অশ্রুমালা পর্ব ৩১+৩২

#অশ্রুমালা
part–31
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

মাঝরাস্তায় রোদেলা মাস্ক নাক থেকে থুতনিতে টেনে এনে লম্বা করে শ্বাস নিল। এই কান্ড দেখে আবেগ এমন ভাবে রোদেলার দিকে তাকালো যেন রোদেলা কোন অপরাধ করে ফেলেছে। শুধু অপরাধ না ঘোর অপরাধ!

আবেগকে এভাবে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে রোদেলা কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে গেল এবং মাস্ক ঠিক ভাবে পড়ে নিল।

আবেগ কড়া গলায় বলে, স্ট্রেঞ্জ! মাস্ক খুলে কেন ব্রিথ নিচ্ছো?

রোদেলা সহজ গলায় বলে, মাস্ক পড়ে থেকে নিশ্বাস নিয়ে আরাম পাই না৷

আবেগ কিছুক্ষন তার দিকে তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বলে, তাহলে আমরা ডাক্তাররা কিভাবে সারাদিন ডাবল মাস্ক পড়ে সেবা দিচ্ছি? তাও হাতে গ্লোভস পড়ে গরমের মধ্যে বারো ঘন্টার বেশি ডিউটি করে গেছি।

রোদেলা কাচুমাচু করে বলে, তোমরা ডাক্তার রা অনেক কিছু সহ্য করতে পারো যেটা একজন স্বাভাবিক মানুষ পারে না।

–তাই নাকি?

–হুম। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের আর্তনাদ, মৃত্যু মিছিল, আপনজন হারানোর হাহাকার, কান্না দেখে দেখে তোমরা ভেতর থেকে রোবট হয়ে গেছো।

— এটা অবশ্য ঠিক বলেছো। একজন ডাক্তার সহজে কাদে না। মেন্টালি খুব শক্ত হয়। আসলে সে শিখে যায় কিভাবে শক্ত হয়ে হয় কেননা
একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট প্রথম ধাক্কা খায় যেদিন সে এনাটমী ডিপার্টমেন্টে দশ-বারো বছর পুরোনো লাশ দেখে। গাছের বাকলের মতো রক্তনালি, নার্ভগুলো বের হয়ে থাকতে দেখলে সযে কেউ আধ পাগল হবে৷ অথচ সেই লাশটার না চাইলেও কাটাকাটি দেখতে হয় তাকে। এরপর ফরেনসিকের কথা নাহয় বাদ ই দিলাম। তারপর হুট করে সুস্থ একজন পেশেন্ট কে কোন রকম প্রতিক্রিয়া ছাড়াই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়তে দেখে তখন আস্তে আস্তে একজন ডাক্তারের চোখের পানি কমে যেতে থাকে। আচ্ছা এসব জটিল কথা বাদ দাও। ফুচকা খেতে চাইছিলে না? সামনের রেস্টুরেন্টে চল। এই রেস্টুরেন্টটা ভালো। নিট এন্ড ক্লিন। হাইজেনিক। পরিবেশ ও ভালো।

রোদেলা কিছু বলল না। তার মাথায় কেবল আবেগের বলা কথাগুলো ভাসছে৷ ইশ! সে যদি ডাক্তার হতে পারব! কতো ভালোই না হত!

আবেগ রোদেলার হাত ধরেই রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে পড়ে। রেস্টুরেন্টে এসি চলছে। সেন্টের গন্ধ নাকে আসে রোদেলার।

তারা মুখোমুখি দুইটি চেয়ারে বসে পড়ে। আবেগ হ্যান্ড স্যানিটাইজার বের করে রোদেলার হাতে দিল। তারপর এক প্লেট ফুচকা,ফ্রাইড রাইস প্ল্যাটার আর কফি অর্ডার দিল৷ এখানে এক প্লেট ফুচকা দেড় শ টাকা দাম। কিন্তু স্বাদ একদম ই মজার না। বাইরের মামার দোকানের ফুচকার সামনে এই ফুচকা কিছুই না। কিন্তু এটা তো আর আবেগ বুঝবে না। উলটো এই কথা বললে রোদেলা কে অকারণেই ধমক দিবে। এই মূহুর্তে রোদেলার ধমক খাওয়ার ইচ্ছা নাই তাই চুপ থাকল সে।

তবে রোদেলা মনে মনে খুব খুশি কেননা এই প্রথম বিয়ের পর আবেগ তাকে কোন রেস্টুরেন্টে আনল। রোদেলা টেবিলে হাত রেখে এক ধ্যানে আবেগকে দেখেই যাচ্ছে। আবেগ নিচু হয়ে ফোন চালাচ্ছে।

ছেলেটার মধ্যে “স্টাইল” বলে কোন কিছু নেই। তারপর ও আবেগকে খুব ই হ্যান্ডসাম লাগে!

কিছুটা রোগা হয়ে গেছে সে। কিন্তু লম্বা। চুল গুলো সবসময় গোছানো থাকে আর খুব ঘন ও। এদিকে মেয়ে হয়েও রোদেলার চুল খুবই পাতলা। আবেগের চোখে চশমা থাকে। সবসময় না। হাসপাতাল, চেম্বার আর কিছু পড়ার সময় চশমা ইউস করে। ওর নাকি ডান চোখে মাইনাস পাওয়ার। মায়োপিয়া সম্ভবত। কত ডায়াপ্টরের চশমা পড়ে তা জানে না রোদেলা।

আবেগের চোখের নিচে কালি আছে। ডান চোখটার নিচটা তুলনামূলক বেশি কালো বাম চোখের চেয়ে। শ্যামলা বর্ণের। রোদেলার শ্যামলা বা কালো ছেলেই ভালো লাগে। এটা সম্ভবত তার বাবা কালো হওয়ার জন্য ই কালো ছেলে ভালো লাগে। আবেগের দাড়ি আছে। তবে সেটা স্টাইল বা ফুংফাং দেখাবার জন্য না। বরং নবীর সুন্নত পালন করার জন্য রেখেছে। কিন্তু বেশি বড় না। চাপ দাড়ির মতোই সেটে রাখা। আবেগের নাকি দাড়ি বড় হলে গাল চুলকায়, এলার্জি হয়!

রোদেলার মনে আছে, আবেগ ক্লাস টেন থেকে দাড়ি রাখে। মামা নাকি কড়াকড়ি করে বলেছে দাড়ি রাকতে। আবেগ ও বাধ্য ছেলের মতো আর কোন দিন শেইভ করে নি। সবসময় গালভর্তি দাড়ি রাখে। আবেগ আবার খুব মা-বাবা ভক্ত। বাব-মায়ের অনুগত সন্তান।আবেগের সাথে একটা মজার ছোট বেলার স্মৃতি আছে রোদেলার। সে অনেক আগের কথা তা হলোঃ

গোল গোল চোখে আধ ভাঙ্গাস্বরে রোদেলা বলেছিল , আমি আবেগ ভাইয়াকে বিয়ে করব!

তখন হয়তো রোদেলা বিয়ে নামক ভারী শব্দটার অর্থের মানেও বুঝত না৷ কিন্তু সেদিন আবেগ থমকে গিয়েছিল এক পলকের জন্য!

রোদেলার পাকা পাকা কথায় সবাই হেসে একাকার। কিন্তু সেদিন আবেগ হাসতে পারেনি সবার সাথে। তার কেন যেন তখন নিজেকে জামাই জামাই লাগতে লাগে৷ হুট করে এক রাশ লাজুকতা বিরাজ করে তার মনের মধ্যে! রোদেলা এহেন কথা শুনে আবেগ লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে রুমে যে ঢুকে পড়েছিল। পরের দিন দুপুরে বের হয়েছে সেই ছেলে। অথচ রোদেলা কিন্তু বউ-বিয়ে-স্বামী মানে তখনো বুঝত না! এক পরিচিত ফুপির বিয়ে উপলক্ষে বাবা-মায়ের সাথে আবেগদের বাড়িতে এসেছিল। তখন বিয়ে শব্দটা নতুন শিখে সাথে সাথে এপ্লাই করে বসে রোদেলা। আর আবেগ! বেচারা লজ্জায় রাতে ভাত পর্যন্ত খায় নি। কান্নাকাটি নাকি করেছিল মামীর কাছে কেন রোদেলা তাকে বিয়ে করবে এজন্য কান্না আবেগের৷ আট-নয় বছরের হওয়ার পরও আবেগ কান্না করেছিল। এগুলো অবশ্য রোদেলা কে তার মা গল্প শুনিয়েছে।

অতীতের মিস্টি স্মৃতি চারন করতে করতে রোদেলা হুট করে হেসে ফেলে।

আবেগ দ্রুত ফোন রেখে রোদেলার দিকে তাকায়। মেয়েটা একা একা হাসছে কেন? মাথায় কোন বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিল না তো?

রোদেলা হাসি থামালো আর বলল, সর‍্যি!

আবেগ বিচলিত হয়ে বলে, রোদেলা! ডু ইউ হ্যাভ এনি প্রবলেম? সমস্যা আছে কোন?

–না তো।

–তাহলে একা একা হেসে কি প্রমান করতে চাইছো? পাগল হয়ে যাচ্ছো না তো?

একথায় আবারো রোদেলা হেসে ফেলে।

আবেগ বিড়বিড় করে বলে, অতি হাসি পাগলের প্রাথমিক লক্ষন!

রোদেলা হাসতে হাসতে বলল, সব জায়গায় ডাক্তারি বিদ্যা কাজে লাগাতে আসবে না৷ আমি তোমার রুগী না।এমনি হাসছিলাম। একটা কথা মনে পড়ে গেল তাই!

আবেগ রোদেলার দিকে তাকালো। চারপাশের ডেকোরেশন খুব সুন্দর। আভিজাত্যর শেষ নেই। এক্সপেন্সিভ রেস্টুরেন্ট এটা। চারিদিকে চাকচিক্যময়। তবে এইসব চাকচিক্যময়ের মধ্যে ও রোদেলাকেই বেশি উজ্জ্বল লাগছে। রোদেলার হাসি মাখা চেহারায় ডুবে যাচ্ছে আবেগ।

আবেগ মনে মনে বলে, অশ্রুমালা! তোমাকে হাসলে সবচেয়ে বেশি, অনেক বেশি সুন্দর লাগে! একদম মুক্তা দানার মতো লাগে!

খাবার চলে আসল। ফ্রাইড রাইসের দুইটা প্লেট্যার। এক প্লেট ফুচকা আর দুইটা গরম গরম ক্যাপাচুনা কফি।

প্লেট্যারে রাইসের সাথে বীফ চিলি অনিয়ন, প্রন্ড সিজলিং আর স্পাইসি চিকেন ফ্রাইস আছে। রোদেলার চিকেন ফ্রাই খুব পছন্দ।

সে প্লাটার টা সামনে নিল তখনি আবেগ বলল, আগে ফুচকা খাও।

রোদেলা প্লাটার সরিয়ে ফুচকা হাতে নিল। ফুচকা আলাদা ভাবে সাজানো, ছয় ধরনের টক একটা কাচের গ্লাসে সেই গ্লাসের উপর ফুচকা সাজানো।
এখানে আবার তেতুলের টক বলে না। বরং বলা হয় সস!

রোদেলা ফোন বের করল। তারপর ছবি তুলল খাবারের। আবেগ রোদেলার এই আচরণ সম্পর্কে অবগত। রোদেলা খানা-পিনার ছবি তুলতে পছন্দ করে সেই বহু কাল আগে থেকে। এতো বড় হওয়ার পর ও এই শখ গেল না! থাক। কিছু শখ থাকা ভালো তাই কিছু বলল না আবেগ।

রোদেলা ছবি তোলা থামিয়ে বলে, একটা সেলফি তুলি?

–নো।

–প্লিজ। এমন বয়স্কদের মতো কেন তুমি?

আবেগ বিরক্ত হয়ে গেল এবং বলল, তুলো৷ জাস্ট একটা কিন্তু!

রোদেলা ক্যামেরা বের করে বলে, মাস্ক খুলো৷

আবেগ বলল, না, না। মাস্ক খুলব না।

–কেন? খুলো। নইলে খাবা কেমনে?

আবেগ অনিচ্ছা সত্ত্বেও খুলল মাস্ক। তারপর ছবি তুলে দুজন।

রোদেলা ফুচকায় সস ঢুকালো (দামি রেস্টুরেন্ট ফ্যাক্ট) এবং আবেগের মুখের সামনে ধরল।

আবেগ একটু চমকে উঠে বলে, কি?

রোদেলা সহজ গলায় বলে, খাও৷

–তুমি জানো না আমি ফুচকা তেমন খাই না।

–এটা তো হাইজেনিক প্লেস৷ একটা খাও প্লিজ৷

–না। তুমি খাও।

–তুমি না খেলে আমিও খাব না কিন্তু!

অগত্যা আবেগ হা করে রোদেলার হাত থেকে ফুচকা মুখে পুড়ে নিল। তা দেখে বেশ খুশি হয় রোদেলা।

ফুচকা খাওয়ার পর রাইস খেতে লাগলো তারা। খাওয়ার মাঝখানে আবেগ বলল, কফিটা নেওয়া ঠিক হয় নি। রাইস খাওয়ার পর কোক পেপসি খেতে হয়। দাঁড়াও ওর্ডার দিচ্ছি।

রোদেলা মেন্যু কার্ডে দেখল, কোকের দাম এক গ্লাস ষাট টাকা। অথচ বাইরে এক লিটার সেভেন আপ ই পঞ্চাশ টাকা। সে আবেগকে একথাটা জানিয়ে বলে, দরকার কি?বাইরে থেকে কিনে নিব।

আবেগ আরেকদফা রোদেলার উপর বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, মেয়েদের কিপটা স্বভাবটা মানায় না। স্বভাবটা দ্রুত বদলাও।

রোদেলা মুখ কালো করে আস্তে করে বলে, আমি মোটেও কিপটা না। শুধু তোমার শ্রমের মূল্যায়ন করি। এতো কষ্টে দিন-রাত এক করে টাকা কামাও, আই রেসপেক্ট ইট!

আবেগের কানে কথাগুলো গেল না। সে কোক অর্ডার দিল এবং কফি গরম করতে বলল। কফি গরম করার জন্য এক্সট্রা পঞ্চাশ টাকা দিতে হয়।
কফি খেতে খেতে আবেগ বলল, আরো কিছু খাবে? ডেজার্ট?

রোদেলা বলল, না। না। আমার পেট ভরে গেছে। আচ্ছা তুমি যদি রেস্টুরেন্টে আসতেই চাইছিলে তাহলে ইভু তখন থামালে না কেন? ও আসত আমাদের সঙ্গে। ও তাও বাইরে খেতে খুব পছন্দ করে।

আবেগ মনে মনে বলে, সব জায়গায় সবাইকে নেওয়া যায় না।

তারপর বিল মিটিয়ে তারা বাসার উদ্দেশ্য রওনা হলো।

★★★

ইভানা তাদের বাসা থেকে খানিকটা দূরে রেটিনা কোচিং এর সামনে এসে দাড়িয়ে আছে। মূলত শৌখিনের অপেক্ষায় আছে সে। ছেলেটা এতো বলদ! শৌখিন নাকি আধ ঘন্টা ধরে ট্রেস্টি ট্রিটের সামনে দাড়িয়ে ছিল অথচ তাকে ম্যাসেজ করে ইভানা এই জায়গায় আসতে বলেছে আধ ঘন্টা আগেই। সে নাকি মোবাইল চেক ই করে নি।ইভানা ফোন করায় এখন এদিকে আসছে শৌখিন।

ইভানা মোবাইল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার খুব অস্থির লাগছে।মাগরিবের আযান পড়ে যাবে কিছুক্ষন পর। কখন আসবে মহাশয়? আর তো অপেক্ষা করা যাচ্ছে না।

ইভানা দাঁড়িয়ে ছিল। হুট করে তার সামনে একটা মোটর সাইকেল এসে থামল। ইভানা প্রথমে কিছু বুঝতে পারে নি। কিন্তু পরক্ষনে মোটর সাইকেল থেকে একটা কালো মাস্ক পড়া লোক নেমে তার হাত ধরে দিল টান আর ব্যাগসহ মোবাইল লোকটার হাতে চলে গেল।

ইভানা প্রথমে ভাবে ছিনতাইকারী বোধহয়! কিন্তু না এবার লোকটা তাকে টানতে লাগে। কি আজব কান্ড! লোকটা তার হাত খুব শক্ত করে ধরে সামনে এগুতে থাকে। আতকে উঠে ইভানা। ভয়ে গা কাপুনি দিয়ে উঠছে।

ইভানা ধস্তাধস্তি করতে শুরু করল।আশেপাশে মানুষ আছে কিন্তু সবাই চুপ। কেউ এগিয়ে আসছে না। ইভানা চারপাশে তাকিয়ে একবার সবাইকে দেখে নিয়ে আর কেদে দিল।

লোকটা তাকে টেনে যেই না মোটর সাইকেলে বসাবে ওমনি কেউ বাধা দেয়৷

ইভানা চোখ তুলে তাকায় সেদিকে। শৌখিন দাড়িয়ে আছে৷ হাতে টেস্ট্রি ট্রিটের ব্যাগ নিয়ে। তার ভ্রু কুচকে আছে। বোঝাই যাচ্ছে সেও ভয় পেয়ে গেছে। আতংকে আছে৷

শৌখিন লোকটাকে ইভানার হাত ছাড়তে বাধ্য করে। লোকটা স্বজোড়ে শৌখিনের পেটে ঘুষি মারে। শৌখিন কুকিয়ে উঠে। এর আগে শৌখিন কোন দিন কারো সাথে মারামারি করে নি। মারামারি হতে একশ হাত দূরে থাকা ছেলে সে৷

কিন্তু আজকে তার কি যেন হলো। মারামারি কোন দিন না করা ছেলেটাও ছিনতাইকারী লোকটার সাথে মারামারি শুরু করে দিল। লোকটাকে এমন মাইর মারল শৌখিন যে বেচারা ইভানার ব্যাগ রেখে কোন মতো মোটর সাইকেল নিয়ে দৌড়ে পালালো৷ শৌখিনের এক কিলেই ছিনতাইকারী লোকটার নাক ফেটে গেছে। সম্ভবত পাশে সুন্দরী মেয়ে থাকায় হুট করে ওতোটা জোশ চলে এসেছে শৌখিনের মধ্যে!

এসব দেখে ইভানার চোখ অক্ষি গোলক থেকে বের হওয়ার উপক্রম। এমন কাহিনি সে টিভিতে দেখেছে। নায়ক এসে নায়িকাকে এভাবে বিপদ থেকে উদ্ধার করে। ও মাই গড! ইভানা কি তবে নায়িকা হয়ে গেল নাকি?

শৌখিন পেছনে ঘুরে দাড়াতেই ইভানা তাকে ঝাপ্টে ধরে তাও খুব শক্তপোক্ত ভাবে৷

এতে ভড়কে যায় শৌখিন। এর আগে সে কোন দিন কোন মেয়ের সাথে কথা পর্যন্ত ঠিকঠাক ভাবে বলে নি আর আজকে একটা মেয়ে তাকে রাস্তা জড়িয়ে ধরেছে তাও আবার ডাক্তার মেয়ে!

কি লজ্জা! কি লজ্জা! এই লজ্জা থেকে মুখ কই লুকাবে সে?

★★★

মেঘ আজিজুল সাহেবের অফিসে এসেছে। সোজা তার কেবিনে চলে যায় মেঘ। আজিজুল সাহেব তার কক্ষেই ছিলেন। মেঘকে দেখে তার ভ্রু কুচকে গেল।

মেঘ সাবলীল ভাবে উনাকে সালাম দিয়ে বলে, ভালো আছেন?

উনি মাথা নাড়িয়ে বলে হ্যা৷

মেঘ বলল, বাসার সবাই ভালো আছে?

–হ্যা। এসব বাদ দাও। কেন এসেছো তুমি?

মেঘ মাথা নিচু করে বলে, আরেকটাবার ভাবুন আংকেল। এটা অথৈয়ের সারাজীবনের সিদ্ধান্ত। আমি ওকে খুব ভালোবাসি। প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করুন।

–সাট আপ এন্ড গেট আউট ফ্রম মাই রুম। (রেগে)

–দেখেন ফয়সাল ছেলেটা ভালো না। আপনি একটু চোখ-কান খুলে রাখলেই সবটা বুঝতে পারবেন৷ অথৈও আমাকেই ভালোবাসে৷

–এতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে এই কথা বলাটা তোমার উচিত হলো না।আমার মেয়ের সাথে তোমার কোন যোগসূত্র নেই। নাও গো ফ্রম হেয়ার।

–ফয়সালের চরিত্র ভালো না। ওর অথৈকে সুখে রাখার কোন যোগ্যতাই নাই।

আজিজুল সাহেব তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, তাহলে কি তোমার আছে?

মেঘ মাথা নিচু করে বলে, হ্যা।

–হাসালে আমাকে। অথৈয়ের বিয়ে ফয়সালের সাথেই হবে৷

–ফয়সাল ভাল ছেলে না। আমার কাছে প্রমাণ আছে।

–Thanks for your concern!

★★★

–রিকশা ঠিক করে দিলে একা যেতে পারবে বাসায় রোদেলা?

রোদেলা মাথা নাড়িয়ে বলে। হুম পারব।

এই জবাবে সন্তষ্ট হলো না আবেগ। সে রিকশা ঠিক করল। এবং রোদেলাকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও চড়ে বসল। রোদেলা বিষ্মিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার না কাজ আছে?

আবেগ রোদেলার কোমড় চেপে ধরে বসে বলে, সমস্যা নাই।

রিকশা চলতে আরম্ভ করল। হুট করে ঝুপঝাপ শব্দ করে বৃষ্টি পড়তে লাগে। কোন আগাম বার্তা ছাড়াই বৃষ্টির আগমন এই পহেলা ডিসেম্বরে!

ঝুমঝুম বৃষ্টির ছন্দ পতনের মাঝে আবেগ যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এখানে কিঞ্চিৎ ভুল বলা হলো! বৃষ্টি বলতে প্রকৃতির বৃষ্টির রুপে হারায় নি আবেগ। বরং তার বৃষ্টিবিলাসীর মধ্যে হারিয়ে মরছে ক্ষনে ক্ষনে!

কি মনোমুগ্ধকর চাউনি তার! মুখে ফোটা ফোটা বৃষ্টির জল! ইশ! এতো রূপবতী কেন রোদেলা?

আচ্ছা আবেগ কি রোদেলার প্রেমে পড়ে গেছে? সম্ভবত হ্যা!!!

এই রোদেলা নামক মেয়েটা এমন ই! এই মেয়ের প্রেমে পড়তে বাধ্য আবেগ। প্রতি জনমে একবার করে রোদেলার প্রেমে পড়া আবেগের জন্য বরাদ্দ হয়ে থাকল। এই জনমেরটা ঘটে গেল মাত্র!
#অশ্রুমালা
Part–32
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

রিশাদ সারা ঘরময় পায়চারী করছে। সে বেশ রেগে আছে। কপাল কুচকানোর ভাজ স্পষ্ট হয়ে আছে। রিশাদ যখন প্রচন্ড রেগে থাকে তখন সে হাটাহাটি করে রাগ কমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আজকে কিছুতেই রাগ কমছে না। বরং পার মিনিটে রাগ বেড়েই চলেছে চক্রবৃদ্ধি হারে! এই জন্য অবশ্য আরো একটা মূখ্য কারন আছে।

আজকে বিকেলের দিকে আবেগের বাসার ওইদিকে গিয়েছিল রিশাদ। তখনি আবেগ আর রোদেলাকে রিকশায় করে ভিজতে ভিজতে বাসায় ফিরতে দেখেছে রিশাদ। তাদেরকে এক সঙ্গে দেখে রিশাদের চোখ দিয়ে আগুন ঝড়তে থাকে। দুজনের মাঝে কোন দূরত্ব ছিল না। গা ঘেষে বসে ছিল পাশাপাশি তারা! যা দেখে মাথা নষ্ট হয়ে যায় রিশাদের। সে তখনি সেই মূহুর্তে ঠিক করে বসে আবেগের সব সুখ সে নিজ হাতে মাটিতে পুতে ফেলবে।

তার ভাড়া করা লোক দিয়ে ইভানাকে ধরে আনতে চেয়েছিল কিন্তু হুট করে কোথা থেকে যেন একটা ছেলে চলে আসল ইভানাকে বাচাতে৷ রিশাদ বুঝে পায় না, রহমান বাড়ির দুই মেয়েকে তার হাতের থাবা থেকে রক্ষা করার জন্য কি সবসময় কেউ না কেউ প্রস্তুত থাকে? রোদেলা কে রক্ষা করল আবেগ। এদিকে ইভানাকে সাহায্য করল আরেকটা ছেলে!

রোদেলা আর আবেগের হাসিমাখা মুখ দেখে মোটেও সহ্য হচ্ছে না রিশাদের। রোদেলা তার স্ত্রী। সে কেন আবেগের সাথে থাকবে? কেন এক বিছানায় ঘুমাবে তারা? রিশাদ রোদেলার এই বিয়ে মানে না। কিছুতেই মানে না৷ আর এই ডিভোর্স টাও সে মানতে নারাজ৷ কেন মানবে সে? তাকে জোড় করে সিগনেচার করানো হয়েছে ডিভোর্স পেপারে। তাই সে এই ডিভোর্স মানে না। রোদেলাকেও আবেগের স্ত্রী হিসেবে সে মানবে না কোন দিন। আবেগ ব্লাকমেইল করে রিশাদের স্বাক্ষর নিয়েছে ডিভোর্স পেপারে ।একটা মেয়ের সাথে খোলামেলা ভাবে মেলামেশার ভিডিও দেখিয়ে সিগনেচার করিয়ে নিয়েছে তার কাছ থেকে। আবেগের দাবি ছিল, ডিভোর্স পেপারে সাইন না দিলে সে ভিডিও ভাউরাল করে দিবে। রিশাদের তখন এমপি সাহেবের মেয়ের সাথে সম্পর্ক চলছিল তাই তো ভিডিও ভাইরাল হলে সোনার হরিণ হাত ছাড়া হবে এই ভয়ে সে সিগনেচার করে ফেলে। কিন্তু আফসোস! মেয়েটার সাথে তার সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে । এমপি সাহেবের মেয়ে কিভাবে যেন জানতে পেরেছে রিশাদের চরিত্র ভালো না। তাই সঙ্গে সঙ্গে সব সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে সে নিউইয়র্ক চলে গেছে।

রিশাস কালকেই জানতে পেরেছে এমপি সাহেবের মেয়ের কাছে সব সত্য কথা ফাস করেছে আবেগ আর আবেগের বন্ধু মেঘ।

আবেগ যদি এমপি সাহেবের মেয়েকে সব না জানাত তবে রিশাদের নজর ও আরেকদফা রোদেলার উপর গিয়ে ঠেকত না।

রিশাদ বিড়বিড় করে বলে, সব দোষ আবেগের! ওই বালের ডাক্তারের জন্য আজকে আমার এমপি হওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে গেল! এখন তার কিছু একটা করতে হবে। আবেগকে শাস্তি দিতে হবে। কঠিন শাস্তি! তার সাথে মাঠে খেলতে এসেছে আবেগ! আচ্ছা আবেগ কি ভুলে গেছে? আবেগ যদি খেলোয়াড় হয় তাহলে রিশাদ রেফারি!

রিশাদের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল। এতোদিন মুখ বুজে নিজের বউকে অন্য এক পুরুষের সাথে থাকতে দিয়েছে কিন্তু আর না! ইনাফ ইস ইনাফ! কালকে থেকে তার বউ তার সাথে থাকবে। থাকতে না চাইলে জোর করে বেধে-ধরে, পিটিয়ে রাখবে। দরকার হলে জিন্দা লাশ বানিয়ে নিজের কাছে রাখবে রোদেলাকে তাও তার রোদেলাকেই চাই।

★★★

রিকশা এসে থামল বাসার সামনে। রোদেলা নিচে নেমে গেল। আবেগ ভাড়া দিয়ে রিকশা থেকে নেমে পড়ে৷ সে মনে মনে খুব শান্তিতে আছে। সত্যি বৃষ্টি ফোটা গুলো তার মাথার জট খুলে দিয়েছে। এতো দিন যেই বিষয়টা নিয়ে সে বিড়ম্বনায় ছিল তা দূর হয়ে গেছে।

আবেগ পা বাড়ালো সামনের দিকে। রোদেলা তার অপেক্ষা করছে সিড়ির সামনে৷ রোদেলার চুল গুলো ভিজে গেছে বৃষ্টির পানিতে। ফলে চুল গুলো নেতিয়ে গেছে। এবং দলা পাকিয়ে কাধের নিচে পড়ে কোমড় পর্যন্ত বয়ে গেছে।

আবেগ অপলক বিমুগ্ধ নয়নে তাকালো রোদেলার দিকে। তারপর চোখ নামিয়ে নিয়ে সিড়ি বেয়ে উঠে গেল।।

আবেগদের বাসা তিনতলায়। সিড়ি দিয়েই ওঠা-নামা করে আবেগ। সে লিফট উঠতে পারে না। লিফটের দরজা যখন বন্ধ হয় ওই সময় আবেগের ভয় খুব ভয় লাগে। মনে আতংক খেলা করে। বারবার মনে হয় লিফট ছিড়ে পড়বে। সেজন্য যতোটা সম্ভব লিফট এভোয়েড করে সে।

বাসায় গিয়ে আগে আবেগ ফ্রেস হয়ে নিল। এরপর রোদেলা গোসল করে নেয়।

রোদেলা গোসল করে বের হয়ে দেখে আবেগ সমুদ্রকে দোলনায় দোল খাওয়াচ্ছে আর ওর সাথে খেলা করছে। হাতে ফিডার নিয়ে কিছুক্ষন পর পর সমুদ্রের মুখে তুলে ধরছে৷

রোদেলা মুচকি হেসে আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ালো। আজকে সেও মনে মনে খুব খুশি। এই প্রথম আবেগের চোখে সে নিজের জন্য মুগ্ধতা দেখেছে। রোদেলা আয়নার দিকে তাকালো। তার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। সত্যি! তার চেহারায় পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো চোখে কালি নেই। মুখে ব্যথা বা ফুলে যাওয়ার কোন দাগ ও নেই৷ মুখটা চকচক করছে। আগের চেয়ে কিছুটা স্বাস্থ্য হয়েছে তার। রোগা রোগা ভাবটা দূর হয়েছে। চোখে দুঃখের কোন ছাপ নেই। চুল গুলোও সুন্দর হয়েছে। আগে চুল গুলো উষ্কখুষ্ক থাকত। যত্ন নিত না ঠিক মতো৷ এখনো ঠিক মতো যত্ন নেয় না তাও কেন যেন চুল গুলো বেশ ঝলমলে হয়ে গেছে!

রোদেলা চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে মুছতে লাগে৷

পেছন থেকে আবেগ আয়নায় রোদেল দেখে বলে উঠে, হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাও। চুল ভেজা রাখলে ঠান্ডা লাগবে।

–লাগবে না। আমি হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাই না৷ এতে চুল নষ্ট হয়ে যায়।

–একদিন হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকালে কিছু হবে না।

–না। লাগবে না।

বলে রোদেলা চোখে কাজল দিতে লাগলো। তারপর বারান্দায় গেল টাওয়াল মেলে দিতে।

আবেগ বেশ খানিকটা বিরক্ত হয়ে গেল। কেউ তার কথার পিঠে কথা বললে তার ভালো লাগে না। আবার কাউকে যদি সে কিছু করতে বলে সেটা না করে অন্য কিছু করে তবে আবেগ মনে মনে ক্ষেপে যায়৷ সেই কেউটা যদি রোদেলা হয় তাহলে ক্ষেপে যাওয়ার মাত্রাটা আরো একটু বৃদ্ধি পায়। আপাতত সে মনে মনে ফুসছে।

বারান্দা থেকে বের হতেই বারান্দার দরজার সামনে আবেগকে ভুতের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোদেলা সামান্য চমকায়৷

তা দেখে আবেগ বলে, ভয় পেলে নাকি?

রোদেলা তড়িঘড়ি করে বলে, ভয় কেন পাব?

–তা তো দেখতেই পাচ্ছি।

রোদেলা আবেগকে পাশ কাটিয়ে যেতে ধরলে আবেগ তাকে আটকে দেয় এবং রোদেলার হাত ধরে ফেলে এবং সোজা আয়নার সামনে গিয়ে বসিয়ে দেয়। এবং হেয়ার ড্রায়ার অন করে আবেগ নিজেই রোদেলার চুল গুলো শুকাতে লাগে।

রোদেলা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আবেগের প্রতিবিম্বের দিকে। সাধারণ চেহারার অতি অসাধারণ মানুষটার মধ্যে কি আছে? যা অতি অসাধারণ মানুষের মধ্যে ও নেই?

হুমায়ুন আহমেদ স্যার ঠিক বলেছেন, সাধারণ হওয়া নাকি অনেক কঠিন? আচ্ছা আবেগ কি সাধারণ? তার তো মনে হয় না! বরং তার মনে হয় আবেগ হওয়া চারটি খানি কথা না! আবেগের মতো এতো সরল মনের মানুষ জগতে খুব কমই আছে।

আবেগ মনোযোগ দিয়ে রোদেলার চুল শুকাচ্ছে। তার এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে রোদেলার চুল শুকানোর মতো কঠিন কাজ আর একটাও নেই। এর চেয়ে অপারেশন করাও বেশি সহজ মেবি! কি এক মসিবতে পড়ে গেল। চুল ধরলেই তড়তড় করে হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে এতোই সিল্কি যে হাতে ধরে রাখা যাচ্ছে না। তার উপর বাতাস করলে অন্য দিকে উড়ে যায়। ফলস্বরূপ আবেগ তার হাতকেই গরম হাওয়া পরিবেশন করছে। রোদেলা পুরোটা সময় ধরে আবেগকে দেখতে লাগে।

হুট করে রোদেলার চোখ ভিজে উঠে। আচ্ছা এতো সুখ যদি তার সহ্য না হয়? যদি সুখ গুচ্ছ গুলো কার্পূড়ের মতো তার জীবন থেকে উবে যায়? রোদেলার চেহারায় মূহুর্তের মধ্যে একটা আর্তনাদের ছাপ পড়ে গেল।

★★★

ইভানাকে শৌখিন নিজ দায়িত্বে তার বাসায় পৌছে দিয়ে গেল। ইভানা ভীষণ ভয়ে পেয়ে গেছে। তার হাত-পা এমনকি হৃদপিন্ড এখনো জোড়ে জোড়ে কাপছে। শৌখিন বাসার নিচে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে। সিড়ি বেয়ে উঠতেই ইভানা হাপিয়ে গেল। বড় বড় করে শ্বাস ফেলে সে বেল বাজায়।

গেট খুলে রোদেলা। ইভানাকে দেখে তার ভ্রু কুচকে যায়। এখন বাজে সাড়ে সাতটা। অথচ আবেগের কাছ থেকে ইভানা পাচটার দিকে দেখা করেছে। এই এতোটা সময় কই ছিল ইভানা? রোদেলা কে ইভানা শৌখিনের ব্যাপারে জানিয়েছে। কেবল রোদেলাই শৌখিনের ব্যাপারটা জানে।

রোদেলা প্রশ্ন করে, শৌখিন এসেছিল?

ইভানা মাথা নাড়ায়।

–ওর সাথে ছিলে?

–হুম।

রোদেলা বলল, এতোক্ষণ একসাথে থাকা কি ঠিক হয়েছে?

ইভানা মাথা নিচু করে ফেলে। সে কি ভাবীকে বলবে কি বিপদে পড়তে বসেছিল সে?

রোদেলা মৃদ্যু হেসে বলে, আচ্ছা ঠিক আছে। নেক্সট টাইম থেকে এতো রাত করে বাইরে থাকবে না। তুমি তো জানোই মামী এসব পছন্দ করে না এবার যাও ফ্রেস হয়ে আসো।

ইভানা হুম বলে তার রুমে পা বাড়ালো।ইচ্ছা করে ই কিছু জানালো না রোদেলা কে সে।

রাতে খেতে বসেছে সবাই। আবেগ একটু লেটে আসল। ততোক্ষনে সবাই খেতে বসে গেছে।

আজকে রাতের রান্নাও রোদেলা করেছে। ভাত আর পাতাকপি দিয়ে মুরগীর মাংস। রোদেলা একটু তেল-মশলা বেশি করে দিয়ে রান্না করে। এতে রান্না সুস্বাদু হয়। আজকেও স্বভাব মতো তেল বেশি দিয়ে ফেলেছে৷ মাংসের কড়াইয়ে এক সেন্টিমিটার জুড়ে তেল ভেসে আছে৷

জাবেদা খাতুন প্লেটে তরকারি তুলে নিতে নিতে মুখ কঠিন করে বলে, মাংসে এতো তেল দাও কেন? বলি টাকা কি তোমার বাবা দেয়? তেলের দাম জানো? বাজারে সবচেয়ে দাম বেশি হলো তেলের! কিন্তু এই মেয়ে এমন ভাবে তরকারিতে তেল দেয় যেন আমাদের সয়াবিন তেলের খনি আছে! তুমি লাট সাহেব হতে পারো । কিন্তু, আমাদের এতো টাকা-পয়সা নাই তোমার বাবার মতো। তোমার বাবার বহু আছে তাই বেশি করে তেল দিয়ে রান্না কর ৷ আমরা তোমাদের মতো এতো ধনী না বাপু!

রোদেলার মনটাই বিষিয়ে গেল। মামী ইচ্ছা করেই তার বাবার কথা তুলেছে। সে খুব ভালো করেই জানে তার বাবার অবস্থা ভালো না। অভাবের সংসার তাদের৷ সেই তুলনায় আবেগরা হাজার গুন ভালো আছে। তারপর ও কিভাবে ঠেস মেরে কথা বললেন মামী।

জাবেদা খাতুন খেতে খেতে বলে, তোমার বাবা যদি এতোই ধনী হয় তাহলে মেয়েকে বাড়ি থেকে পাঠানোর আগে খই-মুড়ি দেয় কেন?

রোদেলা লজ্জায় চুপসে গেল। আজকে টেবিলে ইভানা নেই।

মামা আর আবেগ আছে কেবল। আবেগ মাত্র এসে বসেছে কিন্তু মায়ের সব কথাই সে শুনে নিয়েছে।

ইমতিয়াজ রহমান আজকে নিশ্চুপ। সে চাইলেই রোদেলার হয়ে জাবেদা খাতুন কে অনেক কিছু বলতে পারেন। কিন্তু সে চায় আবেগ যেন নিজ থেকে কিছু একটা বলুক তার মাকে। কেননা সে একশ টা কথা বললেও জাবেদা খাতুনের কিছুই যায় আসবে না কিন্তু আবেগের একটা কথাই জাবেদা খাতুনকে চুপ করতে বাধ্য। ইমতিয়াজ রহমান প্রতিদিন ইচ্ছা করেই রোদেলাকে নিজের পাশে বসিয়ে খাওয়ান যেন রোদেলা ঠিক মতো খায়। নিজের মেয়ের মতো আদর করেন তিনি রোদেলাকে। আজকেও রোদেলা তার পাশে বসে আছে কিন্তু মুখে কিছুই তুলছে না।

আবেগ সাবলীল ভাবে প্লেটে মাংস নিয়ে খাওয়া শুরু করল। সবাই চুপ। কারো মুখে কোন কথা নাই।

দুই লোকমা খাওয়ার পর আবেগ বলে উঠে, ফার্মের মুরগী তে তেল-মশলা বেশি না দিলে কেমন গন্ধ করে। আমি খাইতে পারি না। নেক্সট বার থেকে আরো একটু বেশি করে তেল দিবা। আর আমাদের যথেষ্ট আছে আম্মা। আব্বার একটা প্রোডাক্ট সেলের টাকায় পাচ মাসের তেল কেনা যাবে। সো শুধু শুধু কথা শুনানোর আমি কোন কারন দেখি না। ইললজিক্যাল কথা-বার্তা আমার পছন্দ না।

আবেগের কথা শুনে রোদেলা তার দিকে চোখ তুলে তাকায়। সেই চাউনিতে একরাশ ভালোবাসা!

খাওয়া শেষ করে আবেগ উঠে যায়৷ ইমতিয়াজ রহমান খুব খুশি আবেগকে রোদেলার হয়ে কথা বলতে দেখে। তাই তিনি দুইবার ভাত নিলেন। খেতে খেতে বললেন, আহা! এতো মজার মুরগির মাংস আমি জীবনে খাই নি। শেষ বয়সে যে এতো মজার মজার খাবার খেতে পারছি এটা তো আমার ভাগ্য।

জাবেদা খাতুন মুখ কালো করে উঠে পড়েন। রোদেলা সামান্য খেয়ে নেয় এবং সমস্ত কাজ করে রুমে আসে। ততোক্ষণে আবেগ শুয়ে পড়েছে। রোদেলা আবেগের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে।

পরের দিন সকাল-সকাল রোদেলা উঠার আগেই আবেগ বেরিয়ে যায়।

রোদেলা নয়টায় ঘুম থেকে উঠে যাবতীয় সব কাজ শেষ করে ফেলে। দুপুরের রান্না বসিয়ে দেয় সে।

ইভানা তখন এসে বলে, সে বাইরে যাবে।

জাবেদা খাতুন যাওয়ার অনুমতি দেয়।

রান্না শেষ করে সমুদ্র কে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে গোসল করে বের হয় রোদেলা। কি মনে করে ফোনটা হাতে নিল সে।

তখনই জাবেদা খাতুন রুমে আসলেন আর ঠিক সেই মূহুর্তে রোদেলার ফোন বেজে উঠল।

স্ক্রিনে রিশাদের নাম দেখে জাবেদা খাতুন তেলে বেগুন চেতে রোদেলাকে অনেক কথা শুনিয়ে পাশের বাসার ভাবীর কাছে যান।

কিন্তু রোদেলা অস্থিরে মরে যাচ্ছে। রিশাদ কেন কল করেছে?

তখনি আবারো কল আসে। রোদেলা ফোন ধরে।

ওপাশ থেকে ধমকে রিশাদ রোদেলাকে বলে,এতোক্ষন লাগে ফোন ধরতে?

রোদেলা কড়া গলায় বলে, কেন কল করেছো?

–নিচে নামো।

–কেন?

–তোমার সাথে কথা আছে৷

–তোমার কথা থাকতে পারে বাট আমার কোন কথা বলার নেই।

–রোদেলা তুমি যদি নিচে না নামো তাইলে তোমার পেয়ারি ননদকে আমার লোকরা তুলে নিয়ে যাবে৷

রিশাদের কথা শুনে রোদেলা চিৎকার দেয়। ওপাশ থেকে রিশাদ হোহো করে হেসে বলে, ডোন্ট লেট। সময় মাত্র এক মিনিট।

রোদেলা ভয় পেয়ে যায়। সে আবেগকে কল করতে করতে নিচে নামে কিন্তু আবেগ ফোন ধরছে না।

সে নিচে নেমে কোথাও রিশাদকে দেখতে পেল না। পেছনে ঘুরে বাড়ি ফিরবে ওমনি কেউ তার মুখ চেপে ধরে।

রোদেলা চিৎকার করতে গিয়েও পারল না।

চলবে।

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here