আগন্তুক 🍁
দ্বিতীয় পর্ব
মিহি
আদিরার ঘুম ভাঙল মাঝরাতে,প্রায় সাড়ে তিনটে বাজছে তখন। ক্ষুধায় পেটে চোঁ চোঁ করছে আদিরার। অন্ধকার বাড়িতে আন্দাজ করেই রান্নাঘরে পৌঁছে যায় সে। আদৃত খাবারের প্লেট সাজিয়ে মিটসেফে রেখে গেছে। আদিরা প্লেট বের করে হাতমুখ ধুয়ে নেয়। অতঃপর খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে খেতে থাকে। সারাদিনের ক্লান্তি আর ক্ষুধায় এখন খেতে আলোরও প্রয়োজন হচ্ছে না আদিরার। খাওয়া শেষ করতেই আদিরা দেখল খাবারের আরেকটা প্লেট ঢাকনা দিয়ে রাখা। আদৃত যে খাবার না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তা আদিরা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারল। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে আদৃতকে খুঁজে পেল না আদিরা। অবশ্য তার এখন আদৃতকে খোঁজাটাও অহেতুক একটা বিষয় কিন্তু আদিরার মন কিছুতেই মানছে না। আচমকা চোখ পড়ল বারান্দার দিকে। রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে আদৃত। মাঝরাতের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশটা যেন আদিরার মনে শুভ্রর স্মৃতিগুলোকে নাড়াচাড়া দিল। জমাট বাঁধা খেয়ালিপনা উড়াল দিতে চাইল। টুং করে হওয়া একটা শব্দ জানান দিল যে আদিরার কাছে ফোন আছে। সে তো ভুলেই গিয়েছিল। ফোন হাতে নিতেই চোখে পড়ল শুভ্রর নামটা। শুভ্র মেসেজ দিয়েছে? কেন? এখন আবার কি চায় ছেলেটা?
“আদিরা,বিশ্বাস করবি কিনা জানিনা তবে আমি এখনো তোকে খুব ভালোবাসি। তুই পালিয়ে যাওয়ার পর আব্বুর হার্ট অ্যাটাক হয়। ঐ মুহূর্তে ছেলের দায়িত্বের কাছে হেরে যায় একজন প্রেমিক। বাবাকে হসপিটালে রেখে সব দায়িত্ব শেষ করে কাজী অফিসে গিয়েছিলাম। সারাদিন পাগলের মতো খুঁজেছি তোমায়। তুমি নেই। জানিনা এই টেক্সট তুমি অবধি পৌঁছাবে কিনা তবে পৌঁছালে প্লিজ তুমি ফিরে এসো। আমি বাবা-মাকে মানিয়ে নিব। তুমি আমার বন্ধু অভির বাসায় এসো। ওখান থেকে তোমায় আমার শহরের বাসায় রেখে আসবো। কয়েকদিন একা থাকতে হবে। বাবা-মা মানলেই তোমাকে আবার বাড়ি নিয়ে আসব।”
শুভ্রর মেসেজে চোখ থেকে পানি ঝরতে থাকে আদিরার। ছেলেটা এখনো কতটা ভালোবাসে আদিরাকে অথচ সে? শুভ্রর পরিস্থিতি না জেনেই সে শুভ্রকে বিচার করেছে। ডুঁকরে কেঁদে ওঠে আদিরা। খুশিতে চোখের পানি বাঁধা মানছে না। কোনরকম রাতটা পেরোলেই যেন শান্তি পায় সে। ঘুম বুঝি আর ধরা দিবেনা চোখজোড়ায়।
“কি বুঝলি শুভ্র?প্ল্যান কি কাজে দেবে?”মায়ের কথার উত্তর দেয় না শুভ্র। আপাতত সেও কিছু বুঝতে পারছে না। আজমিরা বেগম আরেকটা পান মুখে পুরে চিবুতে থাকেন। আদিরা মেয়েটা তাকে এমন মাইনকার চিপায় ফেলে গেছে যে তিনি না পারছেন মেয়েটাকে বিদেয় করতে না পারছেন ধরে রাখতে। শুভ্রকে দিয়ে মোক্ষম চালটা তো চেলে নিলেন। এবার দেখা যাক তার পরিণতি কি হয়। শুভ্র ভেবেছিল আদিরাকে খেয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসতো। আপদটা চরিত্রহীনা হয়েই বের হত বাড়ি থেকে। এখন অবশ্য ঐ মেয়ের উপর আর তেমন রুচিও আসেনা শুভ্রর। আদিরাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বেশ কয়েকবার আদিরার শরীর দেখার তৃপ্তিটা মিটিয়েছে। তাই হয়তো আর তেমন আকর্ষণ হয়না। অবশ্য আদিরা মেয়েটারও দেমাগ কত! এই যুগের মেয়েরা প্রেমিক বলতে পাগল আর আদিরা এখনো প্রেমিকের হাতে হাত রেখে ফুটপাতে হাঁটার কল্পনাবিলাস করে! ব্যাকডেটেড মেয়ে কোথাকার! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সিগারেটে আগুন ধরায় শুভ্র। আদিরা একবার শুভ্রকে সিগারেট খেতে দেখেছিল। সে কী রাগ! আজাইরা! এমন ঢঙ দেখায়! সিগারেট না খাওয়া ছেলে হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না আজকাল। শুভ্রর সাদা শার্টটা ঘামে ভিজে গেছে। ক্লান্ত লাগছে শুভ্রর। বাবার মিথ্যে হার্ট অ্যাটাকের গল্প বলার আগে বেশ ভালোমতো ভাবতে হয়েছে তার সবকিছু। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলল শুভ্র। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। এক বোতল ওয়াইনে গলা না ভিজালে আজ শান্তি নেই শুভ্রর। নিকোটিনের বাজে অভ্যেসটা বুঝি এবার চিরসঙ্গী হয়ে উঠল শুভ্রর।
~আপনি উঠে পড়েছেন? আমায় একটু *** ঠিকানায় রেখে আসতে পারবেন?
~এটা কার বাসা?
~শুভ্র মেসেজ দিয়েছিল,আমাকে ওখানে যেতে হবে,ব্যস!
এতকিছুর পরেও মেয়েটা শুভ্রকে কিভাবে বিশ্বাস করছে ভাবতেই খানিকটা সন্দেহ সৃষ্টি হয় আদৃতের মনে তবে আদিরার ব্যপারে বলার অধিকার আদৃতের নেই কিংবা আগ্রহটাও নেই। আদিরা বিপদে পড়েছিল,আদৃত সাহায্য করেছে। গল্প শেষ।
গল্পটা এখানে শেষ হলেও পারত তবে তা হয়নি। এত সাধারণভাবে কোন গল্পেরই সমাপ্তি ঘটে না। আদিরার সাথে ঘটতে চলেছিল কোন এক অঘটন যার আশঙ্কা আদৃত করছিল। সকলের আড়ালে আদিরাকে ভোরবেলা বাড়ি থেকে বের করে তার বলা ঠিকানায় পৌঁছে দিল। আদিরার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের ভারে নুইয়ে পড়ছে সে,দূর থেকে দেখছে আদৃত। আদিরার চোখমুখে প্রফুল্লতা,ভালোবাসা প্রাপ্তির মুগ্ধতা,ভালোবাসা পূর্ণতা পাওয়ার তৃপ্তি। আদৃতের হিংসে হচ্ছে,খুব হিংসে। আদিরার ভালোবাসার পূর্ণতা পাওয়াটা সহ্য করতে পারবে না আদৃত। কারণ কি? তন্বীর সাথে তার সম্পর্ক শেষ বলে নাকি আগন্তুক মেয়েটার প্রতি কোন অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে আদৃতের মনে। ফোনটা বেজে উঠল আদৃতের। তন্বী কল করছে। এই ভোরসকালে তন্বী কেন কল করবে আদৃতকে? চিন্তা ভাবনা করতে করতে কলটা কেটে গেল। কল ব্যাক করার নূন্যতম ইচ্ছে হলো না আদৃতের। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে সামনে তাকাতেই দেখল আদিরার দিকে কে যেন চুপিসারে এগিয়ে আসছে। এগিয়ে আসা অবধি ঠিক ছিল কিন্তু লোকটা আক্রমণাত্মক দৃষ্টিতে কেন এগিয়ে আসছে? মুহূর্তেই মস্তিষ্কের সকল নিউরন সঞ্চালিত হয়ে ওঠে আদৃতের। দ্রুত ছোটে আদিরার দিকে। লোকটা আঘাত করার আগেই আদিরার হাত ধরে দ্রুত ছোটে সামনের দিকে। আচমকা কি ঘটল সব মাথার উপর দিয়ে গেল আদিরার। সে তো শুভ্রর খেয়ালে মত্ত ছিল। আচমকা কি এমন হলো যে আদৃত তাকে নিয়ে দৌড়াতে লাগল। আদিরা নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করতেই আদৃত অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল আদিরার দিকে। ভীত আদিরা চুপচাপ আদৃতের সাথে দৌড়াতে লাগল। একটা সময় হাঁপিয়ে উঠল দুজনেই। আদিরাকে নিয়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল আদৃত। লোকটা আশেপাশে খুঁজে কয়েকটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে চলে গেল। আদিরা রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে অথচ এই মেয়েটাই ভালোবাসার টানে বিয়েবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল। তখন মনে ভালোবাসা হারানোর ভয় ছিল বলেই হয়তো এতটা সাহস দেখাতে পেরেছে! আদিরাকে নিয়ে আবারো হাঁটতে শুরু করে আদৃত। তন্বী এর মধ্যে আরো দুবার কল দিয়েছিল। দৌড়াতে দৌড়াতে আর ধরতে পারেনি আদৃত। ফোন বের করে কলব্যাক করতে নিতেই খেয়াল হয় ফোনের ব্যালেন্স শেষ। ভাগ্যের উপর নাকি নিজের উপর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল আদৃত নিজেও বুজল না।
~এখন কি করব আমি?শুভ্র কে কল করব?
~করতে পারো। ইচ্ছে তোমার।
~এমন ভাবে কেন কথা বলছেন আপনি?
~দেখো আমার মনে হচ্ছে আপাতত কিছুদিন শুভ্রর থেকে দূরে থাকাই তোমার জন্য মঙ্গলের।
~কিন্তু আমি থাকবো কোথায়?
~কাল যেখানে ছিলে,সেখানেই।
~আপনি কেন আমার জন্য নিজের বিপদ বাড়াচ্ছেন?আগন্তুক ব্যতিত কেউ নই আমি।
~হুম। তবুও আপনাকে বিপদে ফেলে আমি যাচ্ছি না।
আদৃতের কথার মায়ায় পড়ে যায় আদিরা। একটা আগন্তুক মেয়ের জন্য কয়টা মানুষ নিঃস্বার্থভাবে নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারে? যে পারে,সে নিঃসন্দেহে ভালো মানুষের তালিকায় পড়ে। আদিরার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। আদৃত হাঁটছে। আদৃত লোকটার মাঝে হিমুকে খুঁজে পায় আদিরা। লোকটা এত হাঁটতে পারে যেন হেঁটেই জীবন পার করতে পারবে। নিজের এমন ভাবনায় নিজেই হেসে ফেলে আদিরা। আদৃত সামনে থেকে তাড়া দিতে থাকে দ্রুত হাঁটার জন্য। আদিরা মুচকি হাসছে। ফুটপাতে হাঁটতে নিয়ে শাড়ির সাথে বাড়ি খেয়ে পড়ে যেতে ধরল আদিরা। আদৃত সযত্নে আদিরার হাত ধরে ফেলল। অবাক নয়নে আদৃতের দিকে তাকিয়ে রইল আদিরা। তার কতদিনের স্বপ্ন ছিল শুভ্রর সাথে এভাবেই ফুটপাতে হাতে হাত রেখে হাঁটবে কিন্তু শুভ্র তা পছন্দ করত না। শুভ্রর পছন্দ হুডতোলা রিকশায় দুজনের ঘনিষ্ঠতা অথচ আদিরা চাইতো হুডখোলা রিকশায় শুভ্রর কাঁধে মাথা রেখে থাকবে। স্বপ্নগুলোর কথা ভাবতেই চোখের কোণে অশ্রু জমে আদিরার।
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কাহিনীকে বিস্তারিত লেখার জন্যই বড় করে লেখা। আশা করি খারাপ লাগবে না।]