কলঙ্কের ফুল পর্ব ১৯

#কলঙ্কের_ফুল
#পর্ব_১৯
#Saji_Afroz
.
.
.
-বাবার সাথে মেয়েটিকে পাঠিয়ে দিলেই ভালো হবে।
.
আমজাদ চৌধুরীর মুখে এমন কথা শুনে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে সালেহা চৌধুরী প্রশ্ন করেন-
কেনো?
-দেখে বুঝছোনা কেমন পরিবারের লোক এরা?
-কেমন?
-মধ্যবিত্ত…..
-তাতে সমস্যাটা কি?
-আহ সালেহা! আমাদের সাথে কোনদিকে মিলে তাদের?
-তারাও মানুষ আমরাও মানুষ।
-বোঝার চেষ্টা করো সালেহা। সানিয়াই আদির জন্য ঠিক আছে।
-সেটা আদিকেই বুঝতে দাওনা তুমি!
-আমরা বুঝালে…
-দেখো, আমাকে একদম হাবিজাবি বুঝাতে আসবেনা। মেহেরীকা হলো আদির বউ এখন। প্রেমিকা নয়। তাই আর ঝামেলা না করে তুমিও মেনে নাও। আর মেহেরীকার বাবাকেও মানতে বলো।
.
স্ত্রীর যুক্তির সাথে না পেরে আমজাদ চৌধুরী হতাশ কণ্ঠে বলেন-
হুম।
.
.
.
কেনো যে কথাগুলো বলতে গিয়েছিলাম! এতো আদিখ্যেতা দেখে সহ্য না হয়ে বলে ফেলেছি। বলেছি বলেছি তাও আদি সব শুনে নিয়েছে। উফ্ফ…….
আদির চোখে খারাপ হয়ে গেলাম। একটু হুঁশ নিয়ে কথা বলার উচিত ছিলো। কিন্তু আমিও কি করবো! যা প্লান করছি সবই চপাট হয়ে যাচ্ছে।
তাই মেজাজ কি ঠিক থাকে?
.
নিজের মনে কথাগুলো বলে পায়চারি করতে থাকে সানিয়া।
হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠলে হাতে নিয়ে দেখলো তার বাবার কল।
-হ্যালো আব্বু?
-মামুনি কেমন আছিস?
-আছি ভালো। তোমরা?
-ভালো। আমরা খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবো।
-হুম।
-তোর জন্য কিছু লাগবে?
-নাহ।
-মন খারাপ?
-না আব্বু, আমি রাখি এখন?
-আচ্ছা।
.
বাবার কথা শুনে সানিয়ার মুখে যেনো পৃথিবীর সব অন্ধকার এসে ভর করেছে। তার বাবা মাও চলে আসবে খুব তাড়াতাড়ি। তবে কি আর কিছুই করার নেই!
.
.
.
কিছুক্ষণ আদির দিকে তাকিয়ে কাসেম আহম্মেদ বললেন-
মেয়েটা মা মরা আমার। নতুন মা এনেছিলো কিন্তু সে মা হয়ে উঠতে পারেনি। বড় দুঃখী মেয়ে। তোমার কাছে যদি সে একটুখানি সুখ পায় আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবেনা। মেহেরীকার দায়িত্ব তোমাকে তুলে দিয়ে নিশ্চিতে থাকবো।
.
কাসেম আহম্মেদ এর মুখে এমন কথা শুনে স্বত্বির একটা নিঃশ্বাস ফেললো আদি।
তাকে মাথা ঝুকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেই অবাক হয়ে যান কাসেম আহম্মেদ।
.
মৃদু হেসে কাসেম আহম্মেদ এর উদ্দেশ্যে আদি বললো-
আমি আপনাকে নিরাশ করবোনা।
.
পেছন থেকে এক গাল হাসি নিয়ে সালেহা চৌধুরী বললেন,
আমরা আসার আগেই সব ঠিকঠাক করে ফেলেছে আমার গুণধর ছেলে! যাক কষ্ট কমিয়ে দিলো আমাদের। দেখি ভাই সাহেব এবার বসুন, মিষ্টি মুখ করুন।
-জ্বী।
.
.
.
ঘড়িতে সময় সন্ধ্যা ৭টা…..
মেহেরীকা দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। বাবা আর বোনকে এতোদিন পর দেখে ইচ্ছে করছিলো তাদের সাথে সময় কাটানোর জন্য। কিন্তু তার বাবা তাকে বাসায় নিয়ে যেতে নারাজ। কিন্তু কেনো? রাজীবের ভয়ে নাকি সমাজের ভয়ে? আচ্ছা মুনিয়া কি যেনো বলেছিলো? রাজীব তার খোঁজ করছে। রাজীব যদি তার ভুল বুঝতে পারে সে কি তাকে ক্ষমা করে দিবে? নাহ। কি করে রাজীব তাকে ভুল না বুঝে থাকবে? এখন এই বাড়ির বউ বলে জানে সবাই।
যেদিন সবাই জানতে পারবে কি হবে সেদিন! এতোগুলো মানুষকে ঠকানোটা কি ঠিক হচ্ছে?
আপনমনে এসব ভেবে মেহেরীকার চোখ বেয়ে পড়ছে অজস্র ধারায় অশ্রু।
-এই যে? ভেতরে আসো।
.
আদির ডাকে চোখ মুছে বারান্দা থেকে রুমে আসলো মেহেরীকা।
প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললো-
বাবা আর মুনিয়া বের হওয়ার পরেই তুমি বের হয়েছো সেই বিকেলে। এতোক্ষণ কোথায় ছিলে?
-তোমার জন্য মোবাইল ফোন আনতে গিয়েছিলাম।
-মোবাইল?
.
আদি প্যাকেট থেকে একটা ফোন বের করে মেহেরীকার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো-
হুম মোবাইল। এখন তোমার বাড়ির লোকের সাথে কথা বলতে পারবে। আমার সাথে পারবে যখন আমি অফিসে থাকবো, না মানে কোনো দরকার হলে করবে আরকি। তারপর গান শুনতে পারবে, সেলফি তুলতে পারবে। মোট কথা গুঁতোগুঁতি করে সময় কাটাতে পারবে।
.
মেহেরীকা মোবাইলটা হাতে নিয়ে বললো-
ধন্যবাদ।
-আমি সব ঠিকঠাক করে দিয়েছি। নতুন সিমও আছে। বাসার ফোন নাম্বার মনে আছে?
-হুম।
-গুড। তাহলে প্রথম কলটা বাসায় দাও। আর হ্যাঁ আমার নাম্বারটা আমি সেইভ করে দিয়েছি আদিয়াত দিয়ে।
.
মেহেরীকা মোবাইল হাতে নিয়ে প্রথম ফোনটা দেয় আদিয়াত এর নাম্বারে।
আদির ফোন বেজে উঠলে পকেট থেকে বের করে দেখতে পায় মেহেরীকার নাম্বার। আগেই সে সেইভ করে রেখেছিলো।
এখান থেকে এখানে কল দেওয়ার মানে কি বুঝতে না পেরে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে মেহেরীকার দিকে তাকাতেই সে ইশারায় বলে ফোনটা রিসিভ করার জন্য।
আদি ফোন রিসিভ করতেই মেহেরীকা বলে উঠলো-
প্রথম কলটা তোমাকে দেওয়া উচিত নয় কি? যেহেতু ফোনটা তুমিই উপহার দিয়েছো?
.
মৃদু হেসে আদি বললো-
হু।
.
মেহেরীকা বাবার নাম্বারটা ডায়াল করে এগিয়ে যায় বারান্দার দিকে।
-হ্যালো কে?
-আমি বাবা।
-মেহেরীকা মা! তুই? অনেক বেশি মনে পড়ছিলো তোর কথা।
-হুম। এটা আমার ফোন নাম্বার। এখন থেকে যখনি ইচ্ছে হবে আমায় ফোন দিয়ে কথা বলে নিবে।
-হুম মা।
-আজ থেকে গেলে কি হতো বাবা?
-মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থাকতে নেই রে মা।
আমরাতো কিছু নিয়েও গেলাম না। খালি হাতে গিয়ে নাস্তার সাথে দুপুরের ভাতটাও খেতে হলো। তোর শ্বাশুড়ির জন্য আসতে পারিনি।
-বড় ভালো মানুষ বাবা তিনি। এই বাড়ির সকলেই অনেক বেশি ভালো। আমার ননদ দেখেছো? সেও খুব ভালো। কলেজ থেকে এসেছিলো বলে হয়রান ছিলো নাহলে সে কথার ফুলঝুরি খুলে বসতো।
.
মেহেরীকার কথা শুনতে পাচ্ছে আদি। কতো তাড়াতাড়ি সবার সাথে মিশে গিয়েছে সে। ঠিক যেনো সত্যিকারের বউ এই বাড়ির। তবে আজ মেহেরকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছে আদি। মেহেরের মুখে কখনো বলতে শুনেনি তার মা নেই আর সৎ মায়ের কথা। আর এখন তার বাবাকেও বলে যাচ্ছে এই বাড়ির সকলে অনেক ভালো। এতো ভালো কেনো এই মেয়েটা? একটা মেয়ের মাঝে এতোগুলো গুণ কিভাবে বিদ্যমান থাকে আদি বুঝে উঠতে পারছেনা।
.
.
.
রাত ১১.১৫…..
রান্নাঘরের কাজ শেষে নিজের রুমে গিয়ে চমকে যায় মিলি।
বিছানায় ফুলের পাপড়ি ছিটানো। বিছানার পাশে ছোট টেবিলটার উপরে অনেকগুলো রজনীগন্ধা ফুল রাখা। মেঝেতে হরেকরকমের বেলুন, আর যেটির উপর চোখ যায় তা হলো সোফার উপর রাখা একটা শাড়ি।
মিলি এগিয়ে গিয়ে দেখতে পায় শাড়িটার উপর একটা চিরকুট। তাতে লেখা-
১০মিনিট সময় দিচ্ছি। শাড়িটা পরে তৈরী হয়ে নাও। অনেকদিন পর আজ আমার বউটাকে একটু অন্যভাবে দেখতে চাই।
.
আরিফ করেছে এসব? আরিফ! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা মিলি। আজ কি তাদের বিবাহ বার্ষিকি নাকি তার জন্মদিন না? নাহ কিছুতো না। তবে কেনো? এইরে ১০মিনিট সময় দিয়েছে। এতো ভেবে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।
.
.
.
মুনিরার কাছে থাকা মেহেরীকার ফোনটা বেজে উঠলো।
সবে মাত্র চোখটা লেগে এসেছিলো মুনিয়ার। আর এখুনি ফোন….
একরাশ বিরক্তি নিয়ে সে ফোন রিসিভ করে বললো-
হ্যালো কে?
-নাম্বারটাও কি ডিলিট করে দিয়েছো? যাক, আমি রাজীব।
-ডিলিট করিনি। ঘুমোচ্ছিলাম এতোদিন পর শান্তিতে। তাই এতো কিছু দেখতে ইচ্ছে করেনি।
-এতোদিন পর শান্তিতে ঘুমানোর কারণ কি? মেহেরের কোনো খোঁজ পেয়েছো?
.
রাজীবের মুখে এই কথাটি শুনে ঘুম পালিয়ে যায় মুনিয়ার। তার বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে রাজীব যেনো মেহেরীকার কোনো খবর না পায়।
আমতাআমতা করে বললো-
না পাইনি।
.
মুনিয়ার কণ্ঠ শুনে রাজীব হেসে বললো-
মিথ্যে খুব একটা বলতে জানোনা।
.
এবার মুনিয়া একটু গম্ভীর গলায় বললো-
কে বলেছে আপনাকে আমি মিথ্যে বলছি? মোটেও মিথ্যে বলছিনা আমি।
-এখন আর গলা গম্ভীর করে লাভ নেই। আমার মেহের কোথায় সেটা বলো।
-বললামতো আমি জানিনা। যখন তখন ফোন করে আমায় একদম বিরক্ত করবেনা।
.
কথাটি বলেই ফোনের লাইন কেটে দিলো মুনিয়া।
.
এদিকে রাজীব বুঝতে পারে মুনিয়া মিথ্যে বলছে। মুনিয়া ঠিকই জেনেছে মেহেরের খবর। তবে তাকে বলতে সমস্যা কোথায়? সেতো আপনকরে নিতেই চাইছে মেহের কে। নাহ, কোথায় একটা গোলমাল নিশ্চয় আছে।
.
.
.
-তুমি বলবানা কোথায় গেছিলা আজ তোমরা?
.
রেশমা আহম্মেদ এর মুখে এই প্রশ্নটা শুনে কাসেম আহম্মেদ বললেন-
সব তোমার জানতে হবেনা।
-আমি তোমার বউ। জানতে হবে।
-আমি বলতে বাধ্য নয়।
-ও। ঠিক আছে, বলিও না। তোমার আদরের ছোট মেয়ের গায়ে যখন আগুনের ছ্যাঁক দিবো, গরগর করে সব কথা বলে দিবে সে।
.
এই কথাটি শুনে কাসেম আহম্মেদ এর মেজাজ বিগড়ে যায়।
আচমকা শোয়া থেকে সামান্য উঠে সে রেশমা আহম্মেদ গোলা টিপে ধরেন।
এদিকে রেশমা আহম্মেদ ছটফট করতে থাকেন। সেদিকে লক্ষ্য না দিয়ে কাসেম আহম্মেদ বলেন-
তোর মুখে যেনো আমি আমার মেয়েদের নামও না শুনি। অনেক করেছিস তুই। অনেক আগেই তোকে মেরে ফেলা উচিত ছিলো আমার। শোধরাবি শোধরাবি করে অনেক দেখেছি। আর না।
এক মেয়েকে বাড়ি ছাড়া করে তোর শান্তি হয়নি? আরেকবার আমার মেয়েদের উপর খারাপ নজর দিয়ে তাকালেও তোর চোখ আমি উপড়ে ফেলবো।
.
এপর্যায়ে নিঃশ্বাস বড় হয়ে আসে রেশমা আহম্মেদ এর। তা দেখে কাসেম আহম্মেদ তাকে ছেড়ে দিয়ে হনহন করে এগুতে থাকে ছেলের রুমের দিকে। আজ রাতটা ওখানেই কাটাতে হবে তার।
.
.
.
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে মিলি দেখতে পায় আরিফ দাঁড়িয়ে রয়েছে বিছানার পাশে।
মিলি তার দিকে এগিয়ে যেতেই আরিফ বলে উঠে-
সময় দিয়েছিলাম ১০মিনিট। আরো ৫মিনিট দেরী করেছো তুমি।
-তো?
-তো? আমার ৫টা মিনিট ক্ষতি করে দিলে। জানো জীবনে ১মিনিটের কতো দাম?
-জানি। কিন্তু তোমার কি ক্ষতি করলাম এটা জানিনা।
-এই যে আরো ৫মিনিট আগে আসলে ৫মিনিট আগেই রোমান্স শুরু করতে পারতাম।
.
আরিফের মুখে এই কথাটি শুনে মিলি এক পা পেছনে ফেলতেই আরিফ তার হাত ধরে টেনে নিজের বুকের মাঝে তাকে আবদ্ধ করে ললো-
এতোদিন যা করেছি আমি অন্যায় করেছি তোমার সাথে, যা আমার একদম উচিত হয়নি। আমাকে ক্ষমা করা যায়না মিলি?
.
পরম আবেশে চোখ জোড়া বন্ধ করে মিলি জবাব দিলো-
হু।
-এবার বলো তোমার কি চায়?
অনেকদিন কিছু দিইনি তোমায় তুমিও কিছু খুঁজোনা।
.
আরিফের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে মিলি বললো-
আমারতো কিছু চাইনা। তবে এই চৌধুরী বাড়িটার চায়।
.
অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আরিফ প্রশ্ন করে-
কি চায়?
-ছোট ছোট বাবুরা পুরো বাড়িটা মাতিয়ে রাখুক।
.
মিলির কথা শুনে দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে তার কোমর চেপে আরিফ বললো-
তবে আসো, মিশে যাই দুজনে?
.
.
.
মেহেরীকাকে নিয়ে লেখা কবিতাটি নিয়ে ভাবছে আদি।
কবিতাটি মেহেরীকাকে দেখালে সে কি রেগে যাবে? যেতেই পারে। কিন্তু আদিতো তাকে সত্যি ভালোবেসে ফেলেছে। এটা কি সে মেহেরকে বুঝাতে সক্ষম হবে বা মেহের কি বুঝবে?
.
হঠাৎ রুমের আলো জ্বলে উঠলে চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে আদি।
.
মেহেরীকা তার দিকে এগিয়ে এসে বললো-
আমি একটু তোমার পাশে বসবো।
.
আদি শোয়া থেকে বসে মেহেরীকার উদ্দেশ্যে বললো-
বসো।
.
মেহেরীকা বসতে বসতে বললো-
তোমার কি মনে হচ্ছেনা আমরা সবাইকে ঠকাচ্ছি?
-হুম।
-যেদিন আমাদের বাসার সবাই এসব জানতে পারবে সেদিন কি হবে?
-ফেলে দিবেনা তারা কেউ আমাদের।
-তা জানি। কিন্তু আমি অনেক ভেবেছি। আমার পক্ষে আর মিথ্যে নাটক করা সম্ভব নয়। আমি চলে যেতে চাই।
.
মেহেরীকার মুখে চলে যাওয়ার কথা শুনে আদির বুকটা ধুক করে উঠলো। সে কিছুতেই যেতে দিতে পারেনা তার মেহেরকে। ভালোবেসে আগলে রাখতে চায় তাকে। কিন্তু কিভাবে তাকে জানাবে মনের কথা? এসব শুনে যদি আরো বিগড়ে যায় সে? নাহ, অন্য ব্যবস্থা করতে হবে আপাতত।
.
-কি হলো?
.
মেহেরীকার ডাকে হালকা কেশে আদি বললো-
আমাদের মাঝে একটা ডিল হয়েছিলো। মাঝপথে এভাবে আমাকে বিপদে ফেলে তুমি যেতে পারোনা। দেখছোই সানিয়া এখনো আমাদের বাসায় পড়ে রয়েছে। এর মধ্যে তুমিও যদি চলে যাও তাকে আমার গলায় সবাই মিলে ঝুলিয়ে দিবে।
-মেয়েটা তোমাকে ভালোবাসে বলেই পাগলামি করছে।
-এটাকে ভালোবাসা বলেনা মেহের। জেদ বলে জেদ। সত্যিই যদি সে আমাকে ভালোবাসতো আমাকে সুখে থাকতে দিয়ে চলে যেতো সে। এভাবে বেহায়ার মতো পড়ে থাকতোনা, তার সাথে আমি খুশি থাকবোনা জেনেও।
-কিন্তু…..
-কোনো কিন্তু না। যতদিন না আমি সানিয়ার কাছ থেকে পুরোপুরিভাবে মুক্তি পাচ্ছি তুমি কোথাও যেতে পারোনা। কথার খেলাপ তুমি করতে পারোনা মেহের।
-আর যদি প্রমাণ হয় সানিয়া তোমাকে সত্যি ভালোবাসে? তোমার জন্য নিজেকে পরিবর্তন করছে?
.
ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আদি বললো-
সেদিন আমি ওকে মেনে নিবো।
.
.
.
সকাল ৮টা……
অফিস যাওয়ার সময় মেহেরীকাকে দেখতে না পেয়ে আদি নিজের রুমে যায় মেহেরীকার খোঁজে।
রুমের ভেতর প্রবেশ করতেই বাথরুম থেকে মেহেরীকার বুমি করার শব্দ পায় সে। তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গিয়ে বাথরুমের দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে বললো আদি-
মেহের? এই মেহের? ঠিক আছো তুমি?
.
কোন সাড়া না পেয়ে কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার আদি বললো-
মেহের? দরজা খুলো।
.
মেহেরীকার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে এখুনি পড়ে যাবে সে। কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে বাথরুমের দরজা খুলতেই সেখানে ঢুকে পড়ে আদি।
.
-তুমি এভাবে ঢুকে পড়লে কেনো? বাইরে যাও। আমি বাথরুমের মেঝে থেকে বুমি গুলি পরিষ্কার করে আসছি।
-আমি করে দিচ্ছি, তুমি যাও।
-আরেনা। তুমি কেনো!
-এই আর এমন কি মেহের! পানি ঢেলে দিলেই হয়ে যাবে। যাওতো।
.
মেহেরীকা বের হয়ে এসে বিছানার উপর হেলান দিয়ে বসলো
কাল রাতে পরিবার, রাজীব সবাইকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে একটুও ঘুম হয়নি তার। তাই এখন শরীরটা আরো খারাপ লাগছে।
.
আদি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বললো-
আজ অফিসে যাবোনা। ভাইয়াকে বলে আসি।
-কেনো?
-ডাক্তারের কাছে যাবো তোমাকে নিয়ে।
.
শান্ত গলায় মেহেরীকা বললো-
কালও চলে এসেছো তুমি অফিস থেকে। এইরকম করলে বাবা রাগ করবেন। তাছাড়া আরিফ ভাইয়াও কাজের চাপ থেকে বের হতে পারবেন না।
-কিন্তু….
-কোনো কিন্তু না। আমার কিছু হয়নি। কাল রাতে ঘুম কম হয়েছে বলেই একটু খারাপ লাগছে। এইরকম শরীর খারাপ ঘুম না হলেই হয় আমার।
-আগেও হতো?
-হু।
-ঘুম হয়নি কেনো?
-উহু… দেরী হচ্ছে তোমার।
-আচ্ছা যাচ্ছি। তবে আজ রাতে আমার সাথে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে তোমায়। বলো যাবে?
-হু।
.
.
.
আদি বের হতেই মেহেরীকা ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করে তার নিজের ফেলে আসা সেই নাম্বারে। কাল রাতেই জেনেছে ওটা এখন মুনিয়ার কাছে থাকে।
-হ্যালো মুনু?
-আপুই, তুই এতো সকালে?
-আমার মোবাইল থেকে আনিকার নাম্বারটা নিয়ে দে।
.
আনিয়ার বফ এর বন্ধু হলো রাজীব। আপু কি কোনোভাবে রাজীব ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে?
.
-কি হলো মুনু?
.
মেহেরীকার ডাকে চিন্তার জগৎ থেকে বের হয়ে মুনিয়া বললো-
আপু তুইকি রাজীব…..
-আমি আনিকার সাথে কথা বলতে চাই। আর আনিকাকে নিষেধ করলে কখনো সে আমার কথা রাজীবকে জানাবেনা।
তুই নাম্বারটা নিয়ে আমায় সেন্ড কর।
-ঠিক আছে।
.
.
.
-কি ব্যাপার পিকু? তোমার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা আজকাল? বিয়ের ভয়ে চুপ হয়ে আছো নাকি?
.
দিবার কথায় হালকা কেশে পিকু বললো-
কি যে বলোনা বেবি তুমি! কাজের চাপে আছি একটু।
-আমার বাসায় কবে প্রস্তাব নিয়ে আসবে বলো?
-খুব তাড়াতাড়ি আসবো। একটু কাজের চাপটা কমুক কেমন?
-হুম।
-গাল ফুলিয়েছো?
-না।
-ঠিকতো?
-হুম।
-এইতো, ভালো বেবিটা আমার! আচ্ছা আমি ব্যস্ত আছি, এখন রাখি ফোনটা?
-ঠিক আছে।
.
.
.
মুনিয়া, আনিকার নাম্বার সেন্ড করতেই মেহেরীকা ডায়াল করে সে নাম্বারে।
কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে রিসিভ করে বললো-
হ্যালো কে?
-আনিকা?
.
এতোদিন পরেও এই কণ্ঠটা চিনতে ভুল করেনি আনিকা। খুশিতে বলে উঠলো সে-
মেহেরীকা তুই!?
-চিনতে পেরেছিস তাহলে?
-কেনো চিনবোনা! কোথায় আছিস তুই? কেমন আছিস? আর এতোদিন যোগাযোগ কেনো করিসনি? আর তোর বাবা জানে তোর কথা?
-আস্তে আস্তে। এতো প্রশ্ন একসাথে করলে উত্তর কোনটার দিবো?
-সবগুলোর দে হারামি।
-আচ্ছা শুন, ভালো আছি আমি। চৌধুরী বাড়িতে আছি ফাতেহা ঘোনার। বাবা কাল জেনেছে আমার কথা।
-ওখানে কি করে?
-এই বাড়ির ছোট ছেলের বউ হয়ে।
-মানে?
-সেই অনেক কথারে। তোর কাছে একটা অনুরোধ, রাজীব যেনো আমার খবর জানতে না পারে।
-হুম।
-এবার বল তোর কি খবর?
রায়হান ভাইয়া কেমন আছে?
-ভালো আছে। ২দিন পরেই আমাদের বিয়ে। তোর কথা বড্ড মনে পড়ছিলো।
-কি বলিস! তোদের বিয়ে?
-হুম। আমি তোর শ্বশুরবাড়ি যেতে পারবো? সকলকে দাওয়াত দিবো, তোর বরকে দেখবো আর তোর কাহিনী শুনবো।
-কেনো আসতে পারবিনা! আসিস।
-তাহলে আজ বিকেলেই আসবো। বিয়েরতো আর দেরী নেই।
-সমস্যা হবেনা তোর?
-ধ্যাত কিসের সমস্যা!
-বিয়েতে যেতে পারি কিনা জানিনা কিন্তু তুই আয়। অনেক কথা আছে তোর সাথে।
-তাহলে এখন রাখি। বিকেলে দেখা হবে।
-আচ্ছা।
.
ফোন রেখে লম্বা একটা দম ফেলে মেহেরীকা।
রায়হান আর আনিকার বিয়ে হবে। তাদের প্রেম সফলতা পেতে চলেছে। কিন্তু তার আর রাজীবের বিয়েটা হতে হতেই ভেঙ্গে গেলো। এমন একটা দিন চলে এসেছে, সে তার বেস্ট ফ্রেন্ড এর বিয়েতেই যেতে পারবেনা তাও রাজীবের জন্য!
এসব ভেবে মেহেরীকার চোখের কোণায় চলে আসে বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণা।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here