গল্পটা_পুরনো পর্ব ১১+১২

#গল্পটা_পুরনো
পর্ব – ১১
মুনিরা জলী।

* * *
“এতো তাড়াতাড়ি কেন যাবি? তুই না সেমিস্টার ফাইনাল দিয়ে এলি। তোর তো কিছুদিন থাকার কথা ছিল । ”

রাদীবের প্রশ্ন শুনে সায়েম হেসে বললো , ” কবে ক্লাশ শুরু হবে ঠিক ছিলনা তখন। গতকালই জানালো যে বুধবার থেকে ক্লাস শুরু হবে। কি আর করা যেতেই হবে। পুজোর ছুটিও তো মঙ্গলবার পর্যন্ত ছিল। ”

রাদীব মন খারাপ করে বলে , ” তো কবে যাচ্ছিস? টিকেট কাটা হয়ে গেছে? ”

” এখনও দুটো দিন আছি তো। সোমবার সকালের টিকেট কাটছি। ” বলে উঠে দাঁড়ায় সায়েম। ” তুই একটু বস , আমি এখনই আসছি। ”

” কই যাস? ”

” কফি খাইতে মন চাচ্ছে। নিয়ে আসতেছি। ”

” কি দরকার? এতো খাবার খাইছি। হাসফাস লাগতেছে। আর কিছু পেটে ঢুকবেনা। ”

সায়েম হেসে ওঠে বলে ,” কফি খেলে ভালো লাগবে।”

সায়েম বেরিয়ে গেল। রাদীব মোবাইলে মনোযোগ দেয়। সায়েমের ছুটি শেষ। চলে যেতে হবে। আবার কতদিন পর আসবে। তাই আজ কাছের বন্ধুদের বাসায় দুপুরের খাবার খেতে ডেকেছিল সায়েম। আরও এক বন্ধু এসেছিলো। এক জায়গায় যেতে হবে বলে সে খেয়ে উঠেই চলে যায়। সেই থেকে রাদীব ও সায়েম দুজনে মিলেই আড্ডা দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে দুই মগ কফি হাতে রুমে এলো সায়েম। রাদীবের হাতে একটা মগ ধরিয়ে দিয়ে খাটের রেলিঙে হেলান দিয়ে বসলো সে। কফিতে চুমুক দিয়ে সায়েম বললো৷,

” তোর স্কলারশিপের কি খবর রাদীব? ”

রাদীব মোবাইলটা রেখে দিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে বলে , ” ফাইনাল পরীক্ষার পরেই হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। ”

” মাস্টার্সটা এখানে করে গেলে হতোনা? ”

” তোর কি সেটাই মনে হয়? যাবই যখন দেরি করে কি লাভ? আর এদেশের ডিগ্রি থেকে আমেরিকার একটা বেস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি নেয়াটা বেটার কিনা বল? ”

” হুম। তা ঠিক বলেছিস। তো পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসবিতো , নাকি ওখানেই সেটেল্ড করবি? ”

কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে মগটা খাটের পাশে সাইড-টেবিলে রেখে দিল রাদীব। মৃদু হেসে বলেো ,

” আসলে ফিউচারের কথা কেউ বলতে পারে? আপাতত যাচ্ছি পড়তে। মাস্টার্স , তারপরে পিএইচডি শেষ করতে মিনিমাম চার বছর তো লাগবে। তারপর আল্লাহর ইচ্ছে। রিজিক যেখানে থাকবে সেখানেই থাকা হবে। ”

” বুঝলাম। তোকে অনেক মিস করবোরে তখন। ”

রাদীব আবারও হেসে ওঠে। বলে , ” গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। এখনো অনেক দেরি আছে। আগে যাওয়া হোক তো। তারপর মিস করিস। ”

হঠাৎ মনে হলো এমন ভঙ্গিতে বলল সায়েম, ” এই শোননা যাওয়ার আগে ঐ মেয়েটির সাথে একটু ভালো করে পরিচয় করে দেনা। ”

রাদীব বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললো , “কোন মেয়েটির কথা বলছিস? ”

সায়েম একটু ইতস্তত করে বললো , ” ঐ-যে তোদের পাশের বাসার গেস্ট। কি যেন নাম….”

রাদীব ঝট করে বলে উঠে , ” তোয়া? ”

” হ্যাঁ হ্যাঁ তোয়া। ” এবার অনেকটা মিনতিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সায়েম , ” প্লিজ হেল্প মি। ”

রাদীব এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। কেন জানেনা তোয়ার প্রতি সায়েমের এমন আগ্রহী হওয়া ওর একদম পছন্দ হচ্ছেনা। অনেকটা বিরক্তিমাখা স্বরে বললো সে , ” তুই কি সত্যি সত্যিই সিরিয়াস? নাকি মেয়েটার সাথে অহেতুক ফ্লার্ট করতে চাস? ”

সায়েম লজ্জিত ভাবে দাতে জীব কেটে বলে , ” ছিঃ ছিঃ কি বলিস! আমি সিরিয়াসলি বলছি। এতো কিউট একটা মেয়ে। ওর সাথে ফ্লার্ট করব কেমনে ভাবলি তুই? ”

” তোর স্বভাবের কারণেই ভাবতে বাধ্য হয়েছি। ”

সায়েম প্রতিবাদ জানিয়ে বলে , ” দেখ তুই আমাকে ভুল বুচ্ছিস। আমি কারও সঙ্গে ফ্লার্ট করিনাই। কিন্তু আমার কপালটা এতো খারাপ , যার সঙ্গেই প্রেম করছি বেশিদিন টেকেনাই।এখানে আমার কি দোষ? ”

” তাহলে কার দোষ? তোর প্রেম টেকেনাই আর দোষ হবে অন্য কারও। বাহ্ চমৎকার! ” ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো রাদীব।

” এবার হবেনা দেখিস। এই মেয়েটা অন্য মেয়েদের মতো নয়। মেয়েটাকে সত্যিই খুব ভালো লাগছেরে। ”

” এটাই তো কথা। তোয়া একটু আলাদা। ও খুবই নাজুক , কোমল। একেবারে ফুলের মতো। তাছাড়া ওর মন পাওয়া এতো সহজ হবে না। মেয়েটি ভিষণ লাজুক। সহজে ছেলেদের সাথে কথা বলেনা। ”

সায়েম একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাদীবের দিকে। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে রাদীবকে। তারপর বললো ,

” কি ব্যাপার বলতো? মেয়েটারে নিয়ে তুই একটু বেশিই ডিফেন্সিভ মনে হচ্ছে। ”

রাদীব অপ্রস্তুত হয়ে বললো , ” কি যা-তা বলছিস? ”

” যা-তা বলছি না। দেখ তোর যদি মেয়েটিকে ভালো লেগে থাকে তাহলে আমাকে বল ,সত্যি বলছি আমি আর ওর দিকে ফিরেও তাকাব না। ”

রাদীব এবার বিচলিত বোধ করে। নিজের ভিতরে একটা দমবন্ধ অনুভূতি টের পায় সে। না সে কোন রকম বন্ধনে জড়িয়ে পরতে চায়না। শুধু মাত্র এই কারণে সে কখনও কোন মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কে যায়নি। ওর বন্ধু মহলে দুয়েকজন ছাড়া মেয়ে বন্ধু নেই। রাদীব আনমনে ভাবে , ‘তোয়া নরম কোমল সাদাসিধা একটা মেয়ে। মেয়েটির সাথে শুধু মাত্র বন্ধুর মতোই মিশেছে। বেড়াতে এসেছে। দুদিন পরে চলে যাবে। এর মধ্যে ভালোবাসা কই? এক মিনিট। ভালোবাসার কথা কেন ভাবছি? ধুর! কি সব পাগলের মতো ভাবছি। সায়েম ব্যাটা আমার মাথাটাই খারাপ করে দিবে দেখছি।

সায়েম এক দৃষ্টিতে রাদীবের দিকে চেয়ে আছে । কিন্তু রাদীবকে আনমনা হয়ে আছে দেখে সায়েমই আবারও বলে উঠলো ,

” কিরে? আমার ধারণাই তবে ঠিক। কি বলিস? ”

রাদীব চমকে উঠে। সায়েমের দিকে ভ্রুকুটি করে তাকায়। জিজ্ঞেস করে সে ,

” কি? কিসের ধারণা? ”

” ভালোবাসা মনের দুয়ারে কড়া নাড়ছে তবে। ” আবৃত্তির সুরে বললো সায়েম। ঠোঁটে তার দুষ্টুমি হাসি।

রাদীব এবার শান্ত গলায় বললো , ” তুই তো আমার অবস্থা , পরিস্থিতি সবই জানিস। তবে এমন রসিকতা করে কি মজা পাচ্ছিস? বলতো? ”

সায়েম অবাক হয়ে বললো , ” রসিকতা? রসিকতা কেন করব? কখন কার জীবনে প্রেম , ভালোবাসা এসে ধরা দেয় সেটা কি কেউ বলতে পারে? ভালোবাসা সেতো সময় দেখেনান, অবস্থান,পরিস্থিতি কিছুই দেখেনা। সে হঠাৎ করেই শব্দ হীন পায়ে হেঁটে এসে হৃদয়পটে শক্ত আসন পেতে নেয়। তাকে চাইলেও আর এত সহজে উপ্রে ফেলে দেয়া যায়না। ”

রাদীব হেসে ওঠে বললো , ” তুই তো দেখছি ভালোবাসার উপর পিএইচডি করছিস। কিন্তু আমার জীবন আমি নিজের হাতে নিয়ন্ত্রণে রাখতে জানি। এসব প্রেম ট্রেমের জায়গা আমার জীবনে নেই। অন্তত আগামী পাঁচ বছর এসব অর্থহীন ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ বা ইচ্ছে কোনটাই নেই। ”

” কনফিডেন্স থাকা ভালো কিন্তু ওভার কনফিডেন্স ভালো না দোস্ত । যদি নিজের অজান্তেই সত্যিই কাউকে ভালোবেসে ফেলিস তখন কি করবি? ”

” প্রথমত আমি তেমন পরিস্থিতিতে যাতে না পরতে হয় সেই চেষ্টাই করব আগে। তারপরও যদি ভালোবাসায় জড়িয়েও যাই আমি নিজেকে সামলে নিব। আমার কাছে আমার পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। আদীব সবে ক্লাস নাইনে পড়ে , আর উর্বী আইএ সেকেন্ড ইয়ার। ওদের পড়াশোনা কমপ্লিট করা তারপর উর্বীর বিয়ে দেয়া। আর সবার আগে সেই দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত করে নিজেকে গড়ে তোলা। তাই নিজের মনকে যেকোন ভাবে হোক অন্য কোন দিকে ডিসট্রাক্টেড না হয় প্রাণপণ সেই চেষ্টা করে যাব । ”

সায়েম সিরিয়াস গলায় বললো , “দেখ বলা যতটা সহজ বাস্তবে সেটা করা ততটাই কঠিন। যেখানে মনের মতো নাজুক জায়গায় সামান্য কোন আচর পরলেও সেটার যন্ত্রণা কিন্তু আজীবন ভুগিয়ে ছাড়ে।”

” মনে আগে আচর পরুক তারপরে না ভোগান্তির প্রশ্ন আসবে? ”

” তাহলে বলছিস তোয়াকে তোর ভালো লাগেনি? ”

” ভালো লাগবে না কেন? তোয়া মেয়েটিই এমন যাকে সবারই ভালো লাগবে। কিন্তু তারমানে এইনা যে ওর সাথে প্রেম করতে হবে। ও পরীক্ষা দিতে এসেছে। পরীক্ষা দিয়েই বাড়ি ফিরে যাবে। আমিও হয়তো স্কলারশিপটা পেয়ে গেলে বিদেশে চলে যাব। আর কখনও দেখাও হবেনা হয়তো। ”

” তাহলে আমার সঙ্গে পরিচয় করায় দিতে অসুবিধা কোথায় তোর? ”

রাদীব এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো , ” ঠিক আছে। পরশু দিন আমি তোয়াকে পরীক্ষার হলে নিয়ে যাব। তুই ভার্সিটিতে চলে আসিস। ঐদিন তোর সাথে পরিচয় করায় দিব। ”

সায়েম খুশিতে ডগমগ হয়ে রাদীবকে জড়িয়ে ধরলো। উচ্ছ্বসিত গলায় বললো , ” থ্যাংকইউ দোস্ত। ইউ আর দা বেস্ট। ”

* * *
দড়জা খুলে উর্বীকে দেখেই তোয়ার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। দড়জা ছেড়ে একপাশে সরে এসে ভিতরে ঢোকার জায়গা করে দিয়ে বললো ,” ভিতরে এসো। ”

উর্বী ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো , ” তোমাকে নিতে এলাম আপু। আম্মু বললো তুমি সারাদিন একা একা বোর হচ্ছো বোধহয় , তাই আমাকে পাঠিয়ে দিল তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য । ”

তোয়া দরজাটা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে , ” এখুনি যাব? নানু একা থাকবে? মাগরিবের আজানের পরে আসমার মা আসবে মা আসবে। তখন নামাজ পড়ে নিয়ে গেলে হতো না? ”

উর্বী এক মুহূর্ত ভেবে বললো , ” হুম, তাও হয়। আজানের সময়ও তো হয়ে এসেছে। ঠিক আছে নামাজের পরেই চল তাহলে। ”

দুজনে নানুর রুমে গিয়ে কিছুক্ষন গল্প করে কাটায়।
শাহানা পায়েস বানিয়ে ফ্রিজে রেখে গিয়েছিলেন। এক ফাঁকে তোয়া উঠে রান্না ঘরে গিয়ে তিনটা বাটিতে করে পায়েস তুলে নেয়। আরও কিছু নাস্তা সহ ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে নানীর ঘরে নিয়ে আসে।
একটু পরেই আজান দিতে দুজনেই উঠে পরে। ওজু করে এসে নামাজ আদায় করে নেয়। ওরা নামাজ আদায় করে উঠতে না উঠতেই আসমার মাও চলে এসেছে। তাকে নানির কাছে রেখে তোয়া উর্বীদের বাসার উদ্দেশ্যে বের হলো।
বাসার ভিতর ঢুকার সময় তোয়ার বুকটা দুরুদুরু কাঁপতে থাকে। যতবারই রাদীবের মুখোমুখি হয় ততবারই তোয়ার হৃৎস্পন্দন দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করে । কেন এমন হয়? কেমন যেন একটা ব্যাথায় টনটনে অনুভূতি হতে থাকে বুকের মধ্যে , অনবরত , অসহিষ্ণু। কিন্তু তাও কেন জানেনা তোয়া এই টনটনে ব্যাথা ব্যাথা অনুভব ভিষণ ভালো লাগে তার। একটা কষ্ট কষ্ট সুখের বীণা বেজে চলেছে যেন হৃদয়পুরে।
কিন্তু হায় যে বুকভরা আশা নিয়ে রাদীবদের বাসায় পা রাখে তোয়া। সেই আশা ভঙ্গ হতে বেশিক্ষণ লাগেনি তার।
রাদীবের মায়ের সাথে দেখা হতে তোয়া সালাম দেয়। তারপর বললো , ” কেমন আছেন খালাম্মা? ”

সালামের জবাব দিয়ে বললেন রোকেয়া ,
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোমার সারাদিন কেমন কাটলো? বৃষ্টি না থাকলে সকালেই একবার পাঠাতাম উর্বীকে। কিন্তু দেখ কি বৃষ্টিটাই না হলো আজ সারাদিন। ”

” না না খালাম্মা , কোন সমস্যা হয়নাই। নানু তো আছে। আর সারাদিনের এমন নির্জন পরিবেশে বেশ ভালো পড়াশোনা হয়েছে। পরশুদিন পরীক্ষা। সময় বেশি নাই।আজকের সারাদিন বেশ কাজে লেগেছে।”

” রাদীবের মা হেসে বললেন , “আচ্ছা বেশ, তবে তোমরা কথা বল। আমার কিচেনে একটু কাজ আছে, আর হ্যাঁ চা খাওতো? ”

” খাই। কিন্তু খালাম্মা আমরা নাস্তা করে এসেছি। শুধু শুধু আপনি এতো কষ্ট করবেন কেন? ”

” কিছুই করবোনা। তুমি প্রথম এসেছে, কিছু বলতে মিষ্টি মুখ তো করতেই পার। তাই না? ”

আর কিছু বলেনা তোয়া। শুরু হেসে মাথা নেড়ে সায় জানালে রাদীবের মা রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। উর্বী তোয়ার একটা হাত ধরে নিয়ে বললো , ” আপু চল তোমাকে আমাদের বাসাটা ঘুরিয়ে দেখাই। ”

তোয়া হেসে সায় দিতেই উর্বী ওর হাত ধরেই অন্দর মহলে টেনে নিয়ে গেল। প্রথমে নিজের রুমে ঢুকেই বললো , ” এটা আমার রুম। একচুয়েলি আমার আর আম্মুর রুম। ”
তোয়া ঘুরে ঘুরে দেখল রুমটা ছিমছাম সুন্দর সাজানো গোছানো সিম্পল একটা রুম। আসবাবপত্র গুলো সব অনেক পুরোনো। কিন্তু বেশ ভারী। অনেকটা সাবেকী ডিজাইনের। সবচেয়ে ভালো লাগছে সবকিছু পরিস্কার এবং পরিপাটি করে গোছানো। উর্বীর দিকে ফিরে তোয়া বললো ,

” তোমার রুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো দেখছি। কে গুছিয়েছে? তুমি? ”

উর্বী স্বলজ্জ হেসে বলে , ” আরে না আমি কিছুই পারিনা।বললাম না এটা আম্মুরও রুম। আম্মুই করে।”

” ওহ্ আচ্ছা। ”

তোয়াকে নিয়ে এবার রাদীবের রুমে ঢুকে উর্বী। বলে ,
” এটা ভাইয়ার রুম। যদিও আদিবের আলাদা রুম আছে , তাও আদীব এই রুমেই থাকে। ”

ওদের দেখে আদীব পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে এলো। তোয়াকে সালাম দিল। তোয়ার কানে যখনি ঢুকে যে এটা রাদীবের রুম , তৎক্ষনাৎ তোয়ার বুকের ভিতর রক্ত ছলকে উঠে। একটা হার্টবিট মিস করে । ইদানিং এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে ওর সাথে। রাদীবের নাম শুনলেই বুকটা কেমন ধক করে ওঠে। রুমে রাদীবকে না দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল তোয়ার। আনমনে রুমের চারপাশে তাকিয়ে দেখছে। একদম সাধারণ একটা রুম। একজন ব্যাচেলোর ছেলের রুম যেমনটি হয় তেমনই। তবে একটা ছেলের রুম হওয়া সত্ত্বেও এই রুমটাও পরিপাটি করে গোছানো। আসবাবপত্রের বাহুল্য নেই। যতটুকু প্রোয়োজন ততটুকুই আছে। ডাবল বেড খাট, বেশ বড় একটা কাঠের ওয়ার্ডরোব, উঁচু শেল্ফ লাগানো বড় পড়ার টেবিল, তার পাশে একটা কম্পিউটার রাখা টেবিল। একটা কর্ণারে রাখা আছে লম্বা একটা স্ট্যান্ড আলনা। তাতে হ্যাংগারে করে দু’ভাইয়ের কিছু কাপড় চোপর ঝোলানো আছে। রুমের এক কিনারায় বারান্দায় যাওয়ার দড়জা। তার পাশেই এটাচ্ বাথরুমের দড়জা। এর পাশে বাকি ওয়াল জুড়ে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত সম্পূর্ণটাই বিশাল সাইজের একটা বুকস শেল্ফ।আর সেই শেল্ফ ভরা অসংখ্য বই। সব কিছুই অনেক বড় এবং পুরনো। তোয়ার ভিষণ ভালো লাগে এ ধরনের ফার্নিচার। একটা ঐতিহ্যবাহী সৌন্দর্য ছুঁয়ে থাকে। আর মজবুত হয়। বুকস শেল্ফটি রাখা আছে অদ্ভুত জায়গায়। কেউ চাইলেও চট করে পৌঁছাতে পারবেনা সেখানে। কারণ শেল্ফের সামনেই বিঘৎ খানিক ফাঁক রেখে খাট রাখা আছে। সাত সাগর তের নদীর মতই খাটের ওপর দিয়ে পেরিয়েই তবেই বই গুলোর কাছে পৌছানো সম্ভব। তোয়ার বেশ মজাই লাগে। কি সুন্দর খাটে শুয়ে থেকেই হাত বাড়িয়ে বই বের করা যাবে। আহা! ওর রুমে যদি এমন একটা বুকস শেল্ফ থাকতো। তোয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে , ঢাকায় ফিরেই আব্বুকে বলবে ওর রুমে ঠিক এমন একটা বুকস শেল্ফ বানিয়ে দিতে।

তোয়া খুব মনোযোগ দিয়ে বইয়ের কালেকশন দেখছিল। তাই আদীবের কথা শুনতে পায়নি সে। আদীব আরও একটু জোরে সালাম দিতেই তোয়ার সম্বিৎ ফিরে। ওদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেলো ,

” ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছ ভাইয়া? ”

ওরা কিছুটা সময় নানা বিষয়ে কথা বলে। রাদীবের মা চা নাস্তা আনলে না চাইতেও অল্প কিছু মুখে দেয়। উর্বীর কাছে অনুমতি নিয়ে দুই তিনটা বই বেছে নেয় পরীক্ষার পরে পড়বে বলে।

তারপর একরাশ ভালো লাগা আর রাদীবের দেখা না পেয়ে কিছুটা ভার মন নিয়েই বাসায় ফেরার জন্য বেরিয়ে আসে তোয়া। বাইরে এসে কি মনে করে পুকুরের পারে গিয়ে দাঁড়ালো সে। অন্ধকারে কালো টলটলে পানির দিকে তাকিয়ে থাকে সে আনমনা হয়ে। এমন সময় পেছন থেকে চেনা কন্ঠে কেউ বলে উঠলো ,

“এই অসময়ে একা একা এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?”

তোয়া চমকে উঠে পিছনে ফিরে তাকায়।
গল্পটা পুরনো
লেখা – মুনিরা জলী
পর্ব – ১২।

* * *
সূর্যটা যখন পুকুরের ওপাড় হতে আলোকবিন্দু থেকে একটু একটু করে নরম কোমল সোনা রঙা আলোকচ্ছটা বিশ্ব চরাচরে ছড়িয়ে দিতে ব্যাস্ত ঠিক তখনই তোয়া অশান্ত , উদ্বিগ্নচিত্ত মন নিয়ে কারও জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছে। ওর চোখ দুটো সামনের রাস্তায় নিবিষ্ট মনে নিবদ্ধ।
ফজরের নামাজ আদায় করেই তোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। বাইরে বেরিয়ে যেতে কেন যেন লজ্জা করছে। কাল সন্ধ্যায় দেখা হয়েছিল রাদীবের সাথে। কিন্তু এনিয়ে কোন কথা হয়নি। ‘ কিজানি তার মনেও আছে কিনা?’ এই ভেবে আগ বাড়িয়ে নিচে নেমে যেতে কেমন হ্যাংলামো মনে হচ্ছে । তাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তোয়া।
গতকাল রাতে যখন সে পুকুরের পারে দাঁড়িয়ে ছিল তখন হঠাৎই রাদীবের কথা শুনে চমকে পিছনে ফিরে তাকায় তোয়া। রাদীব জিজ্ঞেস করছিল ,

” এই অসময়ে তুমি এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছ কেন? ”

পিছনে ফিরে রাদীবকে দেখে তোয়ার মনটা খুশিতে নেচে উঠেছিল। এতটাই উদগ্রীব হয়ে ছিল মানুষটাকে একনজর দেখার জন্য। নিজের মনের অবস্থা দেখে ওর নিজেরই আশ্চর্য লাগছে। শুধুমাত্র আজ সারাদিন দেখা হয়নি । অথচ মনে হচ্ছে কতযুগ যেন দেখা হয়নি। কেন এমন লাগছে? যে মানুষটা তিন দিন আাগেও তার কাছে বলতে গেলে অচেনাই ছিল , সেই একই মানুষ কিভাবে এতটা কাছে চলে এসেছে যেন কত যুগ যুগ ধরে চেনা সে। মাত্র তিন দিনে কোন মানুষ মনপ্রাণ জুড়ে এতোটা জায়গা করে নিতে পারে?

” তুমি কি সবসময় যখন তখন যেখানে সেখানে এভাবে আনমনা হয়ে পর? তাহলে তো বিপদ। ” চিন্তিত গলায় বললো রাদীব।

তোয়া লজ্জায় অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে গেল। মনে মনে বলে , ‘ আমি কি এমন কখনো করেছি নাকি? আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে কি যে হয়েছে আমার নিজেও জানিনা। ‘ রাদীব জবাবের অপেক্ষায় তোয়ার মুখের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল দেখে নিজেকে সামলে নিলো সে। লাজুক হেসে বললো,

” তা কেন করব? আসলে আপনাদের বাসায় গিয়েছিলাম। এইতো বাসায় ফিরছিলাম। সারাদিন বাসায় বসে ছিলাম তো। পুকুরটা দেখে ইচ্ছে করলো পারে একটু দাঁড়িয়ে থাকতে। তাই দাঁড়িয়ে ছিলাম। ”

” আচ্ছা তাই নাকি? ভালো করেছ। যখনি একা লাগবে এভাবেই আমাদের বাসায় চলে আসবে। ”

” আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? ” তখনি তোয়ার মনে হলো এমন প্রশ্ন করা উচিৎ হয়নি বোধহয়। তাই তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো , ” সরি আমার এমন কথা জানতে চাওয়া ঠিক হয়নি। ”

” ইটস ওকে। আমি গিয়েছিলাম বন্ধুর বাসায়। ওখান থেকে একটা টিউশনি করে এই ফিরলাম। ”

তোয়ার খুব ইচ্ছে করছে আরও কিছুটা সময় রাদীবের সাথে কাটাতে। কিন্তু চাইলে কি সব ইচ্ছে পুরোন হয় মন না চাইলেও মুখে বললো ,

” ও আচ্ছা। আপনি বাইরে থেকে এসেছেন। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি যাই। অনেকক্ষণ হলো বেরিয়েছি, নানু হয়তো চিন্তা করবে। ”

রাদীব মৃদু হেসে বলে , ” হুম, দাদী তোমার অপেক্ষায় আছে। যাও। বাসায় যাও। ”

তোয়া মাথা ঝাকিয়ে বাসায় চলে এসেছিল। এখন কাল রাতের কথা মনে হতেই ভাবনা গুলোও আবার ওর মনে ফিরে এলো। মনটাকে কিছুতেই নিজের বসে রাখতে পারছে না সে। তাই তোয়ার ভয় করছে নিজের অনুভূতি নিয়ে। রাদীবের মনে কি আছে তার তো জানা নেই। ওর এমন সর্বগ্রাসি অনুভুতি যদি একতরফা হয়? তাহলে ও তো মরেই যাবে। হৃদপিণ্ডে কেমন চাপদায়ক ব্যাথা করছে। তোয়া লম্বা করে বার কয়েক শ্বাস নিয়ে শ্বাস ছাড়তে থাকে।

” তুমি উপরে কি করছ? তোমার না নিচে দাঁড়ানোর কথা ছিল । ” নীচে থেকে গলা উঁচিয়ে বেশ জোরেই বলে উঠে রাদীব।

উঁচু স্বরে রাদীবের কথা শুনে চমকে নিচে তাকায় তোয়া। আর সঙ্গে সঙ্গে তোয়ার মন থেকে হঠাৎ আগত ভয় , সংশয় নিমিষেই কেটে গেল । তার বদলে লজ্জারুণ ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় তোয়ার মনোভূমি। সে অনেকটা ঘোরের মাঝেই
” আসছে ” বলেই দৌড়ে নানুর রুমে যায়। নানু তখন কুরআন তেলওয়াত করছিল। তোয়াকে দেখে তেলাওয়াত থামিয়ে মুখ তুলে তাকালেন তিনি । তারপর বললেন ,

” কিরে কিছু বলবি? ”

” নানু আমি বাইরে হাঁটতে যাচ্ছি। এই আশেপাশেই। একটু পরেই চলে আসব। ”

” ঠিক আছে যা। দরজাটা লক করে যাবি আর চাবিটা মনে করে নিয়ে নিস। ”

” আচ্ছা নানু , তোমার কুরআন তেলাওয়াত হয়ে গেলে একটু ঘুমিয়ে নিও। ঠিক আছে আমি আসছি।”

তোয়া বড় সুতি ওড়না আগেই ভালো করে গায়ে জড়িয়ে পরে নিয়েছিল। ওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা চাবির স্ট্যান্ড থেকে মেইন দরজার চাবি আর মোবাইলটা হাতে নিয়ে দড়জা লক করে সোজা নীচে নেমে গেল সে। গেটের বাইরে বেরিয়ে রাদীবকে পুকুরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকতে দেখে তোয়ার বুকের ভিতর দ্রিমদ্রিম করতে থাকে। টলমল পায়ে হেঁটে রাদীবের পিছনে দাঁড়াতেই রাদীব ঘুরে দাঁড়ালো। তোয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ,

” তোমাকে নীচে থাকতে বলেছিলাম না। তাহলে বারান্দায় কি করছিলে? ”

তোয়া একটু ইতস্তত করে বললো , ” আসলে আমি ভাবছিলাম…” কথা শেষ না করে থেমে যায় সে
বিচলিত ভাবে এদিক ওদিক তাকায়।

তোয়াকে চুপ করে যেতে দেখে রাদীব বললো , ” কি হলো থেমে গেলে কেন? বল কি ভাবছিলে? ”

তোয়া ঠোঁট কামড়ে ধরে একটু ভেবে বললো ,

” আপনার মনে আছে কিনা তাই ভাবছিলাম। ”

তোয়া যদি মুখ তুলে চাইত তবে দেখতে পেত রাদীব ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিল। তোয়ার ঠোঁট কামড়ে ধরা মুহূর্তে ওকে এতো সুন্দর লাগছিল যে রাদীব চোখ ফেরাতে পারছিলনা। সে বললো ,

” আচ্ছা চল হাটতে হাটতে কথা বলি। নয়তো এখানে দাঁড়িয়েই দেখবে যে বেলা হয়ে গেছে। ”

” ঠিক আছে চলেন। “তোয়া সায় দিয়ে বলে।

দু’জনে পাশাপাশি হাটতে থাকে। কিছুক্ষণ দুজনেই নিরবে কাটায়। একসময় পাড়ার রাস্তা ছেড়ে বেরিয়ে আসে ওরা দু’জনে। এবার রাদীব হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। আসলে ওর চিন্তা হচ্ছিল চেনা কারও সামনে না পরে যায়। যদিও সেই সম্ভাবনা কম। প্রতিদিন জগিং করতে যাওয়ার সুবাদে রাদীব খুব চেনা কাউকে জগিং এ বের হতে দেখেনি। তারপরও ভরসা কি? তাই চিন্তায় ছিল সে। হাটতে হাটতেই সে বললো ,

” তোমার কেন মনে হলো যে , আমি ভুলে গেছি। ”

” সেভাবে কিছু ভেবে বলিনি। আসলে এমনই মনে হলো। কিন্তু বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষাই করছিলাম। ”

রাদীবের ভালো লাগলো তোয়ার অপেক্ষায় থাকার কথা শুনে। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে , ” ঢাকা ভার্সিটিতে কিসে পরীক্ষা দিয়েছ? ”

” আমিতো আর্টসের ছাত্রী। তাই ‘ঘ’ ইউনিটেই পরীক্ষা দিতে হয়েছে। ”

” আচ্ছা। রেজাল্ট আউট হবে কবে? ”

” কালকেই হওয়ার কথা। ”

” বাহ্ বেশ তো। ” তারপর একটু ভেবে বললো, ” সেই টেনশনে কাল আবার পরীক্ষার বারোটা বাজিয়ে ফেলবে নাতো? ”

” কিজানি? ” আনমনে জবাব দেয় তোয়া।

রাদীব একপলক তাকিয়ে দেখে তোয়ার মুখের দিকে। তারপর বললো , ” টেনশনের কিছু নেই। আর তাছাড়া ঢাকায় চান্স পেয়ে গেলে এই পরীক্ষার কোন গুরুত্বই থাকবেনা। ”

তোয়া হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। রাদীবের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো , ” কিন্তু সেটাতো ঢাকায় চান্স পাওয়ার পরের কথা। যদি চান্স না পাই? ”

রাদীব তোয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে মেয়েটা সত্যিই টেনশন করছে। অবশ্য টেনশন হওয়াটাও স্বাভাবিক। তাই সে হালকা হেসে তোয়াকে আস্বস্ত করে বললো ,

” কেন পাবেনা? ইনশাআল্লাহ চান্স পাবে , দেখো। ” বলেই হাটতে শুরু করে সে বললো , ” চলো হাঁটি। পরে বেলা বাড়লে লোকজন বেরিয়ে পরবে। ”

তোয়া কিছু না বলে চুপ চাপ রাদীবের পাশে হাটতে থাকে। ঢাকার রাস্তায় ভোর বেলায়ই ব্যাস্ততায় সরগরম হয়ে ওঠে। এখানে এই মুহূর্তে দুয়েকজন মহিলা, পুরুষ মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছে। কিন্তু এখনো রাস্তার দু’পাশের দোকানপাট গুলোর ঝাঁপি খুলেনি। দুয়েকটা রেস্টুরেন্টের ঝাঁপি খুলে চুলায় আগুন জ্বালানোর আয়োজন চলছে। নির্জন রাস্তায় কার্তিকের ভোরের হালকা ঠান্ডা বাতাসের ছোয়ায় দুজনের শরীর-মনে শিহরণ জাগিয়ে তুলছে। একটু পরে তোয়া বলে উঠে , ” আর কতদূর আপনার পার্কটা? ”

রাদীব হাত তুলে তর্জনী আঙুল উঁচিয়ে সামনে দেখিয়ে বলে , ” ঐতো সামনে। ”

পার্কের ভেতরে ঢুকে সোজা হাঁটতে থাকে দু’জনে। পার্কের ভেতরে বৃদ্ধ , যুবা , পুরুষ ও মহিলারা কেউ মর্নিং ওয়াক করছে তো কেউ জগিং করতে ব্যস্ত।
গেট থেকেই ইট বিছানো রাস্তা সোজা চলে গেছে অনেক দুর অবধি। রাস্তার দু’পাশ জুড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ বৃক্ষরাজি। রাস্তাটা চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছে স্বচ্ছ টলটলে জলে ভরা বিশাল একটা দিঘিকে। প্রচুর বাতাসের তোড়ে তোয়ার গায়ের ওড়না ওড়াউড়ি করছিল। সামলে রাখতে হিমসিম খাচ্ছে তোয়া। রাদীবের মাথা ভরা ঘন কালো রেশমের মতো চুলগুলো বাতাসের ঝাপটায় বারবার কপালের উপর অবাধ্য হয়ে আছড়ে পরছিল।

রাদীব হাটঁতে হাটঁতে বলল , ” শাহীলরা কবে আসবে?”

” মামারা কাল সকালে রওনা দিবে। সন্ধ্যায় বাসায় পৌঁছে যাবে ইনশাআল্লাহ। ”

” যাক , আর একটা দিন তোমার কষ্ট করতে হবে। ”

” কষ্ট করতে হবে কেন? বেশ তো আছি। ” হঠাৎ খুশিখুশি গলায় বলে উঠে তোয়া , ” জানেন কালকেই আম্মুরাও আসবে। ”

” তাই? তার মানে কাল তোমার জন্য স্পেশাল একটা দিন অপেক্ষা করছে। তা আম্মুরা বলতে আর কে কে আসছেন? ”

” আম্মু আর ভাইয়া। ভাইয়াকে কতদিন পর দেখব জানেন? আমার তো একদমই তর সইছেনা। ইশ্ কখন যে কাল আসবে। ”

তোয়ার কন্ঠে উচ্ছ্বাস , আনন্দ , আর অদ্ভুত এক চপলতাপূর্ণ আবেগ একসাথে প্রকাশ পেয়েছে। রাদীব একটু অবাক হয়ে তোয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবে।’ শান্ত
শিষ্ট , নরম কোমল , লাজুকলতা এই মেয়েটির তবে এমন উচ্ছলতা , চঞ্চলতা পূর্ণ রূপও আছে? ‘

ভাবনার রাস টেনে রাদীব সুধায় , ” অনেক দিন পরে দেখা হবে কেন? তোমার ভাইয়া ঢাকায় থাকেনা? ”

” তোয়া এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে একইরূপে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে , ” সেটাইতো। ভাইয়া অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। তিন বছর পরে গতকাল রাতে বাড়িতে এসেছে। উফ্! আমিও যদি বাসায় থাকতাম তাহলে কাল রাতেই দেখা হয়ে যেতো। কি মজা হতো! ধুর! ভাল্লাগেনা। এখনি পরীক্ষাটি হতে হতো? ” ঠোঁট ফুলিয়ে মন খারাপ করে শেষের কথাটা বলে তোয়া।

তোয়া একেবারে বাচ্চাদের মতোই গাল , ঠোঁট ফুলিয়ে রেখেছে। রাদীব মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। তোয়া ঐভাবেই পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে হাসে রাদীব। হাসি চেপে বলে ,

” তাতে কি? একটা দিনের ব্যাপারই তো। কালকেই তো দেখা হবে তাই না? ”

” হুম। ” আনমনে বলে তোয়া। তারপর আবারও হাটতে শুরু করে সে। রাদীবও ওর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো ,

” তোমার একটাই ভাই? ”

” একটাই ভাই। আমরা দুই বোন এক ভাই। আপনাদের উল্টো। আপনারা দুই ভাই এক বোন। ” বলেই হেসে ওঠে তোয়া।

” এবার বুঝতে পেরেছি। ভাইকে খুব ভালোবাসো। তাইনা? ”

” হুম খুব ভালোবাসি। জানেন ভাইয়া যেদিন অস্ট্রেলিয়ায় চলে যায় আমি দুদিন ধরে এত কেঁদেছিলাম যে ভাইয়া পৌঁছে যখন ফোন করে , আমার কান্না শুনে বলেছিল , ‘ তুই কান্না থামা আমি প্রথম যে টিকিট পাওয়া যাবে তখনই চলে আসব। ” বলেই তোয়া ফিক করে হেসে দেয়।

রাদীব বললো , ” দেখ জীবনে কিছু অর্জন করতে হলে কিছু ত্যাগ শিকার করতেই হয়। এইযে তোমার ভাইয়া সবার থেকে এতো দুরে এতো কষ্ট করে একা একা আছে , তোমরা আপনজন কেউ তার কাছে নেই ভাবতো কত কষ্ট হয় তার। কিন্তু তাও সে কষ্টটাকে মেনে নিয়েছে। কেন বলোতো? যাতে সে ভালো কোন নামকরা ভার্সিটি থেকে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে নিজের কেরিয়ার সুনিশ্চিত করতে পারে। তবেই তো সে ফিউচারে নিজের ফ্যামিলির প্রতি সুষ্ঠু ভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে। ”

তোয়া চুপচাপ মন দিয়ে রাদীবের কথা শুনছিলো। তোয়ার ভাই নাশীদ যখন অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিল তোয়া তখন সবে ক্লাস টেনে পড়ে। বাড়ির ছোট মেয়ে হওয়ার সুবাদে সবার বড় বেশি আদরের মেয়ে সে। যখন যা মন চেয়েছে করেছে , যা চেয়েছে পেয়েছে। মা, বাবা, ছোঁয়া, নাশীদ সবাই যেন ওর চাওয়া পূরণ করতে হাত বাড়িয়েই থাকে, তোয়ার কেবল কোন আবদার মুখে উচ্চারণ করতে যতটুকু দেরি কিন্তু আনতে দেরি হয়না। ছোট থেকে অভাব কাকে বলে ও দেখেনি। তাই বোঝেওনি। ঢাকা শহরে নিজেদের ছয়তলা বাড়ি। কয়েকটা মার্কেটে দোকান আছে। বাড়ির নিচতলায় তোয়ার মা কিন্ডারগার্টেন স্কুল দিয়েছেন। তোয়ার বাবা বিজনেসম্যান। সবকিছু মিলে ওর ধারণা ছিল ভাইকে বিদেশে গিয়ে কষ্ট করতে হবে কেন? ওদের যা আছে তাতেই তো কতো ভালো চলছে। তবে কেন দুরে থাকতে হবে? তাই রাদীবের কথা শুনে একটু অবাকই হয়েছে তোয়া। তাই সে বললো ,

” কিন্তু ভাইয়ের এতো কষ্ট করতে হবে কেন? এখানে ভার্সিটিতে পড়তে পারতো। আপনিও পড়ছেন তো। আর আমাদের তো আব্বুর নিজের বিজনেস আছে। ভাইয়াকে ফিরে এসে আব্বুর বিজনেসেই জয়েন করতে হবে। তাহলে কেন শুধু শুধু বিদেশে যাওয়া? ”

রাদীব এবার আন্দাজ করতে পারছে তোয়াদের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে। ও বুঝতে পারে মেয়েটার অভাব-অনটন , আর্থিক সংকট , জীবনের টানাপোড়েন , হিসেব করে চলা এসব নিয়ে কোন ধারণাই নেই। বড় আদুরে মেয়ে সে। কিন্তু তোয়ার সাদাসিধা পোশাক , চালচলনে সরলতা এসব দেখে ওর পারিবারিক অবস্থান সম্বন্ধে ধারণা করা সত্যিই মুসকিল। এতোটাই নিষ্পাপ আর পবিত্র মনে হয় মেয়েটিকে। জীবনের কাঠিন্য , দুঃখ , কষ্ট এসব এখনো স্পর্শ করেনি তোয়াকে।

রাদীব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো , ” চলো ফেরা যাক। নইলে অনেক বেলা হয়ে যাবে। ”

” জ্বি চলেন। ”

পার্ক থেকে বেরিয়ে আসার সময় রাদীব বললো , “তুমি এখনো অনেক ছোট। প্রতিটি মানুষের জীবনের একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। সেই মতো সে জীবনকে সাজিয়ে নেয়। কেউ অভাব-অনটনে বেড়ে ওঠে আবার কেউ প্রাচুর্যের মাঝে বেড়ে ওঠে। কিন্তু এরপরও প্রত্যেকটি মানুষকেই সমাজের বুকে নিজের একটা পরিচয় , অবস্থান তৈরি করে নিতে হয়। যাদের ফ্যামিলির আর্থিক অবস্থা ভালো তাদের সেটাকেই কাজে লাগিয়ে আরও বেশি উচ্চ অবস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাটা সহজ হয়ে ওঠে। কিন্তু যাদেরকে অভাবের অভিশাপ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে তাদের জন্য সমাজের বুকে নিজেকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করতেই হিমসিম খেতে হয়। এইযে দেখনা আমিও দিন রাত এক করে পড়াশোনা করছি যাতে স্কলারশিপ পেয়ে হায়ার এডুকেশনের লক্ষ্যে বিদেশে গিয়ে পড়তে পারি। জানিনা আল্লাহ ভাগ্যে কি রেখেছেন। কিন্তু আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। ”

তোয়া চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে বললো ,

“আপনিও বিদেশে চলে যাবেন? ”

” হ্যাঁ। কারণ এদেশে কোন চাকরি পাওয়া অলিক স্বপ্ন দেখার মতো। কিন্তু আমি বাড়ির বড় ছেলে। মা , ছোট ভাই , বোনদের প্রতি অনেক দায়িত্ব আছে আমার। বাবাও নেই। এই মুহূর্তে আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য নিজেকে সেই দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। ”

” আপনার নিজের কোন স্বপ্ন নেই। ”

” নাহ্। স্বপ্ন বল আর দায়িত্ব সবই আমার পরিবারকে ঘিরে। এর বাইরে অন্য কোন দিকে তাকানোর সুযোগ বা ইচ্ছে কোনটাই আপাতত আমার জীবনে নেই। ”

” কিন্তু? ” চিন্তিত গলায় বললো তোয়া।

” কিন্তু কি? ”

” না কিছুনা। ” মাথা নেড়ে বললো তোয়া।

তোয়া আর কিছু বলেনা। মন খারাপ হয়ে গেছে তার। কিন্তু বুঝতে দেয় না তা রাদীবকে। চুপচাপ হাঁটতে থাকে। দুজনেই দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ির পথে এগিয়ে যেতে থাকে।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

3 COMMENTS

  1. “গল্পটা পুরনো” এই গল্পের সমাপ্তি নেই কেন, প্লিজ গল্পটার ফিনিশিং টানেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here