অভিমান পর্ব ২

#অভিমান
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-২
যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘ভালোবাসা তো একটা মেয়ে এবং একটা ছেলেকে পরিপূর্ণ করে তোলে তাহলে সেই ভালোবাসাই কেনো এতো স্বার্থপর?’

তাহলে উত্তর হতে পারে, ‘ভালোবাসা যদি স্বার্থপর না হতো তাহলে কেউ ভালোবাসাকে ভালোবাসতো না। দুনিয়ায় ভালোবাসা নিয়ে প্রতিটা মানুষের মাঝে এতো সুখ, দুঃখ, কষ্ট, আহাজারি, হারানোর বেদনা-ভয় থাকতো না। ভালোবাসা তার নিজের স্বার্থেই বড্ড বেশি স্বার্থপর।

নিষ্পাদন মুখের দু’পাতা বন্ধ চোখের পুতুল পুতুল নারীকে নিজের বুকের মাঝে বিড়াল ছানা রূপে পরে থাকতে দেখে এই মুহুর্তে এই মহাবাক্যটি মনে হলো রাহান আদমান এর।

সত্যিই তো ভালোবাসা খুব স্বার্থপর! এই ভালোবাসাকে রাহান ঘৃণা করে। কিন্তু এই ভালোবাসার মানুষটা তাকে কাছে টানে। এই ব্যাক্তিটি…..বুকের মাঝে পরে থাকা এই উগ্রপন্থি কিন্তু তার গভীরে লুকানো আশ্চর্যজনক সুন্দর মেয়েটি তার জীবন উলোটপালোট এর মূল কারন। এই মেয়েটার জন্য সে একবার কষ্ট পেয়েছে। দূরে চলে গেছে সবকিছু চুকেবুকে। আবার এই মেয়েটার জন্যই তার বুক পুড়েছে। আক্ষেপ হয়েছে।

এতোদিন পর এই আশ্চর্যজনক গভীর সুন্দর মেয়েটির দেখা পেয়ে রাহান এর বুক কাপছে। ভয়ে এক বার হাত পা অসার হয়ে আসছে তো পরক্ষণেই আবার এই নিষ্পাদন মায়াবী মুখটার দিকে তাকিয়ে বুকে স্বার্থপর ভালোবাসারা খেলছে। কতদিন পর….কতদিন পর এই প্রান ভোমরার দেখা পাওয়া! কতদিন পর সেই প্রথম আবেগের সাথে সাক্ষাৎ পাওয়া! কতদিন পর সেই ভালোবাসা ফিরে পাওয়া!

রাহান অনুধাবন করে তার শরীর মৃদু কাঁপছে। সে চাইছে না নার্ভাস হতে তবুও হচ্ছে। রাহান তার কাঁপা কাঁপা হাত টা তুলে ঝুমকোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সাথে সাথে মনে হয়, কষ্ট গুলো তার গলায় এসে আটকে গেছে। চাপা কান্নার গলায় গভীর নিশ্চুপ সুরে আবেগী হয়ে শুধু একবার বলে উঠে,

‘ঝুমকোলতা…..’

,

নেতিয়ে যাওয়া শরীরে বল ফিরে পেয়ে দু’চোখের দ্বার গুলোকে আস্তে আস্তে করে খোলার চেষ্টা করে ঝুমকো। খোলার আগেই তার কানের কাছে গভীর গলায় কেউ বারবার ডাকে ‘ঝুমকোলতা..’। ঝুমকোর মাথা ঝিমঝিম করে উঠে। প্রায় সাথে সাথে বন্ধ চোখের পাতায় আবিষ্কার হয় অনেক অনেক পুরোনো স্মৃতি,,,,,

‘ঝুমকো রেইল লাইনের শক্ত পাথরের উপর দিয়ে তার ফর্সা খালি পায়ে হেটে চলেছে। পা পিছলে বারবার পরে যেতে নিচ্ছে কিন্তু বারবার কোনো ব্যাক্তি তাকে পরম আদরে সামাল দিচ্ছে। কখনো হাত ধরে আবার কখনো কোমড় জড়িয়ে মানুষটা ঠিক আগলে নিচ্ছে বিচ্ছু প্রানবন্ত সেই ঝুমকো টাকে। ঝুমকোও তখন প্রিয়তম মানুষটার গলা জড়িয়ে ধরে খিলখিল করে হেসে উঠছে।
সেই খিলখিল ধ্বনি যেনো ট্রেনের শব্দ থেকেও নিঁখুত, সূক্ষ্ম এবং ঢেউ খেলানো। রেইল লাইনের লোহার পাত বেয়ে যেনো ঝুমকোর খিলখিল হাসির শব্দ বেজে উঠে। আর তখনই সেই মানুষটি ক্ষীণ মুগ্ধতার স্বরে বলে উঠে, ঝুমকোলতা…। ঝুমকো তখন ঝাপিয়ে পরে প্রিয়তম মানুষ টার সুন্দর মাতাল বুকটায়।’

সেই মানুষটাই রাহান। বহু দিন পর প্রায় তিনবছর পর… পুরোনো সেই কন্ঠে ‘ঝুমকোলতা’ নাম শুনে ঝুমকোর শরীরের রগে রগে শীতল রক্ত স্রোত বয়ে যায়। একদম কনকনে ঠান্ডা স্রোত। গা শিরশির করে উঠে। আয়হায়! এভাবে শীতল রক্ত স্রোত বইলে তো ঝুমকো মারা পরবে।

ঝুমকো তখন অবধি চোখ খুলে নি। সে আবিষ্কার করে তার মসৃণ খাঁজওয়ালা গালে হাত রেখে হালকা থাপ্পড় দিয়ে কেউ বলছে,

‘ঝুমকোলতা। গেট আপ ঝুমকোলতা। ‘

ঝুমকো তার নিবন্ত, বিবর্ণ, ক্লান্ত চোখ গুলো খুলে তাকায়। মুখের উপর ঝুঁকে থাকা মানুষটাকে দেখে অহেতুক ভাবে ঝুমকো আবার চোখ দুটো বন্ধ করে।

বিরবির করে নিজের মনে বলে, ‘আজ মনে হয় আমি বেশি ড্রিংকস করেছি। তাই তো প্রতারক কে নিজের চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখছি। যে বারবার ক্ষীণ স্বরে ঝুমকোলতা ঝুমকোলতা করছে। এই নামটা তো বহু দিন আগেই নিঃশেষ হয়ে গেছে আমার জীবন থেকে। তবে আজ কেনো আবার এর উত্তোলন ঘটলো? যেই মানুষটাকে মনে করে আমি নিয়মাফিক প্রতিদিন আই হেইট ইউ বলে মদ্যপান করি শুধুমাত্র তাকে ঘৃণা করার জন্য, তাকে ভুলে থাকার জন্য। আজ সেই মানুষটাকে কেনো নিজের চোখের সামনে দেখছি? কেনো? নিয়তি আর কত খেল দেখাবে আমার সাথে?

ঝুমকো এবার চট করে তাকায়। সামনের মানুষটি যে আসলেই বসে আছে সেটা মস্তিষ্কে বোধ গম্য হতেই ঝুমকো ধাক্কা মেরে তার কোল থেকে উঠে পরে। চারপাশ টাতে তাকিয়ে দেখে সে একটা বড় গাড়ির মাঝে বন্দি। আর তার পাশেই বসে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রতারক। ঝুমকোর চোখ জোড়া আচমকা রাগে দাউদাউ করে জ্বলে উঠে। হাত মুষ্টিময় করে হলুদ টপসের কোণা খামচে ধরে সে।

রাহান ঝুমকোকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বেশ অবাক হয়। যেই মেয়ে লজ্জায় একসময় সেলোয়ার-কামিজ ছাড়া আর কিচ্ছু পড়তো না সেই মেয়ের এ কি ধরণের পোশাক! আর এই ক্লাবে ঝুমকো কি করে? এতো অধপতন!

রাহান থমথমে গলায় কিছু বলতে উদ্ধৃত হয়। তার আগেই ঝুমকো গাড়ির দরজা খুলে চোখের পলকে বেড়িয়ে পরে। রাহানের কথা তার মুখেই রয়ে যায়। মনের ভেতর হিংস্র অপমানবোধ টা জাগ্রত হওয়ার আগেই রাহান তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে বের হয়।

ঝুমকো চলে যাচ্ছে…..। রাহান দৌড়ে গিয়ে টেনে ধরে ঝুমকোর ডান হাত। ঝুমকো নিমিষেই থমকে দাঁড়ায়। ইশশ…কত বছর পর এই স্পর্শ! হাতে লেগে গেলো যে! আবার কবে উঠবে এই স্পর্শ? এই প্রতারকের মাদক মেশানো স্পর্শ যে ঝুমকোর চাই না। তা কি এই প্রতারক বুঝে না? ঝুমকো চকিতেই ঘুরে তাকায় রাহানের দিকে। রাগী গম্ভীর সাথে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,

‘আমার হাত ছাড়ো।’

রাহান ঝুমকোর হাত আরো শক্ত করে ধরে। ঝুমকোর চোখে চোখ রেখে শান্ত নিবিড় কন্ঠে বলে,

‘আই এম স্যরি।’

ঝুমকো কি যেনো ভেবে একটা হাসি দেয়। এক পা দু পা করে এগিয়ে যায় রাহানের সন্নিকটে। রাহান একটু ঘাবড়ায়। কিন্তু স্বভাবসুলত স্ট্রেইট ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।

রাহানের বাম পাশের বুকের উপর আস্তে করে নিজের মোলায়েম ফর্সা হাতটা রেখে নির্বিষে ঝুমকো বলল,

‘এই বুক টাকে আমার ক্ষত বিক্ষত করে দিতে ইচ্ছে করছে। প্রতারকের বুক বলে কথা!’

ঝুমকো তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। রাহানের বুকে চিনচিন ব্যাথা করে। বুকের মাঝে একটা ভয় খিচে খামচে কামড়ে ধরে। তবুও নিজের ইগো ছাড়ে না। তার মুখের ভাবান্তর সে দেখায় না। ঝুমকো আর এক মুহুর্ত সময় বিলম্ব করে না। হালকা পায়ে হেটে চলে যায় নিজের গাড়ির দিকে। রাহান ব্যথাতুর দু’নয়নে তাকিয়ে থাকে ঝুমকোর যাওয়ার পথে। চাপা কন্ঠে বারবার বলে,

‘স্যরি জান। স্যরি। স্যরি। স্যরি। স্যরি।’

__________________________________

নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে দিনশেষে ঠিক কতটি মানুষ জিততে পারে? কতটি মানুষ সুখ অনুভব করে? কতটি মানুষ নিজের জীবন কে ভালোবাসে? আহা! যারা নিজের জীবনকে ভালোবাসতে পারে তারাই এ দুনিয়াতে সার্থক। তাদের ভালোবাসাই সার্থক।

নিজের মাঝে খুব কষ্টে এতোক্ষন কান্নাগুলো আটকিয়ে রাখতে পারলেও চিরচেনা পরিচিত নিজের একান্ত ব্যাক্তিগত ঘরটাতে এসে তা উগ্রে ফেলে দেয় ঝুমকো। এক আহাজারি কান্নায় মেতে উঠে সে। জোরেসোরে বাধন ছাড়া কান্নায় ভেঙে পরে। বিছানার চাদর খামচে বালিশ মুখে ঢুকিয়ে কান্নায় উদ্বেল হয়ে উঠে তার ভারী বুক।

ঝুমকো আর পারছে না! খুব ভালোই এতোদিন সামলে নিয়েছিলো নিজেকে। খুব ভালোভাবেই তো নিজের জীবনটাকে জাহান্নামের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো সে। খুব ভাবে কঠিন হতে শিখেছিলো সে। আজ ও কঠিন ছিলো। ওই নিকৃষ্ট মানুষটার সামনেও কঠিন ছিলো। তবে এখন কেনো বুক ভারী করা কান্নায় মেতে উঠেছে এই দু’চোখ?

ঝুমকোর মনে চায় এই চোখ জলসে দিতে। অসহ্য তীব্র ব্যথায় কাতর হয়ে পরে ঝুমকো। তবুও মনেতে এক প্রশ্নই ঝড় তুলে, ‘এই প্রায় তিনবছর পর লোকটা কেনো এসেছে ফিরে?’ কোনো প্রতারকের প্রতি মায়া বাড়াতে যে চায় না ঝুমকো। এই প্রতারক তার সাথে প্রতারণা করেছে। তাকে ঠকিয়েছে। দীর্ঘ দু বছরের সম্পর্ক নিয়ে তার সাথে ছিনিমিনি খেলেছে। কাউকে কিচ্ছুটি না বলে সে পাড়ি জমিয়েছিলো দূর দেশে। এখন কেনো ফিরেছে?

এই লোকটা ঝুমকোর জীবন থেকে চলে যাওয়ায় পর ঝুমকোর ঠিক কি অবস্থা হয়েছিলো তা যদি সে একবার জানতো তাহলে তার মনেও ভালোবাসার উদয় হতো। বাপ মা মরা মেয়েটা একটা বছর কীভাবে গুমরে গুমরে এক ঘরে বন্দি হয়ে পার করেছে তা যদি রাহান জানতো তবে কখনোই ঝুমকোকে ফেলে চলে যেতো না। দীর্ঘ একটি বছর ঝুমকো ভারসিটির পরীক্ষা দেওয়া ছাড়া ঘর থেকে বের হতো না। তখন সে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে মাত্র। ধীরে ধীরে এক বছর চলে গেলো। ঝুমকো উঠলো থার্ড ইয়ারে। এরপর থেকেই ঝুমকো খারাপ এবং বাজে মেয়েদের খাতায় নাম লিখালো। একসময়ের টপার মেয়ে হয়ে গেলো নাম্বার ওয়ান ফাজিল, বেয়াদপ, মদখোর, নেশাখোর, ছেলেবাজ। সব ঠিক থাকলেও এই ছেলেবাজ কথাটি সম্পূর্ণ ভুল। ঝুমকো কখনো ছেলেবাজ ছিলো না। কারন এখন অবধি তার মন প্রান জুড়ে এক ছেলেরই বসবাস।

দিন কাটতে লাগলো। থার্ড ইয়ারে কোনোমতে টেনেটুনে পাশ করে ফোর্থ ইয়ারে উঠার পরই ঝুমকোর দেখা হলো সোহেলের সাথে। সোহেল তখন মাস্টার্স এ ভর্তি হয়েছে তাদের ভারসিটিতে । প্রথম দিন থেকে সোহেল ঝুমকোর পেছনে লেগে থাকতো। ঝুমকো নানানভাবে অপমান অপদস্ত করেছে কিন্তু তবুও এই ছেলে পিছন ছাড়েনি। ঝুমকোও আর কিছু বলেনি। সে শুধু দেখে গেছে সোহেলের চোখে চাপা রাগ, জিদ আর প্রতিশোধের আগুন। কিন্তু ঝুমকো সব হেসে হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়।

দেখতে দেখতে সোহেলের সাথে পরিচয় এক বছরের মতো হয়ে উঠে। ঝুমকো আবার কোনোমতে টেনেটুনে পাশ করে ফোর্থ ইয়ার। ব্যস, এরপর থেকে আর পড়াশোনার বালাই নেই। বিন্দাস তার লাইফ। মদ, লং ড্রাইভ, বন্ধুদের সাথে পার্টি মজা মাস্তি করেই তার দিন পার হয় আর সাথে তো চিপকে লেগে থাকা সোহেল আছেই।

আশ্চর্যের ব্যাপার এই জায়গায় যে, ঝুমকো কখনো সোহেলের সাথে ফোনে কথা বলে না। ইভেন ঝুমকো কখন কোথায় যায় তার খবরও দেওয়ার মতো কেউ নেই। কিন্তু তবুও ঝুমকো যেখানে থাকুক না কেনো সোহেল ঠিক পৌঁছে যায়। ঝুমকো নিশ্চিত তার পেছনে কোনো স্পাই লাগানো হয়েছে। লাগাক..। যে যত খুশি স্পাই লাগাক। ঝুমকো কেয়ার করে না।

কান্নার আহাজারি টা কমে এলেই ঝুমকো বাহিরের কাপড় নিয়েই বিছানায় শুয়ে থাকলো। তার চোখ ঘুমে ঢুলতে থাকলো। সে আস্তে আস্তে চোখ দুটো বন্ধ করলো। চোখ বন্ধ করার আগে সে অত্যন্ত মর্মাহত গলায় আস্তে করে বলে উঠলো,

“থেমে গেলে নিঃশ্বাস। হারাবে না বিশ্বাস।”

চলবে❤️

এই গল্পটা একটু ধৈর্য্য ধরে পড়তে হবে। ৫-৬ পর্ব পর্যন্ত একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে। তারপর আস্তে আস্তে গল্পের আসল কাহিনী শুরু হবে। সবকিছু সাজিয়ে উঠতে আমার এই কয়েকটা পর্ব লাগবে। তাই বলছি কেউ আমাকে চাপ দিবেন না। পড়তে থাকুন কোনো না কোনো পর্বে আপনাদের প্রশ্নের উত্তর থাকবে। আর যদি না থাকে সেক্ষেত্রে প্রশ্ন করবেন। ধন্যবাদ সবাইকে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here