“আকাশী”
পর্ব ২৭.
আকাশী কাপড় গুছানোয় মগ্ন। সালমার আগমন টের পেয়ে সে বলল, ‘তোর বুঝি সময় কাটছে না?’
‘হুঁ’, সালমা রোকসানার বিছানার একপাশে বসল।
‘আমারও তাই। ভাবছি, হাতে কোনো কাজ নেই। একবার খামারের দিকে যাব। তুই কি যাবি?’
‘না ভাই। আমার এই রোদে হেঁটে ওখানে যাওয়ার ইচ্ছে নেই।’
‘বৃষ্টি যেরূপ একটা নিয়ামত, রোদও তাই।’
‘তোর কাছে এমনটা হতে পারে। আচ্ছা থাক ওকথা। তোর মন খারাপ নাকি? এই টাইমে তো ওখানে তেমন যাস না।’
‘মন খারাপ না।’ আকাশীকে কিছুটা বেখেয়ালি দেখায়।
‘তোর বলার ধরন দেখেই তো মন খারাপের আভাস পাচ্ছি। কী হয়েছে বল তো।’
আকাশীর কাউকে দুঃখ শেয়ার করা ভালো লাগে না। সালমা বান্ধবীর ন্যায় অতিরিক্ত ঝুঁকে পড়ায়, ওকে বন্ধুর মতো বলাই যায়। তাছাড়া মনটা কেন যেন কিছু কথা বলার জন্য বিচলিত হয়ে আছে।
‘আমি কাউকে আমার মনের কথা বলতে চাচ্ছি। কিন্তু সাহসই হচ্ছে না।’
সালমার সবে নেওয়া শ্বাসটা গলায় আটকে যায়। তার সাথে হচ্ছেটা কী? এতমাসে কত কষ্টেই না ওই বদমেজাজি অপূর্ব ভাইয়ের সাথে বন্ধুত্ব করতে পেরেছে। আজ কয়েকটা দিনের কারণেই কি তাদের মাঝে কমানো দূরত্ব বেড়ে যাবে? এইতো, তাদের মাঝে রাগারাগির না একটা অধ্যায় ছিল! এই কয়দিনে কী এমন হওয়ায় ওসব পাল্টে গিয়ে দুজনই কাছে আসার কথা ভাবছে?
সালমা দম নিয়ে বলল, ‘কাকে?’
‘অপূর্ব ভাইকে।’
‘ওহ্।’
‘উনি আমার সামনে থাকতেও চান না, যার জন্যে কিছু বলার অবকাশ পাচ্ছি না। আমার মনে হচ্ছে একবার যদি মনের কথা ক্লিয়ারলি বলে দেই তবে.. ‘
‘তবে ভাবছিস কী?’, সালমা বিরস কণ্ঠে বলল।
আকাশী ইনিয়ে বিনিয়ে বলল, ‘আমি এই পর্যন্ত অনেক ছেলের সাথেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কথা বলেছি। হাসিমজা করেছি, এসাইনমেন্ট কম্পলিট করেছি। বন্ধু হিসেবে চোখে চোখ রেখেও কথা বলেছি। কাউকে নিয়ে আদৌ মনে কিছু উদয় হয়নি। কিন্তু অপূর্ব ভাইয়ের মতো বড় কোনো ছেলের সংস্পর্ষে গিয়ে এই ধরনের সিরিয়াস পর্যায়ের কথা বলার পরিস্থিতি আসেনি। তাই একটু…’
সালমা বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, ‘তাহলে একটি চিঠি লিখে দে না। সামনা-সামনি তো অনেক কথাই গুছিয়ে বলা যায় না। চিঠিতে সবকিছু ব্যক্তও হবে। তার মন পর্যন্তও পৌঁছাবে।’
‘গ্রেট আইডিয়া।’ আকাশী উত্তেজিত হয়ে উঠল।
সে কাজ সেরে খাতা কলম নিয়ে বসে। বুদ্ধি দেওয়ার জন্য সালমা পাশেই ছিল। সে বলল, ‘আমার কিন্তু এসব নিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। অনেকটুকু কাজ করার সম্ভাবনা আছে।’
আকাশী লিখতে শুরু করল। সালমা থামিয়ে বলল, ‘স্টপ। করছিস কী?’
‘কী করছি?’
‘”প্রিয়” কোনো সম্বোধন হলো? তাহলে তিনি শুরুতেই বুঝে যাবেন, তুই চিঠির বাকি অংশে কী লিখেছিস। আর উনি তোর শত প্রিয় হলেও তোদের সম্পর্ক শুরু না হতেই এমনটা লেখা ঠিক নয়।’
আকাশী কাগজটা ফেলে দিয়ে নতুন একটা কাগজে চিঠি লিখে নেয়। শেষে লেখনীর সম্বোধনের সময় সালমা কিছু না বলায় সে লিখে ফেলেছে। কাগজটা ভাঁজ করার পর মনে একপ্রকার শান্তি বিরাজ করছে। যতগুলো কথা লিখেছে, সবগুলোই হয়তো সামনা-সামনি বলা সম্ভব হতো না। তার সাথে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করলেও চিঠি তো অন্তত পড়বেন। সালমা চিঠিটা নিয়ে বলল, ‘তুই এখন খামারের দিকে যেতে পারবি। এটা আমি বাসায় যাওয়ার সময় দিয়ে দিতে পারব।’
‘কিন্তু…’
‘কিন্তু কী ভাবছিস? চিঠিটা তুই লিখে হাতে হাতে দিবি? এটা কেমন কথা, যে লিখে সে দেয় নাকি? অন্যের মাধ্যমে পাঠায়।’
‘ঠিক বলেছিস। এমনিতেও আমার দিয়ে আসার মতো অবস্থা নেই।’
আকাশী ওঠে বেরিয়ে গেল। সালমাও দায়িত্ব পালন করতে বেরিয়ে পড়ল। সে দরজায় টোকা দিলে অপূর্ব দরজা খুলল। সালমা বলল, ‘জয় ভাইয়া কি বাসায় আছেন?’ অপূর্বের জবাব দেওয়ার আগেই চিঠি তোলে ধরে বলল, ‘এই চিঠিটা..’
‘ও তো বাসায় নেই। আমাকে দিতে পারো। আমি দিয়ে দেবো।’
সালমা নিঃশব্দে চিঠি এগিয়ে দেয়। অপূর্ব চিঠি পকেটে পুরে দরজা বাঁধার সময় সালমা চলে যেতে উদ্যত হলে বলল, ‘এই জায়গায় এভাবে ওকে চিঠি কে দিয়েছে?’
সালমা যেন এই কথারই অপেক্ষা করছিল, ‘আকাশী।’
সালমার ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের একটা হাসি দেখা যায়। সে হাসি অপূর্বের মন-বিবেকে দাগ কাটল। জয়ের কাছে আকাশীর চিঠি। এর মানে কী হতে পারে? সালমার মৃদুহাসির অর্থই বা কী? অপূর্ব চিঠি নিয়ে রুমে চলে যায়। আজ আকাশীকে কিছু কথা বলার জন্য মন নিশপিশ করছে। যখন থেকে সে তার হাত গালে চেপে ধরেছে, তখন থেকেই তার বেহাল অবস্থা। বেচারি আকাশী হয়তো ভেবে রেখেছে, সে এখনও তার সাথে রাগ করে রয়েছে। কিন্তু সেরাতের ঘটনাটা তো মাত্র একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। আকাশী নির্দ্বিধায় তার সাথে নদীর পাড়ে যেতে রাজি হয়ে যাওয়ায় সে ভেবেছিল, আকাশীও তাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। ব্যস, এই কারণেই ওর পাশে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। আকাশীরও সম্পূর্ণ অধিকার ছিল তাকে অবজ্ঞা করার। এই নিয়ে তখন সে কিছুটা রাগান্বিত হলেও পরবর্তীতে তা মিটে গেছে। ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতিটার কথা ভেবেছে। আর এজন্যেই আজও সে আকাশীর নিষেধাজ্ঞার কারণে সিগারেটে হাত লাগায় না। আজ যখন সে তার হাত ধরে মনের দুঃখ প্রকাশ করছিল, তখন নিঃসন্দেহেই বলা যায়, সেও তাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে।
আরেকবার তার কাছে যাওয়াই উচিত। চেষ্টা করে দেখা উচিত, তার মনের কথা বলার। তখন যাই হোক দেখা যাবে। আকাশীর মনে তাকে নিয়ে কিছু না থাকলেও সে বলে দিতে পারবে। ভেবে মনটা হাল্কা হয়েছিল। কিন্তু এই চিঠিটা আসার পর আর সালমার বিদ্রূপের হাসি দেখার পর সকল আনন্দই উবে গেছে। চিঠিটা সে কি পড়বে? না, কারো ব্যক্তিগত চিঠি সে পড়বে না। বিছানার একপাশে তা ফেলে দিয়েছে। আবারও চোখ ওটার দিকে যায়। হ্যাঁ -না এর মাঝে ঝুলে থেকে অপূর্ব নিজেকেই শোধালো, আকাশীর কাতরতায় আজ সে ভালোবাসা দেখেছে। তাকে পুড়ে দেওয়ায় সে যেভাবে লজ্জিত হয়েছে, তাতে স্পষ্টই ধারণা করা যায়, অপূর্বের ক্ষমা না মিললে তার মন কোনোভাবেই তৃপ্ত হতো না। সে হিসেবে আকাশী তো তারই হলো। যদি তার সাথে জয়ের বন্ধুত্ব হয়ে থাকে, তবে তার প্রিয়তমার চিঠি পড়াতে তো কোনো দোষ নেই। সে তড়িঘড়ি করে চিঠি খুলে পড়তে শুরু করল।
“চিঠির শুরুতেই সালাম নেবেন। কারো বলায় আমি আপনাকে আপাতত কোনো সম্বোধন দিচ্ছি না। যে কথাটি বলার জন্য এই চিঠি লেখার পথে যাওয়া, তা কীভাবে শুরু করব তাও বুঝতে পারছি না। আসলে এরকম পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়িনি। এমনকি আমি সামনা-সামনিও বলতে পারছিলাম না।
আমার জীবনের একটাই মোটিভ ছিল, আজীবন একা থেকে সংগ্রাম করব। আপনি হয়তো জানেন, মেয়েরা উপরে কিছু প্রকাশ না করলেও তারা অভ্যন্তরে প্রত্যাশিত কাউকে নিয়ে অবশ্যই ভাবে। বলা যায়, সংকল্পের মাঝে আমিও অন্যান্য মেয়েদের মতো স্বপ্ন দেখি, আমার জীবনে একটি প্রিন্স চার্মিং আসবে। আমাকে তারই প্রেমের জগতে নিয়ে যাবে। এসব কথা গোপন থাকলেও, মনের একটি জায়গা জুড়ে আছে। আজকালকার মেয়েরা সমঝোতার মাধ্যমে কারো সাথে সম্পর্কে গিয়েই প্রেমে পড়ে কিংবা তাদের জীবনে প্রেম নিজেই আসে। আমি সবসময় দ্বিতীয়টার জন্য বসেছিলাম। ভাবতাম, কারো প্রেমে পড়লে তবেই কিছু ভাবব। যাকে বিয়ে করার সাধ্য আছে, নিঃসন্দেহে তাকেই ভালোবাসতে যাব। আমাকে এই ধরনের কত ছেলে রিলেশনে যেতে বলেছে, আমি তাদের বলে দিয়েছি, প্রেম থাকলেই সম্পর্ক হবে। সমঝোতার সম্পর্ক ভালো লাগে না। তাছাড়া আমি ছেলেদের দিকে ঝোঁকারও চেষ্টা করতাম না। যদি প্রেমে পড়ে যাই? প্রেম তো আর বলে-কয়ে আসে না। তাই ওদের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতাম, যাতে অন্তত একটা ক্যারিয়ার গড়ে ফেলতে পারি। কিন্তু এখন এমনটা আর হচ্ছে না। প্রকৃতি অবশেষে আমাকে প্রেমে হাবুডুবু খেতে ছেড়েই দিয়েছে। আমি আমার অজান্তেই কাউকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। অন্তত কাল পর্যন্ত তো তা ধরতেও পারিনি।’
চিঠিতে আবেগ দিয়ে লেখা এটুকু পড়ে অপূর্বের হাত কাঁপতে লাগল। ঘামতে লাগল সে। খুশিতেও যে কাঁপুনি আছে, তা তার অজানাই ছিল। সে পুনরায় পড়ে গেল। সম্ভবত আকাশী জয়কে মনের কথাটি শেয়ার করার কথা ভেবেছে। ভাগ্যিস সে চিঠিটা পড়ছে। নইলে তাকে না বলা আকাশীর মনের এই কথা জানতই না।
‘ভালোবাসা এতো প্রশান্তির, ভালোবাসা যে এতো স্পর্শকাতর একটি অনুভূতি তা আমি কখনও ধারণাও করিনি। কারো সাথে কথা বলায়, কারো ছোঁয়ায়, কারো দেখা পাওয়ায় যে এতো তৃপ্তি লুকিয়ে আছে, তা আজই মাত্র জেনেছি। আর এটাও বলতে পারি, বিধাতা নিঃসন্দেহে আমার জন্য একটি কেয়ারফুল পারসন সিলেক্ট করেছেন। কত ভালোবাসা, কত আবেগই না তার মাঝে লুকিয়ে আছে। এগুলো কোনো মেয়ে পেলে নিঃসন্দেহে ধন্য হবেই। যদিও তার ভালোবাসাকে আমি একসময় বুঝিনি, কিন্তু আজ বুঝছি। মনে হয়, আমি অতটা দেরি করিনি।
অনেক তো লিখলাম। সবশেষে এটাই বলতে চাই, আপনি যখনই আমার ভালোবাসাকে আপন করে নেবেন, আমি নিজের সবকিছুই উজাড় করে দিয়ে আপনার মনের আকাশে চলে আসব।
ইতি,
আপনার অমূল্য ভালোবাসার প্রত্যাশী আকাশী”
অপূর্ব থ হয়ে গেল। শেষের প্যারাটা সে আবারও পড়ল। আবারও পড়ল। বারবার পড়ল চিঠিটা। এটা তো জয়ের জন্য লেখা। চিঠিতে লেখা ‘আপনি’ বলতে জয়কেই তো নির্দেশ করা হয়েছে। অপূর্বের নাম কোথায়? উপরের কথাগুলো কি আসলে অপূর্বের জন্য না, জয়ের জন্য ছিল? অপূর্ব থরথর করে কাঁপতে লাগল। তার কপালের ঘাম মুছে সে পায়চারি করতে লাগল। থেমে সে আরও কয়েকবার চিঠিটা পড়ে। একপর্যায়ে মুখস্থও হয়ে যায়। সে বারবার একটা প্যারায় এসে থমকে যায়। “কত ভালোবাসা, কত আবেগই না তার মাঝে লুকিয়ে আছে। এগুলো কোনো মেয়ে পেলে নিঃসন্দেহে ধন্য হবেই। যদিও তার ভালোবাসাকে আমি একসময় বুঝিনি, কিন্তু আজ বুঝছি। মনে হয়, আমি অতটা দেরি করিনি।” কথাগুলো জয়ের জন্যই পারফেক্ট। তার নিজের ভালোবাসাটা গোপন থাকলেও জয় তারটা প্রকাশ করিয়েও একপ্রকার ভালোবাসা দেখিয়েছে। ও আকাশীর পেছনে দিনরাত ছুটেছে। তাকে প্রসন্ন করার কোনো অবকাশ ছাড়েনি। এমনকি জীবনে সে দু’দিনের জন্য গড়া সম্পর্কের মতোও আকাশীকে ভালোবাসেনি। এবার সে প্রকৃত ভালোবাসাটা আকাশীকে বেসেছে। নইলে এতো এতো বছর তার সম্মতির আশায় অন্যান্য মেয়েদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত না। আকাশী সত্যিই একসময় জয়ের ভালোবাসাকে বুঝেনি। অপূর্বের বলা কথাটি ভেবে সে মনে করেছিল, জয় হয়তো রিলেশনে যেতেই পাগলামি করছে। ইদানীং তো তাদের মেলামেশাও কম হয় না। সালমাও তা দেখেছে। সালমার কথা মনে পড়তেই অপূর্বের কাছে তার বলা সকালের কথাগুলো মনে পড়ে যায়। সালমার বলা প্রতিটি কথা আকাশীর সাথে মিলে যাচ্ছে। আজ একদিকে জয়কে লাভ লেটার দিচ্ছে, আরেকদিকে তার হাত ধরে ক্ষমার জন্য মিনতি করেছে। সত্যিই মেয়েটা তাদের সাথে গেম খেলছে না তো? হতেই পারে। এই বয়সে মেয়েরা অনেক চালাক হয়। যার কাছে টাকা, তার পিছুই বেশি ছুটে। আকাশীকে তো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেনি যে, তাকে স্বচ্ছ বলা যায়। হতেও পারে মেয়েটি চালবাজ। তার আর জয়ের ফিলিংস নিয়ে খেলছে। নিজের সাথে অন্যায় হতে দেওয়া যায়। কিন্তু জয়ের মন তো অনেক কোমল। যদিও সে আকাশীকে চায়, জয় তার মতো মেয়েকে ডিজার্ব করে না। ইচ্ছে হলো, চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে। কিন্তু বর্ণিত শব্দগুলো যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে ভালোবাসার নামটাই উঠে যাবে। ছিঃ ভালোবাসার নাম মনে উঠলেই একরাশ ঘৃণা উদয় হয়।
সালমা বাসায় যায়নি। অপূর্বের বাসার একটু সামনে দাঁড়িয়েই বিচলিত ভাবে পায়চারি করছে। অপূর্ব ভাই চিঠিটা পড়ছে তো? শেষের দিকে তার আতঙ্কিত চেহারা দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। তাছাড়া কে না অন্যের চিঠি পড়ার ইচ্ছা রাখে? বিশেষ করে আকাশীর চিঠি অপূর্ব ভাই তো পড়ার ইচ্ছা রাখবেই। ভাবতে ভাবতে একটা মোচড়ানো কাগজ ওপর থেকে সালমার কাছে এসে পড়ল। এটি দ্বিতীয় তলার অপূর্বের রুমের জানালা থেকেই পড়েছে। সালমা খুশিতে আটখানা হয়ে বলটা তুলে দেখল, আকাশীর চিঠিই। তার মানে কারো মনে আগুন অবশ্যই লাগছে। একটু ফুঁ দিলে মন্দ হয় না। সালমার এ নিয়ে আর চিন্তা করতে হলো না। কারণ তখন সে অপূর্বকে বাসা থেকে বেরিয়ে ক্ষেতের মাঝের রাস্তার দিকে যেতে দেখল। সালমা এখন খুশিতে আত্মহারাই হয়ে গেছে। জয়ভাই আগেই আকাশীকে খুঁজতে খামারের দিকে গিয়েছিল। আকাশী এর একটু পরই ওখানে গিয়েছে। এখনও তারা দুজন ফেরেনি। তার মানে তারা এখনও ওখানে আছে, একে অন্যকে পেয়ে গল্প জুড়িয়েছে। এই দৃশ্যটা উত্তপ্ত এই অপূর্ব ভাইও দেখবে। ব্যস, আর কখনও আকাশীর দিকে তাকানোর কথা ভাববে না। তার চাওয়ার মানুষ শুধুই তার। আকাশী ভুল কাউকে চেয়ে বসেছে।
.
আকাশীর পুরো দিনটা একপ্রকার অস্থিরতায় কেটেছে। এমন কখনও আগে ঘটেনি। যাকে পায় তাকেই ঝাপটে ধরছে। সালমাকে তো সকল কথাই বলে দিয়েছিল। বলে খুব আনন্দও লেগেছে। জয়ের সাথে দেখা হলেও সে গাল-গল্প জুড়িয়ে দিয়েছে। যদিও সে অপূর্বের কথা তাকে জানায়নি, তবে সে ছোটখাটো কথাও অনেক আনন্দের সাথে জয়কে বলছিল। জয়ও হয়তো চমকে গেছে আকাশীকে এতো অকপট হতে দেখে। ভাবতেই আকাশীর লজ্জা করল। আগে এতটা ফ্রি সে হয়নি। মন এতটা লাফায়নি। কে জানে, চিঠি পড়ে অপূর্ব ভাই কেমন রিয়েক্ট করেছে। ভাবনায় ছেদ পড়ল সালমার আগমনে। সে বিরস মুখে এসে বসায় আকাশী উঠে পড়ে বলল, ‘কী হয়েছে সালমা?’
সে মোচড়ানো কাগজটা এগিয়ে দেয়, ‘ভাইয়া ফেলে দিয়েছে।’
আকাশীর মুখের উজ্জ্বলতা মুহূর্তেই মিইয়ে গেল। কোথায় গেল সেই অস্থিরতা, সেই উত্তেজনা! আকাশী কাগজটা খুলে সত্যিই দেখল, তার চিঠি। আচ্ছা, ভাইয়া এখনও তার সাথে রাগ করে থাকেননি তো? না, তিনি তো সকালে ক্ষমা করে দিয়েছেন, ভদ্র ব্যবহারও করেছেন। সে সাপেক্ষে চিঠিটা ছুঁড়ে না ফেলে অন্তত বলে দিতে পারত, এখন তোমাকে আমি আর ভালোবাসি না কিংবা অন্য কিছু। এভাবে চিঠি ফেলে দেওয়ার মানে কী? আকাশীর মনে পড়ে গেল, সে জয়ের সাথে কথা বলার সময় রাস্তার দিকে বাইকের যাওয়ার মতো শা করে একটা আওয়াজ হয়েছিল। অপূর্ব ভাই সম্ভবত তাকে জয়ের সাথে কথা বলতে দেখেছে। এজন্যই হয়তো রাগ করে বসেছেন। যতই হোক, ছেলেরাও তার পছন্দের মানুষকে অন্যের সাথে সহ্য করতে পারে না।
সে বলল, ‘উনি হয়তো আমাকে ভুল বুঝেছেন। হয় ক্ষমা চাইব, নয় এই প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে নেবো।’
আকাশী উঠতে গেলে সালমা তার হাত ধরে ফেলল। সে কিছু বলতে যাওয়ার আগে বাহির থেকে রোকসানার ডাক অনবরত ভেসে আসে, যেন কোনো একটা অঘটন ঘটেছে। আকাশী আর সালমা উভয়ই তৎক্ষণাৎ দৌড় লাগাল।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার