#অভিমান
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-২৫
ঝুমকোদের বাড়ির বাগানে অনেকগুলো লাল মোরগ ফুলের গাছ হয়েছে সাথে বেগুনি, গোলাপি, সাদা রং এর ক্ষীরাই ফুলের গাছেও ফুল ফুটে আছে। যদিও ক্ষীরাই শীতের ফুল। তবে শীত তো সবে মাত্র শেষ হলো তাই ফুলের রেষ এখনো আছে। ছোট ছোট গাছে লাল লাল মোরগফুল আর রং বেরঙের ক্ষীরাই ফুল গুলো দেখলেই মনটা পেখম তুলে নাচে। ফুলের সেই পেখমের হরেক রং। বেগুনি, গোলাপি, লাল, সাদা, সবুজ। এতো সব রঙে ঝুমকোকে ময়ূরীর মতোন লাগে। যেই ময়ূরী বর্ষাকাল এলেই নেচে উঠে। উপরের আকাশ থেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পরছে আর এইদিকে ময়ূর পেখম তুলে অবিরাম অন্তহীন নৃত্য করছে। যেনো সে খুব অভিজ্ঞ নৃত্যরানী।
ঝুমকো ফুলগাছগুলোতে হালকা করে পানি দিচ্ছিলো। বাগানের কোনো একটা জায়গা থেকে বেলি ফুলের সুবাস আসছে। ঝুমকোর বমি চলে এলো। মাথা ঘুরছে। বেলি ফুলের সুবাস সে কখনোই সইতে পারে না। এতো কড়া গন্ধে দম আটকে যাবার উপক্রম। নাকে মুখে উড়না বেধে ঝুমকো গাছে পানি দেয়। সেদিনের পর থেকে এখন পর্যন্ত কেটে গেছে প্রায় দু’মাস। এখন অবধি নিয়ন একটা বারের জন্যও ঝুমকোর সামনে আসেনি। ঝুমকোর ও তো রাগ কম না। সেও কখনো নিয়নের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে নি। সেইদিন বাড়ি ফেরার পর ঝুমকো ভিষণ রকম ভয়ে ছিলো। ভয়ে ছিলো বলতে লজ্জায় ছিলো ছোটো ভাই মিনান কি না কি ভাবলো!
কিন্তু মিনান তেমন কোনোকিছু প্রতিক্রিয়া দেখাই নি। মিনানের আর কোনো ভাই বোন না থাকায় সে বরাবরই ঝুমকো আর রুমকে অনেক বেশি প্রায়োরিটি দিয়ে এসেছে। প্রকৃতি পক্ষে মিনান হলো ঝুমকোর মামার ছেলে। নাহ, ঝুমকোর একটাই আপন মামা। এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু মিনান হলো ঝুমকোর মায়ের একমাত্র চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। মাঝে মাঝে দেশে বেড়াতে আসলে মিনানরা ঝুমকোদের বাড়িতেই আসে। গ্রামের বাড়িতে তাদের যাওয়া হয় খুব কম। অনেক কম সময় নিয়ে আসে তো। কিন্তু এবার নিয়ে এসেছে…মিনান তিন মাসের ছুটিতে এসেছে এবার।
ঝুমকোর নাকে বেলি ফুলের ঘ্রাণটা ক্রমাগত ভাবে গাঢ় হয়ে লাগছে। ঝুমকোর মামীর আবার বেলি ফুল খুব পছন্দের। তাই বাগানের একপাশে চার-পাঁচ টা গাছ লাগিয়েছেন।
আর সইতে না পেরে ঝুমকো এবার বাড়ির ভেতর দিকে রৌনা দিলো। চোখ মুখ উলটে বমি আসছে। কি জানি ইদানীং প্রায় ঝুমকোর এমন হচ্ছে, মাথা ঘুরাচ্ছে, বমি বমি হচ্ছে। কাল তো গোসল করে এসে খাটে শুয়েই পরলো। এরপর অজ্ঞান হয়ে গেলো না কি ঘুমিয়ে পরলো ঝুমকোর ঠিক বোধগম্য হলো না।
ঝুমকোকে বাড়ির ভেতরে টলতে টলতে প্রবেশ করতে দেখলো কামিনী বেগম। তার ভ্রু দুটো নিছকই কুচকে এলো। হাতের তসবি গুলো ক্রমাগত দ্রুত গতিতে একটা পর একটা ছাড়িয়ে যেতে লাগলো। তার মুখ চলে বুলেটের থেকেও স্পিডে। ঝুমকো ক্লান্ত শরীরে উপরে গেলো। কামিনী বেগম গত চার-পাঁচ দিন থেকে লক্ষ্য করছেন ঝুমকোকে। ঝুমকোকে হঠাৎ দেখলে তার মনে হয় ঝুমকো একজন পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠেছে। এছাড়াও ঝুমকোর হাব ভাবে পরিবর্তন এসেছে। কিছু খেতে চায় না। কোনো কিছুর গন্ধ শুকতে পারে না। শুধু বলে, ছি! গন্ধ! বমি আসছে। আর চোখ মুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালিও পরেছে।
কামিনী বেগম চিন্তিত মুখে উঠে আসলেন উপরে। ঝুমকো ঘরে ঢুকেই বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিলো যাতে বেলি ফুলের গন্ধ কোনো ক্রমেই ঝুমকোর এই দো’তলার ডান পাশের জাকজমকপূর্ণ ঘরটাতে প্রবেশ করতে না পারে।
কামিনী বেগম ঝুমকোর কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কি হয়েছে নানুমনি?’
ঝুমকো নাক ছিটকে বলল, ‘বেলি ফুলের গন্ধ। উফফ মাথা ঘুরে এই গন্ধে।’
কামিনী বেগমের কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না এই ব্যপারে। কারন ঝুমকো কখনোই বেলি, শিউলি, বকুল, গন্ধরাজ, জুই এসব ফুলের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। কড়া গন্ধ নাকে এলেই না কি তার মাথা ঘুরে। কামিনী বেগম ঝুমকোর বিছানায় আস্তে করে বসলেন। ঝুমকো টলমলে পায়ে এসে কামিনী বেগমের পাশে বসলো। এরপর আস্তে আস্তে মাথাটা এলিয়ে দিলো কামিনী বেগমের বুকে।
বেশ কিছুক্ষণ ঝুমকোর কোনো সাড়া না পেয়ে কামিনী বেগম ওকে ডাকলো। কিন্তু ঝুমকো সজাগ হলো না। কামিনী বেগম আরো দু তিনবার ডাকে। ঝুমকোর থেকে কোনো রেসপন্স নেই। কামিনী বেগম একটু ভয় পেয়ে যান। ঝুমকোর গাল থাপড়ে ডাকেন। কিন্তু কাজ হয় না। কামিনী বেগম ঝুমকোকে আস্তে করে শুইয়ে দেয়। এ যে ঘুম নয় তিনি ভালো করেই বুঝতে পারছেন। পাঁচ মিনিটে ঘুমিয়ে যাওয়ার মতো বাধ্য মেয়ে ঝুমকো কোনো কালেই ছিলো না। কামিনী বেগমের অভিজ্ঞতাপূর্ণ মন অন্য কিছুর আভাস দিচ্ছে। পরক্ষণেই কি ভাবছে ভেবে নিজেকে নিজেই ধিক জানাচ্ছেন, ‘ছি ছি! কি ভাবছি এসব। আমার নানুমনির তো এখনো বিয়ে হয়নি।’
কামিনী বেগম আর সময় বিলম্ব করলেন না। ঝট করে ডাক্তার কে ফোন লাগালেন। কাউকে কিছু জানালেনও না। তার একমাত্র আদরের নাতনীর নামে তো আর কোনো কু রটা রটতে দিতে পারেন না তিনি। ঝুমকোর মামী গেছে এখন বাইরে কেনাকাটা করতে। বাড়িতে আদিম উদ্দিন ও নেই। রুম নিজের ঘরে ব্যস্ত এই সুযোগেই ডাক্তার ডাকতে হবে যাতে কেউ টের না পায়।
_______________________________
পুরো ঘর নিস্তব্ধতায় ঘেরা। কোথাও এক ফুটা আওয়াজ নেই, কলহ নেই একদম শান্তশিষ্ট। এই বাড়িতে যে এই মুহুর্তে কাজের লোক সহ পাঁচ ছয় জন বাস করছে সেটা বোঝার ও কোনো অবকাশ নেই। থমথমে পরিবেশ। ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ। যাতে এতোটুকু আওয়াজ কেউ ঘুণাক্ষরেও টের না পায়। ডাক্তার চলে গেছে ঝুমকোর জ্ঞান ফেরার পর। সাথে ঝুমকোকে বলে গেছে পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক অবিশ্বাস্য চমকপ্রদ কথা। ঝুমকো জ্ঞান ফিরেছে মিনিট দশেক হয়েছে। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর থেকে নিজের নানুমনির এহেন থমথমে এবং কিছুটা রাগী মুখ দেখে ঝুমকোর আত্মা কাপছে। নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে কামিনী বেগম রুষ্ঠ কণ্ঠে বলল,
‘এই ঘটনা ঘটলো কেমন করে নানুমনি?’
ঝুমকোর চোখে পানি চলে আসে। এতো বড় ভয়ানক কথা শুনেও তার নানুমনি তাকে এতো আদর করে ডেকে কথা বলছে! এখন ঝুমকোর কি করা উচিত? সত্যিটা বলে দেওয়া উচিত? কামিনী বেগম হালকা উচ্চস্বরে বললেন,
‘কথা বলো? কি করেছো তুমি এটা? কীভাবে করতে পারলে? আমাদের মান সম্মানের কথা একটা বার ও ভাবলে না?’
ঝুমকো কেঁপে উঠলো কামিনী বেগমের আওয়াজে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘নানুমনি…আসলে আমি.. আমি?’
‘বলি ওতো আমতা আমতা করছো কেনো? কাজটা করার সময় মনে ছিলো না? কাউকে পছন্দ হলে বলতে, এভাবে নিজের মান বিসর্জন দিয়ে…। ছি ছি ছি! বাবা কে এই সন্তানের?’ কামিনী বেগমের তেজি গলা।
ঝুমকো এবার কেদে দিলো। হেচকি তুলে কাদতে কাদতে বলল, ‘নানুমনি আমি বিয়ে করেছি।’
কামিনী বেগম বিস্ময়ে চুপ হয়ে গেলেন। যেনো তাকে বোবায় ধরেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর অবাকের সাগরে হাবুডুবু খেয়ে এসে আপন মনে বললেন, ‘কিহ??’
ঝুমকো কেদে কেটে বলল, ‘হ্যাঁ নানুমনি আমাদের বিয়ের বয়স প্রায় দু’মাস দশ দিন। নানুমনি, আমাকে মাফ করে দেও…নানুমনি। আমি ইচ্ছা করে করিনি। আমি তোমাদের না জানিয়ে বিয়েটা করতে চাই নি। আসলে পরিস্থিতি এমন ছিলো যে….।
ঝুমকোর কথার মাঝে কামিনী বেগম অত্যন্ত মর্মাহত চাহনি ফেলে বললেন, ‘ছেলেটা কে? রাহান?’
ঝুমকো মাথা নাড়ালো। কামিনী বেগমের হাটুতে মাথা রেখে অত্যন্ত হৃদয় শীতল করা বাচ্চাদের মতো করে বলল, ‘আই এম স্যরি নানুমনি। আর কক্ষনো এমন হবে না আই প্রমিজ।’
কামিনী বেগম ভ্রু কুচকে বললেন, ‘আর কক্ষনো হবে না মানে?’
‘মানে, আর কক্ষনো তোমাদের না জানিয়ে কিছু করবো না।’
কামিনী বেগম অতি সন্তপর্ণে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘জীবনের বড় কাজটাই করে ফেলেছো। এক, বিয়ে করেছো। দুই, বাচ্চা নিয়ে ফেলেছো। এখন আর কি করার বাকি আছে।’
কামিনী বেগমের কথায় ঝুমকো শব্দ করে কেদে দিলো। কামিনী বেগম জড়িয়ে ধরলেন আদরের নাতনীকে। একটামাত্র নাতনীকে তিনি অনেক আদর দিয়ে মানুষ করেছেন এতো আদর রুমকেও করেননি কখনো। কামিনী বেগম বাচ্চাদের মতো ভোলাতে ভোলাতে বললেন, ‘কাদে না আমার সোনা। কাদে না। বারবি ডল দের কাদতে নেই নানুমনি।’
ঝুমকো আরো শব্দ তুলে কেদে বলে, ‘সিন্ড্রেলা কেনো রাগ করছে? আমার যে কষ্ট হয়। আমি তো ইচ্ছে করে কিছু করিনি।’
কামিনী বেগম ঝুমকোর মাথায় চুমু দিয়ে বললেন, ‘পাগলী, আমি রাহানকে ফোন করছি। বাবা হতে চলেছে…খবর দিতে হবে না? আর বিয়ের ব্যবস্থাও তো করতে হবে। আজ কালকের মধ্যেই রাহানের মায়ের সাথে আমি কথা বলবো। ‘
কামিনী বেগম চলে যেতে নিলে ঝুমকো পেছন থেকে ‘নানুমনি’ বলে ডেকে উঠলো। কামিনী বেগম পেছন ফিরে মুচকি হেসে বললেন, ‘ভয় নেই। বাচ্চার ব্যপারে কাউকে কিচ্ছু বলবো না। রাহানের মাকেও না।’
কামিনী বেগম ঘর থেকে চলে গেলেন। ঝুমকো আপন মনে তৃপ্তিভাবে হাসলো। এরপর নিজের পেটে অতি মমতাভরা হাতটি রেখে বলল, ‘আমার পেটে আছিস? আমার কথা শুনতে পারছিস? কি করে এলি বলতো তুই?’
ঝুমকো নিজের কথা শুনে নিজেই হেসে উঠলো।
,
বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে ঝুমকো। হাতে ফোন। বিভিন্ন বাচ্চাদের ছবি দেখছে। সে শুনেছে, মা হওয়ার সময় যে যত বেশি সুন্দর মানুষদের দেখে পেটের বাচ্চা ততো বেশি সুন্দর হয়।
ঝুমকো ফোন থেকে চোখ সরালো তখন। যখন হন্তদন্ত রাহানকে ঘরে ঢুকতে দেখলো। রাহানকে এভাবে দেখে ঝুমকো উঠে বসলো। রাহান ঝুমকোর পাশে বসে বেশ কিছুক্ষন হাপালো। এরপর কাঁপা স্বরে বলল,
‘নানুমনি এটা কি বলল?’
ঝুমকো মুচকি হাসলো। কিছুটা লজ্জার আবার কিছুটা বিভ্রান্তিকর। রাহান ঝুমকোর পেটে হাত রেখে অতি উত্তেজনার স্বরে বলল, ‘এখানে? বেবি আছে?’
ঝুমকো মাথা নাড়ালো। রাহান বড় বড় চোখ করে বলল, ‘কেমনে হলো?’
ঝুমকো সাথে সাথে রাহানের বাহুতে একটা চর মেরে বলল, ‘ফাজিল। আমি জানি কেমনে হইলো?’
রাহান হেসে ঝুমকোকে জড়িয়ে ধরলো। ঝুমকোর চুলের ভাজে গোপন সান্নিধ্যে চুমু দিলো। রাহানের চোখ বেয়ে গোপন আড়ালে পরে গেলো দু’ফোঁটা পানি। কেউ বুঝলো না। রাহান নিজেও না। রাহান ঝুমকোর চোখে চোখ রাখলো এরপর উত্তেজনায় অতি আপন ভাবে চেপে ধরলো ঝুমকোর হাত। চোখে চোখে কথা হলো কিছুক্ষণ। দুজনের মুখে হাসি। তৃপ্তিকর সন্তুষ্টির হাসি। রাহান বলল, ‘বেশি খারাপ লাগছে? কষ্ট হচ্ছে?’
‘কষ্ট হচ্ছে মানে? এখনি যা শুরু করেছে! একটু আগেও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম তাই তো নানুমনি জেনে গেলো সব। কালকেও অজ্ঞান হয়েছিলাম কিন্তু জ্ঞান ফেরার পরে ভেবেছি বোধ হয় ঘুমিয়ে পরেছিলাম। কিছুদিন থেকে ক্রমাগত বমি হওয়ার পরও আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। আজ ডাক্তার এনেছিলো বলেই না জানতে পারলাম।’
ঝুমকো সব বলছে এক নিঃশ্বাসে হেসে হেসে। এদিকে কেউ যে অতি সুক্ষ্ম কপাল ভাঁজ করা বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে সেদিকে তার হুশ নেই।ঝুমকো কথা শেষ করে থামলো। রাহান সন্দিহান গলায় বলল, ‘অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে?’
রাহানের গলায় হালকা তেজের ছটা। ঝুমকো হুশে আসলো। কাকে কি বলে ফেলেছে ভেবেই সন্তর্পণে জিব কাটলো। রাহান এবার চড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘ কথা বলছো না কেনো? অজ্ঞান হয়ে পরেছিলে?’
ঝুমকো কেঁপে উঠে আস্তে করে উত্তর দিলো, ‘হুম।’
রাহান সাথে সাথে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো। কয়েক মিনিট জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে চুল গুলোকে মুঠো করে ধরলো। মিনিট দুয়েক পর ঝুমকোর হাত ধরে টেনে নিয়ে খুব অস্থিরতার সাথে বলল, ‘চলো।’
‘কোথায়?’ ঝুমকো অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো।
‘উঠো, তাড়াতাড়ি। হসপিটালে যাবো। এই বেবি লাগবে না।’
ঝুমকো চিল্লিয়ে বলল, ‘কিহহ? আর ইউ ক্রেজি রাহান?’
রাহান দ্বিগুন স্বরে চিল্লিয়ে বলল, ‘ইয়েস আই এম..আই এম।’ ঝুমকোর দু গালে হাত রেখে আবার বলল, ‘আমার ঝুমকোলতাকে যে কষ্ট দিবে তাদের কাউকে রাখবো না। বেবিও লাগবে না আমার। এখনি এই অবস্থা! পরে কি হবে কে জানে।’
রাহানের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো হঠাৎ। খুব আশ্চর্যজনক বিষয়! কেউ এতো পাগলও হয় বুঝি? ঝুমকো রাহানের মুখ ধরে ওর কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘এভাবে ঝুমকোলতা ডেকো না। মরে যেতে ইচ্ছে হয় তো আমার।’
রাহান ঝাপটে জড়িয়ে ধরে ঝুমকোকে। ঝুমকো হালকা একটু হেসে বলল, ‘রাহান দেখো, প্রতিটা মায়ের এই সমস্যা গুলো হয়। তুমি আমার টেক কেয়ার করবে দেখো আমি একদম সুস্থ থাকবো। আমাকে বিশ্বাস করো তো?’
রাহান বাচ্চাদের মতো মাথা ঝাকিয়ে বলল, “থেমে গেলে নিঃশ্বাস হারাবে না বিশ্বাস।”
ঝুমকো হেসে রাহানের কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকায় এরপর নিজেও বলে। অনেক গভীরতা নিয়ে আস্তে আস্তে করে বলে, “থেমে গেলে নিঃশ্বাস হারাবে না বিশ্বাস। ”
#অভিমান
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-২৬
চোখে গাঢ় মোটা করে দেওয়া কালো রঙের কাজল দেখে হঠাৎ মনে হচ্ছে, এই বুঝি স্বচ্ছ দীঘির বুকে এক ফালি কালো কলংক লেগে গেলো! চোখা শ্যমলা স্নিগ্ধ গাল দুটো দেখলেই মন বলে, ‘আজ একটু ভালোবাসি।’ পাতলা ফিনফিনে ঠোঁটের ভাজে লাল লিপস্টিক বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠাবে ক্ষনে ক্ষনে । বোধ হচ্ছে এমন যে, স্বচ্ছ ঝকঝকে সাদা কাপড়ে অসর্তকতাবশত একটু লাল রং লেগে গেছে। গায়ের সেই নীল রঙের শাড়িটা দেখলেই চোখের তাঁরা জ্বলে উঠে। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ গুলো জানান দেয়, আজ বুঝি নিজের গায়ে গোটা আকাশ জড়িয়ে নিয়েছে। আলতা রাঙা পা দুটো যেনো খুব করে আকর্ষণ করবে। খুব করে বলবে ‘আজ একটু ভালোবাসো।’
আয়নায় আরেকবার নিজেকে দেখে নিলো প্রাপ্তি। মাথার চুল মাঝখানে সিঁথি করে খোপা করেছে। সেই খোপা যেনো প্রাপ্তির শরীরে মূল ঐশ্বর্য ফুটে তুলেছে। কালো খোপায় লাল টকটকে গোলাপ ফুলগুলো দেখলেই বুকটা কেমন হু হু করে। কালোর মধ্যে লাল! একি ভালোবাসার চিহ্ন? নাকি বেদনার দুঃখ?
প্রাপ্তিদের বড় করে অনুষ্ঠান করে বিয়ে হয়েছে। আপাতত প্রাপ্তিরা এখন ঢাকার ধানমণ্ডির নিয়নের এই বিলাশবহুল ফ্ল্যাট টাতেই আছে। এ দু’মাসে বদলেছে অনেক কিছু। বদলেছে অনেক গল্প। বদলেছে প্রাপ্তির অবুঝ মন। যে মনে এখন শুধু এবং একমাত্র নিয়নের ই বাস। বন্ধু থেকে কখন যে নিজের অতি একান্ত আপন প্রিয় মানুষ হয়ে উঠলো প্রাপ্তি টেরই পেলো না।
কিন্তু নিয়ন…? তার কি খবর?
তার একটা ভালো চাকরি হয়েছে। বাড়ি, গাড়ি সব হয়েছে। কিন্তু মন জুড়ে এখনো ঝুমকোই রয়ে গেছে। সে স্থানে প্রাপ্তির কোনো জায়গা নেই। প্রাপ্তিকে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড ছাড়া আর কোনো সম্মানই সে দিতে পারে নি। প্রাপ্তির অনেক কষ্ট হয়। একসময়ের সেই হাসি খুশি প্রান-চঞ্চল মেয়েটা কেমন যেনো নেতিয়ে যাচ্ছে। ঝরা বকুলের মতো ঝরে যাচ্ছে দিনকে দিন। কেনোই বা ঝরবে না! তার দু’বন্ধু দু প্রান্তে। ঝুমকোর সাথে যোগাযোগ হয়না প্রায় এক মাস। এমন কি ঝুমকো প্রাপ্তির বিয়েতেও আসেনি নিয়নের মুখোমুখি হতে হবে বলে। প্রাপ্তি কষ্টে সেদিন বুক ফাটিয়ে কেদেছিলো। কথায় বলে, এক সময়ের হাসি খুশী মানুষগুলো অন্য সময়ে গিয়ে অনেক কষ্ট পায়। তাই বোধ হয় প্রাপ্তিও কষ্ট পাচ্ছে। না পাচ্ছে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে আর না পাচ্ছে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড টাকে।
প্রাপ্তি তার সম্মুখের আয়নায় একবার ঘোলা চোখে তাকালো। বেহায়া চক্ষু নয়ন থেকে পানি গড়িয়ে পরার আগেই তা মুছে নিলো পাছে যদি কাজল লেপ্টে যায়। আরেকবার ভালো করে নিজেকে আয়নায় দেখে মুখটাতে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে তুলল। আজ সে সেজেছে! নিয়নের জন্য সেজেছে। জানে না কি হবে? নিয়ন কি রিয়েক্ট করবে? কিন্তু প্রাপ্তির আজ খুব সাজতে ইচ্ছে করেছে। নিজের অবুঝ মনটাকে শান্ত করার জন্য হলেও আজ এই সাজ টা প্রয়োজন ছিলো।
অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে কলিং বেল বেজে উঠলো। প্রাপ্তি শাড়িটা আরেকটু ভালো মতো ঠিক করে শোবার ঘরের লাইট টা অফ করে দিয়ে গেলো দরজা খুলতে। বুক কাপছে। ধিরিম ধিরিম করে শব্দ হচ্ছে। প্রাপ্তি দরজা খুলল অনেক জড়োসড়ো হয়ে।
প্রাপ্তিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলো নিয়ন। প্রাপ্তিকে এমন বেশভূষায় দেখে তার ভ্রু কুচকে গেলো। তবুও রসিকতার স্বরে বলল, ‘কি রে এতো আটা ময়দা মাখছস কেন? কই যাস?’
প্রাপ্তি হাত বাড়িয়ে নিয়নের কাধ থেকে ব্যাগ টা নিলো। এরপর একটু ধাতস্থ কণ্ঠে বলল, ‘এমনি সাঁজলাম।’
নিয়ন ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘আগের থেকে কিন্তু দেখতে প্রচুর সুন্দর হয়ে গেছস।’
নিয়নের এইটুকু কথাতেই যেনো প্রাপ্তির খুশি উপচে পরলো। ঠোঁট নিজ দায়িত্বে প্রসারিত হয়ে হাসলো। এমন একটা কথা এই সময়ে খুব দরকার ছিলো। প্রাপ্তি নিয়নকে বললো, ‘যা ফ্রেশ হয়ে আয়। খেতে দিচ্ছি।’
‘খেয়ে এসেছি। এক কলিগের বিবাহবার্ষিকী ছিলো। ট্রিট দিয়েছে।’
‘ওহ। ফ্রেস হ তাহলে।’
নিয়ন শোবার ঘরে গিয়ে লাইন অফ দেখে দ্বিতীয় বারের মতো ভ্রু কুচকালো। একবার প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে লাইট জ্বালিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই নিয়ন দেখলো ঘরের লাইট আবারও বন্ধ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিয়ন কিছুই দেখতে পারছে না। সে অন্ধের মতো হেটে আসলো রুমের মাঝখানে এরপর দু-তিন বার জোরে জোরে প্রাপ্তিকে ডাকলো। কারোর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আরেকটু এগিয়ে যেতেই নিয়ন খেয়াল করলো কেউ আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে জড়িয়ে ধরেছে। সেই অজানার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস নিয়নের গলায় আছড়ে পরছে। সাথে একটু নাক টানার শব্দ। নিয়ন হাত উঠাতে গেলে শাড়ির আঁচলে হাত লেগে গেলো। প্রাপ্তি ই যে এমন আষ্ঠেপৃষ্ঠে তাকে জড়িয়ে ধরেছে তা বোধগম্য হতেই অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছে গেলো। ক্ষীণ স্বরে ডাকলো,
‘প্রাপ্তি…. ‘
প্রাপ্তি নিয়নের দিকে অদ্ভুত সপ্রতিভ চাহনি ফেলল। তখন বারান্দা থেকে নীল বর্ণের এক হালকা আলো এসে পরছিলো প্রাপ্তির মুখে। নিতান্তই তাকে খুব আকর্ষণীয় লাগছিলো সেই ক্ষীয়মান আলোতে। নিয়নের গালে দু’হাত রেখে ছলছল চোখে বলল, ‘আজ হারাবি আমাতে?’
কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে গেলো নিয়ন। থমকে গেলো হৃদপিন্ড। নিঃশ্বাস পড়লো দ্রুত গতিতে। বাতাসে অস্বস্থিকর এর ছোঁয়া। বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে নিয়ন স্তম্ভিত। প্রাপ্তির মাথা ঠিক আছে তো? প্রাপ্তি নিয়নের শার্টটা খামচে ধরলো। ভাঙা গলায় বলল,
‘আমি তোকে ভালোবেসে ফেলেছি নিয়ন। তুই কবে বাসবি বল তো? তোর মনে আছে কাজী অফিসে তুই বলেছিলি যেদিন আমি ভালোবাসবো, যেদিন তুই আমাকে ভালোবাসবি সেইদিন বউয়ের অধিকার দিবি। সব ঠিক থাকবে। স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন কাটাবো আমরা। আমি তো ভালোবেসে ফেলেছি। তুই কবে বাসবি রে?’
নিয়ন কথা বলল না। নিষ্পলক ধাতস্থ চাহনি ফেলল প্রাপ্তির উপর। মেয়েটার মুখ আজ বড়ই স্নিগ্ধ! মায়া মায়া! কি করবে নিয়ন? প্রাপ্তিকে বউয়ের অধিকার দিলেই কি নিজের মনের অধিকারটুকু দিতে পারবে? হ্যাঁ, এই দুই মাসে নিয়ন প্রাপ্তির উপর নির্ভর হয়ে পরেছে। প্রাপ্তি ছাড়া তার এক মুহুর্তও চলে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাপ্তির মুখটা না দেখলে তার সারাদিন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ক্লান্ত নিয়ন অফিস থেকে ফিরে প্রাপ্তির ঝাড়ি না শুনলে রাতটা বিষাদ লাগে। কিন্তু তাই বলে কি নিয়ন ভালোবেসে ফেলেছে? ভালোবাসা আর অভ্যাস কি এক? হয়তো এক। কারন নিয়ন তো ঝুমকোকে ছাড়া দিব্যি এই দু মাস কাটাতে পেরেছে। হাজার কষ্ট হলেও পেরেছে তো। কিন্তু প্রাপ্তিকে ছাড়া দু মিনিট কি কাটাতে পারবে?
নিয়ন খুবই করুন চোখে তাকালো প্রাপ্তির ওই মুখশ্রীর দিকে। প্রাপ্তির কাজল রাঙা ওই ঐশ্বরিক চোখ৷ দুটো থেকে তখন ঝরে পরছে ঝর্ণার ধারা। নিয়ন হঠাৎ কোলে তুলে নিলো। প্রাপ্তি নিয়নের গলা ঝাপটে ধরে নিজের ঠোঁট চেপে কান্না দমালো। চোখের পানিতে মুখে নোনতা নোনতা স্বাদ অনুভব হলো। প্রাপ্তিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিয়ন গভীর গলায় বলল,
‘তুই আমার অভ্যাস হয়ে গেছিস। তোকে ছাড়া আমার এক সেকেন্ড ও দম বন্ধ লাগে রে…। এই পৃথিবীতে আর কিছু পাই বা না পাই তোর মতো একজন বন্ধুকে আমি স্ত্রী হিসেবে পেয়েছি। যে আমাকে সবসময় বুঝেছে। আমার মন বুঝেছে। আমাকে এতোদিন আগলে রেখেছে।’
প্রাপ্তি শব্দ তুলে কেদে জড়িয়ে ধরলো নিয়নকে। নিয়ন প্রাপ্তির কপালে চুমু দিলো। প্রাপ্তিকে আদর করার মাঝেই নিয়নের ভেতর থেকে আরেক নিয়ন খুব বিজ্ঞ সুরে বলে উঠলো,
“না হোক ভালোবাসা, তাতে কি? পৃথিবীর সবাই কি ভালোবাসা পায়? সব স্বামী স্ত্রী কি ভালোবেসে সংসার করে? ঝুমকো না হয় পুরো বুক জুড়ে থাকুক তার মধ্যে কোনো একটা কোণায় না হয় প্রাপ্তির বসবাস হোক। ওর জন্যেও ভালোবাসা বরাদ্দ করা যাক।”
কেউ শুনলো না এই ব্যথানাশক মনের বাণী। শুনলো শুধু নিয়ন একা। শুধুই একা। যতই সে হেসেখেলে বেড়াক….সারাদিন মানুষের কোলাহলে থাকুক…রাত হলে স্ত্রীর আদর সোহাগ পাক কিন্তু সত্যিকার অর্থে, সে বড্ড একা। এই মনের দায়ভার নেওয়ার ক্ষমতা তার হয় না। দিনশেষে একটা আপসোস তার মনে হানা দেয় বারংবার। ভালোবাসার আপসোস! জীবনটা রঙিন হয়েও সাদা-কালো ডোরাকাটা হওয়ার ক্ষীণ যন্ত্রণা এই নিষ্পাদন মনটাতে ব্যথা তুলে ক্ষনে ক্ষনে।
_________________________________
ফ্ল্যাটে ঢুকেই শব্দ করে দরজা লাগিয়ে হনহন করে ভেতরে চলে গেলো রাহান। শব্দে কেঁপে উঠলো ঝুমকো। তার মুখটা এখন ভয়ে পাংশুটে হয়ে আছে।তবুও একটা মাত্র জামাইয়ের মান ভাঙানো বাঞ্চনীয়। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলো সে। উত্তরার এই ছোটো খাটো গুছানো ফ্ল্যাটটা ঝুমকোর ভীষন প্রিয়। এখানে আসলেই কেমন নিজের সংসার নিজের সংসার গন্ধ পায় ও!
রাহান বসে আছে মাথায় এক হাত রেখে কপাল চেপে। মুখ রাগে লাল। মাত্র দু’মাসেই ঝুমকোর শরীরের অবস্থা বেহাল। শুকিয়ে পাটকাঠি হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। তার মধ্যে কিছু খেতে তো পারেই না উল্টে বমি হয় দিনে দু তিন বার। ডাক্তার দেখানোর সাথে সাথে ডাক্তার গম্ভীর মুখে বলেছেন,
‘উনার হেলথ কন্ডিশন ভালো না। এখনি বাচ্চা নেওয়া ঠিক হয়নি। হেলথটা আরেকটু ডেভেলপ করে তারপর বেবি নেওয়ার উচিত ছিলো আপনাদের। শরীরের ওজন একদম কম। মাত্র চুয়াল্লিশ কেজি। তার উপর লো প্রেসার। শরীর দূর্বল। তাই তিনি বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। বমি হচ্ছে।’
ব্যস, আর কি লাগে! সেই থেকেই রাহানের রাগ। থমথমে মুখ করে বসে আছে। একটা কথাও বলেনি ঝুমকোর সাথে।
ঝুমকো এসে রাহানের পাশে আস্তে করে বসলো। রাহানের বুকে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে বাচ্চাদের মতো করে বলল, ‘আমার সাথে এমন করলে কিন্তু আমি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে যাবো। একদম মরে যাবো।’
রাহান সাথে সাথে ঘুরে তাকালো। নিজের বুক থেকে প্রেয়সীর মাথাটা তুলে ওর সারা মুখে অজস্র চুমু দিলো। ঝুমকো ঠিক দেখতে পেলো রাহানের চোখের কোনায় চিকচিক করা মুক্তোগুলো। রাহান আবারো ঝাপটে ধরলো ঝুমকোকে নিজের সাথে। এরপর কান্না সুরে তেজি গলায় বলল,
‘একদম এসব কথা বলবি না। তোকে ছাড়া আমি বাচঁবো না তুই বুঝিস না?’
‘তাহলে আমার সাথে কথা বলো না কেনো হুম?’
রাহান চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে ঝুমকোকে বুঝিয়ে বলল,
‘জান দেখো, আমরা এখন বাচ্চা না নেই। তুমি তোমার হেলথটা আরেকটু ডেভেলপ করো। তারপর আমরা অনেক বাচ্চা নিতে পারবো। কিন্তু তোমার কিছু হলে তোমাকে আমি কোথায় পাবো?’
‘বাচ্চা অনেক হবে মানলাম। কিন্তু এক ই বাচ্চা তো আর হবে না।’
‘মানে?’
‘মানে..এই যে আমার পেটে এখন যেই বাচ্চা আছে। ধরো মেয়ে বাচ্চা। পরেরবার নিলে তো ছেলেও হতে পারে। এই বাচ্চা তো আর আমি পাবো না। আর তাছাড়া বাচ্চা নষ্ট করা অনেক পাপ।’
রাহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাড়ালো। দাঁত কটমট করে বলল, ‘তুমি তাহলে এই বাচ্চা রাখবেই?’
ঝুমকো নিজের সিদ্ধান্তে অটল, ‘হুম রাখবো, আর তুমি যদি আরেকবার বাচ্চা নষ্ট করার কথা বলো তাহলে আমি তোমার সাথে আর কথা বলবো না।’
রাহান রেগে চুল মুষ্টিবদ্ধ করে ধরলো। সামনের মোড়ায় একটা লাত্থি মেরে হনহন করে চলে গেলো।
রাহান চলে যেতেই ঝুমকো ধপ করে বিছানায় বসলো। শরীর খারাপ লাগছে। কিছুক্ষণ বিছানায় উলোট পালোট করে ফোন হাতে নিলো।
,
বিকাল বেলার সোনালতা ম্লান আলোয় বসে আছে প্রাপ্তি। মলিন মুখটাতে তবুও একটু হাসি। নিয়ন এখন অফিসে। বিকালে বারান্দার এই যত্নকরে বেড়ে উঠা গাছগুলোর সাথে সময় কাটাতে প্রাপ্তির ভালো লাগে। ক্লাস করতে যায় না অনেক…দিন। আর ভালো লাগে না পড়াশোনা। দেখা যাক আবার শুরু করা যায় কিনা সব।
প্রাপ্তি পাশঁকুড়া ফুল গাছগুলোতে পানি দিচ্ছিলো। যদিও এগুলো শীতকালীন ফুল। এই ফুল দেখতে হয় অনেকটা হলুদ-কমলা গাঁদা ফুলের মতো। প্রাপ্তির ভালো লাগে। পাশেই ছোট্ট বেলি ফুল গাছটাতেও পানি দিলো। বেলি ফুল তার খুব প্রিয় একটা ফুল। এই ফুলের গন্ধ পেলে মনে হয় দীর্ঘকালের অনেক আকাঙ্ক্ষিত বস্তুটির শোভন ফুটে উঠেছে। প্রাপ্তিকে আকর্ষিত করছে। ভালোবাসার মানুষটা এইতো একদম কাছে!
প্রাপ্তির ফোন বেজে উঠলো। ফোনের স্কিনে ঝুমকো নামটা দেখেই তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করলো। খুশিতে উপচানো কণ্ঠে বলল, ‘দোস্ত।’
ঝুমকো ক্লান্ত গলায় বলল, ‘বা*র দোস্ত, এখন সোহাগ দেখাও তাই না? একটাবার ফোন কইরে খোঁজ নিবার পাইলা না? আচ্ছা আমি কি এতোই দূরের মানুষ হয়ে গেছি রে? কেউ খোঁজ নেস না আমার।’
শেষের কথা গুলো বলতে গিয়ে ঝুমকো কেদে ফেলল। প্রাপ্তি তার নিজস্ব সুরে বলল, ‘দূর মিয়া, কথায় কথায় সেন্টি খাইস নাতো। কান্দোস কেন? তুই জানোস না কতো ভেজাল? নিয়ন আর আমার মধ্যে কিচ্ছু ঠিক ছিলোনা।’
‘এখন ঠিক হইছে?’
প্রাপ্তি চোখ টিপ মেরে ভাব নিয়ে বলল, ‘ঠিক হইছে মানে? কয়দিন পর খালামনি ডাক শুনবা গ্যারান্টি। যদি আল্লাহ দেয় আরকি!’
ঝুমকো হাসলো, ‘ আলহামদুলিল্লাহ। সব ঠিক হলেই তো ভালো।’
‘তা তোমার সুখবর কবে শুনাবা?’
ঝুমকো লজ্জা পেলো। লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল, ‘দু মাস।’
প্রাপ্তি আমোদিত গলায় বলল, ‘ওহ হো। দু মাস। তার মানে দু মাস পরেই প্রসেসিং চলবে? এখন প্ল্যানিং…।’
ঝুমকো ঝাড়ি মেরে বলল, ‘ধ্যাত, কি আউল ফাউল কথা কস। বললাম, দু’মাস ধরে ক্যারি করতাছি। শরীরের যাচ্ছে তাই অবস্থা!’
প্রাপ্তি চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে চিল্লিয়ে বলল, ‘কিহ?? এতো তাড়াতাড়ি? নাহ এ হতে পারেনা। কাবি নেহি। আমি তো ভাবছিলাম আমি তোর আগে প্রেগন্যান্ট হমু। এরপর আমার পোলার লগে তোর মাইয়ার বিয়া দিমু।’
ঝুমকো হেসে বলল, ‘কেনো আমারও তো ছেলে হতে পারে।’
‘জিন্দেগিতে না তোর মেয়েই হবো।’
তখনি ঘরে রাহান এলো। ঝুমকোর কান থেকে ফোনটা খচ করে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘শালিকা, আই এম ভেরি মাচ এংরি অফ ইউ।’
‘কেনো কেনো দুলাভাই?’
‘এই যে খোঁজ খবর নেও না।’
রাহান প্রাপ্তির কথার মাঝে বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো। ঝুমকো দরজা খুলতে গেলো। রাহানের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে বলল, ‘তুমি কথা বলো আমি দেখি কে এসেছে?’
দরজা খুলা মাত্রই কেউ সজোরে ওর গালে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে থাপ্পড় মারলো। ঝুমকো নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পেরে ফ্লোরে গড়িয়ে পরে যেতে লাগলো। পরার আগেই দুটো শক্তপোক্ত ভরসার হাত এসে ওকে আগলে নিলো।
চলবে❤️
রেসপন্স করবেন সবাই দয়া করে। রোজার দিন কষ্ট করে প্রতিদিন গল্প লিখে দিচ্ছি তবুও একবারও বলি নি, ‘যে আমি গল্প দিতে পারবো না। রোজার মাস কষ্ট হয়।’ তারপরেও আপনারা রেসপন্স করতে চান না। একটা লাইক কমেন্ট করতে তো বেশি সময় লাগে না। তবুও আপনারা এমন করেন। একটু ভেবে দেইখেন আমরা কত কষ্ট করে গল্প লিখে দেই😒
চলবে❤️