“আকাশী”
পর্ব ৪.
আকাশী নিজের মুখের ওপর পাউডার দিয়ে দেখল তাকে ভূতের মতো দেখাচ্ছে। ভূতকে সে কখনও দেখেনি। তবে অনিক বলেছিল ভূতেরা সাদা হয়। আকাশী ফিক করে হেসে দিলো।
পেছন থেকে এক কাঁপাকণ্ঠ ভেসে এলো, ‘রূপে কোনোদিক থেকে কমতি আছে নাকি? তিনবোনকে এক করলেও ওরা তোর রূপের বরাবরি করতে পারবে না। আবার পাউডার কেন? পাউডার রাখ। বিভার পাউডার শেষ করে দিস না।’
আকাশীর মুখ শুকিয়ে গেল, ‘একটু করেই লাগিয়েছি।’
‘আমার মেয়ের পাউডার রাখ বলছি।’
চিৎকার করে উঠতেই রোকসানা দুলে উঠলেন। আকাশী তড়িঘড়ি করে পাউডার রেখে রোকসানাকে ধরল।
‘মা কী হয়েছে আপনার?’
তিনি কিছুই বললেন না। আকাশী তার গা সামলাতে গিয়েই টের পেল মায়ের প্রচণ্ড জ্বর। সে কোনোভাবে তাঁকে হাঁটিয়ে এনে বিছানায় শুতে বলল। এমন সময় বিভাও নেই। সে আপসোস করে বলল, ‘ইশ! সেজ আপাও এমন সময় নেই। আমি একা কী করে..’
আকাশীকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রোকসানা ধীরভাবে বললেন, ‘বিভা নেই তাতে কী হয়েছে? তুই পারবি না? দু’পদ তরকারি রাঁধবি। আমার একটু দেখাশোনা করবি।’
আকাশী নিজেকে আশ্বস্ত করল। পানি এনে সে একটা কাপড় ভিজিয়ে রোকসানার গা মুছে দিতে লাগল। এতে রোকসানার কাঁপুনি কিছুটা কমে আসে। কিন্তু তিনি আর আগের মতো কথা বলার শক্তি পাচ্ছেন না।
আকাশীর মনে পড়ল, সে একবার ফারাবি আর তাসফিয়ার সাথে খেলতে গিয়ে পাথরের উপর পড়ে মাথা ফেটে ফেলেছিল। মা অনেক বকাঝকা করেছিলেন। শেষে তিনি সেজ আপার মাধ্যমে ডাক্তার ডাকিয়েছিলেন। আকাশী তাই করল।
বাড়ির সামনের রোড ধরে সে মেইন রোড দিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে গেল। তাঁকে সাথে করে সে নিয়ে আসে। ডাক্তার এসে তাঁর চেকআপ করলেন। তখন তিনি ভালো করে চোখ খুলতেই পারছিলেন না। আকাশী ভাবল, ডাক্তার চলে যাওয়ার পর এভাবেই ভেজা কাপড় দিয়ে তাঁর জ্বরভাব কমাতে হবে। তাই সে তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে গিয়ে দু’পদের জন্য পরিমাণ মোতাবেক সবজি কাটল।
পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে আঙুলের একপাশে কেঁটে গিয়েছে। দাঁতে দাঁত খিঁচে সে রক্ত বন্ধ করায়। এরপর তরকারি বসিয়ে দিয়ে সে ডাক্তারকে টাকা চুকিয়ে বাইরে এগিয়ে দিয়ে ওষুধ নিয়ে আসে। কাজগুলো যেন সে একের পর এক যন্ত্রের মতোই করে যাচ্ছে। যেন কেউ তার পিঠের একটি অদৃশ্য চাবি ঘুরিয়ে দিয়েছে আর সে কাজে লেগে পড়েছে। একদম ননস্টপ কাজ।
আকাশী এসে রান্নার কাজ ফটাফট সেরে নেয়। ভাজি দেখতে ভালো হয়নি। তবে ব্যাপার না। মা হয়তো ক্ষমা করে দেবেন। শতই হোক, সে সবে শিখেছে, সে মা’দের মতো রান্না করতে পারে না। আকাশী মা’কে ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিলো। তাঁর হয়তো আগে থেকে অনেকখানি স্বস্তি লাগছে।
আকাশী নীরবে আবারও পানি এনে মায়ের কপালের গলার হাতের জ্বরভাব কমাতে লেগে পড়ল ভেজা কাপড় দিয়ে। এই মা কতকিছু একাই না করে! অথচ আজ মাত্র নয়টা থেকে সে কাজ ধরেছে। এখনও সবে বারোটা। কিন্তু এরই মাঝে সে কত ক্লান্তই না হয়ে পড়েছে! তার একটিবার ইচ্ছে হলো মা’কে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু মা তাকে শেষবার কখন জড়িয়ে ধরেছিল মনে নেই। তিনি যদি আবার কিছু মনে করেন! একরাশ দ্বিধার আগে সে হার মেনে নেয়। সে পূর্ববতই মায়ের সেবা করতে লাগল। তাঁর জ্বর দেখে মাম্মার মৃত্যুর সময়ের কথা তার মনে পড়ে গেল। সেদিন রাতে এভাবে অপূর্ব ভাইয়ার জ্বর বেধেছিল। আর সে…
আকাশী আর ওদিকে গেল না। অবুঝ থাকতে যে ভুলটা করেছে, ওটা বারবার ভেবে কি লাভ? আকাশী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজ স্কুলে ক্লাস পার্টি রাখা হয়েছে। সবারই বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে। ষষ্ট শ্রেণিতে আজ তার শেষদিন। সেজ আপা হয়তো অনেক মজা করছে। করারই কথা, আজকের দিনে নো পড়াশোনা। অনলি ফুর্তি।
আর হ্যাঁ, আজই সে দিন যেদিন শিক্ষকদের আশীর্বাদ নিতে হয়। এই নিয়ে দুঃখ করে লাভ নেই। এটা সে এখানেও পূরণ করতে পারবে। আকাশী ওঠে মায়ের পা ধরে সালাম করে নেয়। সে কোথাও যেন শুনেছিল, মা-বাবাই আমাদের প্রথম শিক্ষক।
কিন্তু ফুর্তিটা? সে তো ফুর্তি করতে খুব কমই পায়। ইশ! তার ভাগ্যটা কতই না খারাপ। আজ কিনা সবাইকে একত্র করে কেক কাটা হবে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা বক্তব্য রাখবে। তাদের নিজ নিজ ক্লাসে অধ্যয়নের অভিজ্ঞতার ছোট্ট একটা গল্প পেশ করবে। অথচ আজ ওই এক্সাইটিং কাজটা সে করতে পারছে না। সে ভাবতে ভাবতেই মায়ের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙে দুপুর তিনটার দিকে বিভার ডাকে। আকাশী ধড়মড় করে ওঠে বসলো।
‘কবে এলি?’
‘এখন। মায়ের কী হয়েছে?’
‘গায়ে জ্বর। ডাক্তার ওষুধ দিয়ে গেছে। জ্বর অনেক কমেছে।’
বিভা মায়ের কপাল ধরে দুঃখ প্রকাশ করল।
‘মা’কে উঠিয়ে ভাত খাইয়ে দে।’
‘সে তো হবে।’ আকাশী উত্তেজিত হয়ে বিভার একহাত ধরে বলল, ‘আচ্ছা, সেজ আপা বল না ক্লাস পার্টি কেমন হয়েছে?’
‘ক্লাস পার্টি?’ আকাশীর হাত সরিয়ে বলল, ‘মায়ের অসুখ, আর তুই ক্লাস পার্টির কথা বলছিস?’
‘বাহ্ রে! এক তো কে ভাতটা রেঁধেছে সেই খবর নিলি না। সেবা সব আমি করলাম, তুই আসার পরও আমি করব। শেষে এসে মায়ের শুধু খবর নিয়ে অনেক বড় কাজ সেরে ফেলেছিস?’
বিভা ওঠে আকাশীর গালে স্বজোরে চড় দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেল। তার হাঁটা বলছে বিদ্যা তাকে মহারানী বানিয়েছে। এই পর্যন্ত পড়ালেখার নাম দিয়ে সে সকল কাজ আকাশীর মাধ্যমে করিয়ে এসেছে। কিন্তু পড়ালেখা তো সেও করে। তার তো এতো তেজ নেই! এইটে ওঠার পর চারিদিকেই ঢোল পিটিয়েছে ‘আমি সেকেন্ড হয়েছি’। আকাশী কখনও তো বলেনি ‘আমি ফার্স্ট ডিভিশনে টপ করেছি?’
আজ তার দু’বছরের ছোট হওয়ার দায়ে আকাশী খাবারের পরিবর্তে এই দুপুরে চড়টাই হজম করল। একবার অনিক বলেছিল, কখনও দেমাকে আগুন জ্বললে তা নিভতে না দিয়ে হজম করা উচিত। এই আগুনই তোর মধ্যে কিছু করে দেখানোর শক্তি সঞ্চয় করবে। এই কথাটি তার স্যার তাকে শিখিয়েছিল। আকাশীরও কাজে এসেছে।
সে মা’কে খাইয়ে দিয়ে কাপড় ভিজিয়ে আরও একবার তাঁর জ্বরভাব কমানোর চেষ্টা করল। এই সময় পেটে অদ্ভুত এক ব্যথা অল্প সময়ের জন্য জেগে উঠেছিল। ক্ষুধার যন্ত্রণা ভেবেই সে ঘুমিয়ে পড়ে।
রাত নেমে এসেছে। বিভা পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখন রোকসানার গায়ে জ্বর কমে গিয়ে ঘাম ছুটছে। এখন হয়তো কম, কাল আরও বেড়ে যেতে পারে। তিনি ঘুমিয়েই আছেন। আকাশী সন্তর্পণে দরজা খুলে খালি পায়েই বেরিয়ে পড়ে। জুতোর উষ্ণতা যেন ভালো লাগছে না। মাটির ঠান্ডা ভাবটাই তার মনের ভাবটাকে পাল্টে দিয়ে মনে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে দিয়ে গেল। মাঝে মাঝে বাড়িতে বৈঠক বসে। আজও বসেছে। যাবতীয় মুরুব্বি আর বাচ্চারা ভিড় জমিয়েছে। এসব আসর তার খুব ভালো লাগে। কিন্তু সে এসবের জন্য বের হয়নি। তবু কয়েকজনকে সে সালাম করে দোয়া নেয়।
অপূর্বের বাসার সামনে দরজায় দুইবার টোকা দেওয়ার পর পরিচারিকা দরজা খুলেছে। এই পরিচারিকার বাসায় তেমন কোনো ভূমিকাই নেই। স্রেফ দরজা খুলতে আর ছোটচাচুর লাইব্রেরি পরিষ্কার করতেই তাকে দেখা যায়। আকাশী অপূর্বের রুমে চলে এলো। অপূর্ব ভেবেছিল পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য তারা আজ থেকে আসবে না। কিন্তু আকাশীকে দেখে সে অখুশিও হচ্ছে না। সে বলল, এসো। আকাশী গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে অপূর্বের পায়ে হাত দেয়।
‘ও কি! এভাবে সালাম কেন করছ?’
আকাশী উঠে বলল, ‘আপনি আমার যে সহযোগিতাটা করেছেন, তা আমি কখনও ভুলব না ভাইয়া। আজকে শিক্ষকদের কাছ থেকে তো দোয়া নিতে পারিনি। দোয়া করবেন যেন এই পরীক্ষায়ও আমি ভালো কিছু একটা করে দেখাতে পারি।’
‘শোন, এই দোয়া জিনিসটা সবসময় সবাই পায় না। তুমি এখন থেকেই প্র্যাকটিস করো নিজেকে চেনার। নিজের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস থাকলে তুমিই সবসময় জয় হবে, হারলেও জিতবে।’
সে নিজেকে কখনও বিশ্বাস করতে শেখেনি। এই বিশ্বাসটা ছিল না বলেই সে কাউকে মুখ খুলে বলতে পারে না, আমি এটি করে দেখাব। এমনকি সমাপনীর আগেও নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস না থাকায় কারো সামনে মুখ তুলে বলতে পারেনি, আমি ভালো রেজাল্ট করার সক্ষমতা রাখি। কিন্তু এসবকিছু শেখানোর জন্য কাউকে তো প্রয়োজন হয়ই। আজ অপূর্ব ভাইয়ার কাছে সে পড়তে আসে এই দায়ে তিনি একজন সহকারী হিসেবে কাজগুলো করছেন।
যদি তার কাছে পড়তে না আসত, তখন তো তার কোনো অস্তিত্বই থাকত না। এখন তিনি আছেন, কিন্তু সবসময় তো তিনি থাকবেন না। কাল বাদে পরশু হারিয়েই যাবেন। তখন কেউই তাকে আশ্বাস দেওয়ার থাকবে না। আকাশী ডুকরে কেঁদে ওঠে অপূর্বের কোমর জড়িয়ে ধরল। অপূর্ব কিছুই বুঝতে পারছে না। সে আকাশীকে কখনও কিছু দেয়নি বা আপন করে দেখেনি। কিন্তু কী কারণে সে এভাবে তাকে জড়িয়ে ধরেছে? কিসের তার অভাব? এমতাবস্থায় অপূর্ব তাকে ছাড়াতেও পারছে না।
তবু বলল, ‘আকাশী, এভাবে কেঁদো না। বসো এখানে। মা তোমার আর বিভার জন্য একজোড়া করে কাপড় কিনেছেন। দাঁড়াও, নিয়ে আসছি। দেখলে তোমার ভালো লাগবে।’
আকাশী তাকে ছেড়ে দিলো। অপূর্ব চলে গেল। আকাশী কান্না মুছে সোফায় বসতে যাওয়ার সময় তার অদ্ভুত একটা অনুভূতি জাগে। সেটা পরোয়া না করে সে বসতে গেলে পেটে সেই দুপুরের অদ্ভুত ব্যথাটা আবারও উঁকি দিয়ে উঠল। কিছুক্ষণ পর আবারও একই ব্যথা তীব্রভাবে লাগল, তলপেটের ভেতর কেউ যেন ছুরি দিয়ে পোঁচ দিয়েছে।
আকাশী ঠোঁট কামড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়। তৎক্ষণাৎ সে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এলো। এ কি হয়েছে তার? হাতটায় রক্ত এখনও লেগে রয়েছে। কী করবে? বাড়িতে কীভাবে যাবে? মা’কে কীভাবে বলবে? যেবার সে মাথা ফেটে ফেলেছিল, সেবার সামান্য রক্ত ঝরায় মা কত বকুনিই না দিয়েছিল। আজ তো তার চেয়ে বেশিই পড়ছে। থামছে না। এখন কী করবে সে? আকাশী ওয়্যারড্রো-এর পাশে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপভাবে কাঁদতে লাগল। অপূর্ব এসে বিরক্ত হয়ে বলল, কান্না এখনও করছ? দেখ, ফ্রকটা কেমন হয়েছে? নাও এগুলো।
আকাশী নিতে পারছে না। সে কান্না চাপাতে পারছে না। অপূর্ব এবার আরও বিরক্ত হয়ে কাপড় দেওয়ার জন্য তার হাত টেনে নেয়। হাত দেখে সে আঁতকে উঠল।
‘আরে রক্ত? কী হয়েছে তোমার?’
আকাশী কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘আমি মরে যাব। মা আমাকে মারবে।’
‘কোথায় কেটেছে বল তো?’
‘এমনিই রক্ত ঝরছে। কেন জানি না।’
অপূর্ব থমকে দাঁড়ায়। একটু ইতস্তত করে বলল, ‘এভাবে কেঁদো না। যাও, হাতটা ধুয়ে ফেল।’
আকাশী হাত ধোয়ার পর অপূর্ব বলল, ‘চল, আমি তোমাকে দিয়ে আসি।’
‘না, মা বকবে।’ আকাশীর কাঁপুনি কিছুটা কমল।
‘কিছু করবে না। এসো, সামনে অনেক লোক। চল, তোমাকে পেছন দিক দিয়ে নিয়ে যাই।’
অপূর্ব আকাশীকে নিয়ে পেছন দিকের পরিত্যক্ত জায়গা দিয়ে তার বাড়ির পেছনে এসে দাঁড়ায়।
‘এখান থেকে চলে যাও। তোমাকে আমিই এনে দিয়েছি, একথা কাউকে জানাবে না।’ বলে অপূর্ব দূরে সরে দাঁড়ায়।
আকাশী পেছন দিকের দরজার কড়া বেশ কিছুক্ষণ নাড়ার পর রোকসানা তাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। অপূর্ব তখনও কোণোয় আড়িপেতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওপাশ থেকে প্রথমে আওয়াজ আসে, ‘কী হয়েছে?’ এর কিছুক্ষণ পর শোনা গেল, ‘আয়, এদিকে আয়।’
আওয়াজটা মিলিয়ে গেল। অপূর্ব চিন্তিত হয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দেয়। কী দোষ এই মেয়েটির? মেয়েদের এই পরিবর্তনের কথা কি বয়স হলে কেউ আগে থেকে জানিয়ে রাখতে পারে না? বেচারি, কত ভয়ই না পেয়েছিল। মা আর তিনটে বোন থাকার সত্ত্বেও মেয়েটি কতই না অবহেলিত! আর এসব বিষয় কি কেউ মায়ের গর্ভ থেকে জেনে আসে?
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার