“আকাশী”
পর্ব ১৬.
আকাশী কিছুই জিজ্ঞেস করার শক্তি পাচ্ছে না। থরথর করে কাঁপছে সে। অনিক নিজ দায়িত্বে বলল, ‘আজম চাচা অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। অবস্থা খুব খারাপ। চাচি আর বিভাকে নিয়ে বাবা তাঁর কাছে পৌঁছে গেছে। আমাকে বললেন, তোকে নিয়ে শীঘ্রই যেতে।’
হঠাৎই সারা রাজ্য জুড়ে নীরবতা নেমে আসে। গাড়িটা নিশ্চল। কোনো বাতাস নেই। সময় যেন থমকে আছে। আকাশীর কাছে কথাটি বিশ্বাস হচ্ছে না। বারবারই মনে পড়ছে, বাবা সকালেই সুস্থ শরীরে বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন। বিকেল না হতেই এমন একটা কাণ্ড ঘটে যাওয়া সত্যিই অবিশ্বাস্য। গাড়িটা ক্রমে হাসপাতালের সামনে এসে পৌঁছাল। আকাশীকে নিয়ে অনিক হাসপাতালের ভেতর ঢুকে পড়ল। আকাশীর দৃষ্টির চারিদিক ঝিলমিল করছে। বহু কষ্টে সে তার বাবাকে বেহুঁশ অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখল। এরপরের কিছুই তার কাছে মনে নেই। যখন চোখ খুলল, দেখতে পেল চারিদিকটা শুনশান। ফারুখ চাচা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর চোখে করুণা ভেসে উঠছে। আকাশী তাঁকে জড়িয়ে ধরল, ‘বাবার কিছু হবে না তো?’
‘ধৈর্য রাখ। আল্লাহ্ যা করে ভালোর জন্যই করে। তোর বাবা তো আমার চেয়েও ছোট। আমার আগে ওর কিছু হবে না।’
আকাশী দুর্বল চোখে তাকিয়ে দেখল, মা আর বিভা কিছু দূরত্বে বসে আছে। বিভা মাঝে মাঝে মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু মা অনড়ভাবে বসে আছেন। তিনি শুনে মতো করে আকাশী বলল, ‘মা, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
রোকসানার কোনো ভাবান্তর ঘটেনি। এমনকি চোখের পলকও পড়েনি। আকাশী একবার তাকায়, শয্যাশায়ী চারিদিকে ব্যান্ডেজে আবৃত বাবার দিকে। একদিনের পর পরেরদিন দুটোর মাঝে কতই না প্রভেদ! তাই ধরা হয়, অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ তিনটাই ভিন্ন ভিন্ন, ঠিক পদার্থের তিনটি অবস্থা কঠিন তরল বায়বীয়ের মতো। বরফ গলে তরল পানি হয়, যেমনটা বর্তমানটা পেরিয়ে একসময় অতীতে পরিণত হয়। তরল একসময় তাপ পেয়ে বাষ্প হয়, যেমনটা বর্তমান পরিস্থিতির ছোঁয়া পেয়ে ভবিষ্যতে পরিণত হয়। সেই ভবিষ্যতে দাঁড়িয়ে মানুষ আসলেই পূর্বের বর্তমানের হিসাব মিলাতে পারে না। গতকালকের বর্তমান একটা ছিল, আজ তার উল্টো। আজকের বর্তমান দেখে লাগছেই না গতকালের বর্তমান ছিল অন্য ধরনের আর ভবিষ্যৎ ছিল তার ব্যতিক্রম। কাল বাবা সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। আজ পরিবেশকে ভার করে তোলে তিনি শুয়ে আছেন কিছু মানুষকে জাগিয়ে রেখে।
বর্তমানটা অতীতে গিয়ে সময়টা ভবিষ্যতে পা রাখে। পরদিনের বর্তমানটা ছিল গতকালের রাতের মতোই। এটা কেন পাল্টাতে পারল না? আকাশীদের নিয়ে অনিক বাড়িতে ফিরে আসে। আজমের কাছে ফারুখ আর রোকসানা রয়ে যান। আকাশী রাতের বেলায় এই প্রথম বিভাকে নিয়ে বেরুয়। মেয়েটি কাঠপুতুল হয়ে আছে। যেদিকেই ঠেলে দেওয়া হয়, সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। তাকে উদাসীন দেখে আকাশী তালগাছের নিচে আঁধারের রাজ্যে নিয়ে এসেছিল। তার কেন যেন এই প্রথম, নিজেকে বিভার চেয়ে বড় বোধ হচ্ছে। বিভা যেন এখন তার ছোট বোন। হাসপাতাল থেকে এসে সে আকাশীকে বলেছিল, ‘সব আমার কারণেই হয়েছে। আমি এখন ভালো করে পড়াশোনা করছি না বলে যে বাবা আমার পড়াশোনার গতি দেখে অল্প বয়সে বিয়ে দিলেন না সেই বাবা আমার বিয়ের কথা ভাবলেন। আর সে কারণেই তাঁর এই দুর্দশা।’ সে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল।
আকাশী বলল, ‘জীবনে এমন কিছু জিনিস থাকে, যা উছিলা হিসেবে কাজ করে। বাবার কপালে যা লেখা আছে তাই সংঘটিত হবে। মানুষ কেবল সে লেখাটা বাস্তবায়িত করার মাধ্যম।’ রাতের আঁধার নামতেই তাকে এখানে নিয়ে আসে আকাশী, তার বন্ধুদের কাছে। বিভা আসার পর চুপচাপ ছিল। আকাশীর দ্বিধা হচ্ছিল, তাকে কিছু বলতে। কিন্তু তার মধ্যে আলাদা একটা শক্তি আছে। সে শক্তি তাকে বলে দ্বিধা মানুষকে পিছিয়ে নেয়। যে কাজে রিস্ক থাকলেও অন্তরায় তদ্রূপ ভালো ফল আছে, সে রিস্কের ক্ষেত্রে দ্বিধাকে কাটিয়ে উঠা উচিত। আকাশী বলল, ‘এদের সাথে কথা বল। এই পরিবেশের সাথে নীরবে কথা বল। মানুষের সাথে দুঃখ শেয়ার করলে অনেক সময় মন হাল্কা হয় না, কারণ অনেকে ছল করে। কিন্তু এদের সাথে করলে তা হবে না। ওরা ওদের মনোমালিন্য তোর মধ্যে প্রবেশ করাবে। ওরা দেখ, শান্তিতে আছে। তুই ওদের সাথে কথা বললে ওরা তোকে তাদের জগতে নিয়ে গিয়ে মনে শান্তি এনে দেবে। তাতে অক্ষম হলে এই অসীম আকাশের গহ্বরে ঢোকার চেষ্টা কর। তুই সফল হবি না, কারণ এই আকাশের কোনো সীমা নেই। তখন তুই আকাশের কাছে নিজের মিল খুঁজে পাবি। ভাববি, যেমনি সামান্য একটা গন্ধ যেভাবে পুরো একটা ঘরকে সুগন্ধে শোভাশিত করে তুলতে পারে, তেমনি আমাদের জীবনের ছোটখাটো দুঃখ আমাদের পুরো মনের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে দগ্ধ করে ফেলে। আমাদের মনটাও এই আকাশটার মতো বিশাল। ওই সামান্য দুঃখ সীমা পেরিয়ে বেরুনোর চেষ্টা করে। কিন্তু মন আর আকাশ এই দুটোর সীমা নেই। এজন্য আকাশের সাথে মনের বন্ধুত্ব করাতে পারিস। আকাশ তার বিশাল জায়গার এক অংশে তোর পাঠানো দুঃখের স্বীকারোক্তিকে ঠাঁই দেবে। বিনিময়ে আকাশ তার অভ্যন্তরের সুখের এক টুকরো তোকে দেবে। অনেক ভালো লাগবে। অনেক।’
বিভা এই নীরব ভাষায় কথা বলার কৌশল রপ্ত করল কিনা আকাশী বুঝল না। তবে শেখাতে পেরে ভালো লাগছে। কেউ একজন দুঃখকে জয় করে উঠতে তো পারবে। দু’জনই নীরব বসে রইল। একসময় বিভা ওঠে চলে যাওয়ার পথ ধরল। আকাশী রাত দশটা নাগাদ বসে রইল। ক্রমে আরেকটা দিন কাটল। ওপার থেকে ভালো কোনো খবর আসছে না। আজমের জ্ঞান এখনও ফেরেনি।
তৃতীয়দিন আকাশী আর তার বোনদের নিয়ে অনিক হাসপাতালে পৌঁছানোর পর আজম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। পৃথিবী থেকে একটা প্রাণ কমে গেছে। গেছে বললে ভুল হবে। গিয়েছিল। আকাশী ভাবে, এই লোকটি একসময় তার মতো উড়তে চাওয়া এক পাখি ছিল। কিন্তু সংসারের চাপ পড়ায় তাঁর ডানাগুলো ক্ষয়ে গিয়েছিল। একজন শৌখিন লোকের শখ থেকে বঞ্চিত হতে হলে তার মানসিক মৃত্যু হয়। মনের মৃত্যু একপ্রকার শারীরিক মৃত্যুই। এই লোকটি পরিবারের দায়ভার নেওয়ার জন্য শরীরকে এতদিন সজীব রেখেছিলেন।
.
আকাশী সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ল। তাকে সহজে এক জায়গায় কেউ পায় না। দিনের পর দিন যায়, তার খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হয় না। তার জীবনের অন্তিম মানুষটা চিরতরে হারিয়ে গেছে। কখনও আসবেন না সেই না ফেরার দেশ থেকে। আভা, প্রভা, অনিকের বড় বোন নিশিতা সবাই তাকে দেখতে এসেছে। কিন্তু আকাশী এই পরিচিত চেহারাগুলোকে চিনেও চিনতে পারল না। এই পৃথিবী আর তার মানুষগুলো তার জন্য বড় অচেনা হয়ে গেছে।
কিছুদিন পর আকাশীর পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষাগুলো নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বে সে দিয়ে চলেছে। রাতের বেলায় পড়ায় মন বসে না। সকালের দিকে মনটা হালকা থাকে। তখনই বাকি পড়াগুলো সে কভার করার চেষ্টা করে। গত চারটা মাস রাতদিন করে সে যেটুকু পড়ালেখা করেছে তার ভারের কারণেই এখনের পড়ার কমতি বাবার মৃত্যু পরীক্ষার প্রিপারেশনের ওপর প্রভাব ফেলছে না।
ক্রমে সে পরীক্ষা দিয়ে ফেলল। পরীক্ষার পর সে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে, তাদের নতুন বাড়িটা এখন আজমের অনুপস্থিতিতে হাহাকার করছে। সে আজ বুঝতে পারছে, কেন বাবা মরিয়া হয়ে তাদের জন্য কিছু করে গেলেন। মৃত্যুর পথযাত্রী কত সহজেই না মৃত্যুর রূপ দেখতে পায়! পথযাত্রীর অন্তর কীভাবে যেন জেনে ফেলতে পারে আগামীতে শরীরের মৃত্যু হতে চলেছে। কিন্তু এই উপলব্ধির কথা কাউকেই বলা যায় না। উপলব্ধির কিছু লক্ষণ অবশ্য দেখা দেয়। কিন্তু মরে যাওয়ার আগে টের পাওয়া বড়ই দুঃসাধ্যকর ব্যাপার। মানুষ কত অদ্ভুত! তার প্রাণই বা কম কিসে!
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার