অরূপ জ্যোৎস্না পর্ব -২৫

#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-২৫
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

একটা গুছানো জীবনের আকাঙ্ক্ষা সবসময়ই নিরুপমার মধ্যে ছিল। অভাবের মুখ বাবা জীবিতকালে কখনোই দেখেনি। বাবা দেখতে দেননি। সুতরাং টাকার লোভ কোনোকালেই ছিল না। শুধু সম্মান আর স্বস্তি পেলেই মনে শান্তি পেত। জীবন গুছাতে তাই তখন সমস্যা হয়নি।

খুব সাবধানে জীবনের ওই পথ অতিক্রম করে এসেছে। কলঙ্কের ছায়াও ঘেঁষেনি। লোকে বলত, মা পরের ঘর ভেঙেছে মেয়েটাও তাই করবে। সৎ মা অভিশাপ দিতো, তার সকল দুঃখ সুদের মতো বাড়ুক। তারপর সতিনের মেয়ের কপালে লেপ্টে যাক।

সৎ মায়ের জন্য নিরুপমার মায়া হতো। আবার ভয়ও পেত তাকে। বাবা তাকে ভালোবাসেনি। নিরুপমার মায়েরও হাত রয়েছে এতে। ছলে-বলে কৌশলে স্বামীকে পুরোপুরি নিজের করে নিয়েছিলেন ওর মা। সৎ মায়ের চোখের সামনে তার স্বামী শুধু ভাগই হয়নি বরং ডাকাতি হয়েছে, একেবারে। একটু ভালোবাসা, একটু স্বামী সোহাগের জন্য হাহাকার করতেন। হৃদয় ভাঙা মানুষের আকুতি সৃষ্টিকর্তার কাছে সহজেই পৌঁছায়। সেই ভয় আজও তটস্থ রাখে নিরুপমাকে। সম্পর্কে জড়াতে ভয় পায়। পাছে সৎ মায়ের অভিশাপ না লাগে! তার মতো হাহাকার করতে না হয়! অতটা শক্ত নয় ও। যাকে মন দেবে তাকেই তো দেহ দেবে। মানুষটা সব নিয়ে যদি ওর বাবার মতো পিঠ দেখিয়ে আরেকপক্ষ গ্রহণ করে! নিরুপমা বাঁচবে কী নিয়ে। শূন্যে মিলিয়ে যাবে না?

পাঁচ ঋতুর পর যেমন বসন্তের আগমন ঘটে তেমনি টিনেজ বয়সে হৃদয়ে কমবেশি সকলেরই বসন্তের দোল লাগে। নিরুপমা অস্বীকার করতে পারবে না যে ওর হৃদয় দোলেনি। কিন্তু অল্প বয়সের বায়ু দোষ বলে মাছি তাড়ানোর মতোই মন থেকে তাড়িয়ে দেয়। তবুও কিছু স্মৃতি থাকে যা হাজার তাড়ালেও যায় না। বড্ড একরোখা, দুর্দমনীয়। নিরুপমাও কম যায় না। ওর গুছানো জীবনে ওসব পাত্তা দেওয়ার সময় কোথায়?

তাইতো গুছিয়ে হিসেব করে চলেছে। প্রেম করবে না, বিয়ে করবে না, কোনো পর পুরুষের দিকে দুবার তাকাবে না। পরিবার আর ওর পড়া। এই চক্রে জীবনের সাতাশ বছর পার করেছে। হঠাৎ বাবা মরে গেল। নিরুপমার গুছানো জীবন কম্পিত হয়। এদিকে ওদিকে ছিটকে পড়ে সবকিছু। কয়েকমাস না যেতেই মা পঙ্গু ও অসুস্থ হয়ে গেল। নিরুপমা দিশাহারা হয়ে পড়ে। ওর গুছানো স্বপ্নের জীবন বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তবুও নিজের সাথে করা পণ ভাঙেনি। একটু একটু করে আবার গুছাতে লাগল। পুরোপুরি পারেনি কিন্তু কিছুটা গুছিয়েছিল। ইদানীং সেই প্রায় গুছিয়ে আনা জীবনে নতুন করে এলোমেলো বাতাস বইছে। খুব দাপুটে না বাতাসের গতি। মন্থর মলয়ানিল। তবুও নিরুপমার ভয় হয়। ও ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভিতু একটা মেয়ে।

“দুপুরের ওষুধ কি খেয়েছ তুমি?”

ওই যে সেই মন্থর মলয়ানিল, যাকে নিরুপমা ভয় পায়৷ এখন খু*নি বলে নয়, ডাকাত বলেও নয়৷ ওর এই উদ্বিগ্নতা নিরুপমা চায় না। এমনকি ওর উপস্থিতিও না। লোকটা মায়াজালের ফাঁদ পেতেছে। একটু একটু নিরুপমাকে সেই জালে বন্দি করতে চাচ্ছে। তারপর নিরুপমা সর্বস্ব দিলে নিষ্ঠুরের মতো ছেড়ে যাবে। সৎ মায়ের অভিসম্পাত বজ্রপাতের ন্যায় কানে বাজে। সাবধান! সাবধান! নিরুপমা মন্ত্রের মতো পড়ে মনে মনে।

“আবার সাইলেন্ট মুডে চলে গেলে? উফ! ইরিটেশন হয় যখন এমন করো। লম্বা জবাব দিতে হবে না। জাস্ট ইয়েস অর নো। খেয়েছ ওষুধ?”

নিরুপমা চুপচাপ চলে যাবে। জবাব দেবে না। কিন্তু ওর মন ওকে ধিক্কার দেয়। এই লোক ওর কেউ না। তবুও চারটা দিন সেবা করেছে, ওর বমি পরিস্কার করেছে, জ্বরে পুড়ে যাওয়া মাথা ধুয়েছে, রান্না করে খাইয়েছে, ঝুঁকি নিয়ে বাইরে গিয়ে ওষুধ এনেছে, অসুস্থ মা’কে দেখেছে… নিরুপমা মাথা নাড়ায় ওপর নিচে।

“খেয়েছি।”

নিরুপমার ভালো লাগে না। এই জবাব দেওয়ার দায় কেন? হঠাৎ করে মনটা কী শুরু করল! একজন পলাতক খু*নের আসামীর প্রতি কী করে আকৃষ্ট হতে পারে ও। মনেরই বা দোষ কোথায়? গত চারদিনে লোকটার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছে।ভুলেছে তার আগে কী ছিল সে। তার ওপর এখনও ওর খেয়াল রাখছে.. ভাত খেয়েছ, ওষুধ খেয়েছ? জ্বর কি আবার আসছে? কিছুক্ষণের জন্য লোকটার ওপর থেকে মাইন্ড কনভার্ট করবে সে সুযোগও পাচ্ছে না। সারাক্ষণই ঘরে থাকে। চলে যায় না কেন! কী রূঢ়ই না হয়ে যাচ্ছে ও!

ঘর ঝাড়ু দেওয়া শেষ। সিগারেটের ছাই বা পোড়া অংশ আজকাল আর মেঝেতে পায় না। শ্বাস টানলে বাতাসে সিগারেটের গন্ধ নয় দামি পারফিউমের সুবাস নাকে লাগে। খুশি হওয়া উচিত, কিন্তু গম্ভীর হয়ে যায়। ময়লাগুলো বেলচায় তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তখনই শোনে,

“আর ইউ ওকে নিরুপমা?”

নিরুপমা ফিরে তাকায়। লোকটার ওই চাহনি অদৃশ্য এক থাপ্পড়। যা ওর মাথায় পড়ল৷ সাথে সাথে মনে পড়ল গত রাতের দুঃস্বপ্নের কথা। দুঃস্বপ্নটা দেখেছে বহুদিন পর। তার জন্য দায়ী ওই লোকটা। ওর জীবনে আতঙ্ক হয়ে এসেছে। অতীত যত আতঙ্ক গোপন ছিল, ভুলে ছিল ওর কারণে প্রকাশ পাচ্ছে। পাচ্ছে তো পাচ্ছে সেটাও ওর সামনে৷ নিরুপমা ঢোক গিললো। ওর করা এক অতীত ভুল দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে। কোনো সম্পর্কে না জড়ানোর এটাও আরেক কারণ। ওই দুঃস্বপ্নের কথা বাবা ছাড়া কেউ জানত না। বাবা ছাড়া কেউ জানত না কতটা বিপন্ন, বেসামাল হয়ে যায় নিরুপমা তখন। কিন্তু গতরাতে ওই লোকটা জানল। ওর কান্না, ক্ষমা প্রার্থনা সব শুনেছে। কিছু কি টের পেয়েছে? নিরুপমা চায় না ওর ওই অতীত ভুলের কথা কেউ জানুক। লজ্জা ও অস্বস্তিতে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

“আপনার অভিসন্ধি কি বলুন তো?” কাঠ কাঠ গলায় বলল ও। এহসাস ভুরু কুচকায়।

“তুমি ঠিক আছো কি না জানতে চাওয়ার পেছনে আমার অভিসন্ধি কী হতে পারে? ওই প্রশ্নের পরে এই প্রশ্ন আসবেই বা কেন?”

“কেন আসবে না? চেনা নেই জানা নেই আমার জীবনে কুন্ডলী পাকিয়ে বসে আছেন। জোরপূর্বক এটা ওটা করিয়েছেন। টর্চার করেছেন মেন্টালি। আবার হুট করে বদলে গেলেন। অসুস্থ অবস্থায় আমাকে সেবা করলেন, গরমে আপাদমস্তক বোরকায় ঢেকে রান্না পারেন না সেটাও হাত পুড়িয়ে করলেন, আমার মায়ের সকল প্যানপ্যানানি ভদ্র ছেলের মতো মানলেন, আমার ব..”

“রিয়েলি!” এহসাস বিরক্তি ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

“আমাকে কী ভাবো তুমি? অমানুষ? তুমি জ্বরে শয্যাশায়ী। মেঝেতে তোমার উদগিরণ। কে পরিষ্কার করবে? তোমার পঙ্গু মা? আর আমি হাত গুটিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব? তোমাদের অভুক্ত রেখে নিজে খাব? কী চমৎকার ধারণা আমার প্রতি তোমার! যেন ভালো কিছু আমার দ্বারা হওয়া অসম্ভব অথবা বেমানান। হ্যাঁ, আমি তোমার সাথে যা করেছি অন্যায়। একজন মানুষ অন্যায় করলেই কি সে ন্যায় করতে পারবে না? মানা আছে?” এহসাসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।

“আপনার ভেতর তাহলে ন্যায়-অন্যায়ের বোধ আছে?” নিরুপমা কটাক্ষ করে। একদম অনুচিত করছে। কিন্তু না করেও পারছে না। এহসাস কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে যায়। ওর রাগান্বিত মুখ আচমকাই বদলে গেল। শ্লেষ হেসে বলে,

“বিশ্বাস করো অমাবস্যা, তোমার চেয়ে একটু বেশি ন্যায় -অন্যায় বোধ আছে আমার। তাই তো রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে কাঁদতে হয় না।”

নিরুপমার মুখ লাল হয়ে ওঠে। লজ্জা না অপমানে এহসাস বুঝতে পারে না। ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে চমকে যাওয়ার ভান করে বলে,

“ড্যাম! আমি কথাগুলো ওভাবে বলতে চাইনি। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। বিশ্বাস করো!”

নিরুপমা বিশ্বাস করে না। ওর চোখ ক্রোধে জ্বলছে। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। এই লোককে দেখে এই মুহূর্তে হৃদয় দুলছে না। এটাই চেয়েছিল। কিন্তু খোঁচা দিয়ে হৃদয় ক্ষত করতে তো বলেনি তাকে!

“আপনি একটা জঘন্য লোক!”

“থ্যাংক ইউ।”

“পৃথিবীর সবচেয়ে নীচ মানুষটা আপনি। খারাপ, খারাপ খুব খারাপ লোক।”

“ইয়াহ?”

এহসাস নিঃশব্দে হাসতে হাসতে বিছানায় বসল। দু-হাত মাথার পেছনে ভাঁজ করে তাকিয়ে রইল নিরুপমার ক্রোধান্বিত চোখের দিকে। তারপর ভাবলেশহীনভাবে বলল,

“একটা সত্যি বলব আজ তোমাকে নিরুপমা? আমি খুব করে চেয়েছিলাম আমাকে তোমার ভালো লাগুক। কত কী না করলাম কিন্তু ভালো তোমার দৃষ্টিতে হতে পারলাম না। হলাম জঘন্য, নীচ!” দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল এহসাস। চোখ বন্ধ করল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে নিরুপমা। একটু কি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে! হঠাৎ জ্বলে ওঠা রাগটা হঠাৎই আবার বুঁজে গেল। মুখ নিচু করে চলে যেতে উদ্যত হতে শুনল,

“আমি চলে যাব নিরুপমা।”

“মিথ্যা বলছেন আবার।” নিরাগ গলায় জবাব দিলো নিরুপমা। এহসাস চোখ মেললো। সিলিং এ চেয়ে বলল,

“পুলিশ আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে নিরুপমা। অথচ, খু*নটা আমি করিনি। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ না করা পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ের প্রয়োজন ছিল আমার। আমার মনে হয়েছে তোমার এই বাসার চেয়ে নিরাপদ আর কোথাও নেই। ওরা এখানে কোনোদিন আসবে না।”

“কি..ন্তু আপনি বলেছিলেন..!”

“মিথ্যা বলেছিলাম। কেন বলেছিলাম জানি না। এখন সত্যি বলছি। বিশ্বাস করো, পিয়াসকে আমি গু*লি করিনি।”

“তবে কে করেছে?”

এহসাস জবাব দেয় না সে কথার। ওর কৌতূহলি মুখটার দিকে তাকিয়ে বলে,

“আর দুটো মাস থাকতে দাও আমাকে। শুধু দুটো মাস। তারপর আমি চলে যাব।”

নিরুপমা অনেক কিছু জানতে চায়। কিন্তু লোকটা ওকে বলবে না৷ এইটুকু যে বলেছে সেটাই অপ্রত্যাশিত ছিল। সত্যি বলেছে কী! দুটো মাসই তো! থাকুক। লোকটা খু*নী নয়! কথাটা জেনে যেমন ভালো লাগল তেমন লজ্জিতও হলো। কী না কি বলেছে খু*নী ভেবে। কত রূঢ়ভাবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু নিরুপমা সেসব শুধরাতে যাবে না। এবার ওর মন ধিক্কার দিলেও না।

“ঠিক আছে।” নিরুপমা মেনে নিলো। লোকটার ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি দেখা দেয়। সুন্দর মুখের ওই মুচকি হাসি আরও সুন্দর! ধ্যাৎ! দৃষ্টি সরিয়ে নেয় নিরুপমা। আজকাল ওর মুখে কি একটু বেশিই তাকাচ্ছে না? দুটো মাস! এই দুটো মাসে নিজেকে যতটা পারবে এই লোকের ছায়া থেকে দূরে রাখবে। তাকাবে না অপ্রয়োজনে আর।

“আমি আসছি।” বলল ও। এহসাস ডাকে,

“দাঁড়াও। আরেকটা কথা যদি রাখতে!”

“শুনছি বলুন।”

একটু ইতস্তত করে এহসাস বলে,

“একটু ফ্রেন্ডলি ব্যবহার করতে যদি! কথা দিচ্ছি তোমার অপছন্দ হয় এমন আর কিছুই করব না। সুবোধ অতিথির মতো থাকব এই দুইমাস। এরপরে আর কোনো অনুরোধ করব না, প্লিজ!”

নিরুপমা সাথে সাথে উত্তর দিতে পারে না। একটু চুপ করে বলে,

“মাফ করবেন, আপনার সাথে ফ্রেন্ডলি হওয়া অসম্ভব।”

এহসাস নিরাশ হয়। নিরুপমা আড়চোখে দেখল। ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবুক হয়। বন্ধ দরজার সামনে থেমে যায়। ঘাড় ঘুরাতেই দেখল ওরই দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। যেন আশা এখনও কিছু অবশিষ্ট রয়েছে। খুব মনে বিঁধল। মুখটা আনত করল নিরুপমা। বলল,

“বাট আই উইলবি সিভিল উইদ ইউ।”

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here