অরূপ জ্যোৎস্না পর্ব -৩০

#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-৩০
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

জুম্মার নামাজ আদায় শেষে বাসায় ফিরছিলেন ইকরাম আজাদ। পথের দু’পাশের দেওয়ালে দেওয়ালে লাগানো পুত্র সম প্রিয় এহসাসের হুলিয়া জারি দেখে থমকে দাঁড়ালেন। এহসাসের মুখের ছবি দেওয়া। কতদিন হয় ওই মুখটা তিনি দেখতে পান না। বুকটার ভেতর সংকুচিত হয়। পাশা হক এতদূর গেল! শুনেছে লোকটা এককালে ডাকাত ছিল। এহসাসকে পেলে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করবে না। এই জন্যই ওকে দূরে পাঠিয়েছেন। আত্মগোপনে রেখেছেন। মনসুরকে ডেকে আরও ভালো করে সাবধান করে দিতে হবে। পিয়াসের জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত এহসাসকে জনসমক্ষে আনা যাবে না। ক্ষমতা ও অর্থ দিয়ে এহসাসের নিরাপত্তা রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। অসৎ কাজ করতে বড্ড বাধে তাঁর। কিন্তু কি-ই বা করার আছে! ভালোবাসার কাছে মানুষ নিজেকে বিসর্জন দিতে কুণ্ঠিত হয় না। সততা আর কী জিনিস!

বাসায় এসে লিভিং রুমে বসলেন। এসি বাড়িয়ে দিলেন। চশমাটা খুলে কোলের ওপর রাখলেন। মাথাটা ফের ধরেছে। আজকাল ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না। কাউচে গা এলিয়ে চোখ বুজলেন। কিছুক্ষণ বাদে সামনের টেবিলে শব্দ হতে তাকালেন। শরবতের গ্লাস রেখে ক্যামেলিয়া দাঁড়িয়ে আছে। পরনে হলুদ রঙের একটা জামদানী। চুলগুলো পিঠ ও কাঁধ জুড়ে ছড়ানো। চোখে কাজল টেনেছে। ঠোঁটে কিছু দেয়নি। ওইটুকু বাদ রাখল কেন মেয়েটা? ইকরামের গাঢ় রঙের লিপস্টিক পছন্দ। লালটা বেশি। কাজলকে তিনি ডজন ডজন এনে দিতেন। ভালোবাসার মধুর মুহূর্তের পরে তার দেহে সেই গাঢ় লাল রঙের চিহ্ন থেকে যেত। ওটাই তার ভালোলাগা। কিন্তু এই মুহূর্তে সে কথা কেন ভাবছেন? গলা ঝেড়ে সোজা হয়ে বসলেন। শরবত শেষ করে খালি গ্লাসটা রেখে উঠে দাঁড়াতে ক্যামেলিয়া বলল,

“ঈপ্সা ইদানীং খাবারে বড্ড অনিয়ম করছে। আপনি কি একটু যাবেন ওর ঘরে? একটু বুঝিয়ে আসতেন। চাকর-বাকর কাওকে ঢুকতে দিচ্ছে না। শরীর টরির খারাপ করল কি না!”

এত অপমানের পরেও ঈপ্সাকে নিয়ে কেন যে ভাবে ক্যামেলিয়া। মা হয়ে উঠতে চায়? বোকা মেয়ে জানেনা তা কোনোদিন সম্ভব না। ঈপ্সা মেনেই নেবে না ওকে। আর তিনি? তাঁর হৃদয়ে কাজল আর ঈপ্সা ছাড়া অন্য নারীর বাস আছে? ইকরাম আজাদ মাথা নাড়ালেন। মেয়ের রুমের দিকে যাচ্ছিলেন। ক্যামেলিয়াও তাঁর পিছু নেয়।

“কোথায় যাচ্ছ তুমি?”

“ঈপ্সার রুমে।”

“কোনো প্রয়োজন নেই৷ তোমাকে আমার সাথে দেখলে ও রেগে যাবে৷ আমি মিনির সাথে একটু শান্তিতে কথা বলতে চাচ্ছি। আর হ্যাঁ, ওর কাছ থেকে দূরে থাকবে তুমি, ক্যামেলিয়া।”

কথাগুলো কঠিন শোনাল। ক্যামেলিয়ার মুখে একটু আগে যে আলো ঝলমল করছি তা যেন নিভে গেল। ইকরাম আজাদ ওকে কষ্ট দিতে চাননি। শুধু বাস্তবতা বুঝাতে চান। মাঝে মাঝে বাস্তবতা তিতকুটে লাগে। মেয়ের রুমের দিকে চলে গেলেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল ক্যামেলিয়া। ওর নির্লজ্জ চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। কোথাও ক্যামেলিয়ার প্রয়োজন নেই। রাহাতের জীবনে ছিল না। এখন ইকরাম আজাদের জীবনেও নেই। বোঝা লাগে জীবনটা।

সেদিনের পর থেকে নিরুপমা আরও সাবধানে চলে। কিন্তু ও জানে ওর সকল সাবধানতা ঠুনকো কাঁচের মতো দুর্বল। সামান্যতে ভেঙে গুড়িয়ে যাবে। তারপর বেরিয়ে আসবে ওর ভেতরের গোপন করতে চাওয়া সব আবেগ, অনুভূতি। শুধু কী বেরিয়ে শান্ত হবে? বেপরোয়া, বেহায়া ও লোভী হয়ে উঠবে। পরিণামে ক্ষত-বিক্ষত হবে। এত কিছু জানার পরও নিজেকে এহসাস আরমানের ছায়া থেকে সরিয়ে রাখতে পারছে না। তাকে কামনা করা, আকাঙ্খা করা বা তার প্রতি কিছু অনুভব করা নিরুপমার জন্য বিপজ্জনক। ওই মানুষটাই নিরুপমার জন্য ঠিক নয়। সে যতই আগ্রহ দেখাক, যতই বলুক, “লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট বোঝো নিরুপমা। যদি বলি তোমাকে দেখে আমার তাই হয়েছে, বিশ্বাস করবে?” নিরুপমা বিশ্বাস করতে চায় না। না বলে মুখে। কিন্তু ওই না ওর সমস্ত দেহ-মনের কাছে জয় যুক্ত হয় না। এখানেই ভয়। যা মুখে বলবে তা সবকিছু বিরোধিতা করবে কেন? এত অস্থিরতা আনে কেন? এহসাস আরমান জেনে-বুঝে এই ঝড় তুলছে না তো? কী চায় সে? নিরুপমাকে না ওর মনকে? না কি কেবল ওর দেহটাকে? যাই চাক পাবে সে কিছুই না। কথাটা আগের মতো দৃঢ় কেন লাগছে না! এহসাসের কাছে ওর চাওয়ার বা মতের কোনো মূল্য বা সম্মান নেই বলেই হয়তো এমনটা লাগছে। এই যে রাতদুপুরে এক প্রকার জোর করে ছাঁদে নিয়ে এসেছে। তার ঘুম আসছে না৷ মধ্য রাতের জ্যোৎস্না দেখবে৷ ঘুম ঘুম চোখে ক্ষুব্ধ মেজাজে নিরুপমা ছাঁদে এসে দেখল জ্যোৎস্না না ছাই! ঘোর অমাবস্যার রাত। আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে আছে। কোথাও নক্ষত্র নেই। রূপোলী চাঁদটা আজ রূপ হারিয়ে ম্লান, বিষণ্ণ। অদূরে কোথাও শিয়াল ডেকে ওঠে। নিরুপমার গায়ে কাঁটা দেয়। মৃদু বাতাস বইছে। তবুও কী নিস্তব্ধ এই রাত! এহসাস হেঁটে হেঁটে ছাঁদের দক্ষিণ কোণের শেষে গিয়ে জুতো খুলে তার ওপর বসল।

“কই এসো!” নিরুপমা আশপাশে তাকায়। যতদূর চোখ যায় ঘন অন্ধকার। ওই অন্ধকারে যেন শত সহস্র অশরীরী মিশে আছে। কাল যাদের গ্রাস করেছিল। যে কোনো সময় হৃদয় স্তব্ধ করা ভয়ংকর অট্টহাসি দিয়ে দৃশ্যমান হতে পারে ওরা। নিরুপমা ভীতু! গলা শুকিয়ে এলো। এহসাস ঘাড়ের ওপর থেকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওর মুখটাও এই অন্ধকারে মতো রহস্য ও নিস্তব্ধতায় মোড়ানো। ভীরু পায়ে এগিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

“আজ জ্যোৎস্না নেই। বসে কী দেখব?”

“অমাবস্যা।” এহসাস ম্লান ও বিষণ্ন চাঁদটার দিকে তাকিয়ে বলল। নিরুপমা বলল,

“মানুষ চন্দ্রবিলাস বা জ্যোৎস্না বিলাস করে শুনেছি, কিন্তু অমাবস্যা বিলাস করে তা তো শুনিনি।”

এহসাস মুচকি হাসল। হাত দিয়ে পাশে বসতে বলে বলল,

“অমাবস্যা দুঃখের আর হাহাকারের রাত। দুঃখ আর হাহাকারের বিলাস হয় না? অতৃপ্তের আর্তনাদ এই রাতের বাতাসে মিশে থাকে। চোখ বন্ধ করে চুপ করে থাকো। শুনবে কেউ যেন করুণ বীণা বাজাচ্ছে। কেউ ডাকছে মহাকালের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে। কেউ গাইছে হৃদয় ভাঙার গান। এই রাত আমাকে টানে। বিলাসের জন্য না। আমার আমিটাকে চিনিয়ে দিতে চায় ও। আমার অতীত ক্ষত মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় একজনকে।”

“কাকে?” প্রশ্নটা অজান্তেই করে নিরুপমা। অমাবস্যা বলে এহসাস ওকেই ডাকে। ওকে কি মনে করিয়ে দেয়? এহসাস সাথে সাথে জবাব দিলো না। দূর অন্ধকারে তাকিয়ে বলল,

“তুমি নও।” মনে মনে বলে,”তুমিই, তুমিই সেই একজন৷” তারপর উদাস গলায় বলে,

“ছিল একজন। যার জন্য এখনও আমার হৃদয় অতৃপ্ত আত্মার মতো ছটফট করে। তার দেওয়া আঘাত পুনর্জীবিত হয় এই রাতেই যেন। তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসি এই অমাবস্যায়।”

আশাভঙ্গ হলে মানুষের যেমনটা লাগে নিরুপমার তেমন কেন লাগল? এই অমাবস্যা ডাক ও কখনোই পছন্দ করেনি। ভেবেছ ওর গায়ের রঙ নিয়ে তাচ্ছিল্য করে ডাকে ওই নামে। আজ মনে হচ্ছে তাই যেন করে। তাছাড়া ওই নামে কেন ডাকবে?

“কাওকে ভালোবাসতেন?” নীরবতা ভেঙে বলল। কেন বলল? কী বোকা! কী নির্বোধ ও!

“বোধহয়।”

নিরুপমার মুখে রা নেই। এহসাস তাকাল ওর মুখের দিকে। নিরুপমা ওড়নার ঘোমটা টেনে নিতে মৃদু হাসল। তারপর বলল,

“তুমি কাওকে কখনও ভালোবেসেছ, নিরুপমা?”

“না।” সোজাসাপ্টা খেদে ভরা জবাব। কেন যে ভালোবাসেনি! তাহলে আজ এত খারাপ লাগত না।

“কেন?”

“আমি কি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি কেন ভালোবাসতেন?” ঝাঁঝ গলায় বলল নিরুপমা। এহসাস মনে মনে হাসল।

“জিজ্ঞেস করো আমি বলব।”

“দরকার নেই আমার। উঠছি আমি।” উঠেও আবার বসল নিরুপমা। ঘোমটা একটু সরিয়ে সরাসরি তাকাল। জ্বলন্ত চোখে বলল,

“আপনি আমাকে অমাবস্যা বলে ডাকেন কেন? আমার গায়ের রঙ কালো বলে? অসুন্দর বলে?”

এহসাসের কপালে ভাঁজ পড়ে। ওর চোখে নিরুপমা অনেক কিছু কিন্তু সেই অনেক কিছুতে অসুন্দর বলে কোনো শব্দ নেই। ওর ওই কালো রঙকে ও নারীর চোখের কাজলের মতো মুগ্ধকর মনে করে।

“তুমি নিজেও জানো অসুন্দর কথাটা তোমার সাথে যায় না, নিরুপমা।”

“তবে কেন ডাকেন অমাবস্যা বলে?”

“সবকিছুর কি কারণ থাকে? তবুও বলি, মানুষের জ্যোৎস্না ভালো লাগে, সমুদ্র ভালো লাগে, পাহাড় ভালো লাগে। আমার অমাবস্যা ভালো লাগে। বলেছি না লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট হয়েছে তোমাকে দেখে। তাই হয়তো অমাবস্যার সাথে তুলনা করে ডেকেছি।”

লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট বলে বলে নিরুপমার মাথা খাচ্ছে। নিরুপমা হাঁপ ছাড়ে। কালো বলেই অমাবস্যা ডাকে। মুখের ওপর সত্যিটা বলতে পারছে না। মনে মনে ভীষণ কষ্ট পায় নিরুপমা।

“কোন অমাবস্যার সাথে তুলনা করেছেন? আপনার প্রেমিকা অমাবস্যার সাথে? খবরদার যদি কারো সাথে আমাকে তুলনা করেছেন!”

“এক মিনিট! আর ইউ জেলাস?”

এহসাস হাসছে। সাদা দাঁতগুলো আরও সাদা লাগছে এই আঁধারে। নিরুপমা এই ভয়েই এই লোকের কাছ ঘেঁষে না। এই যে ওকে জেলাস বানিয়ে ছেড়েছে! ও কি সত্যি জেলাস? কেন?

“মোটেও না। আমি শুধু বলেছি কারো সাথে আমাকে তুলনা করবেন না। তুলনা আমার পছন্দ না। আর হ্যাঁ, আর কোনোদিন আমাকে অমাবস্যা বলে ডাকবেন না। কোনোদিন না।”

নিরুপমা উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু যায় না। এহসাস আপত্তি করে না। বেশ! না ডাকুক অমাবস্যা বলে। নিরুপমার তাতে বয়েই যাবে।

“ফিরে যাবে রুমে?” না তাকিয়ে জানতে চাইল এহসাস। নিরুপমা ওর দিকে তাকিয়ে রইল।

“হুম।”

এহসাস উঠতে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। মুখটা ভার নিরুপমার। দুজনে সিঁড়ির কাছে আসতে এহসাস থামে। সত্যিটা কি বলবে? বলবে ওই অমাবস্যা? কারো তুলনা নয়। ওই এহসাসের জীবনের প্রথম ভালোবাসা। যাকে ভেঙেচুরে নিঃশেষ করতে চায়। যার হৃদয় ভাঙায় ওর জীবনের স্বপ্ন ও লক্ষ্য।

নিরুপমা কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে পেছন ফিরে তাকায়। এহসাস ওর দিকে অনিমেষ চেয়ে নামে। ওর বুকে রক্তক্ষরণ হয় ওই চোখে চেয়ে। কেন হয়? ওকে তো এখন আর ভালোবাসে না। চায় না। কেবল ওর ক্ষতি চায়, সর্বনাশ চায়। যেমনটা ও করেছিল এহসাসের। এত কষ্ট ও রিস্ক নিয়ে এই কারণেই এখানে পড়ে আছে। সেসব ব্যর্থ হতে দেবে না। সিঁড়ির কিনারে পা পিছলে পড়েই যাচ্ছিল নিরুপমা ওর বাহু চেপে ধরে দুহাতে।

“সাবধানে!”

সাবধান! সাবধান! এহসাস আলগোছে নিরুপমার হাত থেকে নিজের বাহুটাকে ছাড়িয়ে মনে মনে জপে। তারপর পাশ কাটিয়ে ওকে রেখেই নিচে নেমে যায়।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here