#আঁধারে_আলোর_হাতছানি
#লেখনীতে_মাহমুদা_মায়া
৭ম পর্ব
আজানের ধ্বনিতে মুখরিত চারদিক। ভোরের আলো একটু একটু করে অন্ধকারের মাঝে উঁকি দিচ্ছে। পাখিদের আনাগোনা ও কিচিরমিচির শুরু হয়েছে। সমস্ত পরিবেশ জানান দিচ্ছে, ভোর হয়েছে, নব্য দিন দেখতে পাওয়ায় রবের নিকট শুকরিয়া জানাও।
ঘুম জড়ানো চোখে আঁধার বালিশের আশেপাশে হাতড়ে মোবাইল ফোন খুঁজে নেয়। অভ্যাসজনিত কারণে মোবাইলের স্ক্রিনে এমনভাবে স্পর্শ করে যেন কল রিসিভ করছে। কানে মোবাইল রেখে ঘুম ঘুম কন্ঠে সে বলে,
‘হুম। উঠছি।’
মোবাইল একপাশে রেখে নিভু নিভু চোখে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। আঁধার ফ্রেশ হয়ে, ওযু করে জায়নামাজ বিছিয়ে ফজরের নামায আদায় করে নেয়। নামাযের সালাম ফেরানোর পর তার দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকে বিছানায় পরে থাকা মোবাইল ফোনের উপর। দ্রুতগতিতে ফোন হাতে নিয়ে কল লিস্ট চেক করে আঁধার।
না, আজকের কোন ইনকামিং কল নেই। আঁধার বেশ হতবাক হয়ে যায়। ধ্যান করার মতো কিছুক্ষণ জায়নামাজেই বসে থাকে সে।
দুপুরবেলাতেও একই ঘটনা ঘটে। আঁধার ভুলবশত কানে মোবাইল ধরে একটি কথাই বলে,
“হ্যাঁ, যাচ্ছি মসজিদে।”
নামাজ আদায়ের পর সকালের মতোই তার ভুল ভাঙে। একই ভুলে বিকালবেলা আলোকে পড়ানোর উদ্দেশ্যে কোচিং সেন্টারের সামনে যায়। এভাবে এশার ওয়াক্তও আদায় করা হয়। একদিন, দুইদিন, এক সপ্তাহ তো দুইমাস এভাবে ভুলের উপর কেটে যায়।
সব ভুল মানুষের জীবনে খারাপ কিছু বহন করে নিয়ে আসে না। বরং কিছু কিছু ভুল মানুষের জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটিয়ে যায়।
আঁধারের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। সে ভুল করে হলেও এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে। বেশ কিছুদিন যাবত আঁধার আগের তুলনায় বেশিই গম্ভীর হয়ে থাকে। সোমবার রাতে আলোর বাসার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আর আলোর কুরআন তেলওয়াত শুনতে পায় না। ধীরে ধীরে আঁধারের জীবনে আলোর অবদান সম্পর্কে আঁধার বুঝতে পারে।
এই কয়েকমাসে আলোর সেমিস্টার পরীক্ষাও শেষ হয়েছে। আজ কোন একটা প্রয়োজনে সে ক্যাম্পাসে গিয়েছিল, কিন্তু একা। ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পথে বাস থেকে নেমে যখন গলির ভেতর হেঁটে যাচ্ছিল, তখন গলির মোড়ে আঁধারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। এতদিন পর হঠাৎ করে আঁধারকে দেখে আলোর হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পায়। যদি আবারও বকাবকি করে!!
আলো চুপচাপ মাথা নিচু করে এগিয়ে যাচ্ছে। আঁধার এক হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল ঠোঁটে চেপে নিজের মোবাইল চালাচ্ছিল। পাশ দিয়ে মেয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে সে মাথা উঁচু করে তার দিকে তাকায়। আলোকে দেখে দ্রুত মোবাইল প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নেয়। বাইকের চাবিটি দ্রুত খুলে নেয় আঁধার। আলো ততোক্ষণে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছে। আঁধার দৌঁড়ে গিয়ে আলোর পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। নিরবতা ভেঙে আঁধার বলে,
“আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছ?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
সালামের উত্তরটুকু নেওয়া পর্যন্তই আলোর জবাব। এরপর কিছু বলে নি সে। আঁধার বুঝতে পারে আলো তার সাথে কথা বলবে না। আলোর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার পথ আটকায় আঁধার। আলো একনজর আঁধারের দিকে চোখ মেলে তাকায়। আঁধার বলে,
“আচ্ছা, আমি সরি। সেদিন রাগারাগি করে কথাগুলো বলা ঠিক হয় নি। ক্ষমা করো আমায়।”
“ঠিকই হয়েছিল। কেউ কারো উপর বিরক্ত হলে বণিতা না করে সরাসরি বলাটাই উত্তম মনে করি, ” আলো নিচের দিকে তাকিয়ে বলে।
“না, আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা করো আমায়, নয়তো সৃষ্টিকর্তা আমায় ক্ষমা করবেন না। তিনি এতো ভদ্র ও ভালো মেয়ের মনে আঘাত করার জন্য আমা,,” শেষের বাক্যটি বলার সময় আঁধার আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। যখন সামনের দিকে, যেখানে আলো দাঁড়িয়েছিল ঠিক সেখানে তাকায় সে বোকা হয়ে যায়। আলো সেখানে নেই। আশেপাশে, পেছনে তাকিয়েও আঁধার আলোকে পায় না।
যার অর্থ আলো পালিয়েছে। আঁধার দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে থাকে।
পরদিন বিকালবেলা যখন আলো টিউশনি করিয়ে ফিরছিল, ফের আঁধারের সাথে তার দেখা। চোখেমুখে এক বিরক্তিকর ভাব নিয়ে আলো তার পথে অগ্রসর হচ্ছে। আঁধার আবারও আলোর পাশে হাঁটতে হাঁটতে তাকে সালাম দেয়। আলোও সালামের জবাব দেয়। আঁধার হেসে হেসে বলে,
“আলো, একটা নিউজ শুনলে তুমি খুব খুশি হবে। গত কয়েকমাস যাবত আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাসময়ে আদায় করছি।”
“আলহামদুলিল্লাহ, ” আলো বিরবির করে বলে, যা আঁধারের কান পর্যন্ত যেতে ব্যর্থ।
“কি ব্যাপার, তুমি খুশি হও নি?”
“আপনার মা ওখানে কি করছে?” আলো কোথাও হাত দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে বলে।
“কোথায়?”
ইশারাকৃত স্থানে তাকানোর পর কাউকে পায় না আঁধার। পাশ ঘুরে তাকানোর আর প্রয়োজন মনে করে নি সে। কারণ সে বুঝেছে যে আলোর দেখা এখন আর পাওয়া সম্ভব না।
প্রতিদিন আলোর চলার পথে এসে অপেক্ষা করা, আলোর সাথে কোন না কোন কথা বলাটাও যেন আঁধারের দৈনন্দিন জীবনের এক অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যায়।
একদিন রাতে আঁধার নিজের কক্ষের ব্যালকনিতে মাথার পেছনে দুহাত দ্বারা হেলান দিয়ে বসে আছে। ভাবছে একটা বছরে তার পরিবর্তন হওয়ার কথা। কি ছিল আর কি হয়েছে! যতটা খারাপ স্বভাব ছিল, সবটা বর্তমানে দূর হয়েছে। এখন গম্ভীর হয়ে নয়, বরং হাসিমুখে অন্যদের সাথে কথা বলা শিখেছে। ধুমপানও ছেড়ে দিয়েছে, সাথে মারামারি৷ আর সবটা সম্ভব হয়েছে আলোর জন্য। আলোকেই হয়তো আল্লাহ তায়ালা মাধ্যম হিসেবে আঁধারের জীবনে পাঠিয়েছেন। ভাবতে ভাবতে নিজের কক্ষ থেকে বেরিয়ে বসার কক্ষে এসে হাজির হয় আঁধার। সেখানে তার বাবা বসে কিছু কাগজ দেখছিলেন। আঁধার এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম, বাবা।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। তবে সত্য শুনছি। আঁধার তবে সত্যিই পরিবর্তন হয়েছে!” আঁধারের বাবা কাগজের দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন।
“কোন কিছু চিরস্থায়ী একরকম থাকে না। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়দ সব কিছুর মাঝেই পরিবর্তন ঘটে।”
“হঠাৎ কি দরকারে বাবার কাছে আসলে আজ?” আঁধারের বাবা কথা না বাড়িয়ে সরাসরি জিজ্ঞাসা করে।
“আমি অফিসে জয়েন করতে চাই।”
আঁধারের বাবা কথাটা শুনে চমকে উঠে। কি মনে করে তিনি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন। কিন্তু আঁধার তাকে আরো একধাপ চমক দিয়ে বলে,
“তোমার ছেলে বলে যে বস হিসেবে জয়েন করব তা না। সাধারণ কর্মচারী হিসেবে জয়েন করে, নিজের পরিশ্রমের মাধ্যমে উপরে উঠতে চাই।”
“তুই কি সত্যিই আমাদের আঁধার?” আঁধারের বাবা বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন।
“আমি একই রক্ত মাংসে গড়া একই দেহের আঁধার, বাবা। শুধু এই আঁধারের মাঝে কিছু পরিবর্তন এসেছে। তোমার কোন সমস্যা নেই তো? নয়তো অন্য কোম্পানিতে এপ্লাই করব আমি,” আঁধার বলে উঠে।
“না৷ তবে কালকে সাধারণদের মতোই গিয়ে ইন্টারভিউ দিবে।”
কথাটা বলে আঁধারের বাবা পুনরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। আঁধার নিজের কক্ষে চলে যায়। কথানুযায়ী পরদিন অফিসে গিয়ে ইন্টারভিউ দেয় আঁধার। তার বাবাও নিজের ছেলে নয় বরং অন্যদের আসনে বসিয়েই ছেলের ইন্টারভিউ নেয়৷ ইন্টারভিউতে টিকে যায় আঁধার। শুরু হয় তার জীবনের আরেক নতুন অধ্যায়।
বেশ কয়েকদিন পার হয়ে যায়। আলো তার চলার পথে আঁধারকে দেখতে পায় না। কিছুটা চিন্তিত হলেও পরক্ষণে সে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয় আলো। আলো ও আঁধারের জীবন তার নিয়ম ও গতিতে চলছে। আলোর স্বপ্ন ভালো শিক্ষক হওয়া ও আঁধারের স্বপ্ন ভালো একজন কর্মজীবী।
কিন্তু আলোর স্বপ্নের গতিপথে দেয়াল সৃষ্টি করে দেয় তার বাবা, যা আলো কখনও কল্পনাও করে নি। বাবার থেকে এমন কিছু পেয়ে সব থেকে বেশি আঘাত পায়। সব স্বপ্ন কাঁচের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় আলোর। সে ঘরবন্দী করে নেয় নিজেকে।
চলবে,,,,,,
আর এক অথবা দুই পর্বে গল্পটা শেষ হবে। See less