অরূপ জ্যোৎস্না পর্ব -২৪

#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-২৪
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

দুপাশে দ্বিতল, একতল বা টিনের ছাপড়া বাড়ির অবিন্যস্ত সারির মাঝে সংকীর্ণ এক গলি এঁকেবেঁকে প্রধান সড়কে মিশেছে। সন্ধ্যা হলে এ গলিতে ভূতূড়ে আঁধার নামে। অদ্ভুত রকমের শান্ত। নিরুপমা গলির মাঝপথে এসে থমকে যায়। তারপর ধীরে ধীরে এক পা ফেলে। সতর্কে কিছু শোনার চেষ্টা করে। দু’পা এগোতেই ওর কানে স্পষ্ট এসে লাগে অনুসৃত পদশব্দ। ওর পা ফেলার তালে তালে পা ফেলছে সে৷ ভয়ে কাঠ হয়ে গেল নিরুপমা। সামনের গলি জ্যোৎস্নায় স্নাত। কিন্তু নির্জন। নিরুপমা একা! একা? না, আরও তো একজন আছে ওর পেছনে। নিরুপমা দ্রুত পা চালায়। ওই মানুষটাও তাই করে। নিরুপমা দৌড়াবে বলে মনস্থির করে। চিৎকার করবে। কিন্তু গলাটা শুকিয়ে এলো। বোবার মতো স্বরহীন মনে হচ্ছে। হাঁটার গতি বাড়ে আপনা আপনি। ওর সিক্স সেন্স সতর্ক সংকেত দিচ্ছে। অতি দ্রুত হাঁটাতে কাঁধের বই ভর্তি ব্যাগটা জোরে জোরে ওর পিঠে আছরে পড়ে। এই ভারে কিছুপথ গিয়ে ও হাঁপিয়ে ওঠে। হৃৎস্পন্দন যেন তবলা বাজাচ্ছে। কাঁপছে হাত-পা। চোখে অশ্রু টলমল করে। অনেক হয়েছে! আজ এসপার ওসপার করে ছাড়বে নিরুপমা। রোজ রোজ পিছু নেওয়া! বুকে তান্ডব করা ভয়টাকে গলা টিপে ধরে ঘুরে দাঁড়ায়।

হ্যাংলা পাতলা দেহখানার ওপর ইউনিফর্ম। আবছা আলোতে রঙ আর স্কুল ব্যাচ বোঝার উপায় নেই। তবুও নিরুপমার চেনা ইউনিফর্ম। শুধু ওই মুখটাকে ওর চেনা নেই। সমস্ত আঁধার যেন ওই মুখেই লুটিয়েছে। বিমূর্ত ছায়ার মতো লাগছে ছেলেটাকে। ওকে দাঁড়াতে দেখে দ্রুত পদে এগোতে লাগল। নিরুপমা বুকে তান্ডব করা ভয়টা প্রবল শক্তিতে ফের মুক্ত হয়ে নৃত্য করে। উর্ধশ্বাসে দৌড় দেয় সামনে ও। কিন্তু পালিয়ে বাঁচতে পারে না। বিমূর্ত ছায়াটি পেছন থেকে ওর ঘাড় ধরে ফেলে। টেনে নেয় নিজের দেহের কাছে। নিরুপমার মাথাটা ঠিক ওর বুকের ওপর। আক্রমনকারীর বুকের দ্রুত চলা হৃৎস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু মুহূর্তে ওর শ্রবণশক্তি, বাকশক্তি অসাড় হয়ে এলো। কোমল বাহু ছুঁয়ে সাপের মতো উঠতে লাগল ধারালো ছুরির ফলাটা। শীতল স্রোত বয়ে গেল নিরুপমার শিরদাঁড়া বেয়ে। ফলাটা ওর ঘর্মাক্ত গলার ত্বকের ওপর খেলতে লাগল।

“ভয় পাচ্ছ, অমাবস্যা?” শিউরে ওঠে চাপা রুক্ষ স্বরটি শুনে। ছুরির ফলাটা আস্তে আস্তে ওর গলার ত্বক ছিঁড়ে ভেতরে ঢুকছে। উফ! যন্ত্রণায় নিরুপমার দুচোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে। ঝাপসা হতে লাগল দৃষ্টি। গলা দিয়ে অস্ফুটে বাঁচার আকুতি জানায়। কিন্তু স্বর বেরোচ্ছে না কেন?

“অমাবস্যা, অমাবস্যা, এই.. এই, নীড়।”

নিরুপমা চকিতে তাকায়। ওর সামনের গাঢ় অন্ধকার আবছা হয়। সমস্ত শরীর কাঁপছে। সামনে বসা মানুষটাকে দেখতে চিৎকার করে উঠতে যায়। কিন্তু তার আগেই লোকটা ওর মুখ চেপে ধরে।

“শান্ত হও।” নিরুপমা শান্ত হয় না। দু’হাতে খামচে এহসাসকে দূরে সরাতে চায়। পা ছোড়ে বিছানায়।ওর নখাঘাতে হিস হিস করে ওঠে ব্যথায় এহসাস। কিন্তু দৃষ্টি নিরুপমার পাশে শায়িত ঘুমন্ত নিলুফা বেগমের দিকে। তাকে জাগাতে চায় না।

“দুঃস্বপ্ন দেখেছ তুমি। কিছু হয়নি তোমার। শান্ত হও। তোমার মায়ের ঘুম ভেঙে যাবে। ওই দেখো শুয়ে আছে তোমার পাশে। শান্ত হও নীড়, প্লিজ!”

নিরুপমার আতঙ্কিত শরীরটা ধীরে ধীরে শান্ত হয় ঘুমন্ত মায়ের মুখ দেখে। এহসাস ওর মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নেয়। নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হলো নিরুপমার। কিন্তু দু’হাতের নখ এখনও এহসাসের বাহুর ত্বকে। এহসাস আস্তে আস্তে হাত দুটো নামিয়ে নেয়। নিরুপমা বোবার মতো অন্ধকার শূন্যে তাকিয়ে রইল। কদিন জ্বরে ভুগে মুখটা শুকিয়ে গেছে। ডিম লাইটের আলোয় এহসাস ওর চোখের পানি দেখতে পায়। আঙুলে মুছে দিতে চেয়েও কী এক বাধায় হাতটা আগায় না। কিছুক্ষণ পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো থেকে নিরুপমার ঠোঁট কাঁপতে লাগল৷ ফুঁপিয়ে ওঠে। বিড়বিড় করে বলে,

“ও আমাকে মেরে ফেলবে। ও আমাকে মেরে ফেলবে। আমি ভুল করেছি। আর করব না। কোনোদিন না। আ’ম সরি, আ’ম সরি।”

এহসাস চুপ করে ওকে দেখছে। সান্ত্বনা দিলো না। কাঁদছে নিরুপমা। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে গেল। এহসাস তখনও সেখানে বসে আছে। কী যেন ভাবে। ভাবতে ভাবতে ওর চোয়াল কঠিন হয়ে ওঠে। নিরুপমার সিক্ত নিদ্রিত মুখ, ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠা দু’ঠোঁট ওর নিস্পৃহ দৃষ্টিতে করুণার ছায়া ফেলে। উঠে দাঁড়ায় খাটের পাশ ছেড়ে। নিরুপমার গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দেয়।

নিরুপমার নিদ্রিত চোখের পাতার ফাঁক দিয়ে আরও এক ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। এহসাস মুষ্টিবদ্ধ হাতটা খুললো। আঙুলের ডগায় আলতো করে মুছে নিলো অশ্রুর ধারা। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ভেজা আঙুলের দিকে। তারপর নিরুপমার নিদ্রিত মুখে। কয়েক গাছি চুল এসে পড়েছে ওর মুখের ওপর। এহসাস ঝুঁকে দাঁড়ায়। তর্জনীতে চুলটা সরিয়ে দেয় কানের পাশে।

“হ্যাভ অ্যা সুইট ড্রিম, অমাবস্যা।” তারপর ওর মুখ বদলে যায়। ঠোঁট একপাশে বেঁকে যায়। তারপর আলগা হয়। নিরুপমার অশ্রু ভেজা আঙুলটা মুখে পুড়ে উঠে দাঁড়ায়। রুমে যেতে যেতে রহস্যময় এক হাসি খেলা করে ওর ঠোঁটে।

ঈপ্সা কলেজ গেটে এসে থামল। সাথে সৌমি ও নাফিসা। সামনে কলবেলের আচারের ভ্যান। আচার ওর ভীষণ পছন্দের। দু প্যাকেট কিনে নিলো। নাফিসা বলল ভেলপুরি খাবে। তিনজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্পে গল্পে ভেলপুরি খাচ্ছিল। অদূরে শান্তকে দেখতে পেল। দুজন দুজনকে দেখে মুচকি হাসল। সামনা-সামনি খুব কমই কথা হয় ওদের। মোবাইলে টুকটাক কথাবার্তা হয়। ঈপ্সা এখনও সহজ হতে পারেনি। তবে শান্ত খুব চেষ্টা করছে। নিজ থেকে কত কথা বলে। ওর ভালো-লাগা মন্দ লাগা, দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো। কথায় কথায় কথা বাড়তে থাকে দুজনের। হয়তো এভাবেই একদিন সৌমি ও নাফিসার মতো সেও ঈপ্সার ভালো একটা বন্ধু হয়ে উঠবে। বন্ধুত্বের গভীরতা একদিনে তো আর তৈরী হয় না!

ঈপ্সা দৃষ্টি সরিয়ে নিতে সৌমির ভুরু তোলা দেখল। ও মুখে কিছুই বলবে না। ভুরু তুলে বুঝিয়ে দেবে ঈপ্সা ও শান্তর এই মুচকি হাসি বিনিময়ে সে পছন্দ করেনি। কেন যেন শান্তকে ও পছন্দ করে না। ঈপ্সা কয়েকবার ওদের কথা বলানোর চেষ্টা করেছে। হবু বরের কড়া নিষেধাজ্ঞায় নাফিসা রাজি হয়নি। সৌমি কেন রাজি হয়নি ঈপ্সা বুঝতে পারে না। ছেলে বন্ধু ওর গন্ডায় গন্ডায় আছে। এক শান্ততেই যত সমস্যা! ঈপ্সা ভেংচি কাটল। ভেবেছিল সৌমি দেখবে না। দুর্ভাগ্য সৌমি কড়া দৃষ্টিতে ওকেই দেখছিল। ভেলপুরি এমনভাবে মুখে পুরে চাবাতে লাগল যেন ঈপ্সাকেই চাবাচ্ছে।

“তোমার বড্ড বাড় বেড়েছে ঈপ্সামনি। অত বাড় ভালো না।” সৌমির মুখে তখনও ভেলপুরি। ঈপ্সা বলল,

“কেন বললি এ কথা? কী করেছি?”

“নেকামি করিস না। শেষমেষ আর্টসের ওই হ্যাবলাক্যান্ত! কলেজে ছেলের অভাব?”

ঈপ্সার মুখ হা হয়ে গেল। বলল,

“কী বাজে বকছিস? ও শুধু ফ্রেন্ড।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ বুঝেছি।” সৌমির জিহ্বায় যেন মরিচ লেগেছে। ঈপ্সা বলে,

“সিরিয়াসলি। বিশ্বাস কর।”

“আদরূপ ভাই জানুক তারপর বলিস সিরিয়াসলি ভাই, বিশ্বাস করো। তোর কলিজা বেশি বড়ো হয়ে গেছে, না? সেদিনের ঘটনার পর তোর সাহস কী করে হয় ওই ছেলের সাথে কথা বলার? আবার ফ্রেন্ডশিপ পাতাও!”

ঈপ্সার রাগ হয়। ওর নিজস্বতা বলতে কি কিছু নেই? সামান্য একটু ফ্রেন্ডশিপ করবে তাতেও একে ভয়, ওকে ভয় করে চলতে হবে? কেন? সৌমির তিক্ত কথা ওর পছন্দ হলো না। কই নাফিসা তো কিছু বলে না। সৌমির এত সমস্যা কীসের?

“তোর সমস্যা এক্সাক্টলি কী নিয়ে বলতো আমাকে? কেন তেজ দেখাচ্ছিস?”

“তেজ দেখাচ্ছি? দেখালে দেখাচ্ছি। তোর ভালোর জন্যই দেখাচ্ছি।”

“আমার ভালো তোকে দেখতে হবে না। নিজেরটা আগে দ্যাখ।”

নাফিসার শত বারণ উপেক্ষা করে ঈপ্সা মান করে চলে এলো প্রাইভেট কারের সামনে। সব রাগ ঝাড়ল গাড়িটির দরজায়। ড্রাইভার কথা বলার সাহস করল না। চুপচাপ গাড়ি স্টার্ট দিলো।

মন খারাপ করে জানালার বাইরে মুখ করে বসেছিল ঈপ্সা। শান্তকে ওর পছন্দ না। কথাটা কি ভালোভাবে বলতে পারত না সৌমি? শেষমেশ আর্টসের হ্যাবলাক্যান্ত! এর মানে কী ঈপ্সা বোঝেনি ভেবেছে? সৌমির তো এত এত ছেলেবন্ধু। কই ঈপ্সা তো কখনো এভাবে বলেনি। ওর ভেতরটা ছি! ছি! করে উঠল। মন মস্তিষ্কে একজনকেই ঈপ্সা গেঁথে রেখেছে। সৌমি সব জেনেও কী করে এ কথা বলতে পারল? ঈপ্সার ভীষণ খারাপ লাগে।

গাড়ি ব্যস্ত সড়ক ছেড়ে ফাঁকা রাস্তায় নামল। এদিকের রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা সীমিত। ঈপ্সা উদাস হয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ করে একটা গাড়ি এসে চলতে লাগল ওদের গাড়ির পাশাপাশি। ঈপ্সা ভয়ে আঁতকে ওঠে গাড়িটির পেছনের সিটে বসে থাকা স্মাইলিং মাস্ক পরা সেই মানুষটাকে দেখে। সোজা হয়ে বসল। দৃষ্টি সামনে সরিয়ে আনে। পাশে তাকাবে না তাকাবে না করেও তাকালো। ঘাড়টা কাত করে ঈপ্সাকেই দেখছিল মাস্কধারী লোকটা। লোকটার চাহনি ক্রিপি। ভয়ে মুখ সাদা হয়ে গেল ওর।

“ড্রা..ইভার আ..ঙকেল ওই দেখুন তো..?” ড্রাইভার ওর আঙুল অনুসরণ করার আগেই পাশের গাড়িটি দ্রুত সামনে চলে গেল।

“কী হইছে আম্মা?”

ঈপ্সার হাত পা কাঁপছে। ড্রাইভার ওর ভীত মুখ দেখে চিন্তিত হয়। ঈপ্সা সব খুলে বলল। ড্রাইভার সামনে তাকায়। চোখের নিমেষে গাড়িটি হাওয়া। ড্রাইভার ওকে অভয় দেয়। বলে এরপর আবার দেখলে সাথে সাথে তাকে যেন ও বলে। ব্যাটাকে ভয় দেখানোর মজা বুঝিয়ে দেবে। ঈপ্সার ভয় কাটে না। স্বস্তি পায় না। দুই বার ওই একই লোককে দেখা কি কাকতালীয় হতে পারে?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here