অরূপ জ্যোৎস্না পর্ব -২৬

#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-২৬
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

সৌজন্য বা সুশীলা স্বভাব নিরুপমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে একটু বেশিই রয়েছে। কাওকে তুচ্ছ করে, হেয় করে কথা বলে না। কারো সাথে কথা বললে হেসেই বলে। কিন্তু ওই লোকটার বেলায় সব উলটো হয়। নিরুপমার সহ্য শক্তি বয়সের সাথে সাথে বেড়েছে। তাই বলে সব অন্যায় মুখ বুঁজে সইবে এমনও না ও। লোকটা জোরপূর্বক বাসায় ঢুকেছিল। অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে অচেতন করেছিল। ব্যথার চেয়ে ভয়ই বেশি পেয়েছিল। ভয়ে ভয়ে কেটেছে দিনরাত। সবকিছুতে লোকটা ওর ওপর জোর খাটিয়েছে। রুক্ষ ব্যবহার করেছে। অপমান করেছে। এমন মানুষের সাথে সৌজন্য কী করে আসে?

লোকটার আচার-আচরণ হয়তো বদলেছে। হয়তো বলছে কারণ নিরুপমা ওকে বিশ্বাস করে না। ওর সবকিছু রহস্যজনক। তাছাড়া কয়েকবার মিথ্যা বলেছে। সেই সঙ্গতে পড়ে নিরুপমাও হয়েছে মিথ্যুক। সুতরাং লোকটার প্রতি প্রথম থেকেই তিক্ত-বিরক্ত। ভীষণ অপছন্দের একজন সে। সুশীলা ওর সামনে হতে ইচ্ছে করেনি। কিন্তু জ্বরে পড়ার পর তিক্ত -বিরক্ত হতে পারছে না। ভীষণ অপছন্দের ‘ভীষণ’ শব্দটা মুছে গেছে। কিন্তু লোকটা এখনও অপছন্দের! অপছন্দের মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হয় না। সে যতই বলুক খু*ন করেনি, ডা*কাতি করেনি। নিরুপমার সাথে যা করেছে তা তো অন্যায়। এত সহজে সেসব ভুলবে কি করে? বলেছে সৌজন্যসুলভ আচরণ করবে। এখন মনে হচ্ছে সেটাও সহজসাধ্য না, কিন্তু নিরুপমা চেষ্টা করবে।

দুপুরে খাবার দিতে বিদ্যুৎ চলে গেল। ব্যালকনিতে কাপড় নাড়তে গিয়ে হঠাৎ ঘরের ভেতর তাকাল নিরুপমা। ঘেমে উঠেছে লোকটা। খেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কপালে ঘাম জমে গেছে। গলা ভিজে ঘামের পানি টিশার্টের ভেতরে গড়িয়ে পড়ছে৷ ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে। নিরুপমার বিবেক নাড়া দেয়। এই মানুষটা অসুস্থ অবস্থায় ওকে সেবা করেছে। তার কষ্টে খারাপ লাগা স্বাভাবিক না? একটু ইতস্তত করে হাত পাখাটা নিয়ে এসে বিছানার পাশে দাঁড়ায়। ঘামে ভেজা লাল মুখটা তুলে তাকাল ওর দিকে এহসাস। পাখাটা দেখে মুচকি হাসে। নিরুপমা দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। হাত বাড়িয়ে নিতে গেলে নিরুপমা দিলো পাখাটা৷ খেতে খেতে হাত পাখা নাড়াতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল এহসাসের। নিরুপমা পাখার মাথাটা ধরে বলল,

“আমাকে দিন।”

এহসাস বিস্মিত হলো। কিন্তু কিছু বলল না। দিয়ে দিলো পাখাটা। নিরুপমা ব্যালকনি থেকে আধভেজা গামছা এনে দিলো ঘাম মুছতে। তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাতাস করে। এই লোকটার সাথে সৌজন্য দেখানো কঠিন কিছু না, তবে বেশ অস্বস্তি আর লজ্জার!

ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি নিয়ে ঘুম ভাঙল ঈপ্সার। বুকের ভেতর ঝিরিঝিরি বাতাসের মতো এক ধরনের অনুভূতি দোলা দিচ্ছে। স্বপ্নটা এখনও যেন জীবন্ত। এখনো অনুভব করতে পারছে দুর্জয়কে। কাছে এসে গালে চুমু দিয়ে ভালোবাসি বলাটা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এই স্বপ্ন সত্যি হবে কী? কোল বালিশটাকে বুকে জড়িয়ে রইল। লজ্জায় ওর সুন্দর গাল দুটো রক্তাভ হয়ে উঠেছে।

প্রায় দু ঘন্টা ঈপ্সা বিছানায় সেভাবেই শুয়ে রইল।এর মধ্যে একটু ঝিমুনি এলো। স্বপ্নটা ফের দেখার লোভই পেয়ে বসেছিল। কিন্তু ঘুম আর এলো না। উঠে ফ্রেশ হয়ে ভৃত্যদের একজনকে নাশতা দিতে বলল। আজ ঈপ্সা চায়ে চুবিয়ে গরম গরম পরোটা খাবে। ওর মায়ের প্রিয় নাশতা। ঈপ্সার মন ভালো থাকলেই এটা খায়।

পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দিলো। আজ প্রকৃতিও ঈপ্সার মনের মতো। মেঘে ঢাকা। আকাশ গুড়গুড় করে ডাকছে। বইছে মৃদুমন্দ সমীরণ। ঈপ্সা মোবাইলে পছন্দের একটা গান বাজিয়ে দিলো। রবীন্দ্রনাথের “তোমার খোলা হাওয়া” গুন গুন করে গাইল ঈপ্সা। এলোমেলো চুলগুলো ছেড়ে দিলো। চোখ বন্ধ করে মুখটা বাড়িয়ে দিলো জানালার বাইরে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি নামল ঝড়ো হাওয়ার সাথে। ছুঁয়ে দিলো ওকে।

একটু পর ভৃত্যটি ওর মন ভালোর প্রতীক নাশতা দিয়ে গেল। জানালার পাশে পা তুলে বসল ও। এক হাতে রোল করা পরোটা আর অন্য হাতে সর পড়া দুধ চা। পরোটার রোল দুধে চুবিয়ে ছুটে এসে গায়ে লাগা বৃষ্টির ছাঁট উপভোগ করছে। একটু পর দুধ চায়ে নরম হওয়া পরোটা মুখে নিলো। চোখ বন্ধ করল তৃপ্তিতে। যেন অমৃত। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। ঈপ্সা সেখানে বসে বসে আজকের দিনলিপি তৈরী করল। সারাদিন আজ ও এই রুমেই থাকবে। বই পড়বে, মুভি ও ড্রামা দেখবে। পাচককে বলবে খিচুড়ি আর গরুর গোশত ভুনা করতে। তারপর আবার চা পরোটা খাবে, পাকোড়াও খাবে সাথে। তবে দুপুরেও যদি বৃষ্টি হয় তাহলে ছাঁদে গিয়ে ভিজবে। বৃষ্টির পানিতে ওর অ্যালার্জি। হাত-পা খুব চুলকায়। ঠাণ্ডা লাগে। ঈপ্সা তবুও ভিজবে আজ। ওর মন যাতে সুখ পায় সেসবের সবই করবে আজ ও।

দুপুরে বৃষ্টি বলতে ওই ঝিরঝিরে। ওতে কী আর ভেজা হয়? কিন্তু ঈপ্সার মন মানছে না। বৃষ্টিতে আজ ও গা ভিজাবেই। সে অল্পই হোক না কেন! ড্রয়িং রুমে কারও গলা শুনতে পেল। ভেতর ঘরে সাধারণত বাইরের লোক আসে না। একজন ভৃত্য সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে ঈপ্সা প্রশ্ন করল,

“কে এসেছে, মতি আঙ্কেল?”

“ডাক্তার সাব আর তার আব্বা৷ তোমারেই ডাকতে বলছিল।” বলল ভৃত্যটি। দুর্জয়! ঈপ্সার বুক দুরুদুরু করে। স্বপ্নের কথা ফের মনে করে লজ্জায় রাঙা হয়। চোখ-মুখে উচ্ছ্বাস খেলে গেল,

“আব্বাস আঙ্কেল এসেছে!” ঈপ্সা এক দৌড়ে ড্রয়িং রুমের দিকে গেল। হঠাৎ থেমে যায়। ট্রাউজার আর টিশার্ট পরে আছে। এভাবে ওদের সামনে যাবে! এমন না যে আগে সেজেগুজে যেত। কিন্তু আগে আর এখনে কত পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষে, মনে, অনুভূতিতে ও সময়ে। ঈপ্সা রুমে ফিরে চট করে কাপড় বদলে নিলো। বাসায় পড়ার মতো সাধারণ কিন্তু নতুন একটা থ্রি পিস পরল। মুখ ধুয়ে ক্রিম নিলো, চুলটা আঁচড়ে বাঁধল পরিপাটি করে, চোখে কাজল টানল। ওরা কি বুঝে ফেলবে কিছু? কী বুঝবে? ঈপ্সা কি সেজেছে না কি? একটু কাজল এ আর কী! মাথায় ওড়না টেনে ড্রয়িং রুমের দিকে গেল।

“আসসালামু আলাইকুম, আঙ্কেল।” সামনে বসা মানুষ দুজনকে দেখে ওর চঞ্চলতা লজ্জায় মিইয়ে যায়। হালকা নীল শার্টে দুর্জয়কে হৃৎস্পন্দন কাঁপানো লাগছে।

“ওয়ালাইকুম আসসালামু মা। ওখানে দাঁড়িয়ে কেন! এদিকে এসো! বসো আমার পাশে।”

ঈপ্সা সলজ্জে বসল। চোখ তুলে সামনে বসা দুর্জয়কে দেখে। গম্ভীর হয়ে আছে। হাতে আজকের পত্রিকা। এত গুরুত্বপূর্ণ কী রয়েছে যে ঈপ্সার দিকে একটাবার চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। এই পত্রিকা নিজ হাতে কেটে কুটি কুটি করবে আজ ও।

“কেমন আছো মা?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি? আন্টির শরীর এখন কেমন? আর দিলনাজের কী খবর?”

আব্বাসউদ্দিন মুচকি হাসলেন। একেবারে সাদাসিধা মানুষ তিনি। পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা। ঈপ্সার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“আল্লাহর রহমতে সকলে ভালো আছি। তোমার আন্টি সব সময় তোমার কথা বলে। আসার আগে চিড়ের মোড়া, পিঠা, নারকেলের নাড়ু আরও নানান কিছু তোমার জন্য পাঠিয়েছে। বলেছে ঈপ্সা এগুলো পছন্দ করে। ওকে গিয়ে দেবেন। দিলনাজ সেলাইয়ের কাজ শিখেছে। নতুন মেশিন কিনে তোমার জন্য জামা বানিয়ে পাঠিয়েছে।”

ব্যাগটা ঈপ্সার হাতে দিলেন আব্বাসউদ্দিন। দু হাতে বুকে জাপটে ধরে রইল ব্যাগটা ও। ভীষণ খুশি হলো। চোখ তুলতেই ওর ঠোঁটে প্রশস্ত হওয়া হাসি ক্ষীণ হয়ে এলো। দুর্জয় কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে। সে পছন্দ করেনি। কেন?

দুর্জয় বুঝতে পারে না ওর বাবা মা এই মেয়েকে এত কেন ভালোবাসে। প্রথম প্রথম ভেবেছে ইকরাম আজাদের মেয়েই বলে তারা ওকে এত আদর করে। আসলে তা নয়। মন থেকেই ঈপ্সাকে সন্তানতুল্য মনে করে ওর বাবা মা। বিশেষ করে ওর বাবা। মা শব্দ ছাড়া ঈপ্সাকে তিনি ডাকেনই না। দুর্জয়ের মাঝে মাঝে মনে হয় ওর বোন দিলনাজের চাইতেও বেশি ভালোবাসে এই মেয়েটাকে। দিলনাজকে কথাটা বলাতে হেসে খুন সে। ঈপ্সার প্রতি ওর মনে একটুও ঈর্ষা নেই। নিজের অর্জিত প্রথম উপার্জনের টাকায় পোশাক তৈরী করে দিয়েছে। কতটা ভালোবাসলে এমন করে মানুষ? একমাত্র দুর্জয়ের কাছে ও ভালোবাসা বা আদর পায় না। তাতে কি ওর কিছু এসে যায়? এসব ভাবছেই বা কেন দুর্জয়? ওর জীবনে ঈপ্সা এখন কিছু না।

দৃষ্টি নামাতেই সামনে রাখা মিষ্টির বাক্সগুলো দেখতে পায় ঈপ্সা। আগে থেকেই ছিল, অথচ খেয়াল করেনি।

“এত মিষ্টি! আব্বু তোমার ওপর রাগ হবে দেখো। তোমাকে বলেছে না এসব করতে না। তুমি তো ফ্যামিলি। ফ্যামিলির মানুষ কি ঘরে এত মিষ্টি নিয়ে আসে?” ঈপ্সা অভিযোগের সুরে বলতে আব্বাস মুচকি হেসে বললেন,

“সুসংবাদ কি খালি হাতে দিতে আসতে হয় রে মা?”
দুর্জয়ের দৃষ্টি উপেক্ষা করে একটা মিষ্টির প্যাকেট খুললো। মিষ্টি ও খুব একটা পছন্দ করে না। তবে চমচম খাওয়া যায়।
“সুসংবাদ?”

“হ্যাঁ, তোমার দুর্জয় ভাইয়ের বিয়ে ঠিক করে এলাম। আগামী জুম্মাবার আংটিবদল হবে।”

ঠিক তখনই আকাশে বিকট শব্দে বজ্রপাত হলো। ঈপ্সার মুখের সামনে তোলা চমচমটা খসে পড়ে গেল কার্পেটে।

“ভয় পেলে মা?” ঈপ্সা জবাব দিতে পারে না। ভয়! হ্যাঁ, তা তো পেয়েছে। ওর বুক কেঁপে উঠেছে ভয়ে। ঠোঁট কাঁপছে। দ্রুত পলক ফেলতে লাগল। ছি! ছি! কাঁদবে না। চোখে যে কাজল টেনেছে। কাঁদলে ধুয়ে যাবে। বুঝতে পেরে যাবে ওরা।

“আসসালামু আলাইকুম আব্বাস ভাই।” ইকরাম ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন। মেয়ের বজ্রাহত মুখ চেয়ে ভুরু কুঁচকালেন। সালামের জবাব দিয়ে উঠে কোলাকুলি করলেন আব্বাসউদ্দিন।

দুর্জয় উঠল না। অনিমেষ চেয়ে আছে ঈপ্সার মূর্তিমান মুখের দিকে। এতক্ষণে ঈপ্সার পরিবর্তন ওর চোখে পড়ল। আজ ওকে অন্য রকম লাগছে। চুলগুলো এলোমেলো নেই, পরনের কাপড় শালীন, আর… চোখে কাজল টেনেছে! ঠিক তখনই ঈপ্সা তাকাল ওর দিকে। দুচক্ষু জল আর ব্যথা মিলেমিশে ছলছল করছে। চমকিত চোখে স্তব্ধ হয়ে গেল ও। ঝড় উঠল কোথাও। বাইরে নয় ওর বুকের ভেতর।

“ঈপ্সা!” বাবার ডাকে সম্বিৎ ফেরে ঈপ্সার।

“হুঁ?”
দৃষ্টি লুকায়। গোপনে টুপ করে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ও বুঝল না। এই মুহূর্তে ওর অনুভূতি অসাড়। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। পাগল হলে মানুষের মনে হয় এমন লাগে। সকলকে চরম অবাক করে পায়ের কাছে কার্পেটে পড়ে থাকা চমচমটা হাতে তুলে নিয়ে মুখে পুরল। তারপর উন্মাদের মতো হেসে এক দৌড়ে প্রস্থান করে। আব্বাসউদ্দীন দুষ্টুমি ভেবে হেসে উঠলেন। ইকরাম তা পারেন না। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মেয়েটাকে আজকাল তিনি বুঝতে পারেন না। একই ছাঁদর নিচে অথচ, যোজন যোজন দূরত্ব মাঝে। তাঁকে এড়িয়ে চলে। এই যে এখনই দৌড়ে পালাল!

চলবে,,,,

দুঃখিত এত্ত দেরির জন্য!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here