#অব্যক্ত_ভালোবাসা
#লেখনীঃআরভি_আহিয়াদ_তিহু
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্বঃ25
সৃজা বেডের সাথে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। শান চেয়ারে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সৃজার দিকেই তাকিয়ে আছে। আয়াশ বসে বসে ভ্রু কুচকে দুই ভাই বোনের কান্ড দেখছে। একটু আগে সেন্স আসার পর সৃজা শানকে শুরু থেকে একদম এখন পযর্ন্ত যা যা ঘটেছে সব পাই টু পাই বলে দিয়েছে। সবটা শুনে শান কিছুক্ষণ হতবম্ভ হয়ে বসে থেকে এখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সৃজার দিকে তাকিয়ে ওকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। সৃজা কাচুমাচু করছে। ওর মনে হচ্ছে ‘ও’ শানকে সবটা জানিয়ে ভুল করেছে। শান এক্ষুনি হয়ত বসা থেকে দাড়িয়ে ওর কানের নিচে ধপাস ধপাস করে দুই\তিনটা চড় বসিয়ে দিবে। সৃজার ভাবনাকে ভুল প্রমানিত করে শান হাতে তালি দিতে দিতে কটাক্ষ করে বলে উঠল,
–“ওয়াউ! গ্রেট! তোর আশু আপু তোর কাছে নিজের ভালোবাসার ব্যাপারে বলতে পারল। তোর রুশা আপুর কাছেও সবটা বলতে পারল। নিজের মায়ের কাছেও সবটা বলতে পারল। যেই ভাই সাত বছর ধরে এই শহরে থাকার পরেও কখনো ওর কোনো খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেনি, সেই ভাইকেও সবটা বলতে পারল। অথচ আমাকে এসে একবার বলতে পারল না ‘ও’ আশিষ কে ভালোবাসে? আমি কি এতটা খারাপ? ‘ও’ যদি একটা বার আমাকে এসে বলত ‘ও’ আশিষ কে ভালোবাসে, তাহলে আমি কখনো কি ওর বিয়ে হৃদানের সাথে ঠিক করতাম?”
কথাগুলো বলতে বলতে শানের গলা ভারি হয়ে আসলো। সৃজা চোরা চোখে একবার শানের দিকে তাকিয়ে আবারও মাথাটা নিচু করে নিল। তারপর মিনমিনে স্বরে বলল,
–“আশু আপু ভেবেছিল তুমি সবটা জানলে রেগে যাবে। আর তাছাড়া ফুপ্পিও আপুকে সুইসাইডের ভয় দেখিয়ে তোমাকে সবটা জানাতে বারন করেছিল।”
–“আর তুই? তোকে কে বারন করেছিল? তুই আমাকে এসে সবটা বললি না কেন? মানছি, তোদের সাথে আমার কখনোই আদরে গদগদ ভাবটা ছিল না। ছোট বোন হিসেবে আমি কখনো তোদেরকে তেমন ভাবে প্যাম্পার্ড করিনি। বাট দ্যাট নট মিন্স আমি তোদেরকে মোটেও ভালোবাসি না। আমি সব সময় তোদের পছন্দ-অপছন্দের যথেষ্ট খেয়াল রেখেছি। আচ্ছা এমন কি কখনো হয়েছে, তোরা নিজেদের পছন্দের কিছু আমার কাছে চেয়েছিস আর আমি জোড় করে তোদের উপরে আমার পছন্দের কিছু চাপিয়ে দিয়েছি? হয়নি তো? কজ আমি যেমনই হই না কেনো, আমি সবসময় তোদের পছন্দ-অপছন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছার গুরুত্ব সবার আগে দিয়ে এসেছি। আর এবারেও দিতাম, যদি তোরা আমাকে সবটা আগে থেকে বলে দিতি।”
সৃজা চুপ করে বসে রইল। শানের কথার প্রতিউত্তরে বলার মতো কোনো শব্দই ওর কাছে অবশিষ্ট নেই। কারন ওরা শানকে কিছু না জানিয়েই নিজেদের মতো করে ভেবে নিয়েছিল যে শান সবটা জানলে কখনো আশিষকে মেনে নিবে না। তাই শানকে বলার মতো সৃজা আর কোনো কথাই খুঁজে পেল না। সৃজাকে চুপ থাকতে দেখে আয়াশ শানকে উদ্দ্যেশ্য করে বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বলল,
–“তোমাকে সবটা বলবে কীভাবে? তোমার গাব্বার সিংয়ের মতো চেহারা দেখলেই তো সবার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যায়। আর তাছাড়া তুমি কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিয়েছো? সেদিন সৃজা আর রুশা ওই বেয়াদবটার সাথে কফি শপে দেখা করে বাড়িতে যাওয়ার পর তুমি ওর মিথ্যা কথা বিশ্বাস করে সৃজার গায়ে হাত তুলেছো। সৃজার থেকে ওর ফোন নিয়ে নিয়েছো, ওকে ধমকেছো। একটাবার ওকে জিজ্ঞেস পযর্ন্ত করোনি যে হৃদান যে কথাগুলো তোমাকে বলেছে সেগুলো আদৌ সত্যি কিনা।”
শান বলল,
–“তখন হৃদানের কথা অবিশ্বাস করার মতো আমার কাছে কোনো কারন ছিল না। সত্যি বলতে আমি ওকে ভিষণ বিশ্বাস করতাম। সেইজন্যেই আশুর সাথে ওর বিয়েটা ঠিক করেছিলাম। ওর কথাবার্তা, আচাড়-ব্যবহার, বিজনেসের প্রতি সিরিয়াসনেস দেখে আমার মনে হয়েছিল ওর সাথে আশুর বিয়েটা হলে আশু ভালো থাকবে। ওর কথা মিথ্যা ভাবার মতো অথবা ওকে সন্দেহ করার মতো আমি কখনো কোনো কারন খুঁজে পাইনি। আর তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম রুশার যেহেতু ওই পরিবারের সবার প্রতি একটা চাপা রাগ আছে। তাই সেই রাগ-ক্ষোপ থেকে ‘ও’ হৃদানের সাথে দেখা করে আশু আর হৃদানের বিয়েটা ভাঙতে চেয়েছে। কিন্তু রুশার সাথে রুড ব্যবহার করার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। সেইজন্যে রুশার উপরে থাকা রাগ আমি সৃজার উপরে সেদিন ঝেরেছি।”
কথাটা বলতে বলতে শান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আয়াশ মুখ বাঁকাল। কটাক্ষ করে বলল,
–“ভালো করেছো। এরজন্যে তুমি একটা অস্কার ডিজার্ভ করো। কিন্তু অনফরচুনেটলি অস্কারটা আমার কাছে নেই। তাই তোমাকে দিতে পারলাম না। আ’ম এক্সট্রেমলি সরি।”
কথাটা বলে আয়াশ ফোন চাপায় মনোযোগ দিল। শান বিরক্তির দৃষ্টিতে আয়াশের দিকে তাকিয়ে রইল। মাঝে মাঝে আয়াশের কথা শুনলে ওর ইচ্ছে করে এই ছেলের মুখে ধপাস-ধপাস করে দুটো খু’সি মেরে ওর নাকের স্টাকচার চেইঞ্জ করে দিতে।
_________________________
দুপুর ১ টার দিকে শান হসপিটাল থেকে সৃজার ডিসচার্জ করিয়ে আয়াশ আর সৃজাকে নিয়ে বাসায় আসলো। দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই মোহনা সিকদার, ইমদাদ সিকদার, আরাফ রায়জাদা এবং রাহেলা রায়জাদা এসে শানকে ঘিরে ধরে ওকে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগল। এদের এত প্রশ্ন শুনে আয়াশ বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুচকে ফেলল। শান ওনাদের সাইড কাটিয়ে হেঁটে গিয়ে সৃজাকে কোল থেকে নামিয়ে সোফার উপরে বসিয়ে দিল। তারপর ওনাদের সবাইকে উদ্দ্যেশ্য করে গম্ভীর গলায় বলল,
–“শুরু থেকে তোমাদের ডিটেইলে সবটা বলার মতো সময় এখন আমার হাতে নেই। তবে এইটুকু শুনে রাখো, গতকাল রুশা আর সৃজার সাথে যা হয়েছে, সবকিছু হৃদান করেছে। আর গতকালকে আশুর সাথে ডাঃ রবিনের ছেলে আশিষের বিয়ে হয়েছে। বর্তমানে আশু আশিষদের বাড়িতেই আছে। আর ওদের বিয়েটা ধর্মীয় মতে এবং আইনি মতে দুটো নিয়ম মেনেই হয়েছে। আশাকরি সবার কাছে সবটা ক্লিয়ার। এরপরেও যদি তোমাদের কারো কোনো প্রশ্ন থাকে তাহলে পরে কোরো। আপাতত আমি ভিষণ টায়ার্ড।”
শানের কথা শুনে সবাই রীতিমতো ঝটকা খেলেও মোহনা সিকদার তৈলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। উনি ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন,
–“বিয়ে মাই ফুট। মানি না আমি এই বিয়ে। আমি এখনই গিয়ে আশুকে ওখান থেকে নিয়ে আসব। আর ওই ছেলে সহ ওর চৌদ্দ গুষ্ঠিকে আমি জেলের ভাত খাওয়াব। দেখি আমাকে কে আটকায়।”
মোহনা সিকদার কথাটা বলার সাথে সাথে শান জ্বলন্ত চোখে ওনার দিকে তাকাল। চোয়াল শক্ত করে বলল,
–“খবরদার ফুপ্পি এটা নিয়ে একদম কোনো বাড়াবাড়ি করবে না। দুজন এডাল্ট মানুষ নিজেদের স্ব-ইচ্ছায় বিয়েটা করেছে। এরমধ্যে যদি তুমি নাক গলিয়েছো তাহলে সবার আগে আমি তোমাকে জেলের ভাত খাওয়াব।”
শানের কথা শুনে মোহনা সিকদার শকড হলেন। বাকিরাও সবাই বেশ অবাক হলো। কারন শান এর আগে কখনো কোনো গুরুজনদের সাথে এই টোনে কথা বলেনি। যত রেগেই থাকুক না কেন ‘ও’ সব সময়ই গুরুজনদের সাথে মার্জনীয় ভাবে কথা বলে। মোহনা সিকদার বিষ্ময় ভরা কণ্ঠে বললেন,
–“তুমি আমাকে হু’ম’কি দিচ্ছো শান? তুমি সবার সামনে দাড়িয়ে তোমার ফুপ্পিকে হু’ম’কি দিচ্ছো?”
–“হু’ম’কি দিচ্ছি না, শুধু তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। তুমি আশু আর আশিষের বিয়েটা নিয়ে যদি কোনো রকম সিনক্রিয়েট করো, অথবা ওই বাড়ির কাউকে হেনস্তা করার চেষ্টা করো, তাহলে আমি যেটা বলেছি আমি সত্যি সত্যি সেটাই করে দেখাব।”
শানের এরূপ কথায় মোহনা সিকদার ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। গলা উচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন,
–“বাহ, ভালো বললে তো। ওই ছেলেটা আমার মেয়েকে বাড়ি থেকে ভাগিয়ে নিয়ে গেল। আবার আমাদের কাউকে না জানিয়ে ‘ও’ আমার মেয়েকে ফাশিয়ে বিয়েও করে নিল। সমস্ত আত্মীয়স্বজনের কাছে ওদের জন্যে আমরা ছোট হয়ে গেলাম। ওদের জন্যে সোসাইটির কাছে আমাদের নাক কাটা গেল। আর তুমি এখানে দাড়িয়ে ওদের হয়ে আমাকে হু’ম’কি দিচ্ছো? লজ্জা করছে না তোমার?”
শান বলল,
–“তোমার মেয়েকে ‘ও’ ফাশিয়ে বিয়েটা করেনি। তোমার মেয়ে ওকে ভালোবাসে বলে স্ব-ইচ্ছায় বিয়েটা করেছে। আমি নিজে দাড়িয়ে থেকে ওদের বিয়েটা দিয়েছি।”
শানের কথা শুনে আয়াশ আর সৃজা দুজনেই টাস্কি খেল। মোহনা সিকদার চিল্লিয়ে উঠে বললেন,
–“হোয়াট? তুমি ওই ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিয়েছো? তোমার সাহস হলো কিভাবে এই কাজ করার? কার থেকে পারমিসান নিয়ে তুমি আমার মেয়ের বিয়ে ওই অসভ্য, ম্যানারলেস ছেলেটার কাছে দিয়েছো?”
শান একরোখা গলায় বলল,
–“কারো থেকে পারমিসান নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। আশুর জন্যে আমার তখন যেটা সঠিক মনে হয়েছিল, আমি সেটাই করেছি।”
শান কথাটা বলার সাথে সাথে রাহেলা রায়জাদা এগিয়ে এসে কষিয়ে ওর গালে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। চড়ের শব্দে ওখানে উপস্থিত সবাই স্তব্দ হয়ে গেল। রাহেলা রায়জাদা শানের সামনে তর্জনী আঙুল উঠিয়ে রাগী কণ্ঠে বললেন,
–“যাস্ট শাটআপ। একটা কথাও বলবে না তুমি। এত খামখেয়ালি করার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে হ্যাঁ? তুমি যদি আশিষের সাথেই আশুর বিয়েটা দিবে তাহলে হৃদানের সাথে ওর বিয়ে দেওয়ার নাম করে এত নাটক করতে গেলে কেন? কেন এত মানুষের সামনে আমাদের সবাইকে ছোট করে দিলে? আগেই বলতে পারতে তুমি আশিষের সাথে আশুর বিয়েটা দিতে চাও। তাহলেই তো আমরা সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিতাম। শুধু শুধু এত ড্রামা করে সবার সামনে আমাদের হিমিউলিয়েট করতে গেলে কেন? আমাদের মান-সম্মানের কি তোমার কাছে কোনো দাম নেই?”
শান চোখ জোড়া বন্ধ করে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। রাহেলা রায়জাদার কথা শেষ হতেই ‘ও’ ভারী গলায় বলে উঠল,
–“যা বলার আমি অলরেডি বলে দিয়েছি। আপাতত তোমাদের কাউকে আমার আর কিচ্ছু বলার নেই।”
কথাটা বলে শান এগিয়ে এসে সৃজার সামনে দাড়াল। সৃজা অপরাধীর দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকিয়ে রইল। শান সেসবে তোয়াক্কা না করে সৃজাকে কোলে তুলে নিয়ে উপরে যাওয়ার জন্যে সিড়ির দিকে হাঁটা দিল। আয়াশ সেখানেই থম মেরে দাড়িয়ে রইল। শানকে চড় মারাটা ওর কিছুতেই যেন হজম হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে সবাইকে সব সত্যিটা বলে দিতে। কিন্তু এখন সবাই যদি সত্যিটা জানতে পারে তাহলে মোটামুটি মিটমাট হয়ে যাওয়া বিষয়টা নিয়ে আরো বেশি সিনক্রিয়েট হতে পারে বলে আয়াশ তখনকার মতো নিজের মুখটা বন্ধ রাখল।
#চলবে