“আকাশী”
পর্ব ১১.
নতুন বছরের প্রথম মাস। স্কুলের চারিদিকে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী নিজ নিজ অভিভাবককে নিয়ে এসেছে। কিছু কিছু ভর্তি হয়ে ইতোমধ্যে ক্লাস শুরু করে দিয়েছে। আর কিছু কিছু এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছে। বই বিতরণী এখন শেষ পর্যায়ে। আকাশী মৃত্যুঞ্জয় স্যারকে দেখতে পায়নি। আজ তার প্রথম ক্লাস। স্যারের সাথে দেখা করা উচিত। তিনিই তো তাকে পথ দেখিয়েছেন। বিভা কমার্স নিয়ে পড়ায় সকলে আকাশীকেও তা নিতে বাধ্য করছিল। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় স্যার বললেন, সায়েন্সের ভেল্যু বেশি। সায়েন্স তার জন্য বেস্ট হবে। যদিও এবার সে সমাপনীর মতো টপ করতে পারেনি, কিন্তু পড়ালেখায় যে অসম্ভব ভালো, তা দেখেই মৃত্যুঞ্জয় তাকে সায়েন্সে পড়তে উদ্বুদ্ধ করলেন। আকাশী আর আগপাছ না দেখে সাবজেক্টটা নিয়ে ফেলেছে।
ভর্তির জন্য স্কুলে সে গতবার যখন এসেছিল, তখন চারিদিকটা এতো ছাত্রছাত্রীর ছড়াছড়ি ছিল না। আকাশী আসতেই হঠাৎ সবাই যেন মন্ত্রীকে আসতে দেখার মতো করে দাঁড়িয়ে পড়ল। আকাশী এদিক-ওদিক চাওয়া-চাওয়ি করল। তার সাথে একই বাড়িতে বাস করা ছেলেমেয়েরা তার দিকে প্রথমে তাকিয়েছিল। তাদের ওভাবে একটা মেয়ের দিকে তাকাতে দেখে বাকিরাও না তাকিয়ে পারেনি। মেয়েটার মাঝে তো কিছু নেই। সাধারণ একটা স্টুডেন্টের মতো ড্রেস পরেছে। চুলগুলো বেণি করেছে। একটা লম্বা আর সুন্দর মেয়ে হওয়ার সত্ত্বেও সাজগোজ করেনি। তবে কিছু কিছু স্টুডেন্ট তার দিকে কেন তাকায়? বাকিদের ধারণাটা কিছুটা এরূপ। আকাশী বোকা বনে গিয়ে বারান্দায় সবার মাঝখান দিয়ে হেঁটে নিজ ক্লাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার সামনে তারই একটা সহপাঠী এসে দাঁড়ায়। তাদের গ্রামেরই মেয়ে। কিন্তু একই বাড়িতে থাকে না। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে, আকাশীকে দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে এসেছে। মেয়েটা আগে কখনও আকাশীকে পাত্তা দেয়নি বলে সে বিস্মিত হয়েছে। তার বিস্ময় কাটাতে মেয়েটা বলল, ‘আমি তোমার কাছে কিভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব জানি না। আজ বিবিজানের বাড়িতে তোমার মতো একটা মেয়ে থাকায় আমারও কপাল খুলে গেছে।’
আকাশী তাকে থামিয়ে অবাক হয়ে বলল, ‘মানে?’
‘মানে আবার কি! চেয়ারম্যান যে-সিদ্ধান্তটা নিলেন, তার পেছনে যে তোমারই হাত তা স্কুলের সবাই জানে। কারণ স্কুলের প্রায় মানুষ তো এই গ্রামের। আর এই গ্রামসুদ্ধ দুই-চার গ্রামে তো তোমার অনেক চর্চা আছে। তোমাকে নাকি মাঝে মাঝে এই গ্রামগুলোতে দেখা যায়। তোমার সম্বন্ধেও সবাই জানে। তাই সকলে আন্দাজ করে ফেলেছে। কিছু গার্জিয়ান ফুঁসে উঠলেও আমার মতো অনেক মেয়ের ভাগ্য খুলে গেছে। আকাশী, তুমি না হলে আজ আমার এতো তাড়াতাড়ি ক্লাস নাইনে না উঠতেই বিয়ে হয়ে যেত।’
রহস্যগুলো তখনও যেন গোছাচ্ছিল না। আকাশী বড় কোনো কাজ তো করেনি। স্রেফ চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে অনুরোধ করেছিল, মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে সকলকে নিষেধ করে দেওয়ার জন্য আর যারা মনে করে মেয়ের পড়ালেখার খরচ জোগাতে পারবে না তারা যেন স্কুলে উপবৃত্তির জন্য আবেদন করে। কারণ ফারুক চাচা আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করবেন। শুধু এটুকু অনুরোধ সে চেয়ারম্যানের সামনে রেখেছিল। বাকিটা তিনিই সে আশার অনুরোধ বাস্তব করে দেখিয়েছেন। সে আর কিছুই করেনি।
আকাশী বলল, ‘আমার বান্ধবী তাসফিয়ার মৃত্যুর জন্য কিছুটা তার বিবাহই দায়ী। শুধু এদিকটা আমি চেয়ারম্যানকে দেখিয়েছিলাম। বাকিটা উনিই মেয়েদের জন্য এতো সুবিধা করে দিয়েছেন। আমাকে খামোখাই বড় করছ।’
‘ওমা, খামোখা করব কেন? তোমার অবদান হিসেবে হোক সেটা তোমার সামান্য অনুরোধ, তোমার কারণেই এই অসাধ্যের সাধন হয়েছে। নইলে আজ আমি কমার্সে ভর্তি হতে পারতাম না।’
আকাশী কী বলবে খুঁজে পায় না। লজ্জায় ফেলে দিয়েছে মেয়েটা। বারবার অস্বীকারও সে করতে পারছে না, কারণ সত্যিই সে অনুরোধ করায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে যা করেছে তাসফিয়ার জন্য করেছে। তাসফিয়া হয়তো খুশি হচ্ছে এই দেখে যে, তার মতো আর কোনো তাসফিয়ার সর্বনাশ হবে না। আবার এই নিয়েও অনেক খুশি লাগছে যে, মানুষের মতো মানুষ হিসেবে ফারুক চাচাকে গ্রামের চেয়ারম্যান হিসেবে তারা পেয়েছে। চাচা আর্থিক দিক থেকে না হলেও আত্মিক দিক থেকে সকলকে সর্বাধিক সাহায্য করে যাচ্ছেন। এই যে, তিনি মতিভাইকে গ্রাম থেকে বের করে না দিলে গ্রামের কতিপয় নেশাখোর লোকের নেশা দূর হতো না। মদ্যপায়ীদের কথা শোনার পর থেকে চাচা আকাশীকে বলে রেখেছিলেন, তুই তো ঘোরাঘুরি করিস, খেয়াল রাখিস একটু কোনোদিকে কোনোকিছুর হদিস পাস কিনা। তাসফিয়ার মৃত্যুর হাওয়াটা গ্রাম থেকে সরার আগেই তিনি মুরুব্বিদের নিয়ে সভা বসিয়ে মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি এতই সুন্দর একটা বক্তব্য রেখেছিলেন যে, বুজুর্গরা এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।
তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের মেয়েগুলোও ছেলেদের চেয়ে কোনোক্ষেত্রে কম কিছুই নয়। আমাদের আকাশীর ছেলেদের সাথে এক মাঠে ফুটবল খেলার কথা আপনারা সবাই হয়তো জানেন। এরপর থেকে আকাশীর মতো অনেক মেয়েই ঘর থেকে বার হয়ে বাইরের বাতাস উপভোগ করতে শুরু করেছে। অথচ একসময় এই মেয়েদের কাছেই ভয় থাকত, পাছে কোনো ছেলে আবার তাদের দিকে না তাকায়। আকাশীর ওইদিনের কাজটার কারণে কোনো ছেলে মেয়েমানুষের দিকে খারাপ নজরে তাকায়নি। কারণ তারা বুঝে ফেলেছে, আকাশী সামান্য ফুটবল খেলে তাদের হারাতে পারলে অন্য মেয়েও অনেক কিছু করতে পারবে। একদিক থেকে আপনাদের খুশি হওয়া উচিত, মেয়েদের ওপর থেকে বদনজরের সংখ্যা কমে গেছে। আর এসবের কারণেই তো আপনারা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিতেন। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিতেন, যাতে তারা উঠতি বয়সে কোনো ছেলের পাল্লায় না পড়ে। আমাদের স্কুলে কোন একটা মোবাইলের ঘটনা ঘটেছিল জানি, এরপর থেকে আমার মতে অনেক মেয়েই যথেষ্ট শিক্ষা আগেভাগে পেয়ে গেছে। এখন কি কোনোকিছুর ভয় আছে? তবে হ্যাঁ, ভয় এটা নিয়ে আছে, অল্প বয়সে আশা হারানোর জন্য আমাদের তাসফিয়া মা’র মতো আর কোনো সদ্য বিবাহিতা বালিকা আত্মহত্যা করে না বসে। এসবকিছুর একটাই সমাধান, আমাদের মেয়েগুলোকে আরও কিছুদিন পড়তে দেওয়া। অন্তত এসএসসি পর্যন্ত তো আপনারা তাদের পড়াতেই পারেন। এতে করে তাদের মানসিক অবস্থা অনেক উন্নত হবে, মানসিক বিকাশও অনেকটুকু হবে। আমাদের মেয়েরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে না। নিজের ভালো নিজে বুঝবে। পরের ঘরেও নিজ বোঝ-ব্যবস্থায় চলতে জানবে। তাদের স্বামীও তাদেরকে কোনোক্ষেত্রে কম ভাববে না। আর সবচেয়ে বড় কথা, আপনারা কোনো বেওয়া অথবা তালাক হওয়া মেয়েকে হতাশাগ্রস্থ করবেন না। সবারই সুখ পাওয়ার অধিকার আছে। সবাইকেই সমান চোখে দেখবেন। আর যদি কারো এতে একান্ত দ্বিমত থাকে, যদি মনে করেন আপনাদের সিদ্ধান্তের সামনে মেয়ের জান আর মেয়ের খুশির কোনো মূল্য নেই, তাহলে এই গ্রাম ছেড়ে একেবারের জন্য চলে যাবেন।
আকাশী মৃত্যুঞ্জয় স্যারকে অবশেষে পেয়েছে। তার বিজ্ঞান নেওয়ার কথা শোনে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। এই স্যারের সামনে গেলেই আকাশীর কাছে বোধ হয়, এই তার প্রথম টিউটর। এর আগে সে কারো কাছে পড়েনি। অপূর্ব ভাইয়াকে কখনও টিউটরের মতো লাগেনি। তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও আকাশীর মায়ের জোরাজুরিতে তাদের পড়িয়েছে। তিনি কখনও আকাশীদের স্টুডেন্ট মনে করেননি। কেবল একটা গাইডার হিসেবে তাদের পাশে ছিলেন। আকাশী তার কাছে পড়তে যাওয়ার আগে কখনও তাকে দেখেইনি।
মৃত্যুঞ্জয় বললেন, ‘নিজের লক্ষ্য থেকে কখনও চোখ সরাবে না, পেছন থেকে কেউ যতই ডাকাডাকি করুক। কারণ জীবনটা তোমার, ওদের ডাকে পিছু ফিরলে তোমার সর্বনাশের ভার ওরা নেবে না। আবার পেছনের কোনো সঙ্গীরও সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করবে না। নিজের লড়াই নিজে লড়বে। কারণ কেউ সামান্যটুকু অবদান রাখলেও একদিন তোমার কামিয়াবির ভার আগেভাগে নিয়ে নেবে। এই কথাটা তোমার স্বার্থসিদ্ধির লাগতে পারে। কিন্তু এইটেই বাস্তবতা। তুমি ভালোই জানো, পরীক্ষায় আগে নিজের উত্তরপত্রে লিখতে হয়, তারপর অন্যকে সাহায্য করতে হয়। সাহায্য তো বাহ্যিক ব্যাপার। যারা একনিষ্ঠ হয়ে টপ করার চিন্তাভাবনা করে ফেলে তারা একটু স্বার্থপরের মতো নিজের সময় ব্যয় করে অন্যকে সাহায্য করতে যায় না। দিনশেষে তারাই তো বিজয়ী হয়। এই পৃথিবীতে তারাই টিকে, যারা বৈধ স্বার্থপরতা করে।’
আকাশী মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে রইল। তার নীরবতায় লুকিয়ে আছে সায়। মৃত্যুঞ্জয় এও জানেন, আকাশী এসব অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। কেননা তিনি সঠিক লক্ষ্যেই তীর ছুঁড়েছেন।
প্রথম দিনে আকাশীর মোটেও ক্লান্তি লাগেনি। আগে এক ক্লাসরুমেই পড়াশোনা করতে হতো। এখন সাধারণ বিষয়ের ক্লাস ব্যতীত বাকিগুলো একেকটা একেক ক্লাসরুমে। তার কাছে বারবার ক্লাসরুম বদল করার পর্যায়টাও ভালো লেগেছে। তার মন বলল, পূর্বে যে-ক্লাসগুলো করেছে, সবই খুব বোরিং ছিল। এক ক্লাসরুমেই একটানা ক্লাস করা। আর এখন ক্লাসের পাশাপাশি নানান মাল্টিমিডিয়া আর ব্যবহারিক ক্লাস আছে। পড়ালেখার পাশাপাশি একটু বাহ্যিক জ্ঞানার্জন আর একটু ফুর্তিও হবে।
আকাশী ফারাবির সাথে বাড়িতে ফিরছে। ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে বাড়িতে যাওয়া রাস্তাটা পূর্ববতই নির্জন। আকাশী দূর থেকে চেয়ে দেখল, রাস্তার পাশে বাইকে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে নীল শার্ট পরিহিত লম্বামতো একটা ছেলে কী যেন করছে। আকাশীর প্রথম দেখাতেই বোধ হলো, এই ছেলেটা এখানকার নয়। হয়তো জয় ভাইয়া আবারও এসেছেন নয়তো অনিক এসেছে। নাহ্, অনিক হয়তো এতো লম্বা এখনও হয়নি। আকাশী ধীরপায়ে হেঁটে যাচ্ছে। তার পথসঙ্গী রাস্তায় উঠে বিদায় নিয়েছে। দু’জনের বাড়ি একই হলেও, ভিন্ন রাস্তা দিয়ে যেতে হয়। দু’জনই স্ব স্ব রাস্তায় উঠে পড়ে। আকাশী ছেলেটার কিঞ্চিত দূরে পৌঁছালেই থমকে দাঁড়ায়। ছেলেটাকে চিনতে মোটেও সময় লাগেনি। সবসময় ভ্রূ কুঁচকে রাখার ভাবটা এখনও তার আছে, যেন দুনিয়ার সকল বিরক্তি একমাত্র তার কাছেই। কানের পাশ থেকে নিয়ে চোয়াল জুড়ে খোঁচা দাড়ি গজিয়েছে, চোখের পাপড়িগুলো আগের মতোই ঘন। অনেক মানুষের চেহারা দেখা ব্যতীত তাদের চেনা যায়। অপূর্বের চেহারা দেখা ব্যতীত তাকে সে এখন চিনতই না। গড়নের দিক থেকেও যে তার আমূল পরিবর্তন এসেছে। ঘাড় কিছুটা চওড়া হয়েছে। স্বাস্থ্য কিছুটা কমেছে। একদম ছিমছাম ব্যাপার। এখন যদি কেউ এসে বলে দেয়, এই ছেলেটা অপূর্ব নয় -অপূর্বের চেহারা পেয়েছে, তবে আকাশী হয়তো নির্ঘাত তাই মেনে নেবে। অপূর্ব মুখে সিগারেট ঠুকে তাতে আগুন ধরনোয় ব্যস্ত। আকাশী গিয়ে বলল, ‘কেমন আছেন?’
অদ্ভুত একটা ভঙ্গিতে আকাশীর দিকে অপূর্ব ফিরে তাকায়। যেন তার অটোগ্রাফ নিতে এসেছে, এই ভাব করে অপূর্ব বলল, ‘কী চায়?’
আকাশী শুধরিয়ে বলল, ‘না কিছু চাই না। আমি আকাশী, ওই যে পড়াতেন।’
এতক্ষণে গলা সোজা করে অপূর্ব বলল, ‘ওহ্ তুমি? ভালোই আছি। তুমি ভালো আছো?’
‘হুঁ’, বলে আকাশী চুপ হয়ে গেল। বলার জন্য সে আর কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না অপূর্বের ভাব দেখে। অপূর্বও আর কিছু না বলে সিগারেটে আগুন ধরায়।
অগত্যা আকাশী বলল, ‘আপনারা কবে এসেছেন?’
‘কাল রাতে।’
‘ও। কয়দিন থাকবেন?’
‘শীঘ্রই চলে যাব। আসতেই চাইনি।’ এটুকু বলে অপূর্ব চুপ হয়ে গেল।
আকাশী বেশ বুঝতে পারছে, ভাইয়া তার সাথে কথা বলতে চাইছে না। জয় ভাইয়া একই জায়গায় বছরের পর বছর থেকেও তার কাছে শহুরে রং যতটা লাগেনি, তারচেয়ে অধিক গাঢ়ভাবে মাত্র দুইবছর থেকে অপূর্ব ভাইয়ার কাছে লেগেছে। বিগত সময়ে যতটা শ্রদ্ধা তাকে নিয়ে তার মনে ছিল, নিমিষেই তা মিইয়ে গেল। কিই বা করতেন, কেবল বলতেন মন দিয়ে পড়। পড়া বুঝিয়েও দিতেন না। তার কাছে কেবল একটা অবদানের জন্য সে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। সেদিন তিনি না থাকলে আকাশী হয়তো কিছুই হ্যান্ডেল করতে পারত না। রক্ত দেখে সে ঘাবড়েই গিয়েছিল। মনে হয়েছিল সে মরেই যাবে। ভাইয়া তার ঋতুস্রাবের কথা ধরেই তাকে লুকিয়ে বাড়ির পেছন দিয়ে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন, সে যেন কাউকে না বলে ভাইয়াই তাকে দিয়ে গেছে। তখন বুঝতে না পারলেও আজ সে বুঝে, সেদিন ভাইয়ার লজ্জা করেছিল। কেউই যদি জানতে পায়, আকাশীকে ওই অবস্থায় কোনো ছেলে দেখেছে, তবে ভাইয়ার নাক কাটা যাওয়ার মতো অবস্থা হতো। এসব বিষয় সে জয় ভাইয়াকে বলেছিল। তিনি বলেছেন, আমাদের ওখানে এসব নিয়ে ছেলেরা মিন করে না। এটা মেয়েদের ক্ষেত্রে ন্যাচারাল। তবে হ্যাঁ, গ্রামের মানুষেরা মনে করে এগুলো ছেলেদের বলতে নেই। ছেলেদের সামনে ধরা পড়তে নেই। ব্লা ব্লা।
আকাশী যদিও বলতে চায়নি, মুখ ফসকেই বেরিয়ে গিয়েছিল, সেদিন ওই বিষয়ে উনার মত পেয়ে বরং আকাশীর ভালোই লেগেছে। সে বেশ কিছুক্ষণ একইভাবে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকায় অপূর্ব মুখ তোলে তাকিয়ে নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করে নিশ্বাস ফেলল।
‘কী হয়েছে?’
‘কিছু না।’ বলে আকাশী চলে যেতে উদ্যত হলো।
কিছুদূর গিয়ে আকাশী হঠাৎ থেমে পেছনে ফিরে বলল, ‘ধোঁয়া ছাড়লে একত্রে নাকমুখ দিয়ে ছাড়বেন না। পরপর ছাড়বেন। এতে করে দুটোরই আলাদা আলাদা মজা পাওয়া যায়।’
অপূর্ব অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়, ‘কীভাবে বুঝলে? তুমি কি কখনও সিগারেট খেয়েছ?’
আকাশী কিছু না বলে মুচকি হাসল। অপূর্বের বিস্ময়কে না ভেঙেই সে চলে গেল।
(চলবে..)
লেখা: ফারিয়া কাউছার