অভিমান পর্ব ২৭+২৮

#অভিমান
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-২৭
জাহিদা রহমান থরথর করে কাঁপছেন। রাগে তার মুখশ্রী লাল হয়ে উঠেছে। চোখ দিয়ে আগুনের বজ্র ঝড়ছে। যেনো মুখ খুললেই ড্রাগনের মতো আগুন বের হবে। আর সেই আগুন জলসে দিবে ঝুমকোকে। ভস্ম করে দিবে তার ভস্মীভূত শক্তি দ্বারা। ঝুমকো গালে হাত দিয়ে তখনো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে জাহিদা রহমানের দিকে। জাহিদা রহমান কিছু পেপার ছুড়ে মারলেন ঝুমকোর মুখে। ঝুমকো অপমানে চোখ বন্ধ করে নিলো। সাথে সাথে গড়িয়ে পরলো নোনাজল।

রাহান তখন ঝুমকোকে আগলে নিয়েছিলো নিজের বাহুডোরে। ছেলের এমন বেহায়া কান্ডে জাহিদা বেগম কটমট দৃষ্টি ফেলেন। রাহান মিনিট খানিকের জন্য বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো। কিন্তু সম্ভিত ফিরে সে এবার গর্জে উঠলো। গর্জন করে বলে উঠলো, ‘মা তুমি এটা কি করলে? ঝুম…প্রেগন্যান্ট মা।’

ধপ করে দাউদাউ করে জ্বলা আগুনটা নিভে গেলো।জাহিদা বেগমের চোখের রাগ নিমিষে কমে এলো। মুখের হিংস্র ভাবটা খানিক উবে গেলো। চোখে খেলে গেলো এক নিদারুণ বিস্ময়তা। এরপর ক্ষনিকের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন নিরবতা। ঝুমকো তখন শাশুড়ী মায়ের দ্বারা নিজের মুখের উপর ছুড়া সেই পেপার গুলোর মধ্যে একটা হাতে নিয়ে দেখলো এটা তাদের কাবিননামার কাগজ। ঝুমকো অবাক চোখে আরো একবার তাকালো। তারপর আবার চোখ নিচে নামিয়ে নিলো।

জাহিদা রহমানের চোখ শীতল হয়ে এসেছে। তিনি ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছেন। যেনো রাহানের মাত্র বলা কথাটা তার বিশ্বাস হচ্ছে না কোনোমতেই।

আজ সকালে তামিম কিছুদিন আগের ওর ভারসিটি থেকে পিকনিক ট্যুরে যাওয়ার ছবি দেখাচ্ছিলো জাহিদা রহমানকে। ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ অসতর্কতাবশত একটা ছবি চলে এলো, যেটায় ঝুমকো লাল উড়না মাথায় দিয়ে কাদতে কাদতে একটা পেপারে সাইন করছে আর রাহানের মুখে খুশি উপচে পরছে। ছবিটা দেখার সাথে সাথে তামিম ফোন অফ করে এক দৌড়ে নিজের ঘরে চলে যায়। আর জাহিদা রহমানের ভ্রু দুটো কুচকে কপালে চিন্তিতপূর্ণ ভাজ ফেলে।

দুপুর দিক দিয়ে জাহিদা রহমান রাহানের ঘরে গিয়ে চিন্তিত মুখে ঘরটাকে গোছ-গাছ করে দিচ্ছিলো। এরপর আলমারি গুছাতে গিয়েই হাতে পরে এই কাবিননামা। পেপারস গুলো দেখার সাথে সাথে জাহিদা রহমানের হার্টবিট বেড়ে যায়। প্রেসার বেড়ে যায়। তার আদরের ছেলে তাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছে…? এই দিনও তার দেখতে হলো? তারপর তিনি গিয়ে তামিমকে চেপে ধরলেন। কিন্তু তামিম সব কিছু স্বীকার করতে নারাজ। ধৈর্য্যহারা জাহিদা বেগম ওত্তো বড় ছেলের গালে চর মারতেও দ্বিধাবোধ করলেন না। তবুও তামিম মুখ খুলল না। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকলো। জাহিদা বেগম এবার কাদতে কাদতে জিজ্ঞেস করেন। মায়ের কষ্ট দেখে তামিম মাথা নিচু করে সব সত্যি বলে দেয়। সাথে সাথে জাহিদা বেগম গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরেন রাহানের এই ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে।

এই মুহুর্তে জাহিদা রহমান কারোর সাথে আর বারতি কোনো কথা না বলে হনহন করে ভেতরে চলে গেলেন।

,

মাকে থমথমে মুখে বিছানায় বসে থাকতে দেখে রাহান তার পায়ের কাছে বসলো। করুন স্বরে বলল, ‘মা আই এম স্যরি।’

জাহিদা রহমান শীতল চাহনি ফেলে ধিক করে বললেন, ‘ছি! এতো বড় কাজগুলো করতে তোমার বাঁধলো না? একটাবার বলতে আমায়। আমি নিজে নাহয় দাঁড়িয়ে থেকে তোমাদের বিয়ে দিতাম। তাই বলে এভাবে লুকিয়ে বিয়ে করে বাচ্চাও নিয়ে ফেললে?’

রাহান অপরাধী মুখ করে বসে থাকে। জাহিদা রহমান একবার কড়া দৃষ্টি ফেললেন ঝুমকোর উপর। ঝুমকো আরো জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালো। রাহান তৎক্ষণাৎ চেঁচিয়ে বলল, ‘মা তুমি ঝুমকোর দিকে ওভাবে তাকাও কেনো? ও ভয় পায় তো। সব দোষ তো আমার।’

জাহিদা রহমান ছেলের এমন ছুবলামি দেখে কটমট দৃষ্টি ফেললেন। বউয়ের গোলামগিরি করতেই কি এতো টাকাপয়সা খরচ করে ছেলেকে তিনি বিদেশ পাঠিয়েছিলেন? দাঁত কিড়িমিড়ি করে তিনি জীবনে কোনোদিন যা বলেননি তাই বললেন, ‘এক থাপ্পড়ে সব দাঁত ফেলে দিবো বেয়াদব ছেলে। মায়ের মুখের সামনে বউয়ের গোলামগিরি করিস?’

রাহান তাজ্জব বনে গেলো। সে আশ্চর্য হয়ে তাকালো মায়ের দিকে। তার মা জীবনে তার সাথে এভাবে কথা বলেনি অথচ আজ তুই-তোকারি পর্যন্ত করছে। এমন কি করেছে রাহান? নিজের বিয়ে করা বউয়ের পেটেই তো বাচ্চা এসেছে না কি? জাহিদা রহমান ঝুমকোর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘বসো।’

ঝুমকো ভীত হয়ে বিনাবাক্যে বসলো। একটা প্রশ্নও করলো না। জাহিদা রহমান অনেকক্ষণ ঝুমকোর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এই মেয়েটার একসময় তার ছেলের সাথে প্রেম ছিলো। তিনি সব জানতেন। বাপ-মা মরা মেয়ে! তিনি কখনোই ঝুমকোকে পছন্দ করতেন না। যতোই ঝুমকো বড়লোক ঘরের মেয়ে হোক। নানি, মামা, মামীর আদরের হোক আসলে তো সে অনাথ। কিন্তু আজ এই গর্ভবতী অনাথ মেয়ের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া মুখটা দেখেই তার খুব মায়া হলো। একটু আগে এই মেয়েটাকে না জেনে শুনেই চর মেরেছেন বলে নিজেকে পাপীবোধ হলো। ঝুমকোর পেটে তো তারই বংশধর। সেই বংশধরের মায়ের গায়ে সে কীভাবে হাত তুলল? বুকটা হুহু করে উঠলো তার। এই প্রথম ঝুমকোকে তার চোখে খুবই সুন্দর লাগছে। আগে তো এই মেয়ের চলন ফেরন কেমন জানি ছিলো। উদ্ধতস্বভাব, পোশাক-আশাক ঠিক নেই, চাল-চলন উল্টাপাল্টা সব এলোমেলো। কিন্তু এখন ওই কলাপাতা রঙের কামিজ পরা স্নিগ্ধ ঝুমকোকে দেখতে লাগছে ভারী মিস্টি। আগের চেয়ে অনেক ফর্সা হয়ে গিয়েছে মেয়েটা। গাল দুটো লাল হয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। নাকের নাকফুল টার জন্য তার সৌন্দর্য পরিপূর্ণ নারীরূপী হয়ে এসেছে। তার মধ্যে একটা মা মা ভাব এসে গেছে।

জাহিদা রহমান টেনে নিলেন ঝুমকোকে নিজের বুকে। ঝুমকোর থুতনিতে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে খুব মধুমাখা গলায় বললেন, ‘ মাশাল্লাহ!’

জাহিদা রহমানের এহেন কথায় ঝুমকোর ভীতিকর কাঁপুনি খানিকটা কেটে গেলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো শ্বাশুড়ি মায়ের মুখের দিকে। এরপর হঠাৎ সে ঝাপটে ধরলো। জাহিদা রহমান ঝুমকোর গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘স্যরি আম্মু।’

জাহিদা রহমানের এমন আদরে ঝুমকো কেদে দিলো। শব্দ তুলে কেদে দিয়ে জাহিদা রহমানকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে আপন কষ্টের ধ্বনিতে বলল, ‘জানো, আমার না কোনো মা নেই….সেই ছোট্ট বেলা থেকে। আমি কক্ষনো কাউকে আজ পর্যন্ত মা ডাকিনি। বাবাকে তো তাও পাঁচ বছর পর্যন্ত পেয়েছিলাম। কিন্তু মা পাই নি। তোমাকে আমি আম্মু বলে ডাকি?’

কি সুন্দর বাচ্চাদের মতো আবদার! জাহিদা রহমান কেদে দিলেন। এই মেয়েটাকে তিনি কতো অবহেলা করেছেন। কখনো সহ্য করতে পারতেন না। রাহান যখন বিদেশ চলে গেলো এই মেয়ে কতবার বাড়িতে গিয়েছে আর শুধু একটাই বুলি আওড়েছে, ‘প্লিজ বলুন রাহান কোথায় চলে গেছে?’ কিন্তু জাহিদা রহমান প্রতিবার নিষ্ঠুর ভাবে ঝুমকোকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। সেসব দিনের কথা ভেবে জাহিদা রহমানের এখন বুক কাঁপিয়ে কাদতে ইচ্ছে করছে। আপসোস হচ্ছে! ঝুমকোর কপালে চুমু দিয়ে তিনি মাতৃভক্তিময় কন্ঠস্বরে বললেন,

‘কেনো বলবে না মা? ডাকো আম্মু। আমি তো তোমার আম্মুই। যতো ইচ্ছা আম্মু ডাকো।’

ঝুমকো ঠোঁট ভেঙে কেদে দিয়ে বলে উঠলো ‘আম্মু’। সাথে সাথে আরো জোরে জোরে কেদে দিলো। শ্বাসবন্ধ করা কান্নায় মেতে উঠে বারবার ময়না পাখির মতো বুলি আওড়ালো, ‘আম্মু..আম্মু…আম্মু….’

জাহিদা রহমান ঝুমকোর চোখে মুখে চুমু দিলেন। রাহান আর পারলো না ধৈর্য্য ধরে রাখতে৷ এতোক্ষন একটু একটু মায়ের ভয়ে কোনো কথা না বললেও এবার মুখ খুলল, ‘ঝুম… তুমি কাদছো কেনো?’

জাহিদা রহমান আবারো কড়া দৃষ্টি ফেলে বলে উঠলেন, ‘আবারো….আবারো শুরু করেছো গোলামি? তুমি দেখতে পারছো না ও কেনো কাদছে? বুদ্ধির সাথে সাথে চোখও হাটুতে নিয়ে ঘুরো নাকি?’

রাহান চুপ হয়ে গেলো। ঝুমকো হেসে উঠলো। খানিক পরে জাহিদা রহমানও হেসে দিলেন। রাহান একটু চুপসে যাওয়া গলায় বলল, ‘ওর হেলথ কন্ডিশন ভালো না মা। এই অবস্থায় কান্নাকাটি ওর পক্ষে খারাপ।’

জাহিদা রহমান একটু অবাক হয়েও আবারো রাগী গলায় বললেন, ‘তো এখনি বাচ্চা নেওয়ার কি ছিলো? বিয়ের মাত্র দু মাস। পরেও তো নেওয়া যেতো নাকি? এতো তাড়া কিসের শুনি? বাচ্চা কি পালিয়ে যেতো?’

মায়ের এহেন লাগাম ছাড়া কথায় রাহান অস্বস্থিতে পরে গেলো। ঝুমকো মুখ টিপে হাসলো। এরপর রাহান আমতা আমতা গলায় বলল, ‘ওই তো… হয়ে গেছে। যাই হোক, আমি ওকে বলেছিলাম বাচ্চা না রাখতে ও শুনেনি।’

পুরো কথা এবার ঘুরে গেলো ঝুমকোর দিকে। ঝুমকো রাহানের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। জাহিদা বেগম দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর সুরে বললেন,

‘দোষটা তো তোমার রাহান। ঝুমকো কেনো বাচ্চা নষ্ট করবে? জানো কতো মানুষকে আল্লাহ বাচ্চা দেন না?’

রাহান মাথা নিচু করে কিছু বিরবির করলো। ঝুমকো মুখ খুলল, ‘সেটাই তো ওকে কে বুঝাবে আম্মু?’

জাহিদা রহমান আদেশস্বরূপ কণ্ঠে বললেন, ‘আগামী সাত দিনের মধ্যে তোমাদের ধুমধাম করে বিয়ে দিবো। তোরজোড় শুরু করতে হবে। ঝুমকোর বাড়িতে খবর দেও।’

ঝুমকো নিচু গলায় বলল, ‘নানুমনি আজকালকের মধ্যে তোমাদের সাথে কথা বলতো।’

‘ওহ তাহলে আমি তোমার নানুমনির সাথে কথা বলছি।’

____________________________

আজ ঝুমকোর বিয়ে। অতি জাকজমকপূর্ণ আয়োজন না হলেও কোথাও কোনো কিছুর কমতি নেই। সব ঠিক আছে। বড় করে রঙ বেরঙের ফুল আর চকমক কাপড় দিয়ে স্টেজ বাধাই করা হয়েছে। বাগানের একপাশে বাবুর্চিরা রান্না করছে বড় বড় ডেসকিতে। একপাশে সাউন্ড বক্স বাজছে। সেই গানে ছোট ছোট বাচ্চারা শাড়ি লেহেঙ্গা পরে হৈ-হুল্লোড় করে নাচছে। চারিপাশে রমনীরা ছুটাছুটি করছে। তারা আজ বড়ই ব্যস্ত। আর একটুপর বর এসে যাবে। সব তোরজোড় শেষ করতে হবে তো।

সারা বাড়ি লাইটিং এ ঝিকমিক করে ঝিলিক দিতো যদি রাতের বেলা হতো। বিকেল বেলা বলে লাইট অফ করে রাখা। আর একটু পরেই হয়তো জ্বলবে। সাথে জ্বলবে ঝুমকোর নতুন পথের আলো। ঝুমকোকে একটা নীল জামদানি শাড়ি পরানো হয়েছে। হালকা ভারী গহনার সাথে হালকা একটু সাজ। ওর শরীরের অবস্থার তুলনায় এইটুকুই অনেক বেশি।

পার্লারের মেয়েগুলো ঝুমকোকে সাজিয়ে সরে ধারালো। প্রাপ্তি ঝুমকোর থুতনিতে হাত দিয়ে ওর মুখটা খানিক উঁচু করে বলল,

‘মাশাল্লাহ….’

ঝুমকো ঝটকানা দিয়ে প্রাপ্তির হাত সরিয়ে দিলো। তার রাগের মাত্রা প্রচন্ড বেরে গেছে আজ। প্রাপ্তিকে সে পৈ পৈ করে বলেছিলো যাতে দুদিন আগে আসে। কিন্তু নাহ…মহারানী এসেছে আজ সকালে। সেই থেকে ঝুমকো প্রাপ্তির সাথে একটা কথাও বলেনি। এদিকে প্রাপ্তি ওর পেছন আঠার মতো লেগে রাগ ভাঙানোর মিশনে নেমেছে। ঝুমকো এবার ঝাড়ি মেরে বলল,

‘জামাই রাইখে আসতে ইচ্ছা করে না? এখন আসছস কেন? যাহ ভাগ…এক্ষুনি বাইর হ আমার বাড়ি থেকে।’

‘যামু না।’ প্রাপ্তি বিছানায় গিয়ে বসলো।

ঝুমকো কিছুক্ষন বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে অন্যরকম গলায় বলল, ‘আচ্ছা নিয়ন কেনো এলো না? আমি কি ওর বন্ধু নই? ও কি পারতো না একবার আসতে? এতো রাগ…!’

প্রাপ্তি একটু অপ্রস্তুত হলো। বিছানা থেকে উঠে বসে মলিন মুখে বলল, ‘রাগ না রে…অস্বস্থি। ও মনে করে ও এই বিয়েতে থাকলে তুই, আমি, রাহান ভাইয়া সবাই বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পরে যাবো।’

ঝুমকো আর কোনো কথা বলল না। এই কয়েক মাসে ও নিয়নের সাথে যোগাযোগ না করলেও আজ ফোন করেছিলো। আসতে বলেছিলো। কিন্তু নিয়ন নানান কাজের বাহানা দিয়েছে।

,

বর এসেছে, বর এসেছে করে চারিদিকে তখন কিচিরমিচির করে লাগামহীন ছুটাছুটি। কেউ মিস্টি নিয়ে যাচ্ছে তো কেউ পানির গ্লাস নিয়ে ছুটছে। আবার দুজন মহিলা কামিনী বেগমকে ধরে বরের কাছে নিয়ে যাচ্ছে।

বর এসে স্টেজে বসার পর যখন ঝুমকোকে নিয়ে আসা হলো তখন উজ্জ্বল শ্যামলা মুখশ্রীর রয়েল ব্লু কালারের শেরওয়ানি পরা রাহানের পাশে তেথিকে দেখে ঝুমকোর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। ধপ করে নিভে গেলো আনন্দের বহ্নি। রাহান ঠিক দেখলো সেই দীঘির চোখে ঢেউ আর উপচানো পানি। ঝুমকোকে রাহানের পাশে বসানো হলে। রাহান ফিসফিস করে বলল, ‘তেথিকে আমি বিয়েতে দাওয়াত দিয়েছি। ও আমাকে আগেই বলেছিলো যাতে আমাদের বিয়েতে ওকে দাওয়াত দেই। তোমাকে দেখার জন্য ভিষণ এক্সাইটেড ছিলো। প্লিজ রাগ করো না জান।’

ঝুমকো ভ্রু কুটি করে সামনে তাকিয়ে থাকলো। সাথে একটু হালকা বাতাস ভারী বুকের উপর দিয়ে চলে গেলো কোমলতার সাথে।
ঝুমকো দেখলো সাজানো গেট দিয়ে আলুথালু ভাবে ঢুকছে সোহেল। হাতে গিফট বক্স। ঝুমকো দাঁড়িয়ে গিয়ে হেসে বলল, ‘কি খবর?’

রাহান অন্যদিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে ঝুমকো- সোহেলের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়েছে ততক্ষনে। প্রাপ্তি একটু বিভ্রতবোধ করলো। সোহেল একবার প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই তো যাচ্ছে ক্লাব, বার, মদ এইসবেই ডুবে আছি। যাই হোক, আগামী দিনের জন্য শুভকামনা রইল।’

প্রাপ্তি পেছন থেকে বলল, ‘তো আপনি বিয়ে করছেন কবে?’

সোহেল একটু হেসে বলল, ‘আমার আর বিয়ে! বিয়েতে গিয়ে দেখবো বউ আমার গলায় ছুরি ধরে বলছে- বিয়ে করবার আসছোস কেন? আজকে সকালে আমার বিয়ে হয়ে গেছে…লুকিয়ে বিয়ে করেছি। বলি তোর লজ্জা করে না একটা বিয়াত্তা মেয়েকে আবার বিয়ে করতে এসে পরেছিস? কয়দিন পর তো ডেলিভারি পেইন উঠা মেয়েকে বিয়ে করতে যাবি। যাহ ভাগ। যেখান থেকে আসছিস সেখানে যাহ!’

সোহেল এটুকু বলে থামতেই আশপাশ থেকে হাসির গুঞ্জন শুনা গেলো। সোহেল বলল, ‘আমার যেতে হবে ঝুমকো। ভালো থেকো।’

মুচকি একটা হাসি দিয়ে সোহেল চলে এলো। লাইট থেকে অন্ধকারের পথ ধরেই ভিজে যাওয়া চোখদুটো মুছলো। আরেকবার ঘুরে তাকিয়ে দেখে নিলো ঝুমকো আর প্রাপ্তিকে। আলোর পরতেই সোহেলের চোখের পানি চকমক করে ধরা দিলো প্রাপ্তির চোখে। ফুরফুরে মেজাজটা উড়ে গিয়ে প্রাপ্তির বুকে একরাশ দীর্ঘশ্বাস জমাট বাঁধলো হঠাৎ ।

মিনান আর রুম মিলে তখন ক্যামেরা নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে বর-বউয়ের ছবি তোলার জন্য। ঝুমকো রাহান কে ঘিরে রয়েছে তেথি প্রাপ্তি রিয়া সবুজ সহ আরো কিছু কম বয়সী চাচাতো মামাতো ভাই বোনেরা। চারিদিকে বাতির ঝিলিক মারা উজ্জ্বল আলো, রঙ বেরঙের চাঁদোয়া টানানো, মানুষের ভিড়, কোলাহল সাথে সবার মুখে উৎফুল্লতা আর আনন্দের আওয়াজ।ঝুমকো নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রাজকীয় সিংহাসনে বসেই দেখতে পেলো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কামিনী বেগমের চোখের পানি আর আদিম উদ্দিনের চোখের তাঁরায় চিকচিক করা অশ্রু।#অভিমান❤️
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-২৮
বিকেলে এখন মৃদুমন্দ বাতাসের গুঞ্জন। হালকা বাতাস ধীরে ধীরে ভারী হয়ে উঠলো এরপর শনশন শব্দ। সেই শব্দে বাতাসের দাপট বাড়তে লাগলো। উড়লো ধুলাবালি, রাস্তার আবর্জনার মাঝে হালকা ওজনের পলিথিন গুলোও, আশেপাশে পথচারীরা দৌড়ে যাচ্ছে, বাড়ি ফিরে যাওয়ার তাড়া সবার। এই ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কারো জীবীকার তাড়না। আকাশটা ঘোমট ছাই রঙা মেঘে ছেয়ে গেছে। ছাই রঙা মেঘের কোলে ভেসে ঢেকে যাচ্ছে বিকালের ডুবি ডুবি প্রায় কমলা-লাল সূর্যটা।

ঝুমকো বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। চোখ ঝাপটানোর সাথে সাথে তার বড় বড় পাপড়ি বিশিষ্ট লাল চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো পানি সাথে নাক টানার শব্দ আর একটু বাচ্চামি। নয় মাসের ফুলে উঠা সেই মোলায়েম পেটে মাতৃভক্তিময় হাতটা রেখে ঝুমকো কান্নার স্বরে বলল, ‘বাবা কাদছো? কাদে না মা। বাবা আসলে আমি ঠিক বকে দিবো।’

বলতে বলতেই ঝুমকোর চোখের জল আরো মোটা মোটা হয়ে পরলো। জাহিদা রহমান ঘরে ঢুকলেন শরবত হাতে নিয়ে। বারান্দায় ঝুমকোকে বিষন্ন মনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে টেনে হিচড়ে ঘরের মাঝে নিয়ে আসলেন। এরপর গমগমে গলায় বললেন,

‘কি করো বলো তো। খাওয়া দাওয়া সব ছেড়ে দিয়েছো। নাও এই জুসটা খাও।’

ঝুমকো বিছানায় আস্তে করে বসলো। এরপর ডানে বামে মাথা নাড়াল। জাহিদা রহমান হতাশ হলেন। আজ প্রায় সাতদিন ধরে মেয়েটা শুধু কাদছে। কিচ্ছু খেতে চাইছে না। ডেলিভারির ডেট এগিয়ে আসছে এই সময় এমন করলে তো সমস্যা। এমনি হেলথ কন্ডিশন ভালো না। জাহিদা রহমান মনে মনে ছেলেকেও কিছু গালি দিলেন। ছেলের ডাক পরেছে তার ইউনিভার্সিটি থেকে। দশ দিনের জন্য যেতে হয়েছে আবারো অস্ট্রেলিয়াতে। খুব আর্জেন্ট। ঝুমকোকে বললে ঝুমকো কেদে ভাসাতো এবং রাহানকে কোনোমতেই যেতে দিতো না দেখে রাতে ঝুমকোকে ঘুম পাড়িয়ে না বলেই চলে গেছে। সেই থেকে ঝুমকো বিষন্ন মুখ নিয়ে ঘুরছে।

জাহিদা রহমান এবার আদর করে ঝুমকোর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আমার আম্মাটা…আমার সোনামনি একটু খাও মা। শরীর খারাপ করবে তো। পেটের বাচ্চার কথাটাও একটু মাথায় রাখ মা..’

ঝুমকো প্রায় সাথে সাথে কেদে দিলো। জাহিদা রহমানকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো করে নাক টেনে টেনে বলল, ‘তোমার ছেলে খুব পঁচা। হি ইজ ভেরি বেড। আমি আর কক্ষনো ওর সাথে কথা বলবো না। ‘
জাহিদা রহমান ঝুমকোর মাথায় চুমু খেয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, বলিস না।’
ঝুমকো আবার বাচ্চাদের মতো বলল, ‘আমি আমার বেবিকেও ওকে কক্ষনো দিবো না।’
‘আচ্ছা দিও না। এবার একটু খাও মা।’

,

রাতের আঁধারে গা ছমছমে নিস্তব্ধতা। আশেপাশে কুকুরের ডাকে থেকে থেকে গা শিউরে উঠছে। প্রকৃতি বিশাল আকারের চক্রান্তকরে কালো কালো ঝটলা বাধিয়েছে। বিকালের বৃষ্টির রেষ আছে তখন অবধি। ভারী বাতাসে বৃষ্টি বৃষ্টি ছন্দ, ঘ্রান, আমোদ। ঝুমকো ঘুমের ঘোরে পাশে হাত দিলো। একটা শক্তপোক্ত দেহ অনুভব করতেই ভীত হয়ে মুহুর্তে চোখ খুলে তাকালো। পাশের ব্যক্তিটি তখন দাঁত বের করে হাসছে। ঝুমকোর অবচেতন মন বিস্ময়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো। রাহান তাড়াতাড়ি ঝুমকোর মুখ চেপে ধরে বলল, ‘আহা! জান… সবসময় চিল্লানো শরীরের পক্ষে ভালো না।’

ঝুমকো উত্তেজনায় জড়িয়ে ধরলো রাহানকে এরপর আবার শুরু হলো কান্না-আহাজারি। রাহান ঝুমকোর চোখে-মুখে অনেকগুলো চুমু দিলো। ঝুমকোর গালের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে গম্ভীর মুখে বলল, ‘তুমি এগুলো কেনো করো বলোতো? খাওয়া দাওয়া করো নাই। আমার ফোন ধরো নাই। বাবুর কষ্ট হইছে না?’

ঝুমকো কোনো কিছুর উত্তর না দিয়ে উল্টে বলল, ‘তোমার না আরো তিনদিন পরে আসার কথা?’

রাহান ঝুমকোকে আরো শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে, ‘হুম কিন্তু এসে পরলাম। বউ ছাড়া ভালো লাগে বলো?’

ঝুমকো হেসে ফেলল। হাসলো রাহানও। এরপর ঝুমকোর কপালে তপ্ত চুমু দিয়ে ঠান্ডা বাতাসের কোমল ঝুমকোকে মিশে নিলো নিজের সাথে।

__________________________

আজ সকাল থেকে পেটে ব্যাথা ঝুমকোর। রাহান গেছে বাইরে। তামিম গেছে ভারসিটিতে। রাহানের বাবা নিজের অফিসেই আছেন। জাহিদা রহমান আজ গেছেন একটু কেনাকাটা করতে। অনেকদিন করবেন করবেন বলে করা হচ্ছে না। বাবুর জন্যেও কিচ্ছু কেনা হয়নি। রাহান আর রাহানের বাবাই যা কিনে এনেছে। ছেলেদের পছন্দতে কি আর হয়! এদিকে বাবু আসার টাইম হয়ে গেলো। দুলনা কিনতে হবে, খেলনা, জামা কাপড়, বাবুর কাঁথা, ডায়পার, শ্যম্পু, তেল, সাবান উফফফ…কত্তো…কিছু। তাই ঝুমকো আজ জোর করেই পাঠিয়ে দিলেন জাহিদা রহমানকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রেগন্যান্ট বউমাকে রেখে জাহিদা রহমানের যেতে হয়েছে। তিনি যাওয়ার সময় বলেও গেছেন, ‘এক ঘন্টার ভেতর চলে আসবেন।’

ঝুমকোর পেটে ব্যাথা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। পানি ভেঙেছে। আজও মেঘলা আকাশ। একটুপর ই আকাশ কাদবে। ঝুমকো যেইদিন কষ্টে থাকে ঠিক সেইদিন ই আকাশ কাদে। কেনো? ঝুমকো ঠোঁট চেপে ওই দূরের মেঘলা আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ক্ষীন স্বরে বলে উঠলো, ‘মেঘ তুমি আজ প্লিজ বৃষ্টি হয়ে ঝড়ো না। কেনো যেনো মনে হচ্ছে আমি আজ তোমার সাথে ঝড়ে যাবো।’

ঝুমকোর ব্যথা সময়ের সাথে বাড়ছে। ডেট তো আরো সাতদিন পরে। আজ ই কেনো পেটে ব্যথা শুরু হলো? ঝুমকো আর সইতে পারলো না। মৃদু আওয়াজে কুকরিয়ে উঠলো। কি আশ্চর্য! সবসময় গলা ফাটিয়ে পকপক করা ঝুমকোরও এই বিপদের ক্ষনে গলার স্বর আসছে না। মিনমিন করে আওয়াজ করছে। দাঁড়ানো থেকে কালো আলমারিটার সাথে হেলান দিয়ে ঝুমকো ফ্লোরে বসে পরলো। চিৎকারের সাথে সাথে ভেসে আসছে এখন ভারী কান্নার আওয়াজ। ঝুমকো নিস্তেজ হয়ে পরছে। শরীরের শক্তি চলে যাচ্ছে।

মৃত্যু বুঝি এতোটাই কাছে আজ? ঝুমকো অনেক কষ্টে উঠে দাড়ালো। দাঁতে দাঁত খিচে দাড়ালো। রাহানের স্টাডি টেবিলটা থেকে একটা খাতা হাতে তুলে নিলো। এরপর দূর্বল কাঁপা কাঁপা হাতে এলোমেলো ঝুমকো লিখতে বসলো জীবনের শেষ পাতা। যেই পাতায় ঝুমকোর অবসান ঘটবে। ঝুমকোর দিন বুঝি এই পাতায় শেষ হয়ে যাবে। এই পাতা পড়ার পর আর পরবর্তী কোনো পাতায় ঝুমকোকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

লিখা শেষ করে ঝুমকো পেটে হাত রেখলো। চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে ফুলে উঠা পেটের উপর গিয়ে পরলো। ঝুমকো অনেক কষ্টে অবাধ্য ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে বলে উঠলো, ‘বাবা কষ্ট হচ্ছে? মা আছি তো…ঠিক….ঠিক তোমাকে বাঁচাবো। আমি না বাঁচলেও তোমাকে বাঁচাবো।’

সাথে সাথে ঝুমকোর ব্যথার তীব্রতা বাড়লো। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জোরে এক গগণবিধারী চিৎকার দিলো। জাহিদা রহমান যাওয়ার সময় পৈ পৈ করে কাজের মেয়েটাকে বলে গেছিলেন যাতে পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর ঝুমকোকে দেখে আসে। কিন্তু জাহিদা রহমান যাওয়ার পর ই কাজের মেয়ে সাজতে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। যার বেশিরভাগ চুরি করা ঝুমকো বা জাহিদা রহমানের ডয়ার থেকে। ঝুমকোর চিল্লানো শুনে কাজের মেয়ে চমকে উঠলো। দৌড়ে গিয়ে দেখলো ঝুমকো কাতরাচ্ছে। কাজের মেয়ে ঝুমকোকে ধরে ঝাকালো। ঝুমকোকে পানি খাওয়ালো। ঝুমকো অনেক কষ্টে শুধু বলল,
‘রাহানকে ফোন দেও।’

কাজের মেয়ে তড়িঘড়ি করে রাহানকে ফোন দিলো। সব শুনে রাহানের শরীর দরদর করে ঘামতে লাগলো। হাত থেকে ফোন পরে গ্লাস ফেটে গেছে। কাঁপা কাঁপা পা দুটো এগুচ্ছে না অথচ তার এখন ছুটার কথা….তাকে ছুটতে হবে…ছুটতেই হবে। রাহান দৌড়ে এলো। আধ ঘন্টার রাস্তা পনেরো মিনিটে পার করে এলো।

,

ঝুমকো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে স্ট্রেচারে করে। উপরে সেলাইন চলছে। ঝুমকো কাতরাচ্ছে। ঝুমকোর এক হাত বন্ধ রাহানের হাতের মাঝে। আশেপাশে ঘিরে রয়েছে প্রাপ্তি নিয়ন তামিম রুম মামা মামি নানুমনি মা বাবা সহ সবাই। ঝুমকো পানিতে ঝাপসা হওয়া চোখ দুটো দিয়ে একবার সবাইকে দেখে নিলো। এরপর রাহানের দিকে তাকিয়ে অনেক কষ্টে আওড়ালো,

‘রাহান, তোমার টেবিলের উপর তিনটে চিঠি আছে একটাতে তোমার নাম লিখা আরেকটাতে নিয়ন আরেকটা প্রাপ্তি।’

রাহান জোরপূর্বক হেসে বলল, ‘কি বলছো ঝুম….চিঠি কেনো? তুমি তো ফিরেই আসবে। আসার পরে সব বলবে। এখন কথা বলো না তো ওতো…’

শক্ত হৃদয়ের পুরুষ, রাহানের চোখ থেকেও তখন গড়িয়ে গেলো পানি। হায়! কি অসহ্যকর বেদনা! ঝুমকো তাচ্ছিল্য হেসে বলল, ‘আমার হাতে সময় নেই রাহান। মানুষ মরার আগে বুঝতে পারে। আমিও পারছি।’

রাহান জোরে চেঁচিয়ে এবার বলল, ‘এক থাপ্পড়ে সব দাঁত ফেলে দিবো। কি সব আবোল তাবোল বলছিস হ্যা? মনে রাখিস তুই জোর করে এই বাচ্চা নিয়েছিস। এরপর তুই যদি ফিরে না আসিস এই বাচ্চার দিকে আমি মুখ তুলেও তাকাবো না।’

ঝুমকো ব্যথাতুর হাসলো। বলল, ‘তাহলে আমি মরেও শান্তি পাবো না।’

রাহান কথা বলে না ফ্যলাফ্যাল নয়নে তাকিয়ে নরম সুরে বলে, ‘এভাবে বলো না জান। আমি কথা দিচ্ছি তুমি যা চাইবে তাই হবে।’

‘চিঠিতে আমার যা কিছু চাই সব লিখে দিয়েছি জান…’ ঝুমকো ডাকলো এই প্রথম…জান বলে। কি শান্তি! কঠিন সময়টাতেও রাহানের চোখ দুটো আবেশে বুঝে আসলো সাথে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো ঝুমকোকে। নার্সরা ওদের সরানোর চেষ্টা চালালো কিন্তু ব্যর্থ হলো।ঝুমকো কান্নার সুরে বলল, ‘আরেকটু জোরে জড়িয়ে ধরবে…?

রাহান আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। যেনো আজ নিকের বুকের মিশিয়ে নিবে নিজের প্রিয়তমাকে। রক্তে রক্তে খেলে যাবে ঝুমকোলতার করুন স্পর্শ। ঝুমকো ফিসফিস করে থেমে থেমে উচ্চারণ করলো,’আই লাভ ইউ জান।’

ইশশ…কত্তদিন পর এই কথা শোনা..রাহান আরো চেপে ধরলো ঝুমকোকে নিজের সাথে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আই লাভ ইউ টু জান। প্লিজ ফিরে এসো। ধোকা দিও না আমায়।’

রাহান আবারো বলল অভিমানী গলায়, “ইশশ তোমার এতো কষ্ট কেনো হচ্ছে জান? আল্লাহ যদি সমান সমান ভাগ করে দিতো আমি তোমার সব কষ্ট নিয়ে নিতাম। বাচ্চা হওয়ায় মায়েদের এতো কষ্ট কেনো হবে? বাবাদের কেনো হয় না?”

রাহানের বাচ্চামো কথায় ঝুমকো ব্যথার মাঝেও হালকা হেসে দিলো। নার্সরা জোর জবরদস্তি করে আলাদা করে নিলো ঝুমকো আর রাহানকে। ঝুমকো তখনও হাত ধরে আছে রাহানের। ঝুমকোকে যখন বেডে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আইসিউ তে তখন আস্তে আস্তে ছিড়তে লাগলো ওদের হাতের গভীর বাধন। রাহান চোখে পানি নিয়ে ক্ষীন, মৃদু, নরম ও গভীর গলায় শুধু ডেকে উঠলো, ‘ঝুমকোলতা……’

সাথে সাথে ঝুমকো দু’চোখের পাতা বন্ধ করলো। চোখের কোল ঘেঁষে পরে গেলো অশ্রুকণা। ঠোঁটে ফুটলো এক পুলকিত হাসি।

,

বাচ্চার কান্নার সুরে সবাই উঠে দাড়ালো। ডাক্তার বেরিয়েছে একটা ছোট্ট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে। রাহান একবার দেখলো বাচ্চাটাকে। জাহিদা রহমান কোলে তুলে নিলেন এরপর আমোদিত গলায় বললেন, ‘রাহানরে তোর মেয়ে হয়েছে!’

রাহান একবার দেখে আর কোনোকিছুতে কান দিলো না। উত্তেজিত গলায় বলল, ‘ডক্টর মাই ওয়াইফ??’

ডক্টর মাথা নিচু করে রাখলো। বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেলো। সবার চোখে পানি। ভারী নিঃশ্বাস। বুঝে গেছে সবাই। রাহান আবারো বলল, ‘ডক্টর প্লিজ…আন্সার মি। আই এম আস্কিং ইউ…’

ডক্টর মাথা নিচু করে হালকা গলায় বললেন, ‘আই এম স্যরি মিস্টার রাহান আদমান। আমরা পারি নি। ওনার হেলথ কন্ডিশন ভালো ছিলো না। ব্লিডিং হয়েছে অনেক। আটকাতে পারিনি আমরা। আর আপনারা উনাকে নিয়ে আসতে দেরি করে ফেলেছেন। আমরা বাঁচাতে পারি নি। উই আর এক্সট্রিমলি সরি।’

এই কয়েকটা কথা…এলোমেলো করে দিলো সব। এলোমেলো করে দিলো সবার নিঃশ্বাস…বিশ্বাসকে। সবার গলায় কান্নার আহাজারি। রাহানের মাথা নিচু। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে খুব জোরে। আকাশ ক্ষনে ক্ষনে নীল রশ্মিতে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। রাহান মাথা নিচু করে পাগলের মতো হেসে বিরবির করলো, ‘এটা হতে পারেনা। হতে পারেনা এটা।’ সাথে সাথে ডাক্তারের কলার চেপে ধরে দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল, ‘আপনি.. আপনি মেরে ফেলেছেন আমার ঝুম..কে? আমার এই বাচ্চা চাই না। ওকে নিয়ে যান বিনিময়ে আমার ঝুমকোকে ফেরত দিন।’

রাহান কেদে উঠে ভিক্ষা চাইলো। ডাক্তার নিজের কলার থেকে রাহানের হাত সরিয়ে দিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘আপনার ওয়াইফ চেয়েছিলো বাচ্চাকে রাখতে।’

রাহানের কানে বজ্রপাত শুনালো কথাটা। মনে হলো বিদ্যুৎ আকাশে না রাহানের কলিজায় চমকেছে। ডাক্তার চলে গেলো। রাহান ময়লা যুক্ত ফ্লোরেই বসে পরলো। সবাই পাগল হয়ে গেছে…রাহান নিশ্চিত সবাই পাগল হয়ে গেছে। কিছু ঘন্টা আগেও যে মানুষটার সাথে সে ভালোবাসা-বাসি ভাগ করলো সেই মানুষটা কি করে নাই হয়ে যেতে পারে? কি করে? রাহান বিশ্বাস করে না। কেদে উঠে জোরে জোরে। রাহানের কাদার প্রতিটা শব্দ কাঁপন তুলে প্রত্যেকের মনে। জাহিদা রহমান এগিয়ে আসেন। ছেলেকে বুকের মাঝে নিয়ে বসে থাকেন। রাহান কাদতে কাদতে হাত পা ছড়িয়ে দেয়। বাচ্চাদের মতো আবদার করে,

‘আমি যখন যা চেয়েছি তাই তো দিয়েছো মা। এনে দাও এখন। আমার ঝুমকে এনে দাও…মা এনে দাও…ওকে ছাড়া আমি নিঃস্ব মা। ও এটা কিভাবে করতে পারলো? এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা? ও জানে আমি ওকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না তবুও আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। বাচ্চাটাই সব? কেনো চলে গেলে ঝুম? ফিরে এসো..ফিরে এসো।’

আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিতকার করলো।হাসপাতালের অনেকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাহানের আহাজারির দিকে। রাহান মাটি কাঁপিয়ে কেদে উঠে। তখনি রাহানের সামনে একটা চাকাওয়ালা বেড গড়িয়ে আসে। একটা মৃত মানুষ শুয়ে আছে তাতে। মুখসহ সারা শরীর ঢাকা সাদা কাপড়ে। রাহান উঠে দাঁড়ালো। কাঁপা কাঁপা হাতে খুব আস্তে করে কাপড়টা খুলল। ঝুমকোর মুখটা দেখে রাহানের হৃদয় কেঁপে উঠলো। খামচে ধরলো কেউ তার কলিজাকে। মেয়েটার মুখ দেখেই মনে হচ্ছে মারা যাওয়ার আগে সে অনেক লড়াই করেছে বাঁচার জন্য। শেষ পাতাটাকে বৃদ্ধি করার জন্য সে অনেক কষ্ট করেছে কিন্তু আল্লাহর কাছে হার মেনে গেছে।
লাল শাড়ি পরা ঝুমকোর গোলাপি ঠোঁটের কোনে তখনো লেগে আছে মৃদু পুলকিত হাসি। রাহান সেই হাসিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আশেপাশে কোনো জায়গা থেকে ভেসে আসছে সুর। রাহানের মনের মাঝে গেঁথে যাচ্ছে সেই গানের প্রতিটি লাইন। রাহান ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো ঝুমকোকে। হাসপাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করলো।

“চান্দের মতন মুখটি যখন ভাসতো নয়ন জলে,
আদর কইরা মুইছা দিতাম গালে,
ঘাটে আইসা পাশে বইসা জড়াইতো এই বুকে,
বলবো আমি এ কথা কেমনে?
তবে ভালো কেনো বাসিলা?
স্বপ্ন কেনো দেখাইলা?
ভালো কেনো বাসিলাই আমারে….?
ওও….লাল শাড়ি পড়িয়া কন্যা..
রক্ত আলতা পায়…
আমার চোখের জল মিশাইলা
নিলানা বিদায়…
তুমি ফিরাও চাইলানা একবার
চইলে গেলা হায়…”

এতোটুকুতে সুর বন্ধ করে দিলো নাম না জানা কোনো অজানা ব্যক্তি । রাহান তখন ঝুমকোর মৃত শরীর জড়িয়ে ধরে উন্মাদ হয়ে বলছে, ‘ফিরে এসো জান…আমার হৃদয়…আমার সুন্দর পাখি ফিরে এসো। কথা দিচ্ছি তুমি যা বলবে তাই করবো। একটা কথার খেলাপ ও হবে না আর। আসো কলিজা… আমার খুব কষ্ট হচ্ছে জান। তুমি আসবে না বলো?’

চলবে❤️

আগেই কেউ উত্তেজিত হবেন না।
গঠন মূলক মন্তব্যের আশা করছি……❤️

চলবে❤️
Surprise is coming in the next part………💥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here