আকাশী পর্ব ১৭

“আকাশী”
পর্ব ১৭.

আকাশী গেইট খুলে ভেতরে পা রাখতেই ঈষৎ শিউরে উঠল। নতুন পরিবেশ, নতুন একটি জায়গা। একা একাই আনাড়ি হাতে সকল কাজ করতে হবে। একাই পথ চলতে হবে। আগেও একা ছিল সে, এখনও একা। কিন্তু কে বুঝে এই একাকীত্বের মিষ্টত্ব? একা থাকলে কাউকে কৈফিয়ত দিতে যেতে হয় না। নিজের ভালো-খারাপ কাজের ক্রেডিট নিজেকেই দেওয়া যায়। নিজের করা ভুল কাজের থেকেও নিজের শিক্ষা নেওয়া যায়। এই স্বাধীনতা আর কোথায়! হয়তো ভালোবাসার চেয়েও দামি এই জিনিস। ভালোবাসা ছড়িয়ে থাকলে সাফল্য হাতের মুঠোয় আসে না। না চাইতেই তখন অনেকের কাছে আপনদের ভিড়ে শিকলে বন্দি থাকতে হয়। তাদের সুখ কোথায়!
আকাশী কাগজপত্র নিয়ে কলেজে ঢুকে পড়ল। নিজ গ্রাম থেকে দূরে এই কলেজ। এখানকার পরিবেশ অনেকটাই উন্নত। বারান্দায় ছেলেমেয়েরা কথা বলছে। পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছে না। কিছুদূর পর পর গুচ্ছ গুচ্ছ আড্ডাবাজ দেখা যাচ্ছে। কেউ পড়তে এসেছে। আর কেউ হয়তো এমনি। আকাশী কয়েকটা অফিসে দৌড়াদৌড়ি করে অবশেষে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গার্জিয়ানদের মাঝে ঠেলাঠেলি করে ফরম ফিল আপ করল। আশেপাশে যতদূর চোখ যায়, দেখা যায় প্রতিটি মেয়ে গার্জিয়ান হিসেবে বাবা-মা বা ভাই যে-কাউকে সাথে এনেছে। কিন্তু তার বাবা কী ভাই নেই। মা থাকলেও সে হয়তো মা’টার সন্তান নয়। মাধ্যমিক পরীক্ষায় নিজ প্রচেষ্টায় প্রথম বিভাগে সে উত্তীর্ণ হয়েছিল। জড়িয়ে ধরার জন্য কাউকে সে খুঁজে পায়নি। বাবার যাওয়ার পর মা অনেক ভেঙে পড়েছেন। নিজের খেয়ালও নিজে রাখতে পারেন না। বিভার বিয়েটা হয়ে গেল। অমন পাত্র হাতছাড়া করতে নেই, তার সাথে সম্বন্ধ করতে যাওয়া লোকটির মৃত্যুর কথা শুনে যে কিনা দৌড়ে আসে। বিভার বর্তমান স্বামী দৌড়ে অবশ্য এসেছিল। কিন্তু তার হৃদয়ের মতো স্বচ্ছত্ব তার পরিবারের কারোতে নেই। কে জানে বিভা সুখে আছে কিনা। মায়ের সাথে তার একতরফা জমে না। মা এখনও মাঝে মাঝে মনে করেন, বিভার কারণেই তাঁর কপাল খারাপ হয়েছে। পীড়িত ব্যক্তিকে কে বুঝায় নিয়তির রেখা! সে আপন রেখা বানিয়েই তা অনুসরণ করতে শেখে। বিভা এজন্য মা’কে কিছু বলতে যায় না। তাই জানা হয়ে ওঠে না বিভার মনের অবস্থার কথা। বাবার যাওয়ার পর বাসার ভেতর যেন সাগরের উৎপত্তি হয়েছে। তারা ডুবে যাওয়ার পর কিনারা পাচ্ছিল না। দুটো মানুষের ভরণপোষণের ধার কেউ ধরে না। বাবার দেওয়া টাকা থেকে মায়ের গোপনে জমানো টাকা থেকেই সংসার চলছে। কেউ কেউ করুণা দেখিয়ে আকাশীর জন্য সম্বন্ধ এনেছে। অভাবের বশে মা তাকে দিয়েই ফেলতে চেয়েছিলেন। তার কাছে মা’র মন ভাঙতে হলো। সে বলেছে, ‘আমি বিভার কথা কিংবা আপুদের কথা জানি না। কিন্তু তাদের মতো অসুখী আমি হতে চাই না। কাউকে করতেও চাই না। আমি বিয়ে করব না এমন কথা নয়। বিয়ে করব, তবে এমন একজনকে, যাকে পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব, তদ্রূপ সেও আমাকে নিয়ে তাই ভাববে। আমি বিয়ের পর অসুখী থাকলেও অতৃপ্ত থাকতে চাই না। তাসফিয়ার মতো স্রেফ সংসারের কথা ভেবে মরার আগে বারবার মরতে চাই না। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর কিছু হয়ে গেলে আমি নিজের ভার নিজে নেওয়ার মতো কোনো কূল পাব না। পড়াশোনা আমি চালিয়ে যাব। হোক তা নিজ আয়ে। একদিন আমার দিকে কেউ ফিরে না তাকালে আমি নিজেকে নিয়ে উঠে দাঁড়াব।’
কথাগুলো মায়ের মনে কাঁটার মতো ফুটল। তবে তিনি কিছু বলেননি। তাঁকে এই যাবৎ মেয়ের কোনো জামাইও চালায়নি। নিশ্চিত আকাশীর ক্ষেত্রেও তাই হবে। বিয়ে দেওয়া- না দেওয়া এক। তাছাড়া সে নিজের ভার নিজে নিয়ে নিলে ভাবার আর কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, ভালো পাত্র হাতছাড়া না করার জন্য তিনি কিছুটা পীড়াপীড়ি করেছিলেন। তারপর হাল ছেড়ে দিলেন, এই মেয়েকে কখনও মেয়ের মতো করে ভাবেননি বিধায়। একদিক থেকে এই কারণেই আকাশী রেহাই পেয়েছে। নইলে বিভার মতো করে বাধ্য মেয়ের মতো শ্বশুরবাড়িতে পা রাখতে হতো। তার স্থলে সে পড়াশোনা না থামিয়ে টিউশন করছে। অবশ্য ফরম ফিল আপের পর্যাপ্ত টাকা জোগাতে পারেনি। আকাশী ব্যাগ থেকে বাবার শেষবার আনা সেকেন্ডহ্যান্ড ছোট মোবাইল বের করে অনিকের নাম্বারে ফোন দিলো। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর সে কেটে দেয়। ওপাশ থেকে বিদেশী নাম্বার থেকে কল এলো। অনিক হেসে বলল, ‘কী? কেমন আছিস?’
‘এইতো ভালো। তুই কেমন আছিস?’
‘যেমন থাকি।’
‘কেমন থাকিস?’
‘দিব্যি আছি। টাকা ইনকাম করি। দুইহাতে খরচ করি। আবার ইনকাম করি। মাঝখানে রেস্টের সময় একটু ফুর্তি করি।’
‘কেমন ফুর্তি?’
‘সব না হয় নাই বললাম।’
‘সুদূর দূরের বিদেশে থেকে তোদের এই তো মজা, মুখে মদের বোতল ঠুকে নিশ্চিন্তে ডগডগ করে গেলা যায়।’
অনিক একটু হাসল, ‘তুই মেয়েটা এতকিছু কী করে বুঝিস?’
‘বুঝার অনেক উপায় আছে। আমার বুঝার উপায়টা হলো, আমি নিজেকে অন্যের জায়গায় ভেবে দেখি। বুঝে ফেলি তার স্থলে আমি কী করতাম।’
‘তাহলে তুই ছেলে হলে আমার মতোই হতি?’
‘ছেলে তো হইনি। তোর মতো ওই পরিস্থিতিও আসেনি। ওইটা নিয়ে কথা কেন! আচ্ছা শোন, তোকে থ্যাংকস বলার ছিল।’
‘কেন রে?’
‘কেন মানে? আমার অবস্থার কথা জেনে নিজ দায়িত্বে হাজার চারেক টাকা পাঠিয়ে দিলি। নইলে ফরম ফিল আপের এই টাকা পেতাম কই? টিউশনি তো সবে শুরু করলাম। তবে বলে রাখলাম, একদিন এই টাকা ফেরত দেবো।’
‘থ্যাংকস দেওয়ার মতো এখানে কিছু নেই। তোর বন্ধু হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে। ওইটাই করলাম। আর হ্যাঁ, আমি কখনও লাভ না দেখে কিছু করি না। তোর কাছ থেকে আদায় করে নেওয়ার সময় করে নেব।’
‘তা দেখা যাবে। ফরম ফিল আপে কিন্তু তিন হাজার টাকা লেগেছে। এক হাজার বেঁচে গেছে। তা তোকে কী করে পাঠাই?’
‘পাঠানোর প্রয়োজন নেই। ওই এক হাজার টাকা আমাকে কিছুই দিতে পারবে না। তিন হাজার টাকা দায়িত্ব আর এক হাজার টাকা বকশিশ ছিল ভেবে মনে রেখে দে।’
আকাশী মৃদু হেসে ফোন রেখে দপ্তরির নির্দেশে ওপরের তলায় ওঠে এলো। ওখানে ওর বয়সীই একটি মেয়ে ওড়না দুই কাঁধে ছড়িয়ে মাথা নিচু করে লম্বা একটি মোবাইল টিপছে। মোবাইল দেখে নিজেকে আজ গরিব বলে বোধ হচ্ছে। আগে কখনও দামি মোবাইল ফোন না পেলেও তারা নিম্নবিত্ত পরিবারের ছিল না। বাবা বেঁচে থাকলে মেয়ে বড় হওয়ার দায়ে নির্ঘাত একটি পাঠিয়ে দিতেন। অন্তত সেকেন্ডহ্যান্ডের চেয়ে তা ঢের ভালো হতো। পরক্ষণে আকাশী নিজের বোরকার দিকে তাকিয়ে সব ক্লেশ ভুলে গেল। মেয়েটির পরিচ্ছদ অনুযায়ী মোবাইলটা স্যুটেবল। অপরপক্ষে ওর নিজের পোশাক অনুযায়ী ভদ্রঘরের মেয়েদের হাতে তার কাছে থাকা মোবাইল স্যুটেবল। যার যার পরিবেশে যেমন মানায়! এসব দামি কিছুর লালসা ওর নেই। যাই আছে, তাই নিয়ে সন্তুষ্ট। ভাবতে গেলে একদিকে অনেকের কাছে সেটুকুও নেই। অনেকের কাছে পরার জন্য এই বোরকাও নেই। গ্রামের ব্যাপার যেন ভিন্ন। ওখানে শাড়ি পরে ঘুরা যায়। ছোটবেলা থেকে অভ্যস্ত বলে তেমন কেউ খারাপ চোখে দেখে না। দেখলেও তা এতদূর কলেজে আসার সময় তার দিকে দেখে থাকা মানুষের সংখ্যার সামনে কিছুই না। অগত্যা শরীর ঢাকতেই হয়। কিন্তু সে মুখ ঢাকার ক্ষেত্রে কিছুটা কৃপণতা করেছে। যাদের ভয়ে সে নিজেকে ঢেকে চলে, তাদেরও মানুষ হিসেবে নিজেদের চোখকে সংযত রাখা উচিত। কেবল সে-ই কেন দায়িত্ব পালন করে চলবে! এখানে ওর মতো অনেক মেয়েই আসে, একান্ত নিজ লক্ষ্যের প্রয়োজনে। সেক্ষেত্রে মুখ ঢাকা রেখে অনেক কাজই স্বাধীনভাবে করা যায় না। পানি খেতে গেলে ঢের ছেলে থাকে। তাই বলে কি মুখ ঢাকা রেখে তৃষ্ণাকে সহ্য করে যেতে হবে? আর শিক্ষকের কাছে ভালো একটা স্টুডেন্ট হিসেবে নিজেকে প্রদর্শন করার জন্য ঢাকা মুখে অনেক দ্বিধা ভরে থাকে। কথা বলতে হয় চিৎকার করে। তাই সে মুখ ঢাকা না রাখাকেই নিয়ম বানিয়ে ফেলেছে। চোখকে সংযত আর গায়ের ভাঁজকে ঢাকা রাখলেই অনেককিছু ঠিক থাকবে। কেবল কিছু বদলোকের জন্য মনে অনেক গ্লানি জমে। মাঝে মাঝে মন বলে উঠে, নিকাব পরা উচিত। পরক্ষণে মনের আরেক কোণ বলে উঠে, কিছু চিপ লোকের জন্য নিজেকে কেন বঞ্চিত রাখবি? তাদের নজরের কারণেই নিজেকে অনেককিছু থেকে বঞ্চিত রেখেছিস, এরচেয়ে অধিক কিছু তোর না করাই শ্রেয়। তাদেরও দায়িত্ববোধ আছে, নিজের চোখকে সংযত রাখার। সে ওই কথাই এখন মান্য করে। এও মান্য করে, তার মুখের কাঠিন্য ভাব দেখে অনেকে হয়তো ওই দায়িত্ববোধের সাথে পরিচিত হবে।
আকাশী ভেবেছিল ক্লাস হবে না। কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে ক্লাসে চলে গেল। অনিচ্ছাটা ক্ষণকাল পর প্রশান্তিতে রূপান্তরিত হয়। নতুন প্রতিষ্ঠানের নতুন গন্ধ নিতে ফার্স্ট ক্লাস করাই উচিত। নানা শিক্ষক পরিচয় দিচ্ছেন, পরিচিত হচ্ছেন। নিজের সম্বন্ধে বলছেন। আকাশীর কাছে জীববিজ্ঞানের শিক্ষককে অধিক ভালো লেগেছে। বাসায় ফেরার পর তাঁর একটাই কথা আকাশীর কানকে বারবার খাঁড়া করে দেয়, আমি একটি নাম্বারের জন্য ওই বড় চাকরিটা পেলাম না। সত্যিই কি একটা নাম্বারের এতই মূল্য? আকাশীর মনে পড়ে যায়, নিরানব্বই টাকার সাথে এক টাকা যোগ করলে তবেই একশ টাকা হয়। মৃদু হাসে সে। কলেজ থেকে ফিরে এসেছে একরাশ অভিজ্ঞতা নিয়ে। একহাজার টাকাটা সে নিজের জন্যই রেখে দিয়েছে। তা থেকে কিছু টাকা দিয়ে সে একটি ডায়েরি কিনে এনেছে। ডায়েরির খুব শখ। আগে কেবল টুকটাক লেখা সে লিখত। এখন অভিজ্ঞতার অধ্যায় খুলবে। কাপড় ছেড়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে সে লিখতে বসল ডায়েরিতে। প্রথম পৃষ্ঠায় নিজের পরিচয় লেখার জন্য খালি রেখে পরিবর্তি অধ্যায়ে তারিখ লিখে সে লিখতে শুরু করল। শিরোনাম হিসেবে লিখেছে, ‘কলেজে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here