাবে। তোমার জন‍্যে ভালো এটাই হবে যে-তুমি সময় থাকতে নিজের মুখে লাগাম টানো। আর নিজের মধ‍্যের রুড স্বভাব টা একটু কমাও। নাহলে সিচুয়েশন যতটা খারাপ আছে, ভবিষ্যতে তারথেকে আরো বেশি খারাপ হবে।”
__________________
রুশা নিজের ফ্লাটে ঢুকে দরজা’টা আটকে ধপাস করে বেডের উপরে বসে পড়ল। রাগে ওর প্রতিটা শিরা জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই রাগের উৎস শানের বলা অপমান-জনক শব্দগুলো নয়। ওর রাগের মূল কারন শানের এখানে উপস্থিতি। শানের এখানে উপস্থিতি টা কোনো রকম কো-ইন্সিডেন্স যে না, সেটা রুশা ভালো করেই বুঝতে পারছে। ওর এখানে আসার প্রথান উদ্দ‍্যেশ‍্য’টা যে রুশা, সেটাও রুশার বুঝতে আর বাকি নেই। যেদিন শানদের বাড়ি থেকে আয়াশ আর রুশা চলে এসেছিল, সেদিনই পথে আসার সময় আয়াশ রুশাকে বিয়ের ব‍্যাপারে সবটা বলেছিল। বিয়ের ব‍্যাপারে শুনে রুশা যতটা না শকড হয়েছিল, তারথেকে বেশি ওর রাগ উঠেছিল শানের উপরে। ‘ও’ যখন কাগজ গুলোতে সাইন করেছিল, তখন ওর ধারনারও বাইরে ছিল যে শান বিয়ে নামক এরকম সিরিয়াস একটা বিষয় নিয়ে ওর সাথে এরকম বিশ্রি একটা গেম খেলবে।

সেদিন রুশা বাসায় আসতে না-আসতেই শান ওর ফোনে কল দিয়েছিল। আর জিজ্ঞেস করেছিল, কোন সাহসে রুশা ওর পারমিশন না নিয়ে ওই বাড়ি থেকে চলে আসলো। শানের এই প্রশ্নে রুশার রাগের মাত্রাটা তরতর করে বেড়ে গিয়েছিল। সেই সময়ে ওর মুখে যা এসেছে ‘ও’ তাই বলে শানকে গালি-গালাজ করেছে। এমনকি ওকে আর কোনোভাবে বিরক্ত করলে শানের নামে পুলিশ কেস করারও হুমকি দিয়েছে। রুশার কথাগুলো শুনে শান সেদিন একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছিল। পুরোটা সময় ধরে রুশার কথার মধ‍্যে একটা কথাও বলেনি। তার কিছুক্ষণ পর টুশ করে ফোনটা কেটে দিয়েছিল। সেই দিনের পর মাঝখানে আজকে প্রায় বিশ দিনের মতো কেটে গেছে। এরমধ‍্যে শান না রুশাকে কোনো কল করেছে। আর না সামনা-সামনি রুশার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এতে শানের প্রতি থাকা রুশার রাগ-ক্ষোপ একটুও কমেনি। বরং যত দিন অতিক্রম হয়েছে তত শানের প্রতি রুশার রাগ’টা বেড়েছে। সেই রাগের জন‍্যেই রুশা এখানে আসার পর সৃজারও খোঁজ-খবর নেয়নি। এমনকি ওই বাড়ির কারোরই খোঁজ নেয়নি। সৃজা কয়েকবার কল করেছিল ঠিকই। কিন্তু রুশা সেগুলো টোটালি ইগনোর করেছে।
_________________________

দুপুর বারোটার দিকে রুশা রাউন্ড চেকআপ শেষ করে নিজের কেবিনের দিকে পাঁ বাড়াল। দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে ডাঃ প্রিয়া এসে রুশার পথ আগলে দাড়াল। রুশা ডাঃ প্রিয়ার দিকে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠল,
–“এ‍্যানি প্রবলেম মিস প্রিয়া?”

প্রিয়া এপ্রোনের পকেটে দু-হাত ডুকিয়ে সোজা হয়ে দাড়াল। তারপর কণ্ঠে খানিকটা এ‍্যাটিটিউড এনে সোজাসাপ্টা ভাবেই বলল,
–“শুনলাম পাশের বিজ্ঞান ভবনের সাইন্স ল‍্যাবের এক্সেস কার্ড তুমি না-কি সবার থেকে নিয়ে নিয়েছো? আর পুরো ভবনে না-কি কড়া সিকিউরিটির ব‍্যাবস্থাও করা হয়েছে। কি কারনে জানতে পারি?”

রুশা স্বাভাবিক স্বরে জবাব দিল,
–“সরি, এই বিষয়ে আমার কোনো আইডিয়া নেই। আমি যা করার অথোরিটির নির্দেশে করেছি। আপনার কিছু জানার থাকলে আপনি বোর্ড মেম্বারদের সাথে কথা বলুন।”

–“এই বিষয়ে তোমার কোনো আইডিয়া না থাকলে তুমি ওখানের এ‍ক্সেস কার্ড পেলে কোথায়? আর ওখানে ঢোকার পারমিশন-ই বা পেলে কীভাবে? এই হসপিটালের অন‍্য কোনো ডাক্তারেরা তো ওখানে ঢোকার এক্সেস কার্ড পায়নি। বরং রবিন স‍্যার নিজে তাদের কড়া ভাবে আদেশ করে দিয়েছেন যাতে ওই ভবনের চারপাশেও কেউ না যায়। আর তোমাকে তো দেখলাম, একটু আগে দিব্বি ওখানে ঢুকে আবার বের হয়ে আসলে। ব‍্যাপার’টা কি বলো তো? সবার অগোচরে কি খিচুরি পাকাচ্ছো তোমরা?”

রুশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই পাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠে কেউ একজন বলে উঠল,
–“সব ব‍্যাপারে নাক গলানোর অভ‍্যাস’টা বদলান ডাঃ প্রিয়া। নিজের ডিউটি’টা ঠিকভাবে পালন করুন। নাহলে তো ভবিষ্যতে আপনার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।”

কণ্ঠের উৎসের খোঁজে রুশা আর প্রিয়া দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাল। পাশে তাকিয়ে আশিষকে থমথমে মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে প্রিয়া কিছুটা ভরকে গেল। ‘ও’ থতমত খাওয়া কণ্ঠে বলল,

–“না মানে স‍্যার, আসলে আমি কৌতূহল-বশত ব‍্যাপার’টা জানতে চাইছিলাম আরকি। হঠাৎ করে ওখানে এত সিকিউরিটির ব‍্যবস্থা করা কেন হয়েছে সেটা বুঝতে পারছিলাম তাই আ…….”

প্রিয়াকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে আশিষ কণ্ঠে গাম্ভীর্য’তা রেখেই বলে উঠল,
–“এতটাও কৌতূহল দেখাবেন না, যাতে পরে আপনাকে বিপদে পড়তে হয়। যান গিয়ে নিজের কাজ করুন।”

আশিষের কথা’টা বলতে দেড়ি হলো। কিন্তু প্রিয়া ওখান থেকে যেতে দেরি হলো না। প্রিয়া এক প্রকার দৌড়ে ওখান থেকে চলে গেল। ‘ও’ যেতেই আশিষ এগিয়ে এসে রুশার সামনে দাড়িয়ে সতর্ক গলায় বলল,

–“এই মেয়ের থেকে সাবধান রুশা। এর ব্রেনের ভেইনের প্রত‍্যেকটা প‍্যাচে প‍্যাচে কিন্তু শয়তানি বুদ্ধি। এর সামনে ভুলেও নিজের মুখ খুলবে না। আর এক্সেস কার্ড’টা সব সময় সামলে রাখবে। ওটা কারো হাতে পড়লেই কিন্তু মহাবিপদ।”

আশিষের কথায় রুশা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। আশিষ নিজের প‍্যান্টের পকেট থেকে চিকন বেল্টের একটা স্মার্ট ওয়াচ বের করে রুশার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করল। রুশা বিনা-বাক‍্যে ওয়াচ’টা হাতে পড়ে নিল। রুশা তাকিয়ে দেখল আশিষের হাতেও সেম ডিজাইনের একটা ওয়াচ। শুধু রুশার’টার বেল্ট হোয়াইট আর আশিষের’টা ব্লাক। আশিষ চাপা কণ্ঠে বলল,

–“এটাকেও সাবধানে রেখো। আর টুয়েন্টি-ফোর আওয়ার’স অন করে রাখবে। ভুলেও যেন এটার চার্জ শেষ হয়ে অফ হয়ে না যায়।”
_________________________

রাত 11:00

আশিষ শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে দেখল আশু রুমের কোথাও নেই। রুমের দরজাও ভেতর থেকে লক করা। ব‍্যালকনির দরজার দিকে ওর চোখ যেতেই ধারনা করল আশু হয়ত ব‍্যালকনিতেই আছে। আশিষ ওর হাতে থাকা টাওয়েল’টা দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ব‍্যালকনির দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ব‍্যালকনির দরজা’টা ভিড়িয়ে রাখা। আশিষ দরজা’টা ঠেলে ভিতরে ঢুকে ব‍্যালকনিতে থাকা রঙিন লাইটের সুইচ টা অন করে দিল। লাইট অন করতেই দেখতে পেল আশু রেলিংয়ে দু-হাত রেখে শূন‍্য দৃষ্টিতে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। রেলিংয়ের উপরে যেখানে ওর হাত দুটো রাখা তার পাশেই ওর সেলফ ফোন’টা রাখা আছে। ওর চোখে মুখে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। আশিষ ধীর পাঁয়ে আশুর দিকে এগিয়ে গেল। তারপর আশুর পিছনে দাড়িয়ে নিজের দু-হাত আশুর দু-পাশের রেলিংয়ের উপরে রেখে ওর পিঠের সাথে নিজের বুঁক ঠেকিয়ে নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
–“কি ব‍্যাপার? মন খারাপ কেন? কেউ কিছু বলেছে?”

আশিষের উপস্থিতিতে আশু বিন্দুমাত্রও বিচলিত হলো না। আগের মতোই ঠায় দাড়িয়ে থেকে বিষন্ন গলায় বলে উঠল,
–“শান ভাইয়া আজকেও আমার ফোন’টা রিসিভ করল না। ভাইয়া বোধহয় আর কখনো আমার সাথে কথা বলবে না। আচ্ছা, আমি কি এতটাই বড় অন‍্যায় করে ফেলেছি যে আমার সাথে কথা বলতেও এখন ভাইয়ার ঘৃনা লাগছে?”

আশুর গলার স্বর’টা ভারী হয়ে আসলো। আশিষ রেলিং থেকে এক হাত নামিয়ে আশুর পেটের সামনের অংশে রেখে ওকে পেচিয়ে নিজের সাথে আগলে নিল। তারপর পিছন থেকে ওর গালের সাথে নিজের গাল আলত করে স্পর্শ করে নরম স্বরে বলে উঠল,

–“আবারও একই কথা বলছো? এসব নিয়ে তোমাকে মন খারাপ করতে বারন করেছি না আশু? আমি তো বললাম, আমি সব ঠিক করে দিব। রিসিভশন পার্টিতে শান তো আসছে। দরকার হলে ওইদিন আমি নিজে ওর কাছে গিয়ে মাফ চাইব। তারপর দেখবে, শান ঠিক তোমার সাথে কথা বলবে। তোমার সাথে আর রাগ করে থাকতে পারবে না। প্লিজ এসব নিয়ে আর মন খারাপ কোরো না।”

আশিষের কথায় আশুর এতক্ষণের চেপে রাখা কষ্টগুলো উপচে বেড়িয়ে আসলো। ‘ও’ চোখ জোড়া বন্ধ করে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। কান্নাভেজা কণ্ঠে ফোপাতে ফোপাতে বলে উঠল,

–“আমার একটুও ভালো লাগছে না আশিষ। ভিষণ খারাপ লাগছে। গিলটি ফিল হচ্ছে। আমার জন‍্যে পাপা, শান ভাইয়া, বড় মামু ওরা সবাই গেস্টদের কাছে অপমানিত হয়েছে। আমি ওদের সবার কাছে সারাজীবনের জন‍্যে অপরাধী হয়ে গেলাম আশিষ। ওরা আমাকে কোনোদিনও ক্ষমা করবে না। আমি হয়ত আর কোনোদিনও ওদের সামনে গিয়ে মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারব না।”

আশুর কান্নার শব্দ শুনে আশিষ ওকে নিজের দিকে ঘোরাল। তারপর স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আশুর কান্নারত মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। আশুর কান্নার বেগ আগের থেকে আরো বেড়ে গেল। আশিষ আলত হাতে আশুর গালে গড়িয়ে পড়া পানিটুকু মুছে দিতে দিতে বলল,

–“আবারও কান্নাকাটি শুরু করেছো? তোমাকে আমি হাজার বার বলেছি আশু, আমার সামনে একদম কান্নাকাটি করবে না। তোমাকে কাঁদতে দেখলে আমার একদম ভালো লাগে না। আমার কথার কি তোমার কাছে একটুও দাম নেই?”

শেষের কথাটা আশিষ খানিকটা বিরক্তিভরা কণ্ঠেই বলে উঠল। এতে আশু বেশ রেগে গেল। আচমকা আশিষের বুঁকে জোরে ধাক্কা মেরে ওকে নিজের থেকে খানিকটা দূরে সরিয়ে দিয়ে কান্নাভেজা-খিটখিটে গলায় বলল,

–“তুমি আমার কষ্ট’টা কোনদিনও বুঝতে পারবে না। তাই অযথা আমাকে কিছু বোঝাতেও এসো না। দূরে থাকো আমার থেকে। একদম আমার চারপাশেও আসবে না।”

কথাটা বলে আশু গটগট করে রুমের মধ‍্যে চলে গেল। আশিষের মেজাজ’টা চরম মাত্রায় খারাপ হয়ে গেল। এই মেয়েটাকে যতই বোঝানোর চেষ্টা করছে, ততই যেন মেয়েটা আরো অবুঝ হয়ে যাচ্ছে। আরেহ ওরও তো বোঝা উচিৎ যে এই সিচুয়েশনে ‘ও’ শুধু একা না, আশিষও পড়েছে। আশিষকেও ওর ফ‍্যামিলি-আত্মীয় স্বজনদের কাছে ছোট হতে হয়েছে। তাদের সবার কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছে। কই তাও তো আশিষ কান্নাকাটি করছে না। আর ওকেও কোনো কিছুর জন‍্যে ব্লেম করতে যাচ্ছে না। তাহলে ‘ও’ কেন বারবার অবুঝের মতো বিহেব করছে? ওদের তো আগে থেকেই জানা ছিল যে ওরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলে ওদের ফ‍্যামিলির লোকদের প্রতিক্রিয়া এমনটাই হবে। তাহলে এখন অযথা রাগ দেখিয়ে লাভ কি? কথাগুলো ভেবে আশিষ রেগে জোরে-জোরে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করল। ওর একটাই প্রবলেম। ‘ও’ আশুর বিষন্ন চেহারাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। আশিষের তো আশুর সেই পুরনো হাসিমুখ’টা দেখার জন‍্যে মন উতলা হয়ে থাকে সবসময়, যেটা দেখে ‘ও’ আশুর প্রেমে পড়েছিল। কিন্তু আশু? সে যেন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে সারাক্ষণ বিষন্ন আর মনমরা হয়ে থাকার।

প্রায় মিনিট দশেক পর আশিষ নিজের মেজাজটাকে শান্ত করে রুমে ফিরে গেল। গিয়ে দেখল, আশু পাশ হয়ে শুয়ে একটা কোল-বালিশের সাথে মুখ গুজে ফুপিয়ে কাঁদছে। ফোপানোর জন‍্যে ওর শরীর বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। খোলা চুলগুলো এলোপাথাড়ি হয়ে মুখে আর পিঠে ছড়িয়ে আছে। আশিষ ধীর পাঁয়ে আশুর দিকে এগিয়ে গেল। কোনো শব্দ না করেই বেডের উপরে আশুর পাশে কাৎ হয়ে শুয়ে আলত হাতে আশুর ঘাড়ে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতে লাগল। আশু খানিকটা বিরক্ত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে কোল-বালিশটাকে ঝাপটে ধরে শক্ত হয়ে শুয়ে রইল। আশুর এমন কান্ডে আশিষ মুচকি হাঁসল। তারপর পিছন থেকে আশুকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে ওর ঘাড়ে একের পর এক ঠোঁট ছোয়াতে লাগল। আশিষের প্রত‍্যেকটা ছোয়ায় আশু কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগল। ধীরে ধীরে ওর কান্নার বেগ কমে আসলো। আশিষের নিঃশ্বাসের শব্দে আশুর হৃদ-স্পদন বেড়ে যেতে লাগল। আশিষ ঝট করে আশুর বাহু টেনে ওকে নিজের দিকে ঘোরাল। তারপর পরম যত্নে আশুর হালকা কম্পিত ঠোঁটকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিল। আশুও আবেশে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিজের প্রিয়তমকে আকড়ে ধরল। দুজনের স্পর্শগুলো ধীরে ধীরে গভীর হতে লাগল। একজনের নিঃশ্বাস এসে মিশ্রিত হলো অন‍্যজনের নিঃশ্বাসের সাথে। কিছু অনুভূতির আবির্ভাবে সৃষ্টি হলো একটা সুন্দর মুহূর্তের।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here