#আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২০]
________
সময়টা প্রাতঃকাল চারিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখোরিত।আধাঁরকে পেছনে ফেলে সূর্য্যি মামা আলো নিয়ে উঠছে।ঘরের দোর খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো মিহি।হাতে তার ছাই।দাঁত মাজতে মাজতে এগিয়ে গেলো দিঘির পাড়ে।বেশ কিছুক্ষণ পর হাত মুখ ধুয়ে উঠে এলো সে।চোখের সামনে স্থির নয়নের মানবকে দেখে শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে গেছে।
– ওয়াসিম ভাই আপনি এখানে?
– কেমন আছিস?
– জি ভালো ভাইয়া।
–
বেশ শান্ত কন্ঠে জবাব দিলো মিহি।
– তোর বাবা কোথায়?
– বাপজান তো ভোরেই বাজারে গেলেন।
– তোর সাথে কিছু কথা আছে।নদীর পাড়ে আয়।
– ন..নদীর পাড়ে কেন?এখানে বলেন,ঘরে চলেন অন্তত।
– না নদীর পাড়েই বলবো দ্রুত আয় দেরি করিস না কিন্তু।
ওয়াসিমের শান্ত কন্ঠ।মিহি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।
__
দিন দিন মনে কেমন যেন ঘুনপোকারা বাসা বাধঁছে, যা ধীরে ধীরে বিনষ্ট করছে অন্তঃকরণ।অনুভূতিরা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।একটু চিৎকার দিয়ে কাদঁতে পারাদ যেন জো নেই।কাদঁবেই বা কি করে রমণীর আজকাল কাদঁতেও আজ্ঞার প্রয়োজন।এছাড়া কান্না তার জন্য নিষিদ্ধ।আর যদিও চোখের কার্নিশ বেয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে তবে আর রক্ষে নেই।ইনান,নাসরিন সবাই চিৎকার চেচামেচি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলবে।এই যে এখন একটু কাদঁতে চাইছে ইতিকা কিন্তু কাদঁতে পারছেনা সে।
তাকে হতে হবে পাথরের মতো শক্ত।হাতের কফি মগটায় একটু খানি ফুঁ দিয়ে চুমুক বসালো।তার পাশে রুমু, যে কী না আগের দিনের মত হাজারটা নিন্দাসূচক বাক্য ব্যয়ের প্রতিযোগিতায় নেমেছে।তার প্রতিটি কথা, প্রতিটি ধাপে বার বার বুঝিয়ে দিতে চাইছে ইতিকা ইনানের জন্য নয়!গ্রাম্য মেয়ে মানানসই বিষয়টা তার মাঝে নেই।ইতিকা সব কথা হজম করছে নির্বাক ভঙ্গিতে।
আকস্মিক মেঝেতে কাচঁ ভাঙ্গার শব্দে কেঁপে উঠলো ইতিকা।ভাবনার জগৎ ছেদ হতেই লাফিয়ে উঠে সে।সহসা চোখের সামনে ভেসে উঠে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা।মূহুর্তেই কানে আসে ঠাস ঠাস শব্দের প্রতিধ্বনি।হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পলকহীন ভাবে।আরেকটি চড়ের শব্দে সৎবিৎ ফিরলো ইতিকার।ততক্ষণেও ইনান থেমে নেই।ইচ্ছে মত রুমুর গালে থাপ্পড় দিতে থাকে।ইতিকা লাহমায় রুমুকে সরিয়ে আনে হিংস্ররূপির মানুষটার কাছ থেকে।যার দৃষ্টিতে মায়া-দয়ার ছিটেফোঁটা ও নেই।আরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে ক্রুদ্ধ হয়ে।
– সামনে থেকে সরে যান ইতিবউ।
– যাবো না আমি।রুমুকে মারছেন কেন?
– তার কৈফয়ত আপনাকে দিতে বাধ্য নই।
– বেশ তবে আমিও সরবো না।
ইতিকার দৃঢ় প্রত্যয়।তবে সেটা আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।ইনান ঝটকায় সরিয়ে দিলো ইতিকাকে।এতটাই জোরে ছুড়ে মারে মেয়েটি তৎক্ষণাৎ মেঝেতে পড়ে যায়।হাতের তালুর অংশে খানিকটা ছিলে গেছে।তবুও সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আবারো ছুটে আসতে নেয় রুমুর কাছে।অতি অল্প সময়ের মধ্যে অলীদ তার হাত ধরে নেয়।এবং ইনানের সম্মতি পেয়ে তাকে টানতে টানতে নিচে নামিয়ে আনে।
.
কাঁপা-কাঁপা হাতে অলীদের হাত থেকে দ্রুত পানির গ্লাসটি হাতে তুলে নেয় মেয়েটি।ঠকঠক করে কাঁপছে তার শরীর।নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়েছে।গলার স্বর বসে গেছে।দ্রুত পানি পান করে চোখ তুলে তাকায় মেয়েটি অলীদ টিস্যু বাড়িয়ে দেয় তার দিকে।ঠোঁট থেকে গলায় জামাকাপড়ে পানি পড়ে সবটা ভিজে আছে।
– এত অস্থির হচ্ছেন কেন ভাবী?
– অস্থির!অস্থির হবো না আমি?উনি ম..মেয়েটা মারছেন কেন?
– কাল সে আপনাকে কী বলেছিল?
-ক…কই কিছু না।আমরা তো শুধু….
– চুপ করেন ভাবী।আজ আমরা অনেক্ষণ যাবৎ আপনাদের আড়ালে ছিলাম।রুমু যে কথার ধাচে আপনাকে বার বার অপমান করেছে সেটা আপনি বুঝেও না বুঝার ভান করে ছিলেন।কাল কী বলেছে সেটা আমরা জানি না।তবে আজকে যে মেয়ে এতটা হেয় করেছে আপনাকে কাল যে করেনি তার নিশ্চয়তা কী?
– তাই বলে এত গুলো থাপ্পড়!
– রুমুকে আমি তার ছোট বেলা থেকে চিনি মেয়েটি অতিসাধারণ।সারাদিন রঙতুলি তার আঁকিবুঁকি,পেইন্টিং নিয়ে সে ব্যস্ত।কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ তোমার পেছনে লাগলো কেন বুঝলাম না।নিশ্চই ওয়াসিমের চাল।
– ওয়াসিম?
– আপনাকে যেদিন গ্রামে ইনান ফিরিয়ে আনতে যায় সেদিন ওর মামার বাড়ির সবাই এসেছিল, ইনান এবং রুমুর বিয়ের সম্বোধন নিয়ে।কিন্তু ইনানের পক্ষ থেকে সব নাকচ করা হয়েছে।বিষয়টি একদিক দিয়ে অপমান জনক তাই হয়তো এমন করছ সে।তাছাড়া ইনান এবং রুমুর বিয়ে হলে আপনাকে পাওয়া সহজ হয়ে যেত ওয়াসিমের।
ইতিকা ফস করে শ্বাস ছাড়লো।খোলা চুলগুলোকে মুষ্টিবদ্ধ করে দ্রুত খোপা করে দৃষ্টি নত করলো অলিদের দিকে,
– কিন্তু রুমুর কথা গুলো মিথ্যা নয় অলীদ ভাই।ইনানের সঙ্গে আমাকে কী যায়?সে কোথায় আর আমি কোথায়?তাছাড়া বিয়েটা যে ওয়াসিমের উপর প্রতিশোধ নিতে করা হয়েছে তা আমি বুঝতে পারছি।
ইতিকা কথাটি বলে চুপ রয়ে যায়।অলীদের ললাটে ভাজ পড়ে কিঞ্চিৎ।ঠোঁটে তার অবজ্ঞার হাসি।উঠে দাঁড়িয়ে দরজার সামনে চলে যায়, দরজাটাকে ভিড়ে আবারো বসে যায় ইতিকার সামনে।
– একটা গল্প শুনাই আপনাকে ভাবী মন দিয়ে শুনবেন।
– এই মূহুর্তে গল্প বলতে এসেছেন! আপনি ফাইজলামি করছেন নাকি ভাই?
ইতিকার কথায় পাত্তা দিলো না অলীদ।বরং সে বলতে শুরু করে,
– এক ব্যস্ত শহরে চার বন্ধুর বসবাস।যদিও একজন ঢাকার বাইরে থাকতো তবুও সে ঢাকাতেই আলাদা ফ্লাটে থাকতো কেননা পড়াশোনা তার ঢাকাতেই চলমান।হঠাৎ এক কালো অধ্যায় তাদের আলাদা করে দেয়।ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল চারজন বন্ধু।তার মধ্যে একযোগে রইলো বাকি তিন বন্ধু।আরেকজন ছিল পিশাচ রূপি।বেশ কয়েক বছর পর শোনা যায় গ্রামের কোন মেয়েকে নাকি সে ভালোবেসেছে!এতে পিশাচের পরিবার কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি।সর্বশেষ পিচাশের পরিবার একটি ছলাকলা কৌশল করলো।পিশাচকে পাঠিয়ে দিলো দেশের বাইরে।আর বাকি তিন বন্ধুর মাঝে যে মধ্যেমণি তার পরিবারের একজনের সাথে ডিল করা হয়েছে মেয়েটিকে মারার।যোগ সূত্রে মধ্যেমণিকে বলা হয় মেয়েটিকে মারার জন্য।মধ্যেমণি কৌশল এঁটে মেয়েটির সম্পর্কে দেড়মাস যাবৎ অবগত হলো।পরিশেষে মধ্যেমণি ছেলেটি এটাই বুঝলো মেয়েটির তো কোন দোষ নেই!সে নিতান্তই একজন নির্দোষ ভুক্তভোগী।সে চেয়েছিল ভালোবাসা একটুকু আশ্রয়।মেয়েটির ছিল না কোন নির্দিষ্ট পরিবার।ছেলেটি পড়ে গেলো এক মায়াঘোরে।সবাইকে উপেক্ষা করে মেয়েটিকে নানান বাহানায় ভয়ভীতি দেখিয়ে বিয়ে করে আনলো।আর মেয়েটিকে দিলো একটি পরিবার নতুন করে নিশ্চিন্ত মনে বাঁচার সুযোগ।কিন্তু সব কিছুর মাঝে মেয়েটি আজীবন ছেলেটিকে দোষারোপ করে গেলো।কেননা এই বিয়ের কারনে সে তার ভালোবাসা হারিয়েছে।অবশ্য মেয়েটিরো দোষ কী?অন্তরালের সত্যিটা সে যানে না।
অলীদ তর্জনির আঙুল দিয়ে ললাট ঘষতে থাকে বুকের ভেতটায় ধুক ধুক শব্দ ক্রমশ বাড়ছে।ভ্যাপসা গরমে শরীরের চামড়া জ্বলে উঠছে।হুট করেই সুফিয়ার কথা মনে পড়ে গেলো।ইসস মেয়েটাকে দেখছেনা কতদিন হয়ে গেলো।শার্টের হাতা ফোল্ড করে তাকালো ইতিকার দিকে।মেয়েটির চোখের কার্নিশ বেয়ে নেত্রবারী গড়িয়ে পড়ছে।তবে কী এই গল্পের সর্বশেষটা বুঝতে পেরেছে।তা ভেবেই ঠোঁটের কোনে যেন বিশ্ব জয়ের হাসি ফুটে উঠলো অলীদের।
– অলীদ ভাই সবটা মাথার উপর দিয়ে গেলো গল্পটাতে কোথাও যেন আমি জড়িয়ে আছি একটু বুঝিয়ে বলুন প্লিজ।
অলীদ স্মিথ হাসলো।
– ওয়াসিমের বাবা বাহরুল ইসলামের সঙ্গে ডিল করেছিল তোমায় মারবে।যদিও তাদের দুজনের মাঝে চলছিল শত্রুতা কিন্তু তোমায় মারলে ওয়াসিম তাদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে তাই দুজনে আবার আগের মতো বন্ধু হওয়ার সিধান্ত নেয়।ওয়াসিমের বাবা আর ইনানের মামু তারা আগে থেকেই বন্ধু ছিল।রাজনীতির কলকবজায় তারা বন্ধু থেকে শত্রু হয়ে যায়।মাঝখানে বখরির গরু হলে তুমি।কিন্তু ইনান তোমায় বাঁচিয়ে দিলো।ইনানের মত যদি না পাল্টাতো তবে এতদিন তোমায় আর এই পৃথিবির আলো দেখতে হতো না।
অলীদ থেমে গেলো।চেয়ে রইলো ইতিকার পানে।
ইনান ইতিকাকে বিয়ে করার কারণটা নিয়ে ইতিকার মাঝে ছিল নানান মতবাদ সন্দেহ।আজ সবটা জেনে সে স্তম্ভিত।অলীদের দিকে একটু তাকিয়ে আবার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।বড়ো বড়ো শ্বাস ছেড়ে মাথায় হাত দিয়ে বলে,
– অলীদ ভাই আরেক গ্লাস পানি দিন।
__
– কী ভাবছিস এত? রুমুর বিয়ের কথা ভাবছিস না কি রে তুই?
সাহাব উদ্দীনের কথায় মুখ তুলে তাকায় বাহরুল ইসলাম।হাতে থাকা সিগারেট’টায় আরেকটি টান দিয়ে ধোয়া উড়িয়ে দিলেন চিন্তিত মনে।
– আপদত মেয়ে বিয়ে করছেনা।আর চেয়েছিলাম ইনানের সঙ্গে বিয়ে, কিন্তু….
– এত চাপ নিচ্ছিস কেন তুই?ইনানের জমি,বাড়ি সবটাই তো পেলি এবার শুধু ভালো এবং বড় ঘর দেখে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দে।আমার মাথা থেকে একটা বোঝা নেমে গেলো।ওয়াসিম আর ওই গ্রামের মেয়েটাকে নিয়ে পড়ে নেই।ওই মেয়ে তার রাস্তায় আমার ছেলে তার নিজের রাস্তায়।এবার আমি নিশ্চিন্ত মনে আছি।
সাহাব উদ্দীনের কথায় কিঞ্চিৎ হাসলেন বাহরুল।
– ঠিক বলেছিস।তবে আমি অন্য চিন্তায় আছি ইতিকাকে নিয়ে ব্লাকমেইল করে আমার শত্রু পক্ষ না আবার ইনানের মুখ থেকে আমার বিরুদ্ধে সব প্রমান জোগাড় করে নেয়।
– আমাদের মূলমন্ত্র একটাই যতদিন আমাদের দলে আছে ততদিন তার পৃথিবির আলো দেখার অধিকার আছে।আমাদের দল থেকে বের হওয়া আর পৃথিবির আলো দেখার আশা করা বোকামি।যাস্ট পিষে মে’রে ফেলতাম।কিন্তু ইনানের কেসটা অন্যরকম।যাই হোক ছেলেটা তোর ভাগীনা।
– এই একটাই দূর্বলতা আমার।তাই তো ছেলেটাকে এখনো বাচিঁয়ে রেখেছি।
তবে আমার বিরুদ্ধে এখনো কোন কাজ করেনি।শুধু একবার আমার বিরুদ্ধে রেষারেষি হোক তবেই চিরতরে পরপারের বাসিন্দা করে ছাড়বো।
বাহরুল ইসলামের কথায় ঠোঁট বাকিয়ে হাসতে থাকে সাহাব উদ্দীন।
.
কিছুক্ষণ আগেই হাসপাতালে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে ইতিকা,ইনান এবং অলীদ।সুফিয়ার সুইসাইডের কথা শুনে বুকের ভেতরটায় মুষড়ে উঠে অলীদের।বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সুফিয়ার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়েছে তাদের।করিডোরে চেয়ারে বসে নিশ্চুপ চোখের জল ফেলছেন সুফিয়ার মা।
ইনান তাড়াহুড়ো করে কেবিনে প্রবেশ করে তার পেছনে অলীদ এবং ইতিকা।
– মরতে শখ হয়েছে?এত নিম্ন মানের বিষ পেলি কোথায়?আমাকে বলতি একদম হাই পাওয়ারের বিষ এনে দিতাম।এক ডোজেই যথেষ্ট।
ইনানের স্থির চিত্তের কথায় চমকে তাকায় সুফিয়া।ইনানের চোখে চোখ রাখতেই দু’ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কোন কথা আসছে না তার।গলার কোথাও যেন কাঁটা বিধে আছে।ইনানের আরক্ত দৃষ্টির রুষ্ট কন্ঠে সে হতবাক।
– কিরে তাকিয়ে কী দেখছিস?জানিস না এখন’কার বিষে ফরমালিন মেশানো থাকে।বর্তমান সময়ের বিষ খেলে সর্বোচ্চ হাসপাতালে ভর্তি হতে পারবি তবে মরবি না।
ইনানের কথার যৌক্তিকতা খুঁজে পেলো না অলীদ।ইতিকা বাক্যহীন তাকিয়ে আছে অবাক পানে।অলীদ গলা ঝেরে কেশে এগিয়ে গেলো সুফিয়ার কাছে।
– এমনটা করলি কেন সুফিয়া?আমাকে বললে এবারো বিয়েটা ভেঙ্গে দিতাম।অন্তত এর আগে বারোটা বিয়ে ভেঙ্গেছি এবারের টাও ভাঙ্গতাম।তাই বলে তুই সুইসাইড করতে যাবি।
– বাবা হুট করে দুপুরে এসে বললেন সন্ধ্যার পর এঙ্গেজমেন্ট।তোমার বন্ধুদের চাইলে ইনভাইট করতে পারো।আমার মাথা কাজ করছিলো না।বাবাকে বার বার বলেছি ওয়াসিমের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করো কিন্তু বাবা শুনলেন না।বরং আমার গায়ে হাত তুললেন তাই…..
– তাই বলে মরবি?ওই ছেলের মাঝে কী আছে সুফিয়া?আঙ্কেল তো তোকে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছেনা।কিন্তু তোর ওই নোংরা চরিত্রের ওয়াসিমকেই চাই। একটা মানুষের জীবনে সবচেয়ে বাজে অধ্যায় কী জানিস?ভুল মানুষের প্রেমে পড়া,সেই মানুষটাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসা।আর যা তুই বর্তমানে করছিস।এখনো সুযোগ আছে নিজেকে সামলেনে।ওয়াসিমের সাথে নিজের জীবন জড়ানো মানে জাস্ট তুই শেষ হয়ে যাবি।
ইনান কথাটি বলেই শব্দ করে শ্বাস ছাড়লো।তার পাশে ইতিকা তাকিয়ে আছে অবাক পানে।তার পায়ের নিচের মাটিটা যেন সরে গেছে।ফিসফিস করে আনমনে বলে,
– আপু ওয়াসিমকে ভালোবাসে!
.
মেয়ের সুইসাইডের আকস্মিক পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েন সুফিয়ার বাবা।অবশেষে কোন উপায়ন্তর না পেয়ে ওয়াসিমের সাথে সাক্ষাৎ করেন তিনি।ওয়াসিমের বাবাকে সবটা জানানো হলে তিনি নির্দ্বিধায় সুফিয়াকে বাড়ির পুত্রবধূ করতে রাজি হয়ে গেলেন।
সুফিয়ার বেডের পাশে ইনান,অলীদ,ইতিকা সহ তার বাড়ির সকলেই উপস্থির।হঠাৎ করে কেবিনে প্রবেশ করে সুফিয়ার বাবার সঙ্গে ওয়াসিম।
ওয়াসিমকে দেখেই কর্তব্যবিমূঢ় ইনান,অলীদ ইতিকা।ওয়াসিম এগিয়ে আসে সুফিয়ার কাছে কোন ভনিতা ছাড়াই বলে,
– তুই এত পাগল এই মূর্খ,বেয়াদব ছেলেটার জন্য?সুইসাইড করতে গেলি কেন বোকা মেয়ে।আমি কী তোকে কম ভালোবাসি নাকি?ছোট থেকেই তোকে দেখছি।চিন্তা করিস না।এবার যা হবে ঠিক ঠাক হবে দু’দিন পরেই আমাদের বিয়ে।দ্রুত সুস্থ হয়ে যা।
ওয়াসিমের শান্ত স্বরের কথায় অশান্ত হয়ে পড়ে অলীদ।অস্বাভাবিক ভাবে হঠাৎ করেই সে ঘামছে।দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজেকে একা করে নেয়।অস্থিরতা মাথায় চেপে বসেছে।পরিস্থিতি সবটা তার হাতের বাইরে চলে গেছে।
অপরদিকে ওয়াসিমের দিকে তীর্যক ভাবে তাকিয়ে আছে ইতিকা।ওয়াসিম আড় চোখে একবার দেখে নিলো ইতিকাকে।
উপস্থিত পাঁচজন মানবের মনে আজ পাঁচ রকমের অনুভূতি।কেউ বা চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে আছে প্রশ্নের উত্তর চেয়ে।কেউ বা হারানো প্রাপ্তির খুশিতে বাক্যহীন।আর কেউ ভালোবাসা হারানোর ভয়ে বিবর্ণ পরিস্থিতিতে।
#আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২১]
_________
মধ্যাহ্ন সময়টাতে বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে বিয়ে বাড়ি।স্বল্প আয়োজনে রিসোর্টে বিয়ের সকল কার্যক্রম শেষ করার সিদ্ধান্ত নেন সুফিয়ার বাবা মোস্তাফিজ।মেয়ের ঠোঁটে হাসি দেখে আনন্দ ফিরে পেলেও মানসিক ভাবে একদম ভেঙ্গে পড়েছেন তিনি।অশিষ্ট একটি ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে ভবিষ্যত জীবন কোন পর্যায়ে যাবে ভাবতেই গা শিউরে উঠছে তার।হালকা হিমেল হাওয়ার সাথে আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে।চারিদিকে লাইটিং এর ব্যবস্থা এছাড়াও আর্টিফিশিয়াল ফুলের সাহায্য সাজানো হচ্ছে পুরো রিসোট।অলীদ শার্টের হাতা ফোল্ড করে এগিয়ে গেলো মি.মোস্তাফিজের সামনে।
– আঙ্কেল সুফিয়া কোথায়?
– সম্ভবত তার রুমেই আছে।একবার গিয়ে দেখে আসো।
অলীদ মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো।দু’চারটা রুম খোজাখুজি করে স্বল্প সময়ে পেয়ে গেলো সুফিয়ার রুম।মেয়েটির হাতে গায়ে হলুদের শাড়ি সহ ফুলের গয়না।পাশে বসে আছে কয়েকজন বিউটিশিয়ান।
– সুফু আসবো?
– হ্যা আয়।
অলীদ রুমে প্রবেশ করে বারান্দায় চলে গেলো।তার পেছনে এগিয়ে এলো।সুফিয়া।
– বিয়েটা তাহলে করছিস।একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারনে তোকে সারাজীবন কাদঁতে হবে রে।এখনো সময় আছে বিয়েটা ক্যান্সেল কর।
অলীদের কথায় বেশ রেগে গেলো মেয়েটি।কিছু বলার আগেই তার দু’হাত টেনে নিলো অলীদ।হাতের তালুতে বেশ নজর কাড়া মেহেদী ডিজাইন করা হয়েছে।মাঝে অবস্থান করছে ওয়াসিমের নাম।বিষয়টি অলীদের নজরে আসতেই অন্তঃকরণ থেকে চাপা ব্যাথার অনুভব হলো।সুফিয়াকে দু’বাক্য করার সুযোগ না দিয়ে মাথা নুইয়ে বলে,
– ভালো থাকিস।এই বিয়ের প্রসঙ্গে আমার আর কিচ্ছু বলার নেই।
.
গায়ে হলুদের শাড়ির কুচি ঠিক করে মাথা তুলে ইনানের দিকে তাকায় ইতিকা।ছেলেটির চোখ,মুখ একদম শুকিয়ে গেছে।বড্ড উশকোখুশকো দেখাচ্ছে তাকে।
– আপনি রেডি হচ্ছেন না কেন?আম্মা তাড়া দিয়ে গেলো দ্রুত তৈরি হতে।
– আমি রুমেই থাকবো ভালো লাগছে না আমার।আপনিও যেতে পারবেন না ইতিবউ।
ইনানের কথায় বেশ চমকে যায় ইতিকা।
– আমি যাবো না মানে?আমি কেন যাবো না?
– ওয়াসিম বিয়ে করছে,আপনার কী কষ্ট হচ্ছে না?
– না হচ্ছে না।হবে কেন?যে গেছে তাকে নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই।
ইতিকা আবারো শাড়ি ঠিক করতে
মনোযোগী হয়।ইনান তার দিকে তাকিয়ে আছে প্রমত্ত দৃষ্টিতে।হাতে থাকা সিগারেটটা ট্রেতে রেখে এগিয়ে যায় ইতিকার দিকে।পকেটে হাত দিয়ে ইতিকাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে ব্যস্ত সে।
– কিছু কী বলবেন?
ইতিকার প্রশ্নে সৎবিৎ ফেরে তার।খানিকটা এগিয়ে এসে ইতিকার ঘাড়ে থুতনি রেখে শুধালো।
– হুম অনেক কিছু।শাড়িটা খুলে রাখুন ইতিবউ পড়ার দরকার নেই।
– কি সব বলছে আপনি?অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাচ্ছে আম্মা তাড়া দিয়ে গেলো।
– তুমিও অনুষ্ঠানে যাবে না আমিও যাবো না।আজ আমরা এখানে এই রুমে মধুচন্দ্রিমা কাটাবো।আর সাক্ষি থাকবে ওই যে খোলা আকাশের চাঁদটা।
ইতিকা ঘাবড়ে গেলো।ছিটকে দূরে সরে শাড়ির আচঁলটা গায়ে ভালো ভাবে টেনে নিলো।
– ক..কিসব বলছেন?
– কেন কী বলেছি আমি?দেখো ওয়াসিমের গায়ে হলুদ দেখার আমার কোন শখ নেই।আর আমি তো তোমাকে ওখানে যেতে দেবো না।কখনোই না।
– ওয়াসিমকে টানছেন কেন?সুফিয়া আপুর বিয়ে আর আমরা তার দাওয়াতেই এসেছি।
– চুপ!আগে স্বামী ভক্তি করো।স্বামী ভক্তি পরম ভক্তি।
ইতিকা থেমে গেলো।ইনান তার সামনে এগিয়েছে এসে চুলের খোপা ছেড়ে দেয়।কাঁচা ফুলের গাজরা খুলে হাতে মুড়িয়ে নেয়।নাকের সামনে এনে গাঢ় শ্বাস নিয়ে একপলক তাকায় ইতিকার দিকে।
– আপনার হঠাৎ কি হয়েছে এমন করছেন কেন?
– জিন ভর করেছে।জিনের কাতুকুতুতে আপনার সাথে এমন করছি।
ইনান উগ্র কন্ঠে কথাটি বলে দূরে সরে যায়।ইতিকা ফিক করে হেসে ইনানের হাত জড়িয়ে ধরে।
– আমাকে যেতে দিন মিহি অপেক্ষা করছে।
– মিহি আপনার জন্য অপেক্ষা নয় আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
– মানে?
ইতিকার কথার উত্তর দিল না ইনান।হাতে ফোন নিয়ে কাউকে যেন ফোন করলো কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজায় টোকা পড়লে এগিয়ে গেলো ইনান।হাতে তার একটি হলুদের কৌটা।মিহিকে দরজার বাইরে থেকে খানিকটা দেখতে পেলো ইতিকা।ইনান দরজার বন্ধ করে ইতিকার পাশে এসে দাড়ালো।ঠিক তখনো ইতিকা কিছু একটা ভাবছে।তার চিন্তিত মুখ দেখে শুধালো ইনান,
– এই ইতিবউ কী ভাবছেন?
– মিহির কী হলো?সেদিন সুফিয়া বার বার রিকুয়েষ্ট করেছে বিয়েতে আসার জন্য কিন্তু সে প্রতিবারি নাকচ করে।আর যখন এলো তখন এত চুপচাপ নিরিবিলি।দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে সে।
– আমারো তাই মনে হচ্ছে গতবার তাকে দেখেছিলাম চঞ্চল একটি মেয়ে কিন্তু এবার কেমন যেন হয়ে গেলো।
ইতিকার বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।ইনান তার কাছে খানিকটা ঝুকে গালে, গলায় হলুদ মাখিয়ে দিলো।তার কান্ডে ভড়কে যায় ইতিকা।তোড়জোড় করে সরে ইনানের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
– কি করলেন আপনি?আমার সাজপোশাক সব নষ্ট করে দিলেন।
– রেগে যাচ্ছেন কেন ইতিবউ?আমি তো আপনাকে এই রুমের বাইরে এক পাও যেতে দেবো না।তার থেকে ভালো আমার সাথে হলুদ সন্ধ্যা পালন করুন।আসুন বউ কাছে আসুন।
কথাটি বলে খিটমিট করে হাসতে থাকে ইনান।ইতিকার বেশ রাগ লাগলো।ডানে বামে কিছু একটা খুজঁতে থাকে ইনান তখনো হাসছে।হুট করে কাঁচ ভাঙ্গার শব্দে চমকে তাকায় ইনান।তৎক্ষণাৎ বাম হাতে কামড়ের অনুভব করতেই ছিটকে পড়ে।ইতিকা তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ইনানের হাতে কামড় বসিয়ে দেয়।
– ইতিবউ আমার লাগছে।
– লাগুক অনেক সহ্য করেছি আপনার জ্বালাতন আর পারবো না।
ইনান আবারো খিটমিট হেসে উঠে।কায়দা করে ইতিকার চুলের ভেতর হাত ডুকিয়ে ঝাপটে ধরে তাকে।সহসা ইতিকা অনুভব করে তার কানের লতিতে তীব্র ব্যাথার।চিৎকার দেওয়ার আগেই ইনান তার মুখে হাত দিয়ে খামচে ধরে।
– কার সাথে ঝগড়া করতে এসেছেন ইতিবউ?
ইফতিহার ইনানের সাথে পাঙ্গা নিয়ে কখনোই পারবেন না।
– আর ভালোবাসায়?ভালোবাসায় তো হারিয়ে দিলাম তাকে।মজনু বানিয়ে ছেড়েছি।
ইনান প্রত্যুত্তর করলো না।আড় চোখে নির্বাক ভঙ্গিতে তাকায় ইতিকার দিকে।ইতিকা শাড়ি ঠিক করতে করতে সরে যেতে নিলে ইনান পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরে,
– একটু পাশে বসুন ইতিবউ।বাইরের এত আয়োজন আমার ভালো লাগছে না।কেমন যেন সবটা ধোয়াশা উলট পালট লাগছে।কি হচ্ছে কেন হচ্ছে!
ইনানের মন খারাপ দেখে ইতিকা এগিয়ে আসলো।বিছানায় বসে ইনানের হাত টেনে বসতে ইশারা করে।ইনানো পাশে বসে ইতিকার ঘাড়ে মাথা রাখে।ইতিকা পরম যত্নে ইনানের চুলে হাত বুলিয়ে দেয়।
– একটা কথা না বলে পারছিনা।আপনি আমার কথাটা শুনুন।
– বলুন ইতিবউ।
– আজ যদি আমরা বাইরে না যাই,ইগো নিয়ে বসে থাকি তবে দেখবেন সবাই কিন্তু খারাপ ভাববে আর সবচেয়ে খারাপ লাগা তৈরি হবে সুফু আপুর মনে।প্লিজ চলুন।আর আপনি কী আমায় নিয়ে ভয় পাচ্ছেন?
ইনান দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে।ঘাড় থেকে মাথা তুলে তাকায় ইতিকার চোখের দিকে।
– ওয়াসিমকে দেখে যদি আপনার অতীত মনে পড়ে যায়?যদি খারাপ লাগা তৈরি হয় তখন তো আমায় দোষারোপ করবেন।
– এই ইতিকার জীবনে যদি কেউ থাকতে হয় তাহলে একমাত্র ইফতিহার ইনানি থাকবে।আমি অতীত ভাবতে চাই না।আমাকে ভবিষ্যত ভাবতে দিন।একটা কথা বলি?’আপনাকে কাছে পাওয়ার অনুভূতি গুলো আমার জীবনে সবচেয়ে দামি।’ কিন্তু বিয়ের পরেও আমরা ঝগড়া করেছি,কাছে এসেছি একে অপরজনকে ছুঁয়ে দেখেছি কিন্তু তখনকার চেতনাটা এখনকার মতো তৃষ্ণাতুর হয়নি।
ইনান স্মিত হাসে।প্রমত্ত ঘোরে তাকিয়ে থাকে ইতিকার দিকে।চিবুকটা খানিকটা তুলে অধর ছুয়ে দেয় ইতিকার গালে।কানের সামনে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
– আগে তো অনুভূতি নিয়ে কাছে আসেন’নি।এসেছিলেন অভিনয়,দায়িত্ব আর অনুরাগ নিয়ে।
_
সাউন্ড বক্সের তীব্র শব্দে এক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে পড়েছে ইনানের।চারিদিকে গোচর করেও দেখা মিললো না অলীদের।রিসোর্টের সব রুমে সর্তকতা চাহনীতে গোচর করলো সে।না ওয়াসিম কিংবা অলীদ কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।একটি রুমে বেশ ফুল সহ প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র রাখা।সেখান থেকে পরিচিয় কারো কন্ঠ পাওয়া যাচ্ছে।ইনান সজাগ হয়ে এগিয়ে গেলো।ওয়াসিমের কন্ঠো শুনে দরজায় আড়ি পাতলো বেশ সতর্কতার সাথে।রুমটায় ওয়াসিম এবং তার মায়ের মাঝে বেশ তর্কা বিবাদ লেগে আছে।
– প্লিজ মা এমন ইগো ধরে বসে থেকো না।সবার সাথে মিলেমিশে চলো।
– পারবো না আমি ওই মেয়েকে কিছুতেই আমি আমার বাড়ির বউ করবো না।
– আহ!সুফিয়াকি দেখতে খারাপ?বরং ছোট থেকেই তাকে চেনো তুমি।তাদের পরিবারের সাথেও সখ্যতা।
ওয়াসিমের কথায় তেতে উঠলেন মিনা বেগম।চোখে যেন আগুনের ফুলকি ঝরছে।তার রাগ দেখে ওয়াসিম ঘাবড়ে গেলো।ডান হাতে গাল চুলকে নিজেকে স্থির রেখে এগিয়ে গেলো মিনা বেগেমের সামনে।
– দেখো মা তুমি তো যানো আমি প্রিয়মকে কতটা ভালোবাসি।আমেরিকা সেটেল হয়ে যাবো তিন/চার বছর পর।আর এই কয়েকবছর আমি সুফিয়ার সঙ্গে কাটাবো।সুফিয়ার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়া মানে ইতিকা এবং ইনানকে সামনা সামনি পাওয়া।আর যাই হোক আমি বেঁচে থাকতে ইতিকা অন্তত শান্তিতে ঘর বাধঁতে পারবে না।তাদের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে আমি এই দেশ ছাড়বো।
মিনা বেগেম যেন স্থির হলেন।চুপচাপ দৃষ্টি আবব্ধ করলেন মেঝের দিকে।ওয়াসিম তার মায়ের নিরবতাকে সম্মতি ভেবে জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে।
– লক্ষি মা আমার যাও প্লিজ।সবার সাথে মিলে মিশে চলো।
অদৃশ্য নিকষ কালো ধোয়ার মতো ঘিরে আছে ইনানের চোখ।সবটা পানসে লাগছে তার।একদিকে সুফিয়ার পাগলামো অন্যদিকে ওয়াসিমের বেইমানি কী করবে সে?এই মূহুর্তে বিয়ে ভাঙ্গা মানে সুফিয়া আবার আত্মহনন করবে।
ইনান পড়ে গেছে গোলকধাঁধায়।
.
রঙবেরঙের লাইটিং আর্টিফিশিয়াল ফুল,সহ গাছের তাজা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে স্টেজ।বিভিন্ন রকম লাইটিং এ সমারোহ পরিবেশটা।সুফিয়া স্টেজে বসে আছে তার পাশে ওয়াসিম।দুজনের ঠোঁটের কোনে হাসির আভাস।ইনান সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকায় বিড়বিড় করে বলে,
– উহহ হাসি একদম উতলায়া পড়ছে।অসভ্যর দল।
ইনান তার চাহনী সরিয়ে নেয়।পাশে তাকিয়ে অলীদকে দেখে ভড়কে যায়।ছেলেটার চোখ মুখ অস্বাভাবিক ভাবে ফুলে আছে।আরক্ত হয়ে আছে তার দু’চোখ।
– অলীদ তোর এমন বেহাল দশা কেন?
ইনানের প্রশ্নে চমকে তাকায় অলীদ।নিজেকে আড়াল করতে চেয়েও পারলো না।ঠোটের কোনে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বলে,
– তেমন কিছু না আসলে এর্লাজিটা বেড়েছে।
– তোর এর্লাজি আছে?কই আগে তো এমন কথা বলিস নি।আমার সঙ্গে এত বছর ছিলি অথচ….
ইনানের কাছে পালিয়ে বাচঁতে দ্রুত শুধালো অলীদ,
– তুই থাক আমি একটু আসছি।
অলীদ দ্রুত পা চালিয়ে বিদায় হলো।অপরদিকে ইনানের সবটা এলোমেলো লাগছে।স্টেজের সামনে রাতুলকে দেখে ইশারায় ডাক দিলো সে।ইনান কিছু বলার আগেই রাতুল শুধালো,
– তোমাকেই খুঁজছিলাম ভাই।অলীদ ভাইয়ার আজ কী হয়েছে?তার চোখ মুখ এমন লাগছে কেন।মনে হচ্ছে ভীষণ কান্না করেছে।তাছাড়া তোমাদের সাথে আমার পরিচয়টা অল্প সময়ের হলেও অলীদ ভাইয়ের এমন পরিস্থিতি আমি আগে দেখিনি।ভাইয়া কী কোন কারনে আফসেট?
– আমি জানিনা রাতুল।আমার কাছেও সন্দেহ লাগছে।
– আই থিং অলীদ ভাই সুফিয়া আপুকে ভালোবাসে।আবার নাও হতে পারে।
মূহুর্তেই ইনানের সব ধাঁধার সমাধান যেনো পেয়ে গেলো।চকচক করে উঠলো তার অক্ষি যুগল কিন্তু মূহুর্তেই চুপসে গেলো।বুকের ভেতরটায় কেউ যেন শব্দ করে হাতুড়ি পেটাতে শুরু করেছে।
– ঠিক বলেছিস তুই।আমি পাক্কা শিওর তবে আমাদের হাতে এখন সময় নেই বোকা ছেলে আগে শুধু একটি বার আমায় বলতো সব ব্যবস্থা করে দিতাম।
ইনানের কথা শুনে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো রাতুল।ঠোঁটের কোনে অবজ্ঞার হাসি রেখে বলে,
– যার মনে যাকে চায়,যার নয়নে যার জন্য তৃষ্ণা জাগে তার তাকেই লাগে।অন্য কারো ভালোবাসায় সেই তৃষ্ণা কখনোই মিটে না।
রাতুল থামলো।সুফিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে মিনমিন করে বলে,
– ইনান ভাই তুমি কিছুই ঠিক করতে পারতে না।কারন সুফিয়া আপুর মনে অলীদ ভাইয়ের জন্য তেমন কোন ফিলিং ছিল না।
মূহুর্তে ইনানের কাছে তার নিজেকে সবচেয়ে বড় নিরর্থক এবং বোকা একজন ব্যাক্তি মনে হলো।যে কী না চোখের সামনে তার দুই কলিজার বন্ধুর ধীরে ধীরে জীবন ধ্বংস হতে দেখছে।তবে কী তার কিছুই করার নেই।
_
গভীর ঘুমে মগ্ন ইতিকা।আবদ্ধ সে ইনানের বাহুডোরে।বেনুনির ঢিলে হওয়ায় খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে কপালের উপর।অন্ধকার রুমটায় চাঁদের কোমল আলো আলোকিত করছে ইতিকার মুখখানা।লেখনীতে পলি আনান।এই নিকষ কালো অন্ধকারে ঘুম নেই ইনানে দু’চোখে।ইতিকার গালে কপালে কিছুক্ষণ পর পর অধর ছুঁয়ে দিচ্ছে। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আলতো করে যেন যেকোন মূহুর্তে কেউ নিয়ে যাবে তার ইতিবউকে।ইতিকার কপালে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে চিলতে হাসে ইনান।
– আজ দুটি চাঁদ আমার গোচরে।একটি আমার নাগালে আরেকটি আকাশ পানে।
হঠাৎ নিরব স্তব্দ রুমটায় প্রবল ভাবে ভাইব্রেট হতে থাকে ইনানের ফোন।মোবাইলে সময় দেখেই চমকে যায় সে এত রাতে অচেনা একটি নাম্বার থেকে ফোন আসায় দ্বিধায় পড়ে যায়।
– হ্যালো কে বলছেন?
– ই..ইনান ভাই আমি মিহি।
– মিহি তুই এত রাতে ফোন করলি কেন?আর এই নাম্বারটা কার?
– এ..এটা আম্মার নতুন নাম্বার।আপনি একটু রিসোর্টের বাইরে আসুন ভাই।দোহায় লাগে।
– এত রাতে….
– কসম লাগে ভাই আমি বিপদে আছি আপনি না বাঁচালে কেউ আমার সহায় হবে না।ইতিকাকে কিচ্ছু যানাবেন না প্লিজ!
ইনান দ্বিধা দ্বন্দে ভুগতে থাকে।তবুও মিহির আবদারে নিজেকে সায় দেয়।বেরিয়ে পড়ে দ্রুত রুম থেকে আর যাওয়ার আগে বাইরে থেকে তালা দিয়ে বন্দি করে যায় তার ইতিবউকে।
.
রাস্তার ধারে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।যার শরীর কাঁপছে থরথর করে।ইনানকে দেখে হাত দিয়ে ডেকে ইশারা করে কাছে ডাকে। ইনান তার অবস্থা দেখে এগিয়ে যায় তৎক্ষণাৎ ছিটকে দূরে সরে যায় মিহি।
– ভ..ভাইয়া আমাকে ছুবেন না।আমি অপবিত্র।
– এই মেয়ে মাথায় কি সমস্যা দেখা দিয়েছে কি বলছো এইসব?
– আত্মহত্যা করা ছাড়া আমি কোন পথ পাচ্ছিনা ভাইয়া তবুও আজ কেন যানি বার বার আপনার কথা মনে পড়ছে।আপনাকে কথাগুলো না জানালে আমার সাথে যা হয়েছে বাকিদের সাথেও হয়তো তাই হতো।
ইনান ঘাবড়ে গেলো।আশে পাশে তাকিয়ে মিহিকে ইশারা করে গাড়িতে বসতে।মিহিও বাক্য ব্যয় না করে গাড়ি চড়ে বসে।
দুজনে বেশ খানিকটা পথ গিয়ে গাড়ি থামায়।ইনান চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় মিহির দিকে।
– এবার বলো মিহি কী হয়েছে তোমার সাথে?আর কাল থেকে তোমায় আফসেট দেখাচ্ছে কেন?
– আ..আমি ধ… ধ’র্ষ’ণ হয়েছি ভাইয়া আমি একজন ধ’র্ষি’তা।
কথাটা বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে মিহি।ইনানের চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ।এমন একটা কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে।
– হোয়াট?পাগল হয়ে গেছো তুমি এইসব কি পাগলের প্রলাপ বকছো?
– ভাইয়া আমাকে বিশ্বাস করুন আমি সত্যিটা বলছি।আপনাকে বলা ছাড়া আর কাউকে বলার মতো আমি সুযোগ পাইনি কিংবা সাহস পাইনি।একটা মানুষ কী করে এত নিম্নমানের হতে পারে ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে।অন্তত ইতিকার জন্য হলেও আপনাকে সত্যিটা জানতে হবে।
– মিহি শক্ত হও কি হয়েছে আমায় খুলে বলো।আর কে করেছে তোমার সাথে এমন?
– ওয়াসিম!
ওয়াসিম নামটা শুনতেই ইনানের বাক শক্তি যেন লুপ্ত হয়েছে।হতবাক দৃষ্টি ধীরে ধীরে আরক্ত হতে থাকে।
– সবটা খুলে বলো আমায় মিহি।
– প্রথম দিন সেদিন সকালে….
~অতীত
সময়টা প্রাতঃকাল চারিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখোরিত।আধাঁরকে পেছনে ফেলে সূর্য্যি মামা আলো নিয়ে উঠছে।ঘরের দোর খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো মিহি।হাতে তার ছাই।দাঁত মাজতে মাজতে এগিয়ে গেলো দিঘির পাড়ে।বেশ কিছুক্ষণ পর হাত মুখ ধুয়ে উঠে এলো সে।চোখের সামনে স্থির নয়নের মানবকে দেখে শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে গেছে।
– ওয়াসিম ভাই আপনি এখানে?
– কেমন আছিস?
– জি ভালো ভাইয়া।
–
বেশ শান্ত কন্ঠে জবাব দিলো মিহি।
– তোর বাবা কোথায়?
– বাপজান তো ভোরেই বাজারে গেলেন।
– তোর সাথে কিছু কথা আছে।নদীর পাড়ে আয়।
– ন..নদীর পাড়ে কেন?এখানে বলেন,ঘরে চলেন অন্তত।
– না নদীর পাড়েই বলবো দ্রুত আয় দেরি করিস না কিন্তু।
ওয়াসিমের শান্ত কন্ঠ।মিহি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।
অতীতের কথা বলে থেমে গেলো মিহি।দু’ঠোট তার কাঁপছে।
ইনান সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
– তারপর কী হয়েছে?
– আমি নদীর পাড়ে গেলে আমাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নেয়।তারপর নিরিবিলি একটি জায়গায় নিয়ে…..
মিহি কেঁদে উঠলো।ইনান গাড়িতে হেলান দিয়ে তার রাগ দমনে ব্যস্ত।
– ওয়াসিম আমাকে শর্ত দিয়েছিল কাউকে কিছু বললে আব্বা+আম্মাকে মে’রে ফেলবে।তাই আমি কাউকে কিচ্ছু বলিনি।এইভাবে সময় কাটতে থাকে আমিও নিজেকে নিয়ে অপরাধী হিসেবে ভুগতে থাকি।নিজের উপর যখন নিজেই বিরক্ত হয়ে যাই তখন বেচে থাকা খুব কষ্ট কর হয়ে যায়।
আজ গায়ে হলুদ শেষে সবাই যখন ঘুমে মগ্ন তখন আমার হাত, মুখ, বেধে আবারো তুলে আনে ওয়াসিম।নিয়ে যায় একটি আস্তানায়।যতটুকু দেখেছি আস্তানাটি মাটির নিচে।
– মাটির নিচে!
ইনান বেশ ধমকের সুরে কথাটি বলে তখনি ঘাবড়ে যায় মিহি।চমকে তাকায় ইনানের দিকে।
– হ্যা ভাইয়া মাটির নিচে।
– ওই আস্তানাটা আমার।মামুর দলে থাকাকালীন স্পেশাল সিকিউরিটি নিয়ে আমি আস্তানাটি তৈরি করি।কিন্তু সব ছেড়ে আসায় আস্তানার দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছিলাম মামুকে।এখন হয়তো সেটি ইনানের দখলে।
– হ্যা ওই আস্তানায় নিয়ে যায় আমাকে আবারো।কিন্তু যখন আমায় হুমকি দিলো ইতিকার সম্পর্কে তখন আমি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি।যা করার করে দিয়েছি।
– ইতিকাকে নিয়ে কী হুমকি দিয়েছে তোমায়?
– আমার সাথে যা হয়েছে তা আরো বাজে ভাবে ইতিকার সাথে হবে অন্তত ইতিকাকে কোন ভাবেই ছাড়বে না।
মূহুর্তেই ইনানের দমানো রাগটা দিগুন বেড়ে যায়।জোরে জোরে ফস ফস করে শ্বাস নিয়ে।ঠোঁট কামড়ে বলে।
– কু’ত্তাটা কোথায় আছে এখন?
– সে নেই ভাইয়া।আমি..আমি তাকে মে’রে ফেলেছি।
– মানে?সত্যি?
-স..সত্যি ভাইয়া আমি লোহার পাত দিয়ে মাথার পেছনে বাড়ি মারতেই সে ঘুরে পড়ে।নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি একে একে বেশ কয়েকবার আঘাত করি তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।আর রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে রেখে চলে এসেছি আমি।আমি যা করেছি তা নিয়ে অনুতপ্ত নই।বরং আমার মতো কোন মেয়ের সম্মান হারানোর আগে সেই মেয়েদের বাঁচিয়ে দিলাম।এবার আমি মরলেও শান্তি পাবো।আমি তো বেশি দিন হয়তো বাচঁবো না।কেননা অপরাধ বোধ আমায় বাচঁতে দেবে না।
মিহি ঠোঁট কামড়ে কাঁদতে থাকে।ইনান দিশেহারা হয়ে পড়েছে কি করবে সে ভাবে কুল পাচ্ছেনা।মিহি কী সবটা সত্যি বলছে নাকি লুকিয়ে আছে অন্য কিছু!
#চলবে…