আগন্তুক পর্ব ১

” ঘণ্টাপাঁচেক কাজী অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পরও শুভ্র এলো না। সেদিন প্রথমবারের মতো বুঝলাম ভয় কি! আগে ভালোবাসার কেউ ছিল না তাই হারানোর ভয়টাও ছিল না। শুভ্র, আমার চাচাতো ভাই। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর চাচা-চাচী কখনোই আমাকে সহ্য করতে পারতেন না। দাদু ছিলেন বলে কিছু বলতেও পারতেন না। এক সপ্তাহ হয়েছে দাদু মারা গেছেন। তিনি মারা যাওয়ার পরেরদিনই আমার কলেজ যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। দুদিন পরেই বিয়ে ঠিক আর আজ ছিল বিয়ে। শুভ্র ভাইয়ার কথায় বিয়ের আসর ছেড়ে তার জন্য চলে এসেছিলাম অথচ তিনিই আসলেন না। এখন না আমি ফিরতে পারব আর না শুভ্র ভাইয়ার কোন খোঁজ আছে। “একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেল আদিরা নামের মেয়েটা। মেয়েটার নামের অর্থের সাথে মিল আছে বলতে হবে। বাস্তব অর্থেই শক্তিশালীনী সে নয়তো আমারো সাধ্যি নেই যে কারো প্রণয়ের টানে এমন করে সব বিসর্জন দিয়ে ছুটে আসবো। ভালোবাসা শব্দটার প্রতি বিতৃষ্ণা আমার বহুদিনের। তন্বী চলে যাওয়ার পর থেকে কাউকে আর ভালোবাসতে পারিনি। তন্বী আমার প্রাক্তন স্ত্রী। অবশ্য আইন অনুযায়ী সে এখনো আমার স্ত্রী তবে সে অন্যকারো সাথে এক ছাদের নিচে থাকে। কার সাথে থাকে কোথায় থাকে কিচ্ছু জানিনা। কথাগুলো আপন মনেই আওরাচ্ছিল আদৃত। কপালের এককোণ বেয়ে রক্ত ঝরছে আদিরার। মেয়েটা রাস্তায় গুণ্ডাদের খপ্পরে পড়েছিল নাকি? কিছু তো বলেওনি ঠিকমতো। আদৃতই বা এখন এই মেয়েকে নিয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সে থাকে শহরের মাঝামাঝি বেশ কোলাহলপূর্ণ এক বাড়িতে তাও ভাড়া বাসা। এই মেয়েকে নিয়ে সেখানে ওঠা অসম্ভব। তাছাড়া তন্বী পালিয়েছে দুসপ্তাহও হয়নি এমন সময় অন্য মেয়েকে নিয়ে বাসায় ঢুকলে রীতিমতো চরিত্রহীন খেতাব পেতে দেরি হবে না কিন্তু মেয়েটাকে এভাবে ফেলেও তো যেতে পারছে না আদৃত। মেয়েটার সস্তা লাল শাড়ির আঁচল ঝুলে পড়ছে বেঞ্চের শেষপ্রান্তে,এলোমেলো চুলগুলো সন্ধ্যের মৃদু বাতাসে দোদুল্যমান। আদৃত আর সাতপাঁচ না ভেবে মেয়েটার হাত ধরল। আদিরা চমকে ওঠে ছাড়িয়ে নিল হাতটা।

~দেখুন আমাকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই। আপনার কোন ক্ষতি আমি করব না। মাঝরাতে আপনাকে এখানে ফেলে যেতে পারছিনা।

~আপনার বাসায় প্রবলেম হবেনা?

~হলে হবে,সেটা ভেবে আপনাকে এখানে ফেলে আমি যাব না।

আদিরার ব্যাগটা হাতে নিয়ে সামনে এগোতে লাগল আদৃত। পিছনে আদিরা অনিপুণ হাতে শাড়ি সামলানোর চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত। সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত নামছে,আলোয ছিটেফোঁটাও নেই রাস্তায়। নিয়ন বাতিগুলোও জ্বলছে না। এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতেও ভয় হচ্ছে আদিরার। একটু আগে গুন্ডাগুলো এমনভাবে তাড়া করেছিল। আদৃতের পাশে বেঞ্চে আশ্রয় দিয়েছিল নিয়তি তাকে। এখন সে-ই নিয়তিই আদিরাকে নিয়ে যাচ্ছে আদৃতের বাড়িতে। ” চলে এসেছি আমরা। “আদৃতের কথায় থেমে গেল আদিরা। অন্ধকারে চোখেই দেখছে না সে কিছু। সামনে কি আছে তাও আন্দাজ করতে পারছে না। একটু বাদে উপলব্ধি করল কেউ একজন তার হাত টেনে ধরে বেশ সন্তর্পণে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। একটা ঘরে ঢুকেই খট করে দরজাটা লাগিয়ে দিল আদৃত। আদিরা বেশ ভয়ে ভয়ে আছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।

~আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন,আমি রান্নাবান্না করছি।

~আপনি রান্না করবেন?

~জ্বী,অভ্যাস আছে।

কথা বাড়াল না আদিরা। দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে গেল। আদৃত বেসিনে গিয়ে মুখে সামান্য পানির ছিটে দিয়ে আবার রান্নাঘরের দিকে গেল। সবজি তেমন কিছুই নেই অথচ একটা মেহমান ঘরে এসেছে। তাকে যা তা তো আর খাওয়ানো যাবে না। ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে ভিজতে দিল আদৃত। এরই মাঝে দরজায় খটখট শব্দ শুনে চমকে উঠল সে। এই অসময়ে কে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে? অজানা এক আশঙ্কায় মনের ভেতর ভয় জমতে শুরু করল তার। ঢোক গিলে ধীর পায়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বিসমিল্লাহ বলে দরজা খুলতেই দেখল উপরতলার বাসাওয়ালী খালাম্মা। সালাম দিয়ে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করল আদৃত। অন্য দিন হলে হয়তো ভদ্রমহিলাকে ভেতরে ডেকে খানিকক্ষণ গল্প-গুজব করত সে তবে আজ তা সম্ভব না। আজ এমনিতেই এত ঝামেলার মাঝে আছে সে। ভদ্রমহিলাও যেন ভেতরে আসতে অনাগ্রহী। আদৃতের হাতে একটা ধূসর রঙের খাম ধরিয়ে তিনি দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠলেন। আদৃত খামটা নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। খামটা টেবিলে রেখে দেখতে গেল মাংসের অবস্থা।

আধঘণ্টার বেশি সময় ধরে ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে চোখমুখে পানি দিচ্ছে আদিরা তবুও যেন সে মানতে পারছে না তার সাথে যা হয়েছে তা বাস্তবতা। শুভ্রকে সে দেড়বছর ধরে ভালোবাসে। এটা তো একতরফা ভালোবাসাও নয়,শুভ্রও তো আদিরাকে ততটাই ভালোবাসে তবে কেন হঠাৎ এমন একটা কাজ করে বসল শুভ্র। এমন করে আদিরার সাথে ছলনা করে সবকিছু কেড়ে নিতে একটুও বাঁধলো না তার? আজকের এই রাতটা পেরোলেই তো চলে যেতে হবে তার। কোথায় যাবে,কার কাছে যাবে তার নিশ্চয়তা নেই এমনকি আজকের রাতটাই যে সে আদৃত নামক অপরিচিত লোকটার কাছে নিরাপদ কিনা তার নিশ্চয়তাও নেই। সবকিছুর মাঝে নিজেকে একটুকরো অবহেলিত আবর্জনা খণ্ড মনে হচ্ছে আদিরার। চোখেমুখে আরেকদফা পানি দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই মাথাটা ঘুরে ওঠে আদিরার। সারাদিনের ক্লান্তি আর না খেয়ে থাকা সবমিলিয়ে মাথার উপর দিয়ে অনেক প্রেশার গেছে আজ আর শরীর তো একেবারে শেষ। বিছানায় বসতেই ঘুমে আচ্ছন্ন চোখদুটো আর বাধা মানলো না। বালিশে হেলান দিয়ে ঘুমের জগতে হারিয়ে গেল আদিরা। আদৃত রান্না শেষ করে ঘরে আসতেই দেখল আদিরা বেসামালভাবে বিছানার একেবারে শেষপ্রান্তে শুয়ে আছে। আর একটু হলেই নিচে পড়ে যাবে মেয়েটা। কিছু খেলোও না,সারাদিনের ক্লান্তি,না খেয়ে থাকা-অসুস্থ না হয়ে পড়ে। বারান্দার গ্রিলের ফাঁকে পূর্ণিমা চাঁদটাকে দেখা যাচ্ছে। জোৎস্নার আলো এসে পড়ছে বধূবেশে সেজে থাকা আদিরার উপর। আদিরার শ্যামবর্ণের মুখটাতে চাঁদের রোশনী মুখের সৌন্দর্যটাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

আজকাল তন্বীকে আর মনে পড়ে না আদৃতের। হয়তো তন্বীর অবস্থাটাও এমন ছিল। ভালোবাসার টান সে বিয়ের পরেও ভুলতে পারেনি বলেই ছেড়ে গেছে আদৃতকে। আচ্ছা, একটাবারও কেন সব বলল না তন্বী? আদৃত তাহলে নিজেই তন্বীকে রেখে আসত। এভাবে নিজের আর আদৃতের পরিবারের মুখে চুনকালি মেখে না গেলেও পারতো সে। আদিরা নড়ে উঠছে বারবার। সম্ভবত ঠাণ্ডা লাগছে। আদিরার গায়ে কাঁথাটা দিয়ে বারান্দায় গেল আদৃত। রকিং চেয়ার রাখা আছে একটা বারান্দায়। তন্বী এখানে বসে চুল আঁচড়াত রোজ। বিয়ের এক বছরও পূর্ণ হয়নি তাদের। তন্বীর কথা ভাবতে ভাবতেই আদৃতের মনে পড়ে টেবিলের উপর রেখে আসা খামটার কথা। চোখের কোণে জমে থাকা পানিটুকু মুছে টেবিলের উপর থেকে খামটা হাতে নেয় আদৃত। খাম হাতে নিয়েও যেন খোলার মানসিক শক্তিটাও পাচ্ছে না।

পার্কের ঐ বেঞ্চটাতে তন্বীকে নিয়ে বসত আদৃত। রোজ শুক্রবার এই সময়টা প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে কাটাত তারা। এত ভালোবাসার মাঝেও তন্বীর মনের অভিযোগটা কখনোই বুঝতে পারেনি আদৃত। এটা কি তার ব্যর্থতা নাকি তার ভালোবাসার ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সে। খামটা খুলতেই একটা লিগ্যাল নোটিশ হাতে আসে আদৃতের। ডিভোর্স পেপার! মুহূর্তেই মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ে তার। তন্বী ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে? এতটাই সহজে বুঝি একটা সম্পর্কে বিচ্ছেদ আনা যায়? ডিভোর্স লেটারটা সযত্নে ড্রয়ারে তুলে রাখে আদৃত আর খামে আরেকটা চিঠি পায়। চিঠির গায়ে মাখানো পরিচিত সুগন্ধিটা তন্বীর স্মৃতির খেয়ায় ভাসাচ্ছে আদৃতকে। চিঠিটা খুলল আদৃত। পেন্সিলে লেখা চিঠি,গোটা গোটা অক্ষরে। পরিচিত লেখার মাঝে অপরিচিত কিছু অনুভূতির সংমিশ্রণ।

” আদৃত,
তোমার ভালোবাসা নিখাঁদ ছিল আমার প্রতি তবে তোমার সাথে প্রতারণা করা আমার পক্ষে সম্ভব না। বিয়ের অনেক আগে থেকেই আমি একজনকে ভালোবাসতাম। তাকে ভুলে তোমার সাথে মিথ্যে প্রেমের অভিনয় করতে পারছিলাম না। হয়তো সংসারী হয়ে উঠতে পারিনি বলে চরিত্রহীনা খেতাব পাবো তবে ভালোবাসাকে ভুলে তোমার হয়ে থাকতে আমি পারব না।

বিয়ের আগেই তোমায় সব বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাবা-মা আমার মুখ বন্ধ করিয়ে দিন ধমক দিয়ে। কিছুই করার ছিল না। আমি জানি তুমি মন থেকে যতটা ভালো ততটাই সাহসী। তুমি খুব সহজেই সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে পারবে আর আমাদের সম্পর্কও ততটা গভীর নয় যে একে অপরের প্রতি কোনপ্রকার টান অনুভব হবে। ”

ভালো থেকো আদৃত। ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিও।
ইতি,
তোমার প্রাক্তন তন্বী

আদৃত মুচকি হেসে চিঠিটা পাশে রেখে দেয়। আদিরা এখনো ঘুমাচ্ছে,গভীর ঘুমে মগ্ন সে। আদৃত বুঝতে পারে না এই আগন্তুক মেয়েটার প্রতি কেন মুগ্ধ হচ্ছে আদৃত? মেয়েটার ভালোবাসা আগলে রাখার সাহসিকতা দেখে এই মুগ্ধতা নাকি মেয়েটার শ্যামবর্ণ মুখটায় চাঁদের জোৎস্নামিশ্রিত সৌন্দর্যের আভাস দেখে? নিজের কাছেই এমন একটা অহেতুক প্রশ্ন করে বসে আদৃত অথচ তাদের দেখা এই একটা রাতের জন্যই। ভোরের আলো ধরনীর বুক চিরে উপনীত হওয়া মাত্র আগন্তুক মেয়েটা চলে যাবে নিজের গন্তব্যে। আচ্ছা মেয়েটা কোথায় যাবে? তার তো যাওয়ার জায়গা নেই। আগন্তুক থেকে পরিচিতা হয়ে উঠলে কি খুব ক্ষতি হবে?

চলবে…

আগন্তুক 🍁
লেখা-মিহি
সূচনা পর্ব

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। দুই পর্বের ছোট গল্প এটি। আগামী পর্বে সমাপ্তি হবে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here