গল্পঃ #অসময়ে_রোদন (৫ম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
আঙুলে আঙুল রেখে কোনো এক সময়ের প্রিয় মানুষটার সামনে আরেকটা মানুষের চোখে চোখ। কি করুণ এই দৃশ্য!
আমার ভেতরে তুমুল হাহাকার বিঁধলেও অরুণ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
তার কিছুই আসে যায়না, বুঝা যাচ্ছে এটা নিয়েও সে হাসি তামাশা করতে পারে। তাই আমি ফয়সাল ভাইকে নিয়ে আর কোনো আজেবাজে কথা বলার আগেই বললাম,
___ এখন বলুন স্নেহা কোথায়? আমার মেয়ে কার কাছে আছে?
অরুণ চোখ বেঁকে বললো,
___ না বললে? আর এতো বছর পরে হঠাৎ মেয়েকে পেতে এতো তাড়া কেন? মেয়ে তো এখন আরেকজনের মেয়ে।
ওর কথা শুনে আমার অতিমাত্রায় রাগ জন্মাচ্ছিলো। রাগে ফেটে পড়ছিলো আমার ভেতরটা। কিন্তু মেয়েকে পেতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিলাম। এসব অবান্তর কথা আর নিতে পারছিলাম না, প্রচন্ড রাগটা স্বল্পতায় এনে হালকা ধাঁচের সাথেই বললাম,
___ তাহলে আমি আইনের সহায়তা নিবো। স্নেহার জন্মদাত্রী মা’র চেয়ে ওই মহিলার বেশি অধিকার নেই। মেয়ে আপনার কাছে থাকলে একটা যুক্তি ছিল, কিন্তু আপনি তো বিক্রি করে দিয়েছেন। মা-বাবা আলাদা হোক, কিন্তু এই দুইজনের একজনের কাছেই সন্তান থাকার অধিকার রাখে, তবে অন্য কারো কাছে নয়।
অরুণের বউ মুখটা কয়েকরকম করে চোখ ভ্রু কোঁচকালো। অরুণকে একহাতে টেনে পাশে সরিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ সামনে এনে বললো,
___অহহো, আমি পুলিশকে বড্ড ভয় পাই। প্লিজ ভয় দেখিওনা! অরুণ দেখো দেখো ওর কথা কথা শুনেই আমি ভয়ে নীল হয়ে গেছি।
বলেই হাহাহা করে হেসে উঠলো। অরুণও তার সাথে যুগ দিয়ে অট্টহাসি হাসছে।
এতক্ষণ ধরে আমরা দরজার সামনে দাঁড়িয়েই ওদের তামাশাপূর্ণ কথা শুনছি, তারা আমাদের ভেতরে যেতেও বলেনি, আর আমরা যাইও নি। কিন্তু ওদের হাসির মধ্যেই আমি আলাদা আওয়াজ শুনলাম, কান্নার আওয়াজ! কোনো বাচ্চা ভেতরে কাঁদছে মনে হচ্ছে। আমার জানামতে ওদের এখনো সন্তান হয়নি, আর স্নেহাও এখানে নেই। তাহলে কে কাঁদছে?
আমি ধীর পায়ে ভেতরে অগ্রসর হতে চাইলাম, কিন্তু সেটা খেয়াল করে অরুণের বউ বললো,
___ আরে দাঁড়ান, বাচ্চা ফিরে পাওয়ার উপায় বলি।
আমরা স্নেহাকে ২৫ লক্ষ টাকায় এক কোটিপতি দম্পতির নিকট বিক্রি করেছি, আপনারা এর চেয়ে দ্বিগুণ দিলে, যে করেই হোক ফিরিয়ে এনে আপনাদের দিয়ে দিবো।
আমি রাগান্বিত গলায় বললাম,
___আমাদেরকে দেখে পাগল মনে হয়? কোটিপতির বউ বোরকা পরে বাসে যাতায়াত করে? সেটাও লোকাল বাসে! বাচ্চা বিক্রির বিজনেস দিয়েছেন আপনারা? তাই মিথ্যে বলে মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতান?
আমার কথার মধ্যে অরুণের ভয় আঙুল নাড়িয়ে জোরে বললো,
___ এই আস্তে! আমাদের বিজনেসের জন্য কৈফিয়ত দিতে হবে? তাও তোমাদের মতো এমন ছোটলোকদের কাছে?
হ্যাঁ শুনো, আমাদের মতো বিজনেসম্যানরা অনেক ক্ষেত্রেই বোরকা পরে শুধু বাসে নয় ভ্যানেও চড়ে। এখন এসব প্যানপ্যান বন্ধ করো, বাচ্চা না চাইলে ভাগো এখান থেকে। এমনিতেও বাচ্চা পাওয়ার সময় এবং সম্ভাবনা দুটোই কম। কারণ স্নেহাকে নিয়ে সিনথিয়া এইমাসের শেষ দিকে অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে।
এই কথা শোনার সাথে আমার বুকের মধ্যে আচমকা একটা ধাক্কা লাগলো। এইমাসের মধ্যে চলে যাবে? আমি তাহলে আইনের দারস্থ হতেও তেমন সময় পাবোনা, আবার টাকা জোগাড় তো পুরোপুরি অসম্ভব। ওদের কথা শুনে যা মনে হয়েছে আইনের ভয়টয় ওদের নেই, নইলে এমন ঠাট্টা করলো কেন?
আমি ফয়সাল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
___কি হবে এখন?
ফয়সাল ভাই ঘাড় নেড়ে বললো,
___চিন্তা করিস না। আমি দেখবো সবকিছু। এখন চল বাসায় যাই।
বলেই ফয়সাল ভাই ফিরলো, আমি ফিরতে গিয়েও আবার ওদের দিকে তাকালাম। অরুণের দিকে তাকিয়ে বললাম,
___ কে এই সিনথিয়া? আমি কি তাকে চিনি?
অরুণ দরজা বন্ধ করতে করতে বললো,
___সময় হলে দেখে নিও।
বলেই দরজা বন্ধ করে দিলো। আমি বন্ধ দরজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। ফয়সাল ভাই দুই সিঁড়ি ইতোমধ্যে নেমে গেছে, আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি আবার উঠে এসে বললেন,
___আরে চল না।
আমি উনার দিকে তাকিয়ে পা বাড়ালাম। প্রচন্ডরকম অস্বস্তি লাগছে। মাথাটা সেদিনের মতো আজও যন্ত্রণা করছে। ফয়সাল ভাই আমার দ্বার ঘেঁষে হাতটা ধরে বললো,
___খারাপ লাগছে?
আমি হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,
___ না আমি ঠিক আছি।
তারপর হাত ছাড়ানোদ চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। না পেরে আর চেষ্টা করলাম না। চুপ করে হেঁটে চললাম। নিচে নেমে একটা রিকশা ডাকলো। আমাকে বসায়ে উনি বসলেন।
রিকশা চলছে, আমি আস্তে আস্তে বললাম..
___ভাই এতো টাকা আমাদের বাড়ি বিক্রি করলেও হবে না। কি করে আমার সন্তানকে পাবো?
ফয়সাল ভাই আমার দিকে ঘাড় ঘুরে তাকিয়ে বললো,
___ বললিনা তখন?
আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
___কি বলিনি?
উনি মাথাটা নিচু করে বললেন,
___আমায় বিয়ে করবি কিনা?
আমি উনার কথার জবাবে সাথে সাথেই বললাম,
___ তুমি পাগল? আমার মতো একটা মেয়েকে কেন বিয়ে করবে? আমি আমার সন্তানকে আমার বুকে ফিরে পেলে বাকি জীবনটা দিব্যি কাটিয়ে দিবো। দেখো ভাই, তোমার এখনকার আজগুবি কথা শুনলে ফুফা ফুফিরাও আপত্তি করবে।
ফয়সাল ভাই আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
___ আরে ওটা আমার মা হলেও তোর ফুফি। ফুফিরা মায়ের চেয়ে কম হয়না। তোর মা নেই তুই ভাবিস, আর উনি তোকে মেয়ে ভাবে। তোর ডিভোর্সের পরে আমাকে কতো চেয়েছে আবার বলতে, কিন্তু বলতে পারেনি। ভেবেছে আমি মানবোনা, হ্যাঁ তোর উপর আমার অনেক অভিমান ছিল। কিন্তু এখন আর নেই, মানুষ সত্যি ভুল করে। তাই বলে অনুশোচনার পরেও সেই মানুষটা আর ভুল নয়।
আর তুই যদি আমার বাবা কিছু বলবে ভেবে থাকিস, তাহলে বলি, আমার বাবাও কিছু বলবেনা বরং নিজেই তোর বাবার সাথে আবার কথা বলতে যাবে।
আমি কিছুটা বিব্রতকর গলায় বললাম,
___প্লিজ থামো না। আমার মেয়েকে নিয়ে আমার চিন্তার অন্ত নেই, সেখানে এসব আমি ভাবতে পারবোনা। এতো টাকা আমি কোথায় পাবো? আর টাকা ছাড়াই বা কি করে স্নেহাকে ফিরে পাবো?
ফয়সাল ভাই আবারও সেই প্রসঙ্গ থেকেই বললো,
___টাকা আমি দিবো। তুই আমাকে বিয়ে করলে তোর কাবিনের টাকা হিসেবে সেই অঙ্কের টাকা আমি ম্যনেজ করে নেবো। আর বিয়ে না করলেও দিবো, তোর সন্তানের জন্য।
___এতো টাকা কোথায় পাবে তুমি?
ফয়সাল ভাই হেসে বললো,
___ নগদে হাতে না থাকুক, আমার ভাগের জায়গা জমি তো আছে। বাজারের সাথে লাগানো রাস্তার পাশের জমিটা আছে ওটার আংশিক বিক্রি করে দিলেই হয়ে যাবে।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
___বিয়ে নিয়ে তোমার পরিবারের কারোর আপত্তি না থাকলেও টাকা নিয়ে ঠিকি থাকবে।
ফয়সাল ভাই রেগে বললো,
___ কতো পেঁচাতে পারিস তুই? শুধু আমার ক্ষেত্রেই তুই আগাগোড়া এতো ভেবে কথা বলিস। আমি বলেছি তো সব ম্যনেজ করবো!
আমি চুপ হয়ে গেলাম। পুরো রাস্তায় আর কথা হলোনা। তারপর আমাকে বাসে তুলে দিয়ে ফয়সাল ভাই নিজের বাড়ির দিকে চললো। আর আমি চললাম আমার গন্তব্যে!
বাড়ি ফিরেই দেখি বাবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমারই অপেক্ষা করছে। আমাকে দেখেই এগিয়ে আসলো। বাইরে থেকেই জিজ্ঞাসা করতে লাগলো,
___কিরে মা স্নেহাকে আনতে পারিস নি? কোথায় আছে স্নেহা?
আমি বাবা হাত ধরে সবকিছু বলতে বলতে কেঁদে ফেললাম। বাবা আমাকে ভেতরের দিকে অগ্রসর করতে করতে বললো,
___এবারও কি আগের মতোই ভুল করবি? ফয়সালের প্রস্তাব মেনে নে না! তোর এই অসুস্থ বাবা কয়দিন থাকবে বল? একা বাঁচা যায়না বুঝলি?
বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম এটা মেনে নিলে হয়তো বছর বছর ধরে হাসতে ভুলে যাওয়া এই মুখটায় আবার সতেজতার হাসি ফিরে আসবে! একটু নিশ্চিন্ত হবে।
আমি বাবার প্রশ্নবিদ্ধ শুকনো মুখটা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে যেতে যেতে বললাম,
___বাবা দেখো আজ ফুফা আসে কিনা!
বলেই চলে গেলাম। বাবা উত্তর পেয়েছেন বোধহয়। আর আমি জানি আমার কথা শুনে বাবা এই মূহুর্তে মুচকি হেসেছেন। আমার মেয়ের জন্য, বাবার জন্য এইটুকু তো আমাকে পারতেই হতো। সত্যি জীবন একা চলে না, জীবনের সাথে জীবন সম্পৃক্ত হতে হয়, নির্ভরতা থাকতে হয়।
‘
সন্ধ্যার পর পর ফুফা ফুফি, ফয়সাল ভাই, উনার ছোট বোন আর সাথে কাজীও আসছে। ফুফি খুব খুশি ছিলো। শাড়ী, আর কিছু গয়না দিলো তৈরি হতে। জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো নিজে নিজেই আবার নিজের বিয়ের সাজ সাজলাম। শুধু অনূভুতি, পরিবেশ, চিন্তা চেতনা ভিন্ন। ফয়সালের কথামতো বিরাট অঙ্কের টাকায় কাবিন হলো। যেই টাকা দিয়ে আমি আমার মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে পারবো। তবে নগদ নয়, কয়দিনের মধ্যে জায়গা বিক্রি করেই সেই টাকা দিবে। টাকার ব্যপারটা অগোচরে হবে ভেবেছিলাম, কিন্তু নাহ সবকিছু সবার জানাজানিতেই হয়েছে।
এবার আর ভুল কিছু হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না, আমার বাবার খুশি আছে যে এতে! এখন এমন একটা মানুষের সাথে বন্ধন হয়েছে যে আমাকে সম্পূর্ণ স্বার্থহীনভাবে ভালোবেসে দুটো জীবনের দায়িত্ব কাঁধে নিতে চায়! আজীবন আমার পাশে থাকতে চায়!
‘
‘
যেই জায়গাটা বিক্রির কথা হয়েছে সেই জায়গাটার প্রচুর ডিমান্ড। সেখানে পর্যাপ্ত মূল্য থেকে কিছুটা ছাড় দিয়ে ব্যানার টাঙিয়েছে বলে দুইদিনের মধ্যেই বিক্রি হয়ে গেলো।
আমরা দুজন এর পরেরদিন সকালেই গেলাম অরুণের বাসায়। টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার পরে বললো বিকেলের মধ্যেই বাচ্চাকে আমাদের হাতে তুলে দিবে। অরুণের বউ আমার নাম্বার রাখলো। বললো যে বাচ্চা এনেই আমাকে ফোন দিবে।
আমরা আর বাসায় ফিরলাম না, একসাথে স্নেহাকে নিয়েই ফিরবো বলে আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছিলাম। আমার ভেতরটা ভীষণ প্রফুল্ল ছিল, খুব উদগ্রীব হয়ে ছিলাম কবে আমার সন্তানকে আমার কোলে তুলে আদর করবো।
বারবার ফোন চেক করছিলাম কবে ফোন আসবে। কিন্তু বিকেল হয়ে গেলো ফোন আসছেনা। আমি ফয়সালের দিকে তাকিয়ে বললাম,
___চলো না দেখে আসি! আমার কেমন যেন ভয় হচ্ছে!
সে আমার কাঁধে হাত রেখে নিজের সঙ্গে লেপ্টে বারবার বলছে,
___এতো চিন্তা কেন? যাদের কাছে বাচ্চা উনারা হয়তো বাচ্চা দিতে চাইছেনা, কিন্তু ঠিকি নিয়ে আসবে। অপেক্ষা করি আরেকটু।
কিন্তু আমার কেন জানি মন আকুপাকু করছে। আমি স্থির হতে পারছিলাম না। ফয়সালকে জোর করে নিয়ে গেলাম। বাসার সামনে গিয়ে কলিং বেল চাপার আগেই কেন জানি আমি দরজায় ধাক্কা দিলাম, কারণ দরজার একটা কপাট হালকা খোলা ছিল।
ধাক্কা দিতেই দরজা খোলে গেলো। কিন্তু কাউকেই দেখা যাচ্ছেনা। আমি আশেপাশে তাকিয়ে ডাকলাম কিন্তু কোনো সাড়া নেই। আস্তে আস্তে ভেতরের দিকে গেলাম, কাউকেই দেখা যাচ্ছেনা।
হঠাৎ করে খেয়ার করলাম টাইলসে লাল কিছু দেখা যাচ্ছে, আমি হাত দিয়ে ছুঁতেই আৎকে উঠলাম। মেইন রুমের দিকে এক দৌঁড়ে গিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। ফয়সালও দৌঁড়ে এসে নিজের মুখ চেপে ধরলো। অরুণ অরুণ বলে আমি হাঁটু গেড়ে বসে গেলাম। ফয়সাল মাথার দিকে গিয়ে বুকে কান পেতে বললো,
___ এখনো জীবিত মনে হচ্ছে! কে এভাবে নৃশংসভাবে আঘাত করলো? গলায়,হাতে,পায়ে,বুকে সবখানে ছুড়ির আঘাত মনে হচ্ছে!
চলবে……