‘আই হেট ইউ। আই হেট ইউ মোর দেন মাই লাইফ।’
সুক্ষ্ম নরম চিকন ঠোঁটের ভাঁজে তাচ্ছিল্য হাসি নিয়ে খুব ধিক করে বাক্যটি বলল খাঁজওয়ালা গালের মেয়েটি। বাণীটি বলে নিয়েই হাতে ধরে থাকা গ্লাসের হুইস্কি টুকু এক চুমুকে খেয়ে ক্ষান্ত হলো সে। প্রতিদিন ড্রিংকস করার আগে কারো মুখ বন্ধ চোখের পাতায় ভাসিয়ে নিয়েই এই বাক্যটি বলে উঠে সেই মেয়ে। হ্যা, প্রতিদিন! কেনো কে জানে!
মেয়েটির পরনে বাহু কাটা হলুদ ওয়েস্টার্ন টপস আর সাদা জিন্স। পাশে ভদ্রতার খোলশ পরে থাকা ব্যক্তিটি সুযোগ পেয়ে মেয়েটির ফর্সা বাহুতে হালকা করে হাত রেখে বাঁকা হেসে বলল,
‘ঝুমকো, মাই ডার্লিং। আর কতো? আর কত মদ্যপান করবে তুমি?’
ঝুমকো কটমট চোখে তাকালো। সাথে সাথে ঝুমকোর মোলায়েম বাহু থেকে হাত সরিয়ে গুটিয়ে নিলো সোহেল। চোখে মুখে একটা অজানা অপমান খেলা করে গেলো নিমিষেই। ভাঙা চুয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। নিঃপ্রশন্ন চাহনি দিয়েই জলসে ফেলল যেনো ঝুমকোকে। কিন্তু ঝুমকো কি আর এতো কিছু বুঝে? সে আছে নিজের কষ্টময় দুনিয়ায়। নিজের কল্পনার সুন্দর অতীতময় দুনিয়ায়। যে দুনিয়াটি একান্তই তার ব্যাক্তিগত। অন্য যেকোনো নারী-পুরুষের সে স্থানে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ।
সোহেলের চোখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে। সে চায় ঝুমকো আরো বেশি ড্রিংক করুক। বেপরোয়া ভাবে ড্রিংক করে সে নিজেকে সামলাতে না পারুক। তখন সোহেল এত দিনের প্রতিশোধ ঠিক আদায় করে নিবে। এতো অপমানের বদলা সে এক রাতেই নিয়ে নিবে। এই ব্যাকডেটেড পাগল রাগী বদমেজাজি উগ্র মেয়েটার প্রতি তার রয়েছে সীমাহীন তাচ্ছিল্যতা। এই মেয়েটাকে সোহেল বিন্দুপরিমান সহ্য করতে পারে না। নিজের কার্য হাসিল হলেই নর্দমায় ছুড়ে মেরে চলে যাবে সোহেল।
ঝুমকোর আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে সোহেল ঠোঁটে শয়তানের মতো হাসি ফুটালো। উপরে উপরে দেখাতে চায় সে ঝুমকোকে অনেক কেয়ার করে। কিন্তু মূলত ঝুমকোর ক্ষতিতেই তার প্রশান্তি। এই মেয়েটাকে তার প্রথম দিন থেকে ভালো লাগতো কিন্তু বিনিময়ে পেয়েছে শুধু অবহেলা অপমান আর তাচ্ছিল্যতা। তাই সোহেলের ও জেদ চেপে গেলো। সে ঝুমকোকে কলংকিত করার ছুতা খুজতে লাগলো। বাঙালি মেয়ে যতোই ওয়েস্টার্ন পোশাক পরে বিদেশীদের হাব-ভাব নিয়ে চলুক না কেনো মূলত তো তারা এই বাংলার মাটি থেকেই জন্মেছে। তখন নিশ্চয়ই ঝুমকো সোহেলের পায়ে পরতো। আর সোহেল এতো দিনের রাগের ক্ষুবে লাত্থি দিয়ে তাড়িয়ে দিতো ঝুমকোকে। হায়! ঝুমকো তখন দিশেহারা পথিকের মতো ঘুরতো। কত্তো মজা হতো!
এমন টাই চিন্তাধারা করে রেখেছে সোহেল। কিন্তু দেখা যাক তা আদেও বাস্তবায়ন হয় কি না!
আপনমনে সমানে কিছু বিরবির করে যাচ্ছে ঝুমকো। তার চোখ দুটো স্থির নাইট ক্লাবের লাল নীল আলোয় চকচকে টেবিল টার দিকে। সে প্রায়ই এই ক্লাবে আসে। বাড়িতে ফিরে অনেক রাত করে। বাধা ছাড়া নিয়ম। কেউ আটকাতে পারে না। এ প্রায় চলছে দু বছর থেকে। সে যখন অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে তখন থেকেই মদ নেশায় আসক্ত হয়ে পরে। আর তার এক বছর পর তার দেখা হয় সোহেলের সাথে। বলতে গেলে এই ছেলেটার প্রতি ঝুমকোর বিন্দু পরিমান আগ্রহ নেই। বিরক্তির স্তূপ মনে হয়। কিন্তু ছেলেটাকে দেখা যায় সব সময় ঝুমকোর কেয়ার নিতে। ঝুমকোর আশেপাশে থাকতে দেখা যায় তাকে। ঝুমকো জানে এটা সোহেলের ভালো লক্ষ্মণ না। কোনো মহাকাজে বা কেয়ার করার জন্য সোহেল তার সাথে নেই। সোহেল আছে তার জিদের জন্য। প্রতিশোধের আগুনে অন্ধ হয়ে সোহেল তার কাছাকাছি থাকে। এর জন্যই তো মাঝে মাঝে গায়ে হাত দেয়। কিন্তু ঝুমকোও কম নয় এতো কিছু বুঝার পর ও সে এই ছেলেটাকে সাথে নিয়েই চলে। গায়ে বিন্দু পরিমান স্পর্শ লাগলে সে রাগে বোম হয়ে যায়। এমন হয় যে সোহেলকে মারতেও তখন সে দ্বিধাবোধ করবে না। তার হাতের অনেক জোর। কিন্তু তবুও সোহেল তার পেছনে ঘুরবে নিজের জেদ পূরনে। আর ঝুমকোও পেছনে ঘুরাবে কারন সে রিস্ক নিয়ে খেলতে ভালোবাসে। এককালে যে জিনিস টা নিয়ে সবচেয়ে বড় ভয় ছিলো। এখন সেই জিনিস টাই তার প্রিয়র মধ্যে অন্যতম। অনার্সটা কোনো মতে পাশ করেছে ঝুমকো। মাস্টার্সে পড়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ তার ভেতর দেখা যায় না। এই উগ্রপন্থি মেয়ের যে কি হবে কে জানে!
সোহেল নিজের ভাবনার মাঝেই বুঝতে পারে ঝুমকো কিছু নিয়ে বিরবির করছে। এ আর নতুন কি! প্রতিদিন স্বভাবরত ড্রিংকস বেশি করলে ঝুমকো এমন বিরবির করে কথা বলে আর গুনগুন করে কাঁদে। কেমন ভুতুড়ে শোনা যায়! মনে হয় কার সাথে যেনো সাক্ষাতে কথা বলছে ঝুমকো। সোহেলের তখন অনেক ভয় হয়। এমন ভুতুড়ে মেয়ের কাছ থেকে এক ছুটে পালাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ওই যে জেদ! এই একটা জিনিসই মানুষ ধ্বংসের মূল। না, ভুল বললাম সাথে হিংসে আর রাগ কেও স্থান দেওয়া দরকার। মূলত এই তিনটে জিনিস মানুষকে পতিত করার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
সোহেল ভাবে, আজই বোধ হয় তার কার্য হাসিল করার দিন। ঝুমকো বোধ হয় এখন ফেইন্ট হয়ে যাবে মদের নেশায়। কিন্তু দেখা গেলো কিছুই হলো না। ঝুমকো টেবিল ছেড়ে উঠে দাড়ালো। নীল লাল সবুজ বাতি তে তার মুখ আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠলো। গালের খাঁজের ভাজে ভীষন রকম ঝিলিক দিয়ে উঠলো। আচ্ছা? ঝুমকোর গাল দুটো ওমন চিকচিক করে কেনো সবসময়? মনে হয় এক বস্তা হাইলাইটার মেখে এসেছে। কি আশ্চর্য! পৃথিবীর কত কত সৌন্দর্যের মানুষ আছে। কারোর ঠোঁট জন্মগত ভাবে নিখুত আঁকানো হয়। কারোর জন্মকাজল পড়ানো চোখ হয়। কিন্তু কারোর জন্মগত ভাবে চিকচিক করা গাল হয় তা ঝুমকোকেই প্রথম দেখলো সোহেল। তখন নিতান্তই একটা প্রেম প্রেম দেখা গেলো সোহেলের মাঝে। স্বাভাবিক!
ঝুমকো হঠাৎ দাঁড়িয়েই টেবিলের দিকে ঝুঁকে সোহেলের মুখের সামনে তুড়ি বাঁজালো। বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে ঢুলতে ঢুলতে বলতে দেখা গেলো তাকে,
‘মাই নেইম ইজ ঝুমকো। হোয়াট’স মাই নেম? ইটস ঝুমকো…….গট ইট?’
সোহেলের মাথায় দু আঙ্গুল দিয়ে ঠেকিয়ে বলে উঠলো। সোহেল চোখ মুখ কুচকে তাকালো।
ঝুমকো একটু কেমন করে জানি হেসে হাত দিয়ে হুইস্কির ফাঁকা গ্লাস গুলোকে ইশারা করে বলল,
‘এই সামান্য হুইস্কি আমার ভারসাম্য কখনো টলাতে পারবে না। ইউ নো, আই এম ঝুমকো! সামান্য ড্রিংকস করে যদি ভেবে থাকো আমি ফেইন্ট হয়ে যাবো, নিজের ভারসাম্য রাখতে পারবো না, আবুল তাবুল বকবো। তাহলে বলবো, ইউ আর আবসুলোটলি রং।
সোহেলের মুখখানা অপমানে থমথমে হয়ে যায়। সত্যি সে আশা করেছিলো আজ তার কার্য হাসিলের দিন। কিন্তু সে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো যে এই মেয়েটা ঝুমকো! আর এই ঝুমকোকে সামান্য হুইস্কির বোতল কাবু করতে পারে না। সে দিব্যি হেটেচলে বেড়াতে পারবে। কারোর সাহায্য তার প্রয়োজন হবে না। বেপরোয়া মেয়ে বলে কথা!
সোহেল মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ঝুমকো কিছু বুঝতে পেরে স্মিত হেসে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। চলে যেতে উদ্ধৃত হয়। সাথে বলে,
‘বাই বাই মি. সোহেল। কাল দেখা হবে। ‘
হাত নাড়িয়ে বাই বাই বলতে বলতে ঢুলে ঢুলে চলে যায় ঝুমকো। সোহেল ঝুমকোর যাওয়ায় পানে রক্তলাল চোখে তাকিয়ে থাকে। তার শরীরে অপমানবোধ গুলো বোধ হয় একটু বেশি। কেউ তার সাথে কথা বললেই তার মনে হয় তাকে অপমান করা হচ্ছে। কি আশ্চর্য ব্যাপার না? চোরের মন পুলিশ পুলিশ যাকে বলে। বাবা মায়ের এক মাত্র আদরের ঘরের দুলাল সে। আর তাকে অপমান করা বা কটু করে কথা বলা ইটস এ বিগ ম্যাটার!
বাইরে পার্কিং লটে গিয়ে ঝুমকো আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেক জোরে জোরে হাসে। হাসতে হাসতে আবার অনেক জোরে জোরে কাঁদে। ঘন কালো মেঘেতে ছেয়ে যাওয়া আকাশটায় তাকিয়ে অত্যন্ত দুঃখি এবং তাচ্ছিল্য ভাবে বলে,
‘এই জীবনটা আমাকে কি দিলো বলো তো? কষ্ট ছাড়া তো কিছুই পেলাম না, আল্লাহ! একটা মানুষের গোটা জীবন কি কষ্ট দিয়ে পার হতে পারে? সে কি পার করতে পারে? তুমি ই নাকি বলো, এক দরজা বন্ধ হলে হাজার দরজা খোলা? তুমি নাকি বলো, বারো মুশকিল তেরো অবসান? তবে আমার জীবনটাই কেনো এমন বলতে পারো? আমার জীবন টা কেনো সমস্যায় ভরপুর? কেনো সব দরজা বন্ধ? কোনো দিন ই কি সে দরজা খুলবে না? সবাই কেনো আমাকে ঠকিয়ে চলে যায় বলতে পারো?’
ঝুমকো ডুকরে কেঁদে উঠে। পরমুহূর্তে আবার চোখ মুছে। আবিষ্কার করে তার মাথা ভিষন ভাবে টলছে। কেনো? কখনো তো এমন হয় না। অন্যান্য দিনে তো আজকের তুলনায়ও বেশি ড্রিংকস করে কিন্তু কখনো তো এমন হয় না। তখনি মনে পরে আজ সকালে এক টুকরো সেন্ডউইজ খাওয়ার পর থেকে আর এক ফুটা পানিও তার পেটে পরেনি। পরেছে শুধু এক গাদা মদ। ঝুমকো অনুভব করে তার বমি পাচ্ছে। মাথাটা ঝিম ঝিম করে ঘুরছে। সেই সাথে শরীর উত্তাপে ভরে উঠছে। ভীষণ খিদেও পাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ও আর এক পাও এগোতে পারবে না। এগোনোর সাথে সাথে ঠাস করে মাটিতে লুটিয়ে পরবে। এই এক্ষুনি… এক্ষুনি সে জ্ঞান হারাবে। চোখ মুখে অন্ধকার দিয়ে আসছে।
বলতে বলতেই ঝুমকো ঢলে পরলো। ঠিক তখনই কেউ দৌড়ে এসে পরম যত্নে শক্ত পোক্ত হাত দিয়ে ধরে ঝুমকোকে নিজের বুকে স্থান দিলো।
ঝুমকো অনুভব করলো সে কারোর বুকের মাঝে মিশে যাচ্ছে। লোকটার শরীর থেকে অদ্ভুত মাদকতার গন্ধে ঝুমকো যেনো আরো বেশি করে জ্ঞান হারাচ্ছে। অনেক কষ্টে নিষ্প্রান দুটো চোখের দুয়ার হালকা ভাবে খুলে আগুন্তুক এর মুখশ্রী দেখে সে থমকে গেলো! পৃথিবীটা মুহূর্তে উলোটপালোট হয়ে এলো। এই পৃথিবীর প্রতি ঘেন্না জন্মালো। চাপা কান্নায় উদ্বেল হয়ে উঠলো বুক। অনেক দিনের জমানো কষ্ট গড়গড় করে নিষ্প্রভ চোখ দুটির কার্ণিশ বেয়ে পরে গেলো। হায়! এই পৃথিবী এমন কেনো? যাকে ছাড়তে চায় তার কাছেই নিয়তি এনে কেনো ফেলল তাকে? এই নিয়তি কি চায় তার কাছে? আর কতো কষ্ট দেওয়ার বাকি আছে?
ঝুমকোর চোখ আবারো নিমজ্জিত হয়ে এলো। আস্তে আস্তে খোলা চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো। সে তখন অবধি খেয়াল করলো আগুন্তুক ব্যাক্তিটি তার দিকে নিশাচর বাদুরের তীক্ষ্ণ চোখের নেশামাখানো দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। মুখে তার স্মিত হাসি কিন্তু কেমন যেনো একটা! বোধ হয় অনেকদিনের অপেক্ষায় ছিলো আজকের দিনের জন্য। সত্যি কি তাই? ঝুমকো কি এই কথাটা বিশ্বাস করবে? ঝুমকো কি বুঝতে পারছে আগামী দিনগুলো চলা তার জন্য ভীষণ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে! কেমন করে তখন চলবে ঝুমকো? অতীত ফেলে কি বর্তমান নিয়ে দৌড়াতে পারবে ভবিষ্যতের দিকে? না কি সব আবারও নিছকই ভেঙে চুড়ে একাকার হয়ে যাবে?
চলবে❤️
#অভিমান
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১