এক মুঠো গোলাপ পর্ব শেষ

এক মুঠো গোলাপ
Sinin Tasnim Sara
শেষ পর্ব
______
(কয়েকমাস পর)

আনন্দ-বিষাদ শব্দদুটো একে অপরের পরিপূরক। তবে সুপ্তর মনে হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা ওর ভাগে বিষাদের গল্পগুলো একটু বেশি করে লিখে রেখেছেন।
সুখের দেখা পায় কি না তারমধ্যেই একরাশ বিষণ্নতা হানা দেয় দরজায়।
শ্বশুরবাড়িতে পাঁচ মাস যাবৎ থাকছে সুপ্ত। পাঁচ মাসে বড্ড বিরক্ত হয়ে উঠেছে সে। শ্বাশুড়িকে বাইরে থেকে যেমন মনে হত তেমন সে নয়। অনেক খুঁতখুঁতে স্বভাব আর নির্লজ্জ ধরনের মহিলা।
নির্লজ্জ বলার কারণ, সে সদাসর্বদা সুপ্ত আর নিদ্রর দিকে লক্ষ্য রাখে। তাদের ইন্টিমেসির ব্যাপারটা নিয়ে নানাধরণের প্রশ্ন করে।
এত চেষ্টা করেও ব্যাপারটা যেন তার থেকে লুকোতে পারে না। কোনো না কোনো উপায়ে সে জেনে যায়। আর পরদিন সকালে নানারকম আপত্তিকর প্রশ্ন করে। খুব বিরক্ত লাগে সুপ্তর, মন হয় সিসিটিভি লাগিয়ে তাকে দেখা হচ্ছে।
ইদানিং ওনার কারণেই নিদ্রর কাছে যেতে ইচ্ছে করে না সুপ্তর।
এসব আপত্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে ইচ্ছে করে না।
অবশ্য কাছে যাবেই বা কি করে! সেও যা রূপ পরিবর্তন করছে। চাকরি ছেড়েছে একমাস হলো। সারাদিন ব্যস্ত থাকে আইটি ফার্মের কাজ আর পড়াশোনা নিয়ে। সুপ্তর জন্য তো সময়ই নেই তার।
সুপ্তও যে ওর সাথে বিশেষ কথা বলে তা নয়। সুযোগই তো পায়না। মেজাজ তার সবসময় তিরিক্ষিতে। এর মধ্যে বেশ কিছুটা টাকা বেরিয়ে গেছে হাত থেকে। ওর দু বছর চাকরি জীবন এবং স্টুডেন্ট লাইফের টুকটাক উপার্জনের জমানো অর্থ দাঁড়িয়েছিল পাঁচ লাখের কাছাকাছি। পুরোটা ইনভেস্ট করে এখন শূন্য হাতে বসে আছে। সুপ্তর ধারণা টাকা না থাকায় তার কনফিডেন্সটা কমে গিয়েছে। এবং এ কারণেই সে সবসময় রাগী মুডে থাকে। তাছাড়া এসব ফার্ম টার্ম করে সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা ৪০%
লাক ফেভার না করলে আইডিয়া ফ্লপ। বসে থেকে এতগুলো টাকা ডুবে যাবে।
সুপ্ত চেষ্টা করেছে কিছু টাকা ওর বাবা-র থেকে এনে দিতে। শুনেই নিদ্রর কি ধমক। যে নিজের মায়ের থেকে পকেট মানি নেয়া বন্ধ করেছে কলেজ লাইফেই, সে আবার শ্বশুরের সামনে হাত পাতবে!
এসব নিয়ে বেশ ঝামেলা হয়েছে তাদের মধ্যে। দিনকে দিন ঝগড়ার পরিমাণ বাড়ছে বৈ কমছে না। গতকাল রাতেও তো একচোট ঝগড়া হলো।
অবশ্য রাতের টপিক টা টাকা পয়সা নিয়ে ছিলো না। ছিলো টাইম মেইনটেইনিং নিয়ে। সুপ্ত কিছু শারিরীক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পিরিয়ড মিস করে গেছে দু-তিনমাস হলো। ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা জরুরী। এমনিতেই ওর অসুস্থতার শেষ নেই!
কতদিন থেকে বলছে নিদ্রকে। আজ নিয়ে যাবো কাল নিয়ে যাবো করতে করতে মাস পেরিয়ে গেল। তার খবর নেই। এ নিয়ে কাল একটু চেঁচামেচি করেছে। সেও প্রতুত্তরে কড়া কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিয়েছে। সইতে পারেনি সুপ্ত। বলেছে ইরার দিকে মন ঝুঁকে গেছে নিদ্রর, এজন্য তাকে ইগনোর করছে। মন’ই যদি উঠে যাবে তাহলে বিয়ে করেছিল কেন?
সিলি তর্ক-বিতর্ক।
সুপ্তর মুখে এরকম কথা আনএক্সপেক্টেড ছিল নিদ্রর কাছে। রাগ করে বেরিয়ে গেছে সে বাড়ি থেকে।
সারারাত দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি সুপ্ত। বিরতিহীন ভাবে কান্নাকাটি করেছে।
এক বছরও হয়নি সংসার জীবনের তাতেই এত ঝামেলা, ভবিষ্যতে যে আরো কি হবে ভাবলেই গা শিউরে উঠছে ওর।
কিচেনে দাঁড়িয়ে উদাস মনে এসব ভাবছিল সুপ্ত। ধ্যান ভাঙ্গলো নারী কণ্ঠের ধমকে। চোখ তুলে দেখলো ওর মামী শ্বাশুড়ি রাগী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
হঠাৎ ওনার রাগের কারণ বুঝতে পারলো না সুপ্ত।
স্বাভাবিক ভাবেই জানতে চাইলো,
— কি হয়েছে মামী?
— কি হয়েছে! সংসার পুড়িয়ে ছারখার করছো তুমি। আচ্ছা কোনো কাজই কি ঠিকঠাক পারো না। কাল রুটি পুড়লে, আজ তরকারি পোড়াচ্ছ। কোনদিন বাসাটাতেও আগুন লাগিয়ে দিবে।
তোমাকে কি কিছুই শেখানো হয়নি বাসা থেকে!
মামী শ্বাশুড়ির এমন কটুক্তি শুনে চোখে জল চলে এলো সুপ্তর। কিছু উত্তর দিতে গিয়েও সামলে নিলো। এরা কি ওকে দাসীবাঁদী করে এনেছে! এতই নাকি
টাকাপয়সা যে, তা রাখার জায়গা নেই। অথচ খাটিয়ে নিচ্ছে বাড়ির বউকে।
চাইলেই তো একটা রাঁধুনি রাখতে পারে।
সেদিন বাড়ির ছুটা বুয়াটা বলল দু’টো রাঁধুনি ছিল এই বাসায়। কিন্তু সুপ্ত আসার পূর্বেই তাদের ছুটি দিয়ে দিয়েছে।
এটা কি ওকে জব্দ করার পরিকল্পনা? কিন্তু ও কার ক্ষতি করলো যে এভাবে প্রতিশোধ নিতে হবে!
— এ্যাই মেয়ে কথা বলছো না কেন!
ধমকে উঠলেন মিসেস জামাল। সুপ্ত তড়িঘড়ি করে গ্যাসস্টোভ অফ করে চোখ নামিয়ে নিচু স্বরে বলল,
— স্যরি মামি। আর হবে না।
— পেয়েছো একটা স্যরি। স্যরি বললেই সব সমাধান হয়?
আসুক আজ নিদ্র বাসায়। ওকেও জিজ্ঞেস করার আছে এই অকর্মণ্য মেয়েটাকে সে কি করে পছন্দ করলো।
মুখ ঝামটা দিয়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলেন মিসেস জামাল। তার বহুদিনের ক্ষোভ সুপ্তর ওপর। এই বদমাশ মেয়েটার জন্যই তার একমাত্র সন্তান নুহা নিজের ভালোবাসা পেলো না; নিদ্রকে পেলো না। মেয়েটা মনে মনে যে চাপা কষ্ট বয়ে নিয়ে বেড়ায় খুব করে জানেন তিনি। মা তো। মায়েরাই যে সন্তানের মন ভালো বুঝবে।
,
মামী শ্বাশুড়ি বেরিয়ে যাওয়ার পর হাতে থাকা কড়াইয়ের ঢাকনা টা গায়ের জোরে ছুঁড়ে ফেললো সুপ্ত মেঝেতে।
জিনিসটা কাঁচের হওয়ায় সশব্দে ভেঙে ছড়িয়ে পড়লো চারিদিক।
আর এক মুহুর্ত এই বাসায় থাকবে না ও।
যে সংসারে বউয়ের মর্যাদা নেই সে সংসারের মাথায় লাত্থি।
আর কম্প্রোমাইজ করা সম্ভব নয়। কম্প্রোমাইজিং ওর ধাঁতে নেই। এখনো বাবা-র বাসায় উঠলে তাকে সাদরে গ্রহণ করবেন বাবা।
এই ছোটোলোক গুলোর সাথে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই ওর। ভুলই হয়েছে, বিয়েতে মত দেয়ার আগে আরেকটু চিন্তা করবার প্রয়োজন ছিলো। ভালো প্রেমিক যে ভালো হাসবেন্ড হবে, যাচাই-বাছাই না করে এমন চিন্তা করা উচিৎ নয়।
ধপাধপ্ পা ফেলে বেরিয়ে গেল সুপ্ত। রাগের বশে খেয়ালও করলো না ছড়িয়ে থাকা কাঁচগুলো বেশ কয়েকটা তার পায়ে বিঁধে গেছে।
যতদূর হেঁটে যাচ্ছে ততখানি পথে রক্তের ছাপ ভেসে উঠছে।
______
(রাত্রিবেলার ঘটনা)

রাগের মাথায় তড়িৎ কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যতটা সহজ, বাস্তব জীবনে তা প্রয়োগ করা ততটাই কঠিন।
সুপ্তর ক্ষেত্রে কথাটা যেন শতভাগ সত্যি।
ভালোবাসে সে নিদ্রকে। এত সহজে ছাড়বে কি করে? মানুষটা যে পাল্টে গেছে এটা তো তাকে বোঝাতে হবে।
অভিমান করে কথা বন্ধ করতে পারলেও, তাকে ছেড়ে যাবার শক্তি সুপ্তর নেই।
বিষণ্ন ভাবে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো সুপ্ত। আচনক বলিষ্ঠ একজোড়া হাত ওর কোমর আঁকড়ে ধরলো।
পিছু না ঘুরে শরীরের ঘ্রাণেই বুঝতে পারলো মানুষটা আর কেউ নয় নিদ্র।
প্রতিক্রিয়া বিহীন দাঁড়িয়ে রইল সুপ্ত।
নিদ্র ওর কাঁধে থুতনি রেখে কোমল স্বরে বলল,
— আ’ম রিআ্যালি স্যরি মাই কুইন। কাল রাতে ওরকম ব্যবহার করা মোটেই ঠিক হয়নি আমার।
–…..
— কথা বলবে না আমার সাথে?
সুপ্তকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো নিদ্র। সুপ্ত নিশ্চুপ অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো।
ওর গালে হাত দিয়ে মুখের সামনে ধরে কাতর স্বরে নিদ্র বলল,
— কিছু তো বলো সুপ্ত।
নিদ্রর কথাগুলো সুপ্তর মনের অভিমান কে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। চোখ উপচে জল আসতে চাচ্ছিল কিন্তু নিজের সর্বস্ব টা দিয়ে কান্না আটকালো সুপ্ত। হঠাৎ আসা অভিমানের চাদরে ঢাকা পড়লো সমঝোতার চিন্তাভাবনা গুলো।
ওকে দু হাতে মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রুক্ষ স্বরে বলল,
— একদম আহ্লাদ করতে আসবে না আমার সাথে। তোমাদের আসল চেহারাটা আমার দেখা হয়ে গেছে। স্বার্থসিদ্ধির জন্য নাটক করতে আসে। স্বার্থ শেষ ভালোমানুষি শেষ।
— সুপ্ত কিসব বলছো তুমি!
— ঠিকই বলছি আমি। আফসোস তোমাদের চিনতে বড্ড দেরি হয়ে গেল আমার।
কান্নাটা আটকে রাখতে পারলো না সুপ্ত। অশ্রুকণিকা গুলো ঝর্ণা ধারার মতন অবাধে গড়িয়ে পড়লো চোখের কার্ণিশ ছেড়ে শুভ্র কপলে।
ভেতরে যাবার জন্য পা বাড়াচ্ছিল সুপ্ত; নিদ্র ওর হাত ধরে আটকে ফেললো। অনুনয়ের সুরে বলল,
— আমাকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগ তো দাও সুপ্ত।
— কোনো এক্সপ্লানশনের প্রয়োজন নেই।
— সুপ্ত প্লিজ…
— একা থাকতে দাও আমাকে।
হাত ছাড়িয়ে ঘরে চলে গেল সুপ্ত। কি মনে করে ব্যালকনির দরজার সামনে এক মুহুর্তের জন্য দাঁড়ালো। পিছু না ঘুরেই তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“লোকে ঠিক বলে, সহজলভ্য জিনিসের কদর নেই।
যা অর্জন করতে পরিশ্রম করতে হয়, তা সুরক্ষিত রাখবার আগ্রহও অধিক থাকে। সেটা হোক কোনো বস্তু কিংবা ভালোবাসা”

সুপ্তর যাবার পানে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নিদ্র। মেয়েটা ওকে ভুল বুঝছে। নতুন নতুন বিজনেস শুরু করেছে তার মধ্যে এত ব্যস্ততা!
ভুলটা ওরও কিছু কম নয়। সুপ্তকে রাফনিদের কাছে রেখে আসাটাই উচিৎ ছিল। কেন যে মায়ের কথা শুনে ওকে এ বাসায় আনতে গেলো!
এখন তো ঠিকঠাক সময়ই দিতে পারছে না ওকে । বড্ড বেশিই অভিমান জমেছে বউটার মনে।থাক কিছুটা সময় একা। রাগ ঠান্ডা হলে সব ঠিক করে নেয়া যাবে।
,
ঘরের ভেতর শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি হওয়ায় বাইরে বেরিয়ে এলো সুপ্ত।
বাসার সামনের রাস্তাটা নির্জনই থাকে। ওখানটায় একটুখানি হাঁটাহাঁটি করলে হয়তোবা ভালো লাগবে।
রাত- অন্ধকার আর পায়ের ব্যাথা কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে রাস্তায় নামলো সুপ্ত। ওর এখন নিস্তব্ধতা চাই।
বাইরে এসে চুল খুলে দিলো। নিয়ন আলোয় জনাকীর্ণ রাস্তাটা ভালো লাগছে। মনের সকল ক্লেশ দীর্ঘশ্বাসের সাথে বের করে দিয়ে সুবিশাল আকাশের পানে মুখ তুলে চাইলো। আকাশের বুকে অসংখ্য তারা মুক্তোর মতন জ্বলজ্বল করছে।
এক ধ্যানে তাকিয়ে সেগুলো গুনবার চেষ্টা করলো সুপ্ত।
এক সারিতে কয়েকটা গোনার পর হিসেব এলোমেলো হয়ে গেল।
বিরক্ত হয়ে পুনরায় প্রথম থেকে গুনতে শুরু করলো সুপ্ত।
ছোটোবেলাকার কথা মনে পড়ছে, বাবার কথা মনে পড়ছে।
বুক ভারী হয়ে আসছে সুপ্তর। বহু চেষ্টা করেও চোখের পানি আটকাতে পারলো না সে। শব্দ যেন না হয় এজন্য দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বড় বড় শ্বাস নিতে লাগলো।
মোটা মোটা অশ্রুদানা তার চিবুক ছাড়িয়ে মিশে যেতে থাকলো গলায় পেঁচানো ওড়নায়।
“পৃথিবীটা খুব নিষ্ঠুর বাবা, খুব নিষ্ঠুর”
বিড়বিড় করে শব্দগুলো আওড়ে গেল সুপ্ত।
খানিক পর একটা শীতল হাত তার কাঁধ ছুঁয়ে দিল।
চোখ মুছে পিছু ঘুরতেই দেখলো একটা অপরিচিত মুখ।
ভ্রু জোড়ায় কুঞ্চন আসলো সুপ্তর। রুক্ষতা মেশানো গলায় প্রশ্ন করলো,
— কে আপনি?
— আফনের যম।
বিশ্রী হাসি লেপ্টে আছে লোকটার ঠোঁটে। সুপ্ত আর কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই লোকটা তার হাতে থাকা একটা রুমাল সুপ্তর নাকে চেপে ধরলো। সুপ্ত ত্রস্তে সরে যাবার চেষ্টা করলে আরো একজন ওকে পেছন থেকে চেপে ধরলো।
মিনিট দুয়েক ছটফট করতে করতে এক সময় নেতিয়ে পড়লো সুপ্ত।
ওর চেতনাহীন দেহটা কাঁধে তুলে নিয়ে প্রথম লোকটা ক্রুর হাসি হাসলো৷
— এই মাল পাচার করলে কোটি টাকা পামু ভাই।
দ্বিতীয় লোকটা সেই হাসিতে যোগ দিয়ে মাথা নেড়ে বলল,
— বস রে কল দিয়া ক কাম খতম। সে যাতে চিন্তা না করে। এই মাইয়ার ছায়াও আর খুইজ্জা পাইবো না কেউ। রাইতের আন্ধারে এর আন্ধারী জীবনের শুরু।
সশব্দে হেসে উঠল লোকদুটো।
,
নিদ্রর খুব অস্থির লাগছে। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁইছুঁই। সুপ্ত রুমে নেই। এত রাতে ও কোথায়? মায়ের সাথে তো ঠিকঠাক কথা বলেনা। তবে কি ছাদে?
ভাবনাচিন্তার মাঝেই ফোনটা বেজে উঠল নিদ্রর। হাতে নিয়ে দেখে রাফনিদ।
নিজেকে স্বাভাবিক করে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রাফনিদ আনন্দিত গলায় বলল,
— তৌহিদ কে খুঁজে পেয়েছি নিদ্র।
— আলহামদুলিল্লাহ। ফাইনালি খুঁজে পাওয়া গেল অভিমানী মানুষটাকে?
— হ্যাঁ।
লজ্জা মিশ্রিত গলায় বলল রাফনিদ।
— আচ্ছা সুপ্ত কোথায়? ওকে দাও তো নিউজ টা দেই। ফোনে বন্ধ কেন মেয়েটার!
— আমি তো একটু বাইরে আছি। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো। বাসায় গিয়ে কল দিই।
— এত রাতে বাইরে কেন?
— একটু কাজ ছিল। ডোন্ট ওয়ারি এক্ষুনি বাসায় পৌঁছে যাব।
— ঠিকাছে। ওকে কল করতে বোলো।
— অবশ্যই।
ফোন কেটে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো নিদ্র। মিথ্যে বলতে খারাপ লাগছিল কিন্তু করার কিছু নেই। ছোটোখাটো ঝামেলার কথা পরিবারের সদস্যদের না বলাই ভালো।
ভাবনা চিন্তায় সময় ব্যয় করাটা সমীচীন মনে করলো না নিদ্র। ফোন পকেটে ভরে ছাদের দিকে পা বাড়ালো সুপ্তর খোঁজে।
ছাদে তিনটে বাল্ব লাগানো আছে। সব কটা জ্বালিয়ে পুরো ছাদ, চিলেকোঠার ঘর সব জায়গায় সুপ্তকে খুঁজলো। কোথাও নেই সে৷ বেশ কয়েকবার নাম ধরে ডাকলোও কিন্তু কোনো সাঁড়াশব্দ নেই।
চিন্তিত হয়ে পড়লো নিদ্র। ছাদের দরজা আটকে বাসার ভেতরে ফিরে আসলো।
মনের ভয় বেড়ে গেল সাথে বাড়লো ডাকাডাকির শব্দ।
অনিমা’ই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসলেন এবার।
— কি রে বাবা। এত রাতে বৌ মা’র নাম ধরে ডাকছিস কেন, ঘরে নেই ও?
— না মা।
— ও’মা এতরাতে সে ঘর ছেড়ে বেরুবে কেন!
— আসলে আমাদের মধ্যে একটু মনমালিন্য হয়েছিল। ও রাগ করে…
— ছাদে দেখেছিস?
— হ্যাঁ নেই ওখানে।
— গেস্টরুম গুলোতে দ্যাখ না।
— দেখেছি। সেখানেও নেই।
— সে-কি। বাসা থেকে মেয়ে গায়েব হবে কি করে!
অনিমার কণ্ঠস্বরে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
নিদ্র-অনিমার কথপোকথনের মাঝে বাকিরাও জেগে উঠল।
পুরো বাড়ির লাইট জ্বালানো হলো।
জামাল সাহেবও ভাগ্নের সাথে যোগ দিলেন ভাগ্নে বউকে খোঁজায়। কোত্থাও পাওয়া গেল না সুপ্তকে। এমনকি বাগানেও না।
ভয় ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল নিদ্রর।
জামাল সাহেব আশংকা করলেন,
— বৌমা বাইরে যায়নি তো!
— দারোয়ান নেই গেইটে? সুপ্ত বাইরে গেলে ও জানালো না কেন আমাদের!
রেগে গেল নিদ্র। জামাল সাহেব ওর হাত ধরে বললেন,
— দারোয়ান তো নেই বাবা।
— নেই মানে!
— আজ বিকেলেই ছুটি নিলো। ওর নাকি মা অসুস্থ। তাকে দেখতে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে।
— ওহ্ মাই গড! তারমানে গেইটে এখন কেউ নেই। ফাঁকা পেয়েই সুপ্ত বেরিয়ে গেলো না তো!
বলতে বলতে ছুটে বেরুলো নিদ্র বাসা থেকে।
নাহ্ এখানেও তো নেই সুপ্ত। পুরো রাস্তা ফাঁকা। কদাচিৎ একটা গাড়ি-ঘোড়ারও শব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা।
গেলো কোথায় মেয়েটা! কর্পূরের মত তো উবে যেতে পারে না সে।
চিন্তাগ্রস্থ নিদ্র ডানে বায়ে তাকাতে তাকাতে এলোমেলো পায়ে হাঁটছিল। হঠাৎ তার পায়ের নিচে কিছু একটা চাপা পড়লো মনে হয়। ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে দেখলো স্কাই ব্লু কভার ওয়ালা একটা ফোন পড়ে রয়েছে। ওর বাজের দৃষ্টি সহজেই চিনতে পারলো ফোনের কভারটা। নিমেষে ফ্যাকাশে হয়ে গেল ওর মুখ। এটা তো সুপ্তর ফোন।
তড়িৎ ঝুঁকে হাতে তুলে নিলো ফোনটা। স্ক্রিনটা বাজে ভাবে ফাটা,বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।
ওর ভয়টাই সত্যি হলো। নির্ঘাত বিপদে পড়েছে সুপ্ত।
হাঁটু মুড়ে ধপ করে রাস্তায় বসে পড়লো নিদ্র। মাথার চুল খামচে ধরে চিৎকার করে উঠলো। কোথায় খুঁজবে এখন সুপ্তকে? কি হয়েছে তার সাথে?
সুপ্তর ফোন এখানে ভেঙে পড়ে রয়েছে কেন?ও কোথায়?
শতশত প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। শূন্য শূন্য লাগছে ভেতরটা।
চিৎকার শুনে জামাল সাহেব ছুটে এলেন। ভাগ্নের এমন অবস্থা দেখে কাঁধে হাত রেখে শঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
— কি হয়েছে বাবা?
— মামা সুপ্তর কিছু একটা হয়ে গেছে।
— কিছু একটা হয়ে গেছে মানে! কি হয়েছে? আর কে বলল তোকে?
— ও ভয়ানক বিপদে পড়েছে মামা। এই দ্যাখো ওর ফোন ভেঙে পড়ে রয়েছে এখানে।
হাত বাড়িয়ে ফোনটা দেখালো নিদ্র।
জামাল সাহেব ভয় মিশ্রিত গলায় বললেন,
— বৌ মা’র ফোন এখানে তাহলে বৌ মা কোথায়?
— জানিনা মামা, জানিনা। কিচ্ছু জানিনা।
— তুই ভেঙে পড়িস না বাবা। শক্ত হ। আমরা খুঁজে বের করবোই বৌমা কে। তার কিচ্ছু হবেনা।
— আমার সবকিছু অসহ্য লাগছে মামা। আমার বউয়ের যদি কোনো ক্ষতি হয় তাহলে কাউকে ছেড়ে কথা বলবো না আমি। যে বা যারা ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করবে তাকে জানে মেরে ফেলবো আই স্যয়্যার।
— শান্ত হ বাবা শান্ত হ তুই।
— মামা গাড়ি বের করো। এক মুহুর্ত লেইট করবো না আমি।
— হ্যাঁ। আমি গাড়ি বের করছি।
তড়িঘড়ি করে বাসার ভেতরে ঢুকে গেলেন জামাল সাহেব।
রক্তলাল চোখে সুপ্তর ভাঙা ফোনটার দিকে তাকিয়ে রইলো নিদ্র।
“ওর চলার পথটা আসলেই ভয়ানক কণ্টকাকীর্ণ। পদে পদে বিপদেরা হাতছানি দিয়ে ডাকে। কবে পাবে সে এসব থেকে মুক্তি! কবে হবে একটা মসৃণ জীবন?”
,
সেই রাতে শহর তোলপাড় করে খোঁজ চললো সুপ্তর। মধ্যরাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেল কিন্তু কোথাও মিললো না ওর দেখা। হাল ছাড়লো না নিদ্র।
সূর্যের আলো ফুটতেই থানায় মিসিং ডায়েরি লেখাতে গেল। কিন্তু সেখানে গেলে বলা হলো চব্বিশ ঘন্টার আগে মিসিং ডায়েরি লেখানোর নিয়ম নেই। এটা শুনে ক্ষেপে গেল সে। পুলিশের সাথে একচোট ঝামেলা করায় জেলে ভরা হলো তাকে।
জামাল সাহেব বিপাকে পড়ে গেলেন। সুপ্তকে খোঁজা বাদ দিয়ে মুখ্য হয়ে উঠল আদরের ভাগ্নেকে আইনি ঝামেলা থেকে বাঁচানো।
তড়িৎ ফোন করলেন তিনি ডিআইজি সাহেবের কাছে ।
ছেলে জেলে আছে শুনে ছুটে এলেন অনিমাও।
ক্ষমতার দম্ভে পুলিশদের শাসাতে ভুললেন না।
ওপর মহলের সাথে অনিমার জানাশোনা আছে ভালো। একটা কল করতেই ছাড়া পেয়ে গেল তার ছেলে।
বাড়ি ফিরলো যখন তখন নিদ্রর অবস্থা বিধ্বস্ত।
কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা সে নিজের ঘরে চলে গেল। দরজা আটকে ফেটে পড়লো আক্রোশে। একটা ভুল আর তার শাস্তি এত ভয়ানক!
সেন্টার টেবিলের ওপর সুপ্ত আর তার একটা ছবি বাঁধানো। ছবিটার ওপর চোখ পড়তেই গুটি গুটি পায়ে গিয়ে হাতে তুলে নিলো ফটো ফ্রেমটা।
মেঝেতে বসে কোমল ভাবে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো সুপ্তর হাস্যোজ্জ্বল ছবিতে।
“কোথায় হারিয়ে গেলে সুপ্ত? তুমি জানো না তোমাকে ছাড়া আমি কতটা অসহায়! অপরাধ করেছি মানছি। ক্ষমা চাইবার একটা সুযোগ তো দিতে।
তুমি যা বলবে তাই হবে চাঁদ প্লিজ ফিরে এসো।
ফিরে এসো আমার এক মুঠো গোলাপ”
ফ্রেমটা বুকে চেপে ধরে আর্তনাদ করে উঠল নিদ্র।
ওর আহাজারি সীমাবদ্ধ রইলো নিস্তব্ধ বাড়িটার চারদেয়ালের মধ্যে।
ধুলোর শহরে ব্যস্ততার কোলাহলে নিত্যনতুন বিচ্ছেদের গল্প বোনা হয়।
কংক্রিটের রাস্তায় পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া মানুষটাই উপলব্ধি করতে পারেনা সহচরের অন্তর্দহন। এখন কারো নোনাজল স্পর্শ করে না ভেতরটা। ব্যস্ততম জীবনে এসব অহেতুক অনর্থক।
সমাপ্ত

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here