আকাশেও অল্প নীল পর্ব -০২+৩

#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ০২
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৩,
“সকাল সকাল কোথায় গিয়েছিলি ভাই?”

বাসায় ঢুকতেই বোনের প্রশ্নের সম্মুখীন হয় দিগন্ত। ড্রইং রুমের সোফায় বসে আছে দিগন্তের বোন স্নেহা। দিগন্ত বোনের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়,

“সকালবেলায় আমি কোথায় যাই, সেটা তুই জানিস আপু।”

স্নেহা অবাক হয়না ভাইয়ের উত্তরে। রোজকার ঘটনা এটা। সে উঠে দাড়ায়। দিগন্তের উদ্দেশ্যে বলে,

“খাবার টেবিলে খাবার সার্ভ করে দিচ্ছি। এসে খেতে বোস।”

“হু আসছি।”

দিগন্ত রুমে চলে যায়। স্নেহা গিয়ে টেবিলে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করে দিতে ব্যস্ত হয়ে পরে। দিগন্ত রুমে এসে প্রথমেই গোসল করতে চলে যায়। খানিকটা সময় নিয়ে গোসল সেরে রুমে আসে। ওয়ার্ডড্রব থেকে কাপড় বের করে স্কুলে যাওয়ার জন্য একেবারেই রেডি হয়। পড়াশোনা শেষে বাবার রেখে যাওয়া নিজেদের প্রাইভেট স্কুল পরিচালনা করে দিগন্ত। সেখানে কেজি থেকে দশম শ্রেণী অব্দি শিক্ষাব্যবস্থা আছে। স্নেহাও তার সাথে থেকে সব কাজে সাহায্য করে৷ দিগন্তের বাবা গত ৬বছর আগেই মারা যান। এতোদিন সবকিছু স্নেহা নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি সামলে রেখেছিলো। দিগন্ত পড়াশোনা শেষ করতেই স্নেহা সব দায়িত্ব ভাইয়ের উপর অর্পণ করেছে। স্নেহা দিগন্তের থেকে ২বছরের বড়ো। বয়স ২৯পেরিয়ে ৩০এর কোঠায়। তবুও ভাইকে একা ছেড়ে বিয়ের কথা চিন্তা করতে পারেনা। দিগন্ত বোনের উপর বিয়ের জন্য প্রেশার দিয়েও রাজী করাতে পারেনি। কিন্তু এভাবে তো জীবন চলে না। এবার বেনের বিয়ে দিতেই হবে। দিগন্ত রেডি হতে হতে আনমনে এসবই ভাবছে। দিগন্ত রেডি হতেই স্নেহার ডাক পরে। দিগন্ত চলে যায় ডাইনিং টেবিলে। বোনের সাথে বসে পরে খাবার খেতে৷ খাওয়ার মাঝেই স্নেহা বলে,

“মা এসেছিলো তোর সাথে দেখা করতে।”

দিগন্ত সবে জুসের গ্লাস টা হাতে নিয়েছে। স্নেহার মুখে কথাটা শুনেই গ্লাসটা ফ্লোরে ছুড়ে মা’রে। বোনের দিকে তাকিয়ে বলে,

“সবকিছু জেনেশুনে এই কথাটা তুই কেনো তুলিস আপু? আমায় রাগিয়ে কি শান্তি পাস তুই?”

“আমার উপর তুই রাগ করতে পারিস ভাই?”

দিগন্ত শান্ত হয়ে যায় স্নেহার এক কথায়। টেবিলে শান্ত হয়ে বসে পরে। স্নেহা দিগন্তের কাধে হাত রেখে বলে,

“তোর মায়ের উপর থেকে রাগ টা কি কমবেনা?”

“ঘৃণা করি উনাকে। তুই প্লিস আর উনার কথা আমায় বলবিনা।”

“আচ্ছা বলবোনা। খেয়ে নে৷”

দিগন্ত বোনের কথা অনুযায়ী হালকা একটু খেয়েই উঠে চলে যায় স্কুলের উদ্দেশ্যে। স্নেহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

সোফায় বসে আছেন আজাদ সাহেব এবং উনার স্ত্রী শাহনাজ বেগম। উনাদের সামনে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে রাইমা। আরফান তো বোন শা’স্তি পাবে এই খুশিতে মিটমিট করে হাসছে বোনের দিকে তাকিয়ে। রাইমাদের পিছু পিছু আসা লোকটি আজাদ সাহেব এবং শাহনাজ বেগমের পিছনের জায়গা টায় অবস্থান করছে। আজাদ সাহপব এবার মুখ খুললেন। গুরুগম্ভীর গলায় বললেন,

“তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি কি দিনদিন হাঁটুতে নেমে যাচ্ছে রাইমা? গতকাল রাতে সামান্য একটা বিষয় নিয়ে খুটিনাটি তর্ক করেছো মায়ের সাথে। আর সাত সকালে উঠেই বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পরেছিলে?”

রাইমা বাবার গলার স্বর শুনেই বুঝতে পারে বাবাকে আজ আর মানানো যাবে না। এতোটা গম্ভীর স্বরে তার বাবা তখনই কথা বলে, যখন সন্তানদের দ্বারা উনার মনঃক্ষুণ্ন হয়। রাইমা করুণ চোখে বাবা মায়ের পিছনে অবস্থানরত লোকটার দিকে ইশারা করলো। শাহনাজ বেগম তা লক্ষ্য করলেন। বললেন,

“আজ যতোই মাহাদের দিকে তাকাও! কাজ হবে না। তুমি ভুলে গেছো তুমি এখন যথেষ্ট বড়ো হয়েছো। বিয়ে দিলেই বাচ্চার মা হয়ে বসে থাকবে। সেখানে আজও তুমি তোমার মা বাবাকে চিন্তায় রাখো। দিনদিন তোমার বেয়াদবির মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে রাইমা।”

লোকটার নাম মাহাদ, সম্পর্কে রাইমার বড়ো খালামনির ছেলে। শাহনাজ বেগম এবং আজাদ সাহেব যথেষ্ট ভরসা করে মাহাদকে। সেজন্যই সাত সকালে মেয়েকে পুরো বাড়ি খুজে না পেয়ে বোনের ছেলেকে খবর দিয়েছিলেন যেনো রাইমাকে খুজে পেতে মাহাদ সাহায্য করে। বিষয়টা রাইমা সিড়ি বেয়ে বাসায় ঢুকতেই ঢুকতেই জানতে পারে মাহাদের কাছে। পুরো ঢাকা শহরে আত্মীয় বলতে একমাত্র মাহাদের পরিবারই কাছে আছে রাইমাদের। আর বাকি সবাই গ্রামে নতুবা অন্য শহরে। সেজন্য কোনো সমস্যা হলে সবর আগে খোজ পরে মাহাদের। আর সেই নিয়ম চক্রেই আজও রাইমাকে না পেয়ে শাহনাজ বেগম বোনপুত্রকে খবর দিয়ে এই সাত সকালে এনেছেন ডেকে। মাহাদদের বাসার দূরত্ব রাইমাদের বাসা থেকে মোটামুটি আধঘন্টা সময়ের। সেজন্যই সাত সকালে মাহাদকে দেখে অবাক হয়েছিলো রাইমা। আনমনে যখন মাহাদের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবতে ব্যস্ত রাইমা, তখনই আজাদ সাহেব ফের মেয়েকে প্রশ্ন করলেন,

“আমাদের এভাবে টেনশনে ফেলে কি শান্তি পাও তুমি?”

“বাবা বিষয়টা যতোটা জটিল ভাবে দেখছো তুমি, বিষয়টা ততোটা জটিল নয়। আমি এমনিই সকালবেলা হাঁটতে বেরিয়ে বাসা থেকে এতোটা দূর চলে গিয়েছিলাম। খেয়াল করিনি, যখন খেয়াল হলো, ততোক্ষণে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিলাম। তাই ফিরতে দেরি হলো।”

মাহাদ রাইমার কথা বলার ধরণ দেখেই ধরে ফেলে রাইমা মিথ্যে বলছে। রাইমার দিকে সন্দিগ্ধ চাহনীতে তাকায় মাহাদ। রাইমার মিথ্যা বলার স্বভাব নেই, ঠোট কাপে। আজও কথাগুলো বলতে গিয়ে একই অবস্থা হলো রাইমার। শাহনাজ বেগম রাইমার কথা শেষে বললেন,

“তোমার ফোন কোথায়? ফোন দিলাম, রিসিভ করলেনা। এরপর থেকে ফোন সুইচ ওফ দেখালো। ফোন কি করেছো?”

“আসলে মা আনমনা হয়ে হাঁটছিলাম তো৷ তুমি কল করায় ফোনের দিকে তাকিয়ে রিসিভ করতে যাবো, পিছন থেকে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠায় লাফ দিয়ে উঠেছিলাম। ফোনটা হাত থেকে রাস্তায় পরে যায়। তখনই ফোনের উপর দিয়ে রিকশা চলে যায়। আর ফোনের জান ক”বজ হয়ে যায় তাতে।”

রাইমা সব ঘটনা চেপে মিথ্যা কথা বললো আবার। মাহাদ শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে রাইমার কান্ড দেখছে। এ মেয়ে মিথ্যে বলতে পারেনা। শুধু শুধু চেষ্টা চালাচ্ছে মিথ্যা বলার। মাহাদ পরপর রাইমা দুটো মিথ্যা কথাই ধরে ফেলেছে। শুধু একবার সুযোগ হোক, মিথ্যা বলার কারণটাও জেনে নেওয়া যাবে। আজাদ সাহেব আর শাহনাজ বেগম একই সাথে মেয়ের দিকে বাকশূণ্য হয়ে তাকিয়ে আছে। শাহনাজ বেগম বললেন,

“রাইমা, তুমি যে মিথ্যা বলতে পারো না ঠিক করে। এটা তুমি জানো?”

“কি বলছো মা! আমি যা বলেছি সত্যি বলেছি। তুমি শুধু শুধু আমায় ভুল বুঝছো। রাখো তো এসব। আমার ক্ষুধা পেয়েছে। খেতে দিবে কিছু? আমি ফ্রেশ হতে গেলাম।”

রাইমা বাবা মায়ের প্রশ্নের হাত থেকে মুক্তি পেতে দৌড় লাগায় রুমে। উপস্থিত সকলে শুধু অবাক নয়নে রাইমাকে এক পলক দেখে নিলো।

৪,
বাসার ছাদে চায়ের কাপ হাতে দাড়িয়ে আকাশ দেখছে রাইমা। ভাবছে তার কি মন খারাপ! নাকি ভালো? চায়ের কাপের চা শেষ। নিচে গিয়ে রেখে ভার্সিটিতে যাওয়া! অনার্স ৩য় বর্ষে উঠেছে এবার। ইচ্ছে করছেনা ভার্সিটিতে যেতে। আজ প্রচুর আলসেমি লাগছে সব বিষয়ে। সকালের মিষ্টি রোদ, হালকা শীত। পরিবেশটা দারুণ লাগছে তার কাছে। তখনই মাহাদ রাইমার পিছনে এসে দাড়ায়। কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে রাইমা পিছনে তাকায়। মাহাদকে দেখে এক মিষ্টি হাসি উপহার দেয়। বিনিময়ে মাহাদও মৃদু হাসে। মাহাদকে দেখে রাইমা বলে,

“মাহাদ ভাই, আপনি এখনও বাসায় গেলেন না যে! অফিস নেই আজ?”

” না নেই। ছুটি নিয়েছি অফিসে ফোন দিয়ে।”

মাহাদ উত্তর দেয়। রাইমা চায়ের কাপ ছাদের রেলিং এ রেখে হেলান দিয়ে দাড়ায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ভাবীর সাথে আজ ডেট আছে বুঝি?”

“তোমার উড বি ভাবী রাইমা। আগেই ভাবী বলে পুরাতন করে ফেলছো?”

মাহাদ রাইমার পাশে দাড়িয়ে সেও আকাশের দিকেই তাকিয়ে কথাটা বলে। রাইমা জবাব দেয়,

“না ভাইয়া। এখনও ভাবী হলোই না। পুরাতনের প্রশ্ন আসে কোথা থেকে?”

“তোমার ভাবীর সাথে আমার মন খারাপের পর্ব চলে রাইমা।”

“আবারও? আপনাদের এই নিয়ে কতবার মন খারাপের পর্ব আসলো সেটার খেয়াল আছে?”

“তাতে কি বলো তো? সেই দুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে। রিলেশনের এতোগুলো বছর! দিনশেষে সে আমারই। এটাই আমার শান্তনা।”

“বিয়েটা কেনো করছেন না মাহাদ ভাই?”

“তুমি জানো সব। আমায় ব্লেইম দিও না।”

“ভাবীর সাথে আমি কথা বলি?”

“বাদ দাও সেসব কথা। তোমার কাহিনী বলো তো। খালা খালুর কাছে মিথ্যা বললে কেনো?”

রাইমার হাসিখুশি মুখটায় মাহাদের এই কথায় বিষণ্নতার ছাপ নেমে আসে। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“বাদ দেন না মাহাদ ভাই। আমি চাইনা এসব এখন মনে করতে। পরে বলবো কোনো এক সময়।”

মাহাদ চোখ নামিয়ে রাইমার দিকে তাকায়। চোখের জলের রাশি থইথই করছে। টুপ করে কখন জানি ঝড়ে পরে। মাহাদ জোড় করলো না। বললো,

“রাইমা খন্দকার না হাসিখুশি মেয়ে! তার চোখে জলের আনাগোনা। বিষয়টা মেনে নেওয়া যায়না। আগামীকাল কাল সাড়ে নয়টায় নিতে আসবো। রেডি থাকবে। তোমায় নিয়েই ওর সাথে দেখা করবো। দেখি মন খারাপের পর্ব মিটে কিনা!”

রাইমা চোখের জল আড়াল করতে হাসার চেষ্টা করে। হাসিমুখে বলে,

“আচ্ছা তবে একটা কথা।”

“কি কথা?”

“আমি কিন্তু ভাবীর কাছে বিয়ের কথাটা বলবোই আগামীকাল। আপনি মানা করবেন না।”

“আচ্ছা তোমার যা ভালো মনে হয়। এখন আসি। বিকেলে দেখা হচ্ছে।”

মাহাদ চলে যায়। রাইমা আবারও একাকিনী আকাশ বিলাসে মত্ত হয়ে পরে। গুনগুনিয়ে গান বেরিয়ে আসে তার গলা থেকে।

আকাশেও_অল্প_নীল
ভুল হত অন্তমিল
একা একা রং মিছিল
ছিলে না যখন।
মুঠো ভরা মিথ্যে ফোন
ফিরে আসা ডাক পিয়ন
মিছে মিছে মন কেমন
ছিলে না যখন।

কিছু একটা মনে আসতেই গান গাওয়া থামিয়ে দেয় রাইমা। একা আর ছাদে থাকে না। চায়ের কাপ নিয়ে নিচে নেমে আসে।

৬,
পরদিন সকালবেলায়, আজ ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়েছে রাইমার। ফজরের নামাজ পর বিছানায় গা এলাতেই ঘুমিয়ে পরেছিলো। এরপর আর উঠেনি। দিনটা শুক্রবার। এজন্য ভার্সিটিতে যাওয়ার তাড়া না থাকলেও মাহাদের সাথে বেরুতে হবে, সেই তাড়া আছে। তারাহুরো করে মুখে ব্রাশ ঢুকিয়ে ওয়ারড্রব থেকে ড্রেস বের করে বিছানায় রাখে রাইমা। তখনই ফোনে টুংটাং মেসেজ আসে। ফোনট হাতে নিয়ে দেখে শার্লিনের মেসেজ। জরুরী দরকার, শার্লিনদের বাসায় যেনো ৫মিনিটে যায়। এটাই লিখেছে শার্লিন। তাড়াহুড়োর মাঝে আবার শার্লিনের ডাক। রাইমা কোনো রকমে ফ্রেশ হয়ে এসে চুলগুলো উচুতে ব্যান দিয়ে আটকে দেয়। গলায় ওরনা পেচিয়ে ফোনটা হাতে নিয়েই ছুট লাগায় শার্লিনদের বাসার উদ্দেশ্যে। ড্রইং রুমে আসতেই সোফায় বসে বাবাকে চা খেতে খেতে পেপার পড়তে দেখায় বলে গুড মর্নিং জানায়। আজাদ সাহেব পোপারে মুঝ গুজেই মেয়ের প্রতিত্তোরে গুড মর্নিং বলেন। মা-কে কোথাও দেখতে পায়না রাইমা। হয়তো কিচেনে আছে। রাইমা দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলতেই আরফানকে দেখতে পায় আইসক্রিম হাতে সে বাসায় ঢুকছে। আরফানের হাতে নিজের প্রিয় ফ্লেভারের কাপ আইসক্রিম দেখে কেড়ে নিয়ে ছুট লাগায় রাইমা। পিছনে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ভাইকে দেখে। আরফান দরজায় বসেই কান্না জুড়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন এসব দেখার সময় নেই রাইমার। ৯টা বেজে গেছে। সাড়ে নয়টায় মাহাদ আসবে। রাইমা ছুট লাগিয়ে নিচে আসে। বাসার মূল ফটক খুলে জোড় কদমে শার্লিনদের বাসার দিকে রওনা দেয়। যাওয়ার পথে আইসক্রিমের উপরের খাপটা তুলে ছুড়ে মা’রে রাইমা। ঠিক তখনই কেউ একজন চেচিয়ে বলে,

“হেই ইউ স্টুপিড গার্ল। রাস্তায় কি দেখেশুনে চলতে পারেন না আপনি। চোখ খুলে কি বাসায় রেখে এসেছেন?”

রাইমা থমকে দাড়ায়। কন্ঠস্বর টা কেমন চেনা চেনা লাগছে। সে পিছনে তাকায়। একজন পুরুষ তার দিকে রাগী চাহনিতে তাকিয়ে আছে। তার হাতে আইসক্রিমের উপরের খাপ। রাইমা ফাঁকা ঢোক গিলে। আবারও তার দ্বারা অঘটন। দুইটা দিন সকাল সকাল এসব কি হচ্ছে তার সাথে? রাইমা নিজের অবস্থানে থেকেই বলে,

“স্যরি।”

“স্যরি মাই ফুট। চোখ কোথায় থাকে আপনার। সবসময় আমার পথেই বাঁধা হয়ে আসেন আপনি।”

রাইমা আবারও গলার স্বরটা শুনে চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে তাকায়। লোকটাকে ভালো করে দেখে। চোখগুলোও গতকাল দেখা চোখগুলোর মতো লাগছে। গলার স্বরটাও একই রকম শুনতে লাগছে। লোকটাও ভ্রু কুচকে রাইমাকেই দেখছে। রাইমা হকচকিয়ে বলে,

“চেনা চেনা লাগছে আপনাকে। কিন্তু আপনাকে এর আগে দেখেছি কিনা সন্দেহ। আপনি কে বলুন তো? আমি কি করে সবসময় আপনার পথে বাধা হলাম।”

“মিস রাইমা খন্দকার! আপনি আপনার শ”ত্রুকে এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন? কিন্তু ভুলবেন কি করে? দেখুন না আমার উপর শো”ধ তোলার আপনার এতো তাড়াহুড়ো যে আমায় কোনোভাবে দেখতে পেয়েই একেবারে উল্টো করে সালোয়ার পরে বাসা থেকে বেরিয়ে পরেছেন?”

রাইমা বুঝে যায় লোকটা কে! গতকাল মুখে মাস্ক থাকায় চিনতে পারেনি। এখন চিনলো। কিন্তু লোকটা কি বললো! তার সালোয়ার উল্টো! সে নিজের দিকে তাকায়। সত্যি তো সালোয়ার উল্টো করে পরেছে সে। তার কাপড় তো তার মা গুছিয়ে রাখে। এই কাপড়টা উল্টো করেই রেখেছিলো! রাতে ড্রেস পাল্টে রাতের জন্য আলাদা সালোয়ার টপস থাকে, সেগুলো পরে ঘুমায় রাইমা। সকালে আর পাল্টানো হয়নি। আর রাতে ঘুম চোখে যেরকম ভাজ করা ছিলো, বের করে ভাজ খুলে ওরকমই পরেছে রাইমা। দেখেওনি উল্টোসিধে। এখন এই লোকের সামনে মান সম্মান আর থাকলোনা কিছু। রাইমা আর কথা বাড়ায় না। ছুট লাগায় শার্লিনদের বাসায়। এমনি এই লোকের পাল্লায় পরে অনেকটা সময় নষ্ট হলো তার। হাতের আইসক্রিম টা অনেকটাই গলে গিয়েছে। আইসক্রিম আর খাওয়া হলো না তার। ফেলে দেয় রাস্তার ধারের ড্রেনে। গলা আইসক্রিম সে খেতে পারেনা। রাইমাকে দৌড়ে যেতে দিগন্তের চোখ মুখে ভাজ পরে। আনমনে বলে,

“স্ট্রেঞ্জ, মেয়েটা পাগল নাকি! কিন্তু এতো তাড়াতাড়িই দেখা হতে হলো আমাদের!”
#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ০৩
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৭,
“আরে বইন, তোর সালোয়ার উল্টো করে পড়া কেনো?”

শার্লিনদের বাসার দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে রাইমা। কলিং বেল বাজাতেই শার্লিন এসে দরজা খুলে রাইমাকে দেখেই প্রশ্নটা করে। রাইমা শার্লিন কে সরিয়ে বাসায় ঢুকতে ঢুকতে বলে,

“দুনিয়ার সব পা’গল আমার কপালেই জুটেছে তো এই কারণে। সালোয়ার ঠিক করে আসি। ওয়েট কর।”

রাইমা সোজা শার্লিনের রুমের ওয়াশরুমে গিয়ে সালোয়ার ঠিক করে নেয়। এরপর বাইরে আসে। শার্লিন নিজের বিছানায় বসে নখ খুঁটছে দাঁত দিয়ে। রাইমা শার্লিনের পাশে ধপ করে বসে পরে। শার্লিনকে বলে,

“এতো ইমার্জেন্সি ডাকাডাকি কি কারণে বলে ফেল। আমার কাজ আছে।”

“তোর বান্ধবী অক্কা পাবার অবস্থা আর তুই কাজের তাড়া দেখাস! তোরে কি করা উচিত?”

শার্লিন ক্ষিপ্ত হয়ে রাইমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে। রাইমা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বসে। সে কি করলো! যে শার্লিন তার উপর রে’গে যাচ্ছে। সে শার্লিনের হাত ধরে আদুরে গলায় বলে,

“শালু, আমার আলুর মতো কিউট বান্ধুপী! তোর কি হয়েছে ময়নাপাখি! এমন রাগ করতেছিস কি কারণে? আমায় না বললে বুঝবো কি করে কি হয়েছে?”

“একদম ফাজলামি করবিনা রাই! আমার কান্না পাচ্ছে। ”

“কি কারণে কান্না পাচ্ছে তা তো বলবি! ওয়ান মিনিট, তুই বাসায় একা তোর ব্রিটিশ ভাই, আংকেল আন্টি উনারা কোথায়?”

শার্লিনের কান্নার দমক বেড়েই চলেছে। এরমাঝে রাইমার কথা শুনে নাক টেনে বলে,

“আমার ভাই তোর কি করেছে? আমার ভাইকে ব্রিটিশ বলবিনা আগেও বলেছি তোকে?”

“কান্না থামা তোর! কি হয়েছে তা না বলে আসছে ভাইয়ের গুণগান করতে। থা’প্পড় খেতে না চাইলে চট জলদি বল। আমার সময় নেই, এক জায়গায় যাবো আমি।”

রাইমা শার্লিনকে ধমকে কথাটা বলে। তবুও শার্লিন কাঁন্না থামিয়ে বলার নাম নেই। রাইমা ফোনে টাইম দেখে। নয়টা পয়তাল্লিশ বেজে গেছে। এরমাঝে মাহাদের একটা মিসড কলের নোটিফিকেশনও দেখতে পায় রাইমা, সাথে একগাদা মেসেজ। ফোন ভাঙার পর রাতেই জিদ ধরে বাবার থেকে নতুন ফোন কিনে নিয়েছে। ফোন ছাড়া এক কদম চলাচল করাও কঠিন। শার্লিনকে পাশ কাটিয়ে রাইমা ফোন হাতে ব্যালকনিতে গিয়ে মাহাদের কাছে কল ব্যাক করে। মাহাদ কল রিসিভ করতেই রাইমা শুনতে পায়,

“তোমাদের বাসায় বসে আছি রাইমা। কোথায় তুমি?”

“ভাইয়া আমি শার্লিনদের বাসায়। একটু ১০মিনিট অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।”

“ওকে, অপেক্ষা করছি। একটু জলদি এসো। নয়তো জানোই সে কি রকম রে’গে যায়।”

“আসতেছি ভাইয়া।”

রাইমা কথা শেষে কল কে’,টে আবারও পূর্বের স্থানে ফিরে আসে। শার্লিন চোখের পানি নাকের পানি মুছতে মুছতে একবক্স টিস্যু শেষ করে ঘরটাকে একদম ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলেছে। রাইমা সব দেখে শার্লিনে টেনে উঠা থেকে বসিয়ে দেয়। ওয়ার্ডড্রব থেকে নিজের ড্রেস কালারের সাথে ম্যাচ করে একটা ড্রেস বের করে। শার্লিনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঝাজালো স্বরে বলে,

“৫মিনিটে রেডি হয়ে আমার সাথে বেরুবি চল। নিজে তো কিছু বলবিনা। আমাকেও ছাড়বিনা। কান্নাকাটি বাদ দিয়ে তার থেকে ভালো আমার সাথে ঘুরে আসবি।”

শার্লিন মাথা দুদিকে হেলিয়ে রাইমার কথায় সম্মতি দেয়। ওয়াশরুমে গিয়ে ড্রেস পাল্টে চোখেমুখে পানি দিয়ে আসে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে চুল আচরে একটা হিজাব বের করে নিজে। হিজাবটা বেধে একপাশে ওরনা ঝুলিয়ে দেয়। ঠোটে হালকা লিপবাম লাগিয়ে চশমা চোখে লাগিয়ে রাইমাকে বলে,

“চল আমি রেডি।”

রাইমাও মুচকি হাসে নিজের বান্ধবীকে দেখে। এগিয়ে এসে শার্লিনের মাথায় টোকা দিয়ে বলে,

“পুরোই পাগলি একটা।”

“পাগলি বলেই তোর মতো পাগলির বান্ধবী আমি। এবার তোর দেরি হচ্ছে না? চল চল।”

দুজনেই একসাথে হেসে দেয় শার্লিনের কথা ফুরোতে। একসাথে বাসা থেকে বেরিয়ে পরে দরজায় তালা ঝুলিয়ে।

৮,
বাড্ডার একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে মাহাদ, রাইমা, শার্লিন। মাহাদ বারংবার হাত ঘড়িটায় সময় দেখছে। ভেতরে ভেতরে সে খুব অস্থির হয়ে পরেছে রাইমা বুঝতে পারে। সময়টা এগারোটার কা”টা পেরিয়েছে। মাহাদের ভালোবাসার মানুষটির আসার কথা ১০:৩০ এ। কিন্তু এখনও আসছেনা দেখে মাহাদ অস্থির হয়ে পরেছে। বেশ বুঝতে পারে রাইমা। শার্লিন বসে বসে আইসক্রিম খেয়ে চলেছে। এক বাটি আইসক্রিম শেষ করে মাহাদের উদ্দেশ্যে বলে,

“ভাইয়া আরেক বাটি আইসক্রিম কি পাওয়া যাবে? না মানে বসে বসে অনেক বোর হয়ে গেলাম তো।”

রাইমা চোখ পাকিয়ে তাকায় শার্লিনের দিকে। শার্লিন মুখটা কাচুমাচু করে বলে,

“রাগিস কেন তুই? আসার সময় ঠেলেঠুলে লেইট হলো লেইট হলো বলে বলে কানটার পোকা মে’রে নিয়ে আসলি। এখন এসে ৩০মিনিটের উপর হলো বসে আছি হুদাই। রেস্টুরেন্টে এসেছি, খাবো না কি করবো বল?”

“পেটুক কোথাকার! শুধু খাই খাই। আমাকেই খেয়ে ফেল বরঞ্চ।”

রাইমা দাঁত কটমটিয়ে তাকিয়ে কথাটা বলে। শার্লিন ফোনের লক খুলে ফোনের দিকে তাকিয়ে নেট ঘাটতে শুরু করে। তারমাঝে রাইমার কথার উত্তরে বলে,

“স্যরি আমি লে*সববিয়ান না যে মেয়ে হয়ে মেয়েকে খেতে যাবো। আমি ছেলে হলে বিষয়টা ভাবা যেতো। তুই সুন্দরই আছিস। বিয়ে করে খেয়ে ফেলতাম তোকে।”

শার্লিনের কথা শুনে রাইমার হেঁচকি উঠে যায়। মাহাদ তো মাথা নিচু করে ফোনের দিকে মনোযোগ দেয় তাড়াহুরো করে। শার্লিন রাইমার হেঁচকি উঠেছে দেখে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে,

“কফি ছাড়া তো কিছুই খেলি না। হেচকি উঠে কেন তোর? বাসায় কি কিছু চু’রি করে খেয়েছিলি! আন্টি বোধ হয় এখন টের পেয়েছে। যে কারণে তোর হেঁচকি উঠেছে।”

“বইন দয়া করে অফ যা তুই। আমার কিছু হয়নি, আমি ঠিক আছি।”

এক গ্লাস পানি এক চুমুকে শেষ করে কথাটা বলে রাইমা। শার্লিন তা শুনে অভিমানের স্বরে বুকে হাত বেঁধে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,

“ভালো কথা বলতে নেই। বললেই কেউ গুরুত্ব দেয়না।”

রাইমা শার্লিনের কথা শুনে বললো,

“তোর নির্লজ্জ কথাবার্তার কি পাত্তা দেবো?”

“তোমরা দুজন একটু থামো প্লিস। আমিও এখানে আছি। একটু লজ্জা করো।”

মাহাদ দুজনের কথার মাঝে ফোন টা পকেটে ঢুকিয়ে কথাটা বলে। শার্লিনের এতোক্ষণে খেয়াল হয় মাহাদও এখানে আছে। সে জিহ্বায় কা”মড় দিয়ে বলে,

“স্যরি ভাইয়া। আপনি এখানে আছেন, আমি ভুলে গিয়েছিলাম।”

“মানে কি! যাকে আইসক্রিম খাওয়ানোর কথা বললি, এক নিমিষে জলজ্যান্ত একটা মানুষকে তুই ভুলে গেলি, যে সে এখানে আছে! বাহ বইন বাহ। ভুলে যাওয়ার এওয়ার্ড টা তোরেই দিতে হবে।”

রাইমা শার্লিনের কথার উত্তরে কথাটা বলে। শার্লিন বোকা বোকা হাসি দিয়ে ফের বলে,

“সত্যি এওয়ার্ড টা আমাকেই দিতে হবে। আমি আইসক্রিম খাবো এটাও ভুলে গিয়েছিলাম তোর সাথে কথা বলতে গিয়ে। ধন্যবাদ আইসক্রিমের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।”

রাইমাকে কথাটুকু বলে শার্লিন মাহাদের দিকে তাকায়। এরপর বলে,

“ভাইয়া আর এক বাটি আইসক্রিম খাওয়াবেন প্লিস!”

মাহাদ কথা বাড়ায় না। কথা বলা মানেই মানসম্মানের ফালুদা করে দিবে এই মেয়ে। ওয়েটার ডেকে শার্লিনের জন্য আইসক্রিম সহ আরও কিছু খাবারের অর্ডায় দেয়। রাইমা এতো খাবার অর্ডার করা দেখে বলে,

“এতো খাবার অর্ডার দিলেন কেনো ভাইয়া? আমরা তো এতোকিছু খেতে পারবোনা।”

“তোমার ভাবী আসতেছে রাইমা। ওন দ্যা ওয়ে, সাথে তার ভাইও আসছে। তো তার পছন্দ মতো খাবার গুলো অর্ডার করে দিলাম। আসতে আসতে ওয়েটার খাবার সার্ভ করে দিবে। সে এসে লেইট করবেনা। অল্প কিছু কথা বলেই চলে যাবে। তাই আগেভাগেই অর্ডার করলাম।”

“ওহ আচ্ছা।”

মাহাদের কথায় রাইমা ছোট্ট করে উত্তর দেয়। এরপর অপেক্ষা করে তার হবু ভাবী আসার। ১০-১৫মিনিটের মাথায় ওয়েটার সব খাবার সার্ভ করে দিয়ে যায় এক এক করে। মাহাদ রাইমা আর শার্লিনের উদ্দেশ্যে বলে,

“তোমরা যেটা পছন্দ হয় খাওয়া শুরু করো।”

রাইমা মাহাদের কথার উত্তরে বলে,

“ভাবী আসুক, একসাথে খাই!”

“তুই ভাবীর অপেক্ষা কর। আমার কান্না করে করে ক্ষিধে পেয়েছিলো, এখনও ক্ষিধে আছে। না খাইয়েই টেনে এনেছিস। আমি খেলাম, তুই বসে থাক।”

শার্লিন রাইমার কথার উত্তরে কথাটা বলে। কারোর উত্তরের অপেক্ষা না করে খেতে শুরু করে। মাহাদ হেসে ফেলে শার্লিনের কান্ড দেখে। রাইমা বিরক্তিতে ভ্রু কুচকায়। অস্থির চিত্তে বারংবার রেস্টুরেন্টের গেইটের দিকে দৃষ্টি মেলে। দুই তিন মিনিট যেতেই রেস্টুরেন্টের গেইটে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখে মাহাদ আর রাইমা দুজনের ঠোটের কোণেই হাসি ফুটে উঠে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটির পিছনে অন্য একটি মানুষকে দেখে রাইমা হাসি উবে গিয়ে চোখে মুখে বিস্ময় প্রকাশ পায়। বিরবির করে বলে,

“এই লোক এখানেও! আসার আর সময় পেলো না।”

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here