#আগুন_ঝরার_দিনে
#পর্ব_২
– তোকে স্যার ডাকছে।
রুহি সুমির দিকে বেশ অবাক হয়ে তাকাল। আজ সকালের প্রথম ক্লাসটা আশফাক স্যারের ছিল। রুহি তাই ইচ্ছে করেই সকালের ক্লাসটা মিস করেছে। সে ক্যাম্পাসে এসেছে দুপুর বারোটার দিকে। কারন দ্বিতীয় ক্লাসটা দুপুর বারোটার পর।
রুহি অবাক হয়ে বলল, কোন স্যার ডাকছেন আমাকে?
– আশফাক স্যার।
রুহির ভেতরটা ধক করে উঠল। আশফাক স্যার তাকে ডেকেছেন কেন? সে ফাঁকিবাজ টাইপের ছাত্রী নয়। খুব জরুরি কিছু না ঘটলে সে সহজে ক্লাস মিস করে না। তবে আশফাক স্যারের ক্লাস পরপর দুইদিন মিস হয়ে গেছে! হয়ত এই কারণেই স্যার তাকে ডেকেছেন। টিচার্স রুমে গেলে নিশ্চয় তিনি তাকে যাচ্ছেতাই অপমান করবেন। রুহির হাত, পা ঠান্ডা হয়ে গেল। এই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার কারনটা অবশ্য আশফাক স্যার অপমান করবেন এই জন্য নয় বরং তার সামনাসামনি পড়তে হবে এই ভয়ে। রুহি দুরুদুরু বুকে টিচার্স রুমের দিকে রওনা হলো।
টিচার্স রুমে আশফাক স্যার ছাড়া আর কেউ নেই। পুরো রুম খালি। রুহি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, স্যার আসব।
আশফাক স্যার বোধহয় তার কথা শুনতে পাননি। এই মুহুর্তে তার মন হয়ত ইকোনোমিক্সের কোনো এক বইয়ের পাতায় ডুবে আছে। রুহি আবারো বলল, স্যার আসব।
এবার বোধহয় স্যার রুহির কথা শুনতে পেলেন। তিনি ভ্রু কুঁচকে রুহির দিকে তাকালেন। অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার! আপনি এই সময় এখানে কেন?
এবার রুহির অবাক হবার পালা। স্যার নিজেই তাকে এখানে ডেকে এখন দিব্যি ভুলে বসে আছেন। নাকি সুমিটা তার সাথে এমন বাজে মজা করেছে! রুহি থতমত হয়ে বলে, সরি স্যার। আমার এক বন্ধু জানাল আপনি আমায় ডেকেছেন। সে বোধ ভুল বলেছে স্যার। আমি খুব-ই দুঃখিত।
আশফাক স্যার মুখ শক্ত করে জানালেন, তাই হবে হয়ত। আমি আপনাকে ডাকতে যাব কেন?
রুহি চলে যাবার জন্য পা বাড়াল। পেছন থেকে স্যারের গলা আবার শোনা গেল। আজকে আমার ক্লাসটা করেছেন আপনি?
রুহি মাথা নিচু করে বলল, না স্যার।
– কেন করেন নাই জানতে পারি। এখন তো দেখি দিব্যি ফিটফাট হয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমার ক্লাসের সময় কী সমস্যা ছিল আপনার?
রুহি আশফাক স্যারের প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। এই মুহুর্তে সে নিজের কান্না চেপে রাখার প্রাণপন চেষ্টা করছে। স্যার ডেকেছেন শুনে সে এক ফাকে কমন রুমে যেয়ে চোখে কাজল দিয়ে এসেছে। এখন তার ভয় হচ্ছে চোখের পানিতে তার কাজল বোধহয় পুরোপুরি লেপ্টে যাবে। কাজল লেপ্টে যেয়ে আশফাক স্যারের সামনে তাকে ভূতের মত দেখাবে।
আশফাক স্যার আবারো বললেন, কী হলো জবাব দিচ্ছেন না কেন? ঠিক আছে আপনি যদি মৌখিক কোনো জবাব দিতে না চান তবে আমার কাছে লিখিত জবাব দিন। আজ বিকেল চারটার মধ্যে আপনি আমাকে লিখে জানান, আজ সকলে ইকোনোমিক্সের ক্লাসটা কেনো করেননি আপনি?
কথাগুলো বলার পর আশফাক স্যার রুহির মুখের দিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করলেন না। তিনি কঠিন মুখে আবার নিজের বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলেন।
রুহি প্রায় দৌড়ে টিচার্স রুমের সামনে থেকে চলে এল। যে কেউ তাকে দেখলে ভাববে তার উপর দিয়ে বড় রকমের একটা ঝড় বয়ে গেছে। নিজেকে একটু স্বাভাবিক করার জন্য ওয়াশরুম থেকে সে নিজের মুখে কয়েকবার পানির ঝাপটা দিয়ে এলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, সারে বারোটা বাজে। একটু পরেই দ্বিতীয় ক্লাসটা শুরু হবে। রুহি ক্লাস রুমের দিকে এগুলো। নিয়ম মাফিক পুরো ক্লাসটাও করল। কিন্তু ক্লাসে এক বিন্দু মোনোযোগ দিতে পারল না। তার সামনে বারবার আশফাক স্যারের রাগী কঠিন চেহারাটা ভেসে উঠছে। কী এমন করেছে সে? একটা ক্লাস করেনি এই তো! এই জন্য এত রাগ! নিজের অজান্তেই রুহির চোখ ভর্তি করে পানি এলো।
……………….
আশফাক আজ বেশ ভালো মুড নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছিল। গতকাল রাতে দীপা ছেলেকে নিয়ে বাসায় ফিরেছে। রোজবারের মত এবার আর আশফাককে দীপার রাগ ভাঙাতে শ্বশুর বাড়ি যেতে হয়নি। তবে আশফাকের ভালো মুডের কারন দীপার সন্তানসহ বাড়ি ফেরার চেয়েও অন্য কিছু ছিল। আশফাক খুব ভালো মতই জানে মানুষের জীবনে অন্যায়গুলো আসে খুব ছোট্ট কোনো পথ ধরে। সে পথগুলোকে শুরুরদিকে খুবই নির্দোষ এবং মসৃণ লাগলেও পরে তা বন্ধুর আকার ধারন করে। আশফাক যথেষ্ট ম্যাচিউর একটা মানুষ। গত বছর সে ঊনচল্লিশ পেরিয়ে চল্লিশে পা দিয়েছে। সে ন্যায় অন্যায় খুব ভালো বোঝে। তবুও তার আজ ক্যাম্পাসে আসার সময় মনে হয়েছিল, অসম্ভব মায়াময় সেই চোখের মালিকের সাথে তার আজ দেখা হবে। ক্লাস নেয়ার ফাঁকে দুই একবার সেই চোখে তার চোখ পড়বে! এর বেশী তো আর কিছু নয়! এটুকু ভাবতেই আশফাকের ভেতর অসম্ভব ভালোলাগার একটা রেশ কাজ করছিল। তবে ক্লাসে এসে আশফাক অবাক হয়ে খেয়াল করল, মেয়েটি আজ তার ক্লাসে উপস্থিত নেই। রাগে, বিরক্তিতে আশফাকের মুখটা তিতকুটে স্বাদে ভরে গেল। যে টপিকের উপর সে এর আগে শতবার ক্লাস নিয়েছে সেই টপিকটা পড়াতে যেয়ে বার বার তার ভুল হয়ে গেল। মাথা ব্যথার অজুহাত দেখিয়ে আশফাক টিচার্স রুমে চলে এলো। তবে আসার আগে সুমি নামের মেয়েটিকে বলে এলো রুহি ক্যাম্পাসে এলে যেন তার সাথে টিচার্স রুমে এসে দেখা করে।
“চলবে”