আঁধারের পরে 💔

গল্প
আঁধারের পরে।
(১৮+ সতর্কতা)

আমার রানু আপা বিয়ের আগেই গর্ভবতী হয়ে গেছিল। কাউকে কিছু না বলে সেই অবৈধ বাচ্চাটা নিজে নিজে নষ্ট করতে গিয়ে মারা গেছে। আজ সকালে আপাকে ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। গাছের শিকড় দিয়ে গর্ভপাত করতে গিয়ে জরায়ু ফুটো হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।

আপার বিয়ের কথাবার্তা চলছিলো। মানে টুকটাক ঘর আসছিলো। কিন্তু পায়ে একটু সমস্যা থাকায় সব ঘর ফিরে যাচ্ছিলো। খুব ছোটবেলায় আপার টাইফয়েড হয় । তারপর ডান পা’টা চিকন হয়ে যায়। তখন থেকেই আপা একটু খুড়িয়ে হাঁটে।

পাত্রপক্ষ আপার এই সমস্যা জেনেই দেখতে আসে। তবুও আপাকে দেখার পর বলে,

মেয়ের পায়ে তো বেশ সমস্যা দেখছি।

কথাটা বলার সময় চোখেমুখে চরম অসন্তোষ ফুটিয়ে তোলে। ভাবখানা এমন যেন ব্যাপারটা ওনারা জানতেন না।
তারপর যাবার সময় বলে পরে জানাবে।

কিন্তু পরে আর কেউ জানায় না। শেষে একটা ঘর আসলো ছেলের একবার বিয়ে হয়েছিল,বৌ ছেড়ে চলে গেছে। সেই লোক জানালো যে রানু আপাকে তার পছন্দ হয়েছে। আগামী সপ্তাহে এসে কথা পাকাপাকি করে যাবে।

কিন্তু এর মধ্যেই এই দূর্ঘটনা।
আমরা কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি আপার সাথে এমন কিছু ঘটতে পারে।

গতকাল রাতে মা যখন আপাকে খেতে ডাকলেন, আপা বলল,
আমার খেতে ইচ্ছে করছে না মা,তোমরা খেয়ে নাও।

কিছুদিন থেকেই আপার খাওয়ায় অরুচি। সারাদিন না খেলেও বলবে না যে ক্ষুধা লাগছে। কিছু খেতে দাও।
মা বললেন,

অসময়ে খেয়ে খেয়ে গ্যাস্ট্রিক হয়েছে। কতবার বলেছি সময়মতো খাবি। আমার কথা কে শোনে!

মা জোর করে আপাকে খাবার টেবিলে টেনে আনলেন,

দুপুরেও ঠিকমতো খাসনি। এখন একটু খেয়ে নে মা।

আপা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসলো। মা ওর প্লেটে টেংরা মাছ তুলে দিয়ে বলল,

তোর পছন্দের টেংরার ঝোল করেছি টমেটো দিয়ে ঝাল ঝাল করে। খেয়ে নে।

পাতে মাছ দেবার সাথে সাথে আপা ওয়াক করে মুখে হাত চাপা দিয়ে উঠে পড়ল। তারপর দৌড়ে বাথরুমের দিকে গেলো।

মা চিন্তিত হয়ে বললেন,

নাহ, এবার মেয়েটাকে ডাক্তার দেখাতেই হবে। আলসার হয়ে গেলো কি না কে জানে।

রানু আপাকে ডাক্তার দেখলো ঠিকই তবে আপার প্রাণ যাবার পর।

আমরা তিন বোন। রানু আপা,আমি তনু আর বেনু। বেনু সবার ছোট। আমি আর আপা এক ঘরেই ঘুমাতাম। বেনু থাকত মা বাবার সাথে।

গভীর রাতে কখন যে আপা আমার পাশ থেকে উঠে গেছে টের পাইনি। গাছের শেকড় দিয়ে অবৈধ বাচ্চাটা নষ্ট করতে গিয়েছিল। জরায়ুতে ছিদ্র হয়ে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।

কাউকে বলতেও পারেনি। সারারাত রক্তক্ষরণে মারা যায়।

আপা রোজ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে।‌ ফজরের নামাজ পড়ে কিছু সময় পড়াশোনা করে। তারপর মায়ের সাথে হাতে হাতে কাজ করে। আমাকে স্কুলে পাঠানো,বেনুকে খাওয়ানো সব আপাই করে।

আজ বেলা হয়ে গেলো কিন্তু আপা উঠছে না দেখে মা সালেহা খালাকে বলল আপাকে ডাকতে। সালেহা খালা আমাদের বাড়িতে টুকটাক কাজ করে।

সালেহা খালা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,

ও রানু,কি হলো তোর। এহনো উঠস নাই আইজ।
বলতে বলতেই চেঁচিয়ে উঠলেন,

ওমাগো! রানুরে।

সালেহা খালার চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মা রান্নাঘরে রুটির আটা মাখছিলেন। চিৎকার শুনে দৌড়ে এলেন।

রুমে ঢুকে মা অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

আপা মেঝেতে পড়ে আছে। আর তার চারপাশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আশেপাশের লোকজন চলে এলো।
মবিন ডাক্তারকে খবর দেয়া হলো । উনি এসে আপাকে পরীক্ষা করে বললেন,

কিছুই করার নেই। সব শেষ ।

আপার কোমড় থেকে নীচটা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। মারা যাবার পর আমার শ্যামলা আপাকে কেমন ফরসা লাগছিলো। মুখ দেখে মনে হচ্ছিল কেউ বুঝি সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে সব রক্ত শুষে নিয়েছে।‌

আজ সকালটা অন্যরকম হতে পারত। আপা আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলছে। বেনুটা খেতে চাচ্ছে না আর আপা ওকে এই গল্প সেই গল্প বলে খাইয়ে দিচ্ছে। আমাকে চুলে বেনি করে দিয়ে বইখাতা গুছিয়ে ব্যাগে টিফিন বক্স দিয়ে বলছে,

টিফিন কিন্তু খেয়ে নিবি।

কিন্তু এমন কিছুই হলোনা।

আপাকে বারান্দায় এক কোণে চৌকিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। একটা চাদর দিয়ে পুরো শরীর ঢাকা।

চারপাশে কয়েকজন মহিলা বসে কোরআন তেলাওয়াত করছে। আগরবাতির গন্ধ বাড়ির পরিবেশকে আরো শোকাবহ করে তুলেছে।

মা কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। বাবা একদম পাথরের মতো বসে আছেন।‌ সবাই বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। বাবা সবার মুখের দিকে এমন করে তাকাচ্ছেন যেন কারো ভাষাই উনি বুঝতে পারছেন না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে দেখছেন।

বেনু খুব কান্না করছিলো। ওকে ছোট ফুফু নিয়ে গেছে। ছোট ফুফুর বাড়ি পাশেই। আমি কি করব ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার কাছে শুধু মনে হচ্ছিল কোনো একটা স্বপ্ন দেখছি। একটু পরেই ঘুম ভেঙ্গে যাবে। আপা বলবে,

কিরে তনু, এখনো শুয়ে আছিস যে, ওঠ স্কুলের দেরি হয়ে যাবেতো।

অন্য দিন এই কথাটা পৃথিবীর সবচেয়ে অপ্রিয় বাক্য মনে হতো। কিন্তু আজ এই বাক্যটা শোনার জন্য আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।

আমাদের বাড়ির সব থেকে শান্ত মেয়ে রানু আপা। বাড়ির সব কাজ করে, পড়াশোনায় মোটামুটি । বিএ পরীক্ষা দিয়েছে এখনো রেজাল্ট হয়নি। আপা বাইরে আড্ডা দেয় না। অন্যদের মতো বন্ধু বান্ধবীও নেই । সেই আপা এমন একটা ঘটনা ঘটাবে এটা বিশ্বাস করাটাও কঠিন।

ক’দিন থেকেই আপা কেমন যেন একটু বেশি চুপচাপ হয়ে গেছিল। একা একা কি যেন ভাবত। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতো না। খাবার রুচিও ছিলোনা। প্রতি বেলায় খাবার নষ্ট করতো।
আপার আগে থেকেই খাবারে রুচি কম। তাই বিষয়টা নিয়ে কেউ তেমন একটা মাথা ঘামায়নি। বড়রা ভেবেছে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাটা বেড়েছে আর বিয়ের ঘর ভেঙে যাওয়ায় হয়তো এমন মনখারাপ করে থাকে।

মফস্বল শহরে এমন একটা ঘটনা লুকিয়ে রাখা গেলো না। লাশ দেখতে আসা লোকজন কানাঘুষা করতে লাগল। অবশ্য কানাঘুষা বললে ভুল হবে। অনেকের অনেক কথাই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।

এতো ভালো একটা মেয়ে এই কাজ করল কিভাবে! মা বাবার কথা একবারও ভাবলো না।

কেউ কেউ বলল,

এমন মুখমুন্দা মেয়েগুলোই বদের হাড্ডি হয় এক একটা। ওপরে ওপরে ভদ্র ভাব দেখায় আর তলে তলে এসব আকাম কুকাম করে।

যদিও এসব কথা শোনার মতো অবস্থা তখন আমাদের কারোরই ছিলো না। শোকে বাড়ির প্রতিটা লোক পাগল প্রায় হয়ে গেছিলো।

এর মাঝে পুলিশও চলে আসল। কে বা কারা পুলিশে খবর জানিয়েছে। অস্বাভাবিক মৃত্যু তাই পুলিশ লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যেতে চাইল।

আমার বড় মামা খুব করিৎকর্মা লোক। পুলিশকে কিভাবে কিভাবে যেন ম্যানেজ করে ফেললেন। পুলিশ ফিরে গেলো। ময়না তদন্ত ছাড়াই বিকেলের মধ্যেই দাফনের কাজ শেষ হলো।

আপাতো ওপারে চলে গিয়ে বেঁচে গেলো কিন্তু আমাদের জীবনে নেমে এলো‌ নরকসমান যন্ত্রণা।

এই সমাজের এক অদ্ভুত নেশা আছে। মানুষের দূর্বল জায়গায় আঘাত করে, খুঁচিয়ে এক অদ্ভুত আনন্দ পায় সবাই। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হলো।

বাবার সাথে দেখা হলেই লোকজন এক দু’কথার পর শুরু করে,

কিছু জানা গেলো? না মানে বাচ্চার বাপ কে ছিলো। মেয়েটার কাদের সাথে মেলামেশা ছিলো?

আমাকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করতো,

তোর বোন কি রাতে বাইরে থাকতো? তোরতো জানার‌ কথা কার সাথে কিছু ছিলো কিনা?

তোদের বাসায় কেউ আসতো না কি?

এমনকি স্কুলেও ক্লাসের মাঝে স্যার ম্যাডামরা এসব বিষয়ে কথা বলত।

আমার খুব রাগ হতো । মনে হতো আমার যদি ক্ষমতা থাকতো সবাইকে গুলি করে মারতাম।

শুধু তাই না আপার নামে ভয়াবহ কিছু মিথ্যা কথা ছড়িয়ে পড়ল,
আপা নাকি রাত করে বাড়ি ফিরতো।
ওকে নাকি ছেলেদের সাথে রিক্সায় ঘুরতে দেখা যেত প্রায়ই।

অথচ এসব কথা একেবারেই মিথ্যা। আপা কখনো কলেজ থেকে বাইরে কোথাও যেতো না। পায়ের সমস্যা থাকার জন্য কলেজেও খুব কম যেতো। সারাদিন বাসাতেই থাকতো। আপার ছেলে তো দূরের কথা কোনো মেয়ে বন্ধু ছিলো না। অথচ আপার জীবনেই এমন একটা ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটল।

কথায় বলে শোক যত বড়ই হোক সেটা তত দ্রুত কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা মানুষের তত বেশি।‌

আমরাও দিনে দিনে আপাকে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠলাম।

বাইরের লোকজন অন্য আরো নতুন ঘটনার ভীড়ে এই ঘটনার কথা ভুলে গেলো।

আট বছর পরের কথা। আমি এখন কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে আর মিনু সেভেনে। চেহারা ছবি ভালো হবার কারণে আপার এমন একটা ঘটনার পরেও টেন থেকেই আমার বিয়ের ঘর আসতে লাগল। তবে বাবা ঘটককে বলেন,

এখনি মেয়ে বিয়ে দিবো না। ওরে পড়াশোনা করাবো তারপর বিয়ে।

ঘটক চাচা বলে,

বড় মেয়েটার এমন একটা ঘটনার পরে এই মেয়েকে বেশিদিন ঘরে রাখা ঠিক হবে না। এখন যখন ভালো ঘর আসতেছে বিয়া দিয়া দাও।

বাবা চুপ করে যান। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন‌ যা দেখে বোঝা যায় হয়তো একসময় রাজী হয়ে যাবেন বিয়ে দিতে।

আমি রোজ কলেজে যাবার পথে পাড়ার জাহিদ ভাই দাঁড়িয়ে থাকেন। উনি মনে হয় আমাকে পছন্দ করেন। রোজ বড় রাস্তার মোড়ে আমার কলেজে যাবার সময় উনার লক্কর ঝক্কর বাইকে সমস্যা দেখা দেয়। আমি যখন পাশ দিয়ে হেঁটে যাই উনি তখন ডেকে বলেন,

তনু আয়, তোকে কলেজে নামিয়ে দেই।

আমি মুচকি হেসে বলি,

আপনার বাইকতো নষ্ট।

আরে না,ঠিক আছে।

নাহ,আমি হেঁটেই চলে যাবো।

জাহিদ ভাই আর কিছু বলেন না।‌ উনি খুব লাজুক মানুষ। ভীষণ শান্ত প্রকৃতির। মুখ ফুটে আমাকে পছন্দের কথা বলতে পারেন না। তবে আমি হঠাৎ পেছনে ফিরলেই দেখি উনি হা করে তাকিয়ে থাকেন। চোখে চোখ পড়তেই মুখ নামিয়ে নেন।

আমি মুচকি হাসি দিয়ে বলি,

আগে বাইক ঠিক হোক,তারপর উঠব।

জাহিদ ভাই গভীর রাতে আমাকে মেসেজ দেন। আমিও উত্তর দেই। ওনার সাথে কথা বলার জন্য আমি একটা আইডি খুলেছি। শ্বেতপদ্ম নামে।

কিরে কি করিস?

কিতকিত খেলি খেলবেন?

উনি হাসির ইমোজি দেন।

আমি কখনো আমার ঠোঁটের কখনো চোখের ছবি তুলে ওনাকে পাঠাই।

দেখেনতো কেমন হয়েছে?

খুব সুন্দর।

আমার ভালো ঘরে বিয়ে হবে তো?

তুই এখন বিয়ে করবি?

হুম,পড়তে ভালো লাগে না। তার থেকে বিয়ে করে সংসার করব,স্বামীকে আদর যত্ন করব সেটাই ভালো।

জাহিদ ভাই আবারো হাসির ইমুজি দেন।

কোনো কোনো দিন আমার কলেজের বাইরের চায়ের দোকানেও‌ দেখা যায় ওনাকে। আমার সামনে পড়লেই বলেন,

আরে তনু,ছুটি হলো?

উহু,আপনি এসেছেন শুনে স্যার ছুটি দিয়ে দিলো।

ধূর কি যে সব বলিস !

জাহিদ ভাই হেসে ফেলেন। এই হাসি দেখে পৃথিবীর যেকোনো মেয়ে প্রেমে পড়বেই পড়বে।

উনি কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলেন,

আমি এদিকে একটা কাজে আসছিলাম। এক বন্ধুর কাছে।

নাম কি?

কিসের?

আপনার বন্ধুর।

জাহিদ ভাই আমতা আমতা করে বলেন,

ত ত তমাল।

আমি আবারও হেসে উঠি।

জাহিদ ভাইয়ের চোখ দেখে বুঝতে পারি আমার হাসি দেখে ওনার ভেতরে ঝড় উঠেছে। আমি তখন জাহিদ ভাইয়ের একদম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলি,

আমি কিন্তু সব বুঝি।

পাড়ায় কনফেকশনারির দোকান আছে জাহিদ ভাইয়ের । তবে ওনাকে দোকানে কম বাইকে বেশি দেখা যায়।

লম্বা,ফর্সা দেখতে খুব হ্যান্ডসাম। যেকোনো মেয়ে ওনাকে দেখলে প্রেমে পড়বেই।

উনি আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করেন, তবে যা চুপচাপ জীবনেও নিজ থেকে কিছু বলবেন বলে মনে হয় না।

আপার ভয়াবহ ঘটনার পরে আমার হয়তো কোনো সম্পর্কে জড়ানো ঠিক না। তবুও আমি জাহিদ ভাইয়ের এই ঘুরঘুর করাটা উপভোগ করতে থাকি। নিজেকেই বলি,

এতো ভালো হয়ে কি হবে? আপাতো অনেক ভালো ছিলো। তাও ওকে এভাবে মরতে হলো। না হয় একটু খারাপই হলাম। অত ভালো হবার দরকারটাই বা কি।

আজকাল আয়নায় একটু বেশি সময় কাটাই। কলেজ যাবার আগে নানা কায়দায় চুল বাঁধি, চোখে কাজল দেই। হালকা লিপস্টিকও দেই মাঝে মাঝে। তবে বাসাতে না। ব্যাগে করে লিপস্টিক নিয়ে যাই তারপর কলেজের কমন রুমে গিয়ে দেই। বাড়িতে ঢোকার আগে আবার মুছেও ফেলি।

আষাঢ় মাসের একদিন,কলেজ ছুটি দিয়েছে আর ঠিক সে সময় আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টি থামার কোনো নাম নেই। কলেজের ক্যান্টিনে জাহিদ ভাই বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে বলল,

চল উঠে পড় । এই বৃষ্টি থামবে না। তোকে বাড়িতে নামিয়ে দেই।

উহু বাড়িতে যাবোনা।

আচ্ছা ওঠ।

আমি উঠে পড়লাম।

জাহিদ ভাই বাইক স্টার্ট দিলো। বৃষ্টির পানিতে চোখ খুলে রাখা যাচ্ছে না। চোখে ছাট এসে লাগছে। আমি চোখ বুজে আছি। বাইপাস ধরে বাইক ছুটছে তো ছুটছেই।

কোথায় যাচ্ছি জানা নেই। জানতেও ইচ্ছে হচ্ছে না।
আমি চুপচাপ বসে আছি। এই বৃষ্টিতে ফাঁকা রাস্তায় এভাবে কখনো বাইকে চড়া হয়নি। খুব ভালো লাগছে। ইচ্ছে হচ্ছে জাহিদ ভাইয়ের সাথে অন্য কোথাও চলে যেতে।
জাহিদ ভাই বলল,

একটা জায়গায় যাবি?

হুম আপনার সাথে জাহান্নামেও যাবো।

জাহিদ ভাই আরো গতি বাড়িয়ে দিলেন।

বাইক এসে থামল একটা একতলা বাসার সামনে। শহর থেকে একটু দূরে এসেছি আমরা।

তোর সাথে কিছু কথা আছে তনু।

বাব্বাহ,আপনার আবার বলার মতো কথাও আছে? তা কি এমন কথা এখানে এনে বলতে হবে!

বলছি আগে ভেতরে চল।

দরজা খুলে দিলো মাঝবয়সী এক মহিলা।
জাহিদ ভাই ওনাকে বললেন,

খালা একটা তোয়ালে দাওতো দুজন একদম ভিজে গেছি।
একটা সিগারেট ধরিয়ে জাহিদ ভাই বললেন,

তুই যা,আমি আসছি।

আমি ভেতরে ঢুকলাম। ছোট একটা ঘর। একপাশে একটা চৌকি,আর একদিকে দুটো চেয়ার রাখা। আর কোনো আসবাব নাই। মহিলা একটা তোয়ালে আমার হাতে দিয়ে বললেন,

ধরো, মুছে নাও আমি একটু চা নাশতার ব্যবস্থা করি।

উনি চলে গেলে জাহিদ ভাই এলেন,

মাথাটা মুছে ফেল। ঠান্ডা লেগে যাবে।

হুম মুছছি,এখন বলেন কি বলবেন?

জাহিদ ভাই তোতলাতে লাগলেন,

না মানে,ইয়ে মানে,

আপনি কি আমাকে পছন্দ করেন?

হুম।

কতটা?

অনেক বেশি পছন্দ করি। তোকে বলে বোঝাতে পারবো না।

তাহলে আমাকে একটু আদর করেন।

জাহিদ ভাই অবাক হয়ে তাকালেন। এমন কিছু বলব উনি স্বপ্নেও ভাবেননি।

আমি ভেজা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ওনার একদম কাছে চলে আসলাম।

জাহিদ ভাই কেঁপে উঠলেন।

আমি চোখ বন্ধ করে ওনার দিকে ঠোঁট বাড়িয়ে দিলাম।

নেন আদর করেন।

জাহিদ ভাইয়ের গরম নিঃশ্বাস টের পেলাম। উনি আমাকে আচমকা জাপটে ধরে চুমু খেতে লাগলেন।

আমার পুরো শরীরে ওনার হাত ঘুরতে লাগল।

আমিও সাড়া দিলাম।

এক হাতে ওনার শার্টের বোতাম টেনে খুলতেই উনি নিজেই পুরোপুরি নগ্ন হয়ে গেলেন। তারপর আমার কামিজ ধরে টানতে শুরু করলেন।

হঠাৎ আমার সম্বিত ফিরল।

আমি ঠেলে ওনাকে সরিয়ে দিলাম। বললাম,

একটু চা খাবো।

জাহিদ ভাই অবাক হলেন।

এসময় এ অবস্থায় চা খেতে চাইব এটাও উনি ভাবেননি।
আচ্ছা দেখছি।

তারপর ঐ মহিলাকে ডাকতে ভেতরে গেলেন।

একটা ভুল মানুষ, একটুখানি ভুল জীবনটাকে এলোমেলো করে দিবে, আঁধারে ডুবিয়ে দিতে পারে সমস্ত আলো। আমি বের হয়ে আসলাম,দরজাটা বাইরে থেকে আটকে দিলাম। তারপর দৌড়াতে শুরু করলাম। বড় রাস্তায় এসে একটা রিকশা পেয়ে গেলাম। উঠেই সোজা বাড়িতে।

পাড়ায় রি রি পড়ে গেছে। জাহিদ ভাইয়ের নগ্ন ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে। কার সাথে যেন আকাম করতে গিয়েছিলেন। সেই মেয়ে ভিডিও করে ছেড়ে দিয়েছে। ভিডিওতে অবশ্য মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে না।

তবে জাহিদের মতো শান্ত চুপচাপ ছেলে এমন কিছু করতে পারে এটা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না।

দোকানে, পাড়ার মোড়ে মানুষজন‌ বলছে,

আজকাল কে যে কেমন কিছুই বোঝা যায় না বাইরে থেকে। যেই ছেলে মাথা তুলে কথা বলে না তার চরিত্র এমন! ছিঃ!

কেউ আবার বলছে,

আসলে চুপচাপ ধরণের মানুষ গুলো মিনমিনে শয়তান। এদের ওপরে এক ভেতরে আর এক।

জাহিদ ভাইয়ের বৌ ওনাকে ছেড়ে চলে গেছে। আর যাই হোক এমন লোকের সাথে সংসার করা যায় না কিছুতেই।

আপা মারা যাবার বেশ কয় দিন আগে একদিন স্কুল থেকে ফিরে দূর থেকে জাহিদ ভাইকে দৌড়ে আমাদের বাড়ি থেকে বের হতে দেখেছিলাম। মা সেদিন মামার ওখানে গেছিলেন। আপা বাড়িতে একা। আমি এসে দেখি আপা কাঁদছে। তার পোশাক এলোমেলো।

আমাকে দেখে আপা কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
এই যে আমি কান্না করছি, এসব কাউকে বলবিনা তনু। বললে আমি মরে যাবো।

ছোট্ট আমি কাউকে কিছুই বলিনি। সেদিনও না আর আজও না।

অনেক দিন পর আজ আপাকে স্বপ্নে দেখলাম। কি ভীষণ শান্তি লাগছে! একটা বড় মাঠ। আমার রানু আপা দৌড়াচ্ছে। ওর পা একদম ভালো হয়ে গেছে।

আমি আপাকে ধরতে ছুটছি আর বলছি,

আপা দাঁড়াও,আমি তোমাকে ধরতে পারছি না।
আপা হেসে বলছে,

দেখ তনু,আমি একদম ভালো হয়ে গেছি। আমার পায়ে আর কোনো সমস্যা নেই। অনেক দূর যেতে হবে। আমার পিছে পিছে আয় তনু।

হঠাৎ চারপাশে একটা সোনালী আলো ঝলকে উঠল। আমি চোখ বন্ধ করলাম। তারপর চোখ খুলতেই দেখি আপা একটা লাল বেনারসী পড়ে হাসছে। খুব সুন্দর লাগছে দেখতে।

ঘুম ভাঙলে আপার কবরে গেলাম। ওর কবরে বড় হওয়া বেলি গাছটায় এই প্রথম ফুল এসেছে। বেলি ফুল খুব পছন্দ ছিলো‌ রানু আপার। স্বপ্নে দেখা আলোর মতো এখানেও আলো ছড়িয়ে আছে। আপার সব আঁধার বুঝি ঢেকে দিচ্ছে পরম মমতায়।

ইশরাত হাসান নীরু।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here