#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-১২
লেখনীতে-তানিয়া শেখ
জরুরী বিভাগের কাঁচের জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে পাশা হক। বেডে নিথর পড়ে থাকা একমাত্র পুত্রকে দেখছে একদৃষ্টে। তার চোখে আজ আর পানি নেই। অনাবৃষ্টিতে জমিন যেমন রুক্ষ, নির্মম হয়ে ওঠে। তার চোখের চাহনিতেও এখন তাই স্পষ্ট। পুত্র হারানোর ভয়ে একদিকে যেমন ভীত অপরদিকে শত্রুকে বধের নেশায় উন্মত্ত।
সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো তার ভেতরে লাভা বুদ বুদ করছে। পুত্রের হত্যাচেষ্টাকারীর ধ্বংসী হতে চায় সে। নিশ্চিহ্ন করতে চায় পৃথিবী থেকে। কিন্তু এই মুহূর্তে পুত্রের খোলা চোখ দেখার আশে সব ভুলে আছে।
“সেই সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছেন এখানে, ভাইজান। দুপুর হতে চললো। চলুন কিছু খেয়ে নেবেন।” পাশ থেকে বলল জামশেদ। জামশেদ তার একমাত্র শ্যালিকার স্বামী। অন্য সময় হলে তার সান্নিধ্য পছন্দ করত না পাশা হক। তিক্ত কিছু বলত। জামশেদ তার কাছে খুবই অপছন্দের লোক। অথচ, এই অপছন্দের লোকের কন্যাকেই কি না পুত্রবধূ করতে যেচে প্রস্তাব দিয়েছিল। বাপটা অপছন্দের হলেই কি আর মেয়েও তা হবে?
“আরেকটু থাকি।”
জামশেদ কিছু বলার আগেই বলল,
“জেবিন এখন কেমন আছে?”
“একটু ভালো। কিন্তু দিনরাত শুধু কাঁদে। জোর করেও কিছু খাওয়ানো যাচ্ছে না।” বিষণ্ণ মুখে বলল জামশেদ। পাশা হকের চোয়াল কঠিন হলো। পেছনে রাখা দুহাতের মুষ্টি আরও শক্ত হয়।
“পিয়াসকে মেয়েটা বড্ড বেশিই ভালোবাসত, তাই না?”
জামশেদ জবাবে কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পাশা হকের শার্টের পকেটে মোবাইল বেজে ওঠে। জানালা থেকে দূরে দাঁড়াল।
জামশেদ বসল চেয়ারে। স্ত্রীর ঘ্যানঘ্যানিতে অনিচ্ছায় পাশা হককে দরদ দেখাতে এসেছে। পাশা হককে আগাগোড়া অপছন্দ করে। একটু ভয়ও পায়। পঞ্চান্নতেও পাশা হক শরীরি জোর খাটাতে পারেন সহজেই। কসাই কসাই চেহারা। ডাকাতের বংশধর ডাকাত ছিলেন তা তার হাব ভাবে আজও প্রকাশ পায়। এ ধরনের লোক যখন তখন মানুষ খুন করতে পারে। জামশেদ নিশ্চিত পাশা হকও সেটাতে পারদর্শী। মানুষ খুন তার কাছে পাখি শিকারের মতো। জামশেদ ভাগ্যগুনে বেঁচে গেছে। যদিও এই বাঁচাকে বাঁচা বলে না।
জেবিনের মা অর্থাৎ তার স্ত্রীর সাথে জামশেদের প্রেমের বিয়ে। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের আস্থাভাজন ছিল না সে। সময়ের ব্যবধানে শ্বশুরালয়ে জামাই বলে স্বীকৃতি পেলেও পাশা হক তাকে বিরূপ চোখেই দেখেছে। কিন্তু যেদিন পিয়াসের জন্য জেবিনকে চাইলেন বেশ অবাক হয়েছিল। যে লোক কোনোদিন তাকে মানুষ বলে মনে করেনি তার ঘরে মেয়ে দিতে রাজি ছিল না সে। স্ত্রী ও কন্যা তার মতের দাম দেয়নি। মহামূল্যবান রত্নখনি পেলে কতখানি খুশি হতে পারে মানুষ? ওরা তারচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল।
ঘাড় ঘুরিয়ে অচেতন হবু জামাতাকে দেখল। শিক্ষিত, দেখতে শুনতে ভালো পিয়াস। কিন্তু
কন্যার জন্য উপযুক্ত পাত্র হিসেবে পিয়াসকে পছন্দ ছিল না। বাড়িতে স্ত্রী ও কন্যার ওপর তার কথার কোনো মূল্য নেই। তার মতামতের মূল্য তো দূরের কথা ওদের জীবনে জামশেদ এখন অচল পয়সা। কত স্বপ্নে তৈরি বাড়িটিতে আজকাল আর সুখ পায় না সে। দম বন্ধ হয়ে আসে। স্ত্রী ও কন্যার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। এই যে কন্যার দুর্দিনে খারাপ লাগার ভান করছে সে। সত্যি বলতে জেবিনের প্রতি তাঁর কোনো মায়া নেই আজ। কিন্তু একটু বোধহয় সহানুভূতি আছে। একটু মানুষ মানুষ আছে বলেই সেটা আছে। হাজার হোক নিজের ঔরসজাত বলে কথা।
পাশা হকের অপেক্ষায় বসে থাকার মানেই হয় না। এরচেয়ে কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে তার। পাশা হককে বুঝতে না দিয়ে স্থান ত্যাগ করল জামশেদ।
মোবাইল স্ক্রিনে ভাসা নামটা দেখে পাশা হকের গোল গোল চোখ দুুটো জ্বলে ওঠে। রিসিভ করেই বলল,
“অ্যারেস্ট করেছিস? কোথায় এখন কু*ত্তার বাচ্চাটা? শোন, ওকে কোর্টে চালান করবি না আগেই। ওর সাথে যা করার আমি করব। যেভাবেই হোক আমার আস্তানায় নিয়ে আয়।”
“হক সাহেব, হয়েছে কী..”
“আহ! টাকার চিন্তা করিস না। খুশি করে দেবো। এক হাতে ওকে দিবি অন্য হাতে টাকার ব্যাগ নিয়ে যাবি। কতক্ষণে..”
“হক সাহেব আমরা ওকে ধরতে পারিনি। খবর পেয়ে সকাল সকালই আচমকা সৈয়দ বাড়ি উপস্থিত হয়েছিলাম। পুরো বাড়ি তল্লাশি করেও এহসাস আরমানকে পাইনি। উলটো ইকরাম আজাদের রোষানলে পড়তে হয়েছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ তুলে আমাদের শাসিয়েছেন। চাকরি খাওয়ার ভয় পর্যন্ত দেখিয়েছেন। আপনি তো জানেন তাঁর ক্ষমতা।”
“শুয়োরের বাচ্চারদল! সামান্য একটা কাজ করতে পারস নাই? টাকা নেওয়ার সময় তো পা চাটতে চাটতে কইছিলি একদিনেই ওই কুত্তার বাচ্চারে অ্যারেস্ট করবি। এখন আমারে ব্যর্থতার কাহিনি শুনাস? ওই একরাম আজাদ তোগো চাকরি কী খাইব! আমি খাব। শুধু চাকরি না তোগো জানও। ফোন রাখ শুয়োরের বাচ্চা!”
পুলিশ কর্মকর্তা ভয়ে তাড়াতাড়ি কলটা কেটে দিতে পাশা হক চেয়ারে বসে পড়ে। রাগে কাঁপছে তার শরীর। বার বার একই ব্যর্থতা। ব্যর্থ আক্রোশে গজ গজ করতে করতে পাশা হক বলে,
“ইকরাম আজাদ! সে ভেবেছে এসব নাটক করে ভাতিজাকে বাঁচাতে পারবে? আমার কলিজায় আঘাত করে নিস্তার পাবে ওই পুঁচকে ছেলে? এহসাস আরমান কার কলিজায় আঘাত করেছে জানে না। ওই পুঁচকে ছেলের পাশা হকের অতীত জানা নেই। যদি জানত তবে তার বাড়িতে ঢুকে তারই ছেলেকে খুন.. নপুংসক করার চেষ্টা স্বপ্নেও করতে পারত না। শত্রুতা ও শুরু করেছে। শেষ আমি করব। এই দু-হাত ওর রক্তে ভিজিয়ে। এহসাস আরমান! দৌড়া! যত পারিস রে ছ্যামরা দৌড়া। একবার এই পাশা হকের হাতে পড়লে তোর জীবনের সকল দৌড় শেষ!”
চোখের সামনে ঝাপসা আলো। জ্ঞান ফিরতে এহসাস মাথার পেছনের তীব্র ব্যথা টের পেল। ব্যথায় গোঙানি দিয়ে ওঠে। নড়তে গিয়ে বুঝতে পারে ওর হাত পা বাঁধা চেয়ারে। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য চেয়ার ও বন্ধনকৃত রশির সাথে চলে যুদ্ধ। কিন্তু পরাজিত হয়। রাগে ক্ষোভে চিৎকার করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে মনসুর। হাতে ট্রে। শীতল চাহনি, গম্ভীর মুখ। তাকে দেখামাত্র এহসাসের মুখ দ্রুত বদলে যায়। হেসে বলে,
“আমাকে কদিন বেঁধে রাখবে এভাবে? তুমি ভুলে গেছো আমি আর সেই বাচ্চা ছেলে নেই। যাকে জোর করে, ভয় দেখিয়ে গৃহবন্দী করে রাখতে পারতে। এখন তো আর তা পারবে না। দেখো আমি ঠিক পালিয়ে যাব মনসুর চাচা।”
“তুমি যতবার পালাবে ততবার খুঁজে আনব আমি। আমি বেঁচে থাকতে আমার ছায়াকে পিছ ছাড়া করতে পারবা না বাবাজান। সৈয়দ সাহেব অভিজ্ঞ ও জাদরেল উকিলের সাথে যোগাযোগ করেছেন। কোনো পোক্ত প্রমাণ ছাড়া পাশা হকের চৌদ্দগুষ্টির ক্ষমতা নেই তোমাকে দোষী সাব্যস্ত করে। সুবোধ বালকের মতো উকিলকে তুমি সত্যি ঘটনা খুলে বললেই কাজটা সুবিধার হয়৷”
যে নিজে ফাঁসি কাষ্ঠে উঠতে চাচ্ছে তাকে এসব বলা হাস্যকর ছাড়া কী? মনসুর তো জানে সুবোধ বালক এহসাস কোনোকালেই ছিল না। এহসাস দাঁত বের করে হাসল। যেন মজা পেল। কিন্তু মুহূর্তে সেই হাসি খসে পড়ে অদৃশ্যলোকে। মনসুর আবার বলল,
“অথবা, চিরতরের জন্য স্বদেশ ত্যাগ করতে হবে তোমাকে।”
“কোনোদিন না।” গর্জে উঠে এহসাস। দেশ ছেড়ে চোরের মতো পালাবে না সে। সে ভিতু নয়, চোর নয়। বুক টান করে ফাঁসিতে ঝুলবে, মাতৃভূমির মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু ভীরুর মতো মাতৃভূমি ত্যাগ করবে না।
মনসুর ট্রেটা পাশের টেবিলের ওপর রাখল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,
“তাহলে সুবোধ বালক হতে হবে যে তোমারে বাবাজান। জানি, ব্যাপারটা সহজ না। কিন্তু চোরের মতো মাতৃভূমি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চাইতে সহজ, ঠিক বলছি না?”
এহসাসের বুঝতে আর বাকি নেই মনসুর কার শেখানো বুলি আওড়াচ্ছে ওর সামনে। ছোটো চাচাকে ওর চেয়ে ভালো কে চেনে। তাঁর আভিজাত্যপূর্ণ অমায়িক চেহারা একটা মুখোশ মাত্র। মুখোশের অপরপ্রান্তে রয়েছে ম্যানুপুলেটিভ, ধূর্তবাজ, স্বার্থবাদী একজন মানুষ। এদেরকে মানুষ বলা যায়? পিতৃতুল্য চাচাকে অমানুষ বলতে পারে না ও।
মানুষ মুহূর্তে পালটে যায়। ছোটো চাচা পালটে যাবে কখনো কি ভেবেছিল? মানুষ আসলে পালটায় না। সময়ের পরিক্রমায় মানুষের ভেতরে আত্মগোপন করা অমানুষটা বেড়িয়ে আসে। এহসাস অমানুষ শব্দটা ছোটো চাচার সাথে এক করে অশান্তিতে ভোগে। কোনোদিন ভালোবেসেছিল বলেই হয়তো এমন হচ্ছে। কিন্তু এই মানুষটা নিজ কর্মে এহসাসের মনকে বিষিয়ে দিচ্ছে। চারদিক থেকে কোনঠাসা করছে যেন এহসাস আবার তাঁর বাধ্যগত হয়।
“যদি আমি কোনোটাই মানতে রাজি না হই? কী করবে? চিরজীবন এভাবে হাত-পা বেঁধে বন্দি করে রাখবে?”
“তুমি আমাদের এত খারাপ ভাবো, বাবাজান?”
রাগে নাক সিটকে এহসাস বলে,
“মাথার পেছনে অসহ্য ব্যথা, সর্ব শরীরে অসাড়তা। কোন ভালো মানুষটা এমন করে শুনি?”
মনসুর হাঁপ ছাড়ে। ট্রে থেকে পানির গ্লাস আর ঔষুধ তুলে এহসাসের কাছে এলো।
“ছেলেটা যখন অবুঝ হয়, বিপথে হাঁটে, ভুল সিদ্ধান্ত নেয় হাজার বুঝালেও বোঝে না। তখন গুরুজন বুকে পাথর রেখে কঠিন হয়। তুমি ভাবছো তোমারে ব্যথা দিয়ে আমরা সুখ পাইছি বাবাজান? তোমার তো মাথায় ব্যথা লেগেছে। আমাদের যে বুকে লেগেছে। কোনটার ব্যথা বেশি? কোনটার গভীর?”
এহসাস জবাব খুঁজে পায় না। দৃষ্টি সরিয়ে নেয় অন্যদিকে। মনসুর ওষুধ আর পানির গ্লাস মুখের সামনে ধরে,
“ওষুধটা খেয়ে নাও।”
এহসাস খায় না। অবাধ্য ছোট্ট ছেলেটাকে পিতা যেমন জোরপূর্বক ওষুধ খাওয়ায় মনসুরকেও তাই করতে হয়। এহসাস রাগে ফুঁসতে থাকে। মনসুরকে আঘাত করার কল্পনাও করতে পারে না। অসহায়ত্বে ছটফট করে। চেয়ারে বাঁধা এই বন্দিদশা অসহ্য হয়ে ওঠে। মুক্তি চায়।
মনসুর ওকে ভাবার সময় দিয়ে রুম থেকে চলে গেল। এহসাস ভাবে। দিন গড়িয়ে দুপুর, বিকেল তারপর সন্ধ্যা। পুরো একদিন কাটে বন্দিত্বে। এই রুম, মনসুরের জোর অসহনীয় হতে লাগল। ইকরাম আজাদ ওকে নিরুপায়, মুক্তিপাগল করে তোলে। এহসাস সুবোধ বালক হতে রাজি হয়। ইকরাম আজাদ হয়তো ওর এই দুর্বলতার অপেক্ষা করছিলেন। এহসাস যখন তাঁর বাধ্য হলো তখনই তিনি আরেক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলেন। কিছু কারণবশত এহসাসকে আপাতত আত্মগোপন করে থাকতে হবে। ঢাকা ওর জন্য নিরাপদ নয়। রাঙামাটির এক পাহাড়ি গ্রামে ওর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরবর্তী আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত এহসাসকে সেখানেই থাকতে হবে।
দেশ ছেড়ে যাওয়ার চেয়ে ঢাকা ছাড়ার অপশন ভালো। এহসাস অনিচ্ছা মনে রাজি হয়। ওর শুধু মুক্তি চায়। ইকরাম আজাদ ওকে কঠোর শর্ত ও পাহাড়ায় প্রহসনের মুক্তি দিলো। কালো বোরকা, হাত মোজা, পা মোজায় আপাদমস্তক ছদ্মবেশে ঢেকে গাড়িতে বসিয়ে পালোয়ান গোছের কজন রক্ষীসহ সৈয়দ বাড়ি ছাড়ল এহসাস। মনসুর সাথে গেল না। এতে আশেপাশে ঔঁৎ পেতে থাকা শকুনদের সন্দেহ হবে। তাই রিস্ক জেনেও এহসাসকে রক্ষীদের সাথে পাঠালেন। এদের সাথে শক্তির জোরে এহসাস পেরে উঠবে না। তাই বলে তিনি স্বস্তি পান না। এহসাসের মস্তিষ্কের জোর পালোয়ানগুলোর শরীরের জোরকে সহজেই হারাতে সক্ষম। তিনি ওদের সাবধান করেছেন। ভাতিজাকে যতভাবে মানসিকভাবে দুর্বল করা যায় করেছেন, কিন্তু মনের ভয় ও রাঙামাটি পৌঁছানো না পর্যন্ত যাবে না।
সৈয়দ বাড়ি ছেড়ে গাড়ি মহাসড়কে ওঠে। কিছুদূর পর এহসাস ওয়াশরুমে যাবে বলে পাগল করে ফেলে রক্ষীদের। ইকরাম আজাদের সতর্কবার্তা স্মরণ করে এহসাসকে ওরা ধমকে চুপ করাতে চায়। এহসাস তাতে দমে না। সে গাড়িতে মলমূত্র ত্যাগের ভয় দেখাতে পালোয়ানরা হাসে। এহসাস তখনকার মতো চুপ করে। কিছু সময় পরে ফের পেট ধরে চেঁচায়। রক্ষীরা বিরক্ত হয়। ওর বয়সের দুজন রক্ষী রেগে ফিসফিস করে বলে,”ধনীর দুলালের নাটক দেখো।” এহসাস অনুনয় করে। বুঝায় ওর কষ্ট হচ্ছে। অগত্যা গাড়ি থামাতে হয়। লোকের নজর আকর্ষণ না করে দুজন রক্ষী এহসাসের হাত পেছন থেকে বেঁধে পাব্লিক টয়লেটের দিকে নিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ আগেই মাগরিবের আজান দিয়েছে। ছোপ ছোপ আঁধার ঝুলছে চারিদিকে। মসজিদে নামাজ আদায় করছে মুসল্লীরা। আশেপাশে লোকজন তেমন একটা নেই। এই সুযোগের অপেক্ষা করছিল এহসাস। ঘুরে একজনকে পেটে লাথি দিলো। অন্যজন বিস্ময় কাটিয়ে ওঠার আগেই মাথা দিয়ে সজোরে নাক বরাবর বাড়ি দেয়। আর্ত চিৎকার দিয়ে দুজনে ছিটকে পড়ে। এহসাস কালক্ষেপণ করে না৷ ওরা ধাতস্থ হওয়ার আগে সামনে দৌড়াতে লাগল। কয়েকজন অচেনা পথচারি অবাক চোখে দেখল। রক্ষীরা পিছু নেয়।
পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি উচ্চতার আপাদমস্তক বোরকা ঢাকা নারী ঢাকার রাস্তায় প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে এ দৃশ্য সাধারণ চোখে স্বাভাবিক ঘটনা না। এহসাস লোকের সন্দিগ্ধ নজর এড়াতে সামনের অন্ধকার গলিতে ঢুকে পড়ল। রক্ষীরা তখনও পিছনে। সুকৌশলে ওদের ফাঁকি দিয়ে আরেকটি গলিতে ঢুকলো। এর মধ্যে হাতের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলেছে। তাতে ওর হাতের চামড়া কেটে ঝরছে রক্ত। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দিশাহীন ছুটছে। এ যেন ওর জীবন। কোনো দিশা নেই, গন্তব্য নেই। ছুটছে তো ছুটছে। বিবেকের দংশন, প্রতিশোধের নেশা, আপনজনের প্রতারণা, প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে ছুটছে। একসময় থামতে হয় অচেনা গলির মাঝে। লুটিয়ে পড়ে আধা পাকা সরু গলির রাস্তায়। গলা শুকিয়ে এসেছে৷ শ্বাস অস্বাভাবিক হয়। একটু ভালোবোধ করতে উঠে দাঁড়ায় আবার। এগিয়ে যায় সামনে।
কিছু পথ যেতে একটা বাড়ির গেট খুলে গেল। এহসাস থামে না। গেট খুলে বেরিয়ে এলো একটি মেয়ে। পরনে ধূসর ও নীলের প্রিন্টের বোরকা আর ওই দুই রঙের কিঞ্চিৎ ম্যাচিং হিজাব। মেয়েটা চোখ তুলতে এহসাস থেমে যায়। এই চোখ ওর চেনা। মেয়েটি চেনে না। ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। এহসাস পেছনে তাকাতে চায় না। পা বাড়াতে চায় সামনের দিকে। কিন্তু পারে না। তখনই পেছনের জানালা খুলে একজন নারী কণ্ঠ চেঁচিয়ে বলল,
“এই নিরুপমা, আবার আসিস কিন্তু।”
“আচ্ছা!”
মৃদু হাসি জড়ানো কণ্ঠটি কী এক অদ্ভুত মায়ায় এহসাসকে বশ করে ফেলে। পেছনে ফেরায়। ফের ওর পথ বদলে দেয় এই নারী। ফের একবার ওকে অনুসরণ করে এহসাস৷
চলবে,,,