#আগুন_ঝরার_দিনে
পর্ব-৫
রুহি আজ হালকা গোলাপী রংয়ের একটা শাড়ি পরেছে। গলায় জড়িয়েছে সাদা রংয়ের মুক্তোর মালা। তার কোমর পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো সারা পিঠময় ছড়িয়ে আছে। রুহি ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আজ তার ক্লাসে একটা প্রেজেনটেশন রয়েছে। এই জন্য তার এত প্রস্তুতি। একটু পর সজল বাড়িতে আসবে। কাল রাতে সজলের সাথে তার কথা হয়েছে। সজল তাকে ক্যাম্পাসে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাবে। রুহি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেদিনের পর আশফাক স্যারের সাথে তার আর আলাদা করে কোনো যোগাযোগ হয়নি। এর মাঝে স্যার দুদিন তাদের ক্লাস নিয়েছেন বটে, রুহি সেই ক্লাসগুলোও করেছে তবে স্যার ক্লাসে একদম নিস্পৃহ ছিলেন। রুহির দিকে একবারের জন্যও তাকাননি পর্যন্ত। ভাবটা এমন যেন রুহিকে তিনি চেনেননি, যেন রুহির সাথে সুন্দর একটি বিকেল তার কখনো কাটেনি!
রুহির ভাবনার মাঝেই সজল এলো। সজল সরাসরি তার শোবার ঘরে চলে এসেছে। আর ক’দিন পর যে মেয়ের সাথে তার বিয়ে হবে সেই মেয়ের শোবার ঘরে ঢোকার জন্য অনুমতি নেয়ার সে কোনো প্রয়োজন মনে করেনি। সজলের এই ব্যাপারটা রুহির খুব খারাপ লাগে। ছেলেটার মধ্যে এসব নূন্যতম ভদ্রতা কিংবা সূক্ষ্ম রুচিবোধের কোনো বালায় নেই।
রুহি একটু বিরক্ত হয়ে বলল, এভাবে হুট করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লে যে! ঢোকার আগে একটু নক করলে তো পারতে।
সজল হাসিমুখে বলল, বারে! দুদিন বাদে যে মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হবে সেই মেয়ের ঘরে নক করে ঢুকতে হবে কেন?
– তাই বুঝি? বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তাই নক করার আর কোনো প্রয়োজন পড়বে না? এর মানে তুমি বলতে চাচ্ছো, বিয়ের পর একজন মানুষ আরেকজন মানুষের একেবারে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে যায়, তাই তো?
– তা তো একটু হয়েই যায়। কেন বিয়ের পর আমাদের শোবার ঘরে ঢোকার সময় তুমি কি আমার অনুমতি নিয়ে ঢুকবে নাকি?
রুহি সজলের কথার জবাবে কিছু বলতে যেয়ে থেমে গেল। সজল হয়ত ভুল কিছু বলছে না। এমনটায় তো আমাদের সমাজে হয়ে আসছে। রুহি নিজেও তার চারপাশে এসব দেখে বড় হয়েছে। রুহি সজলের দিকে তাকিয়ে একটা প্রশ্রয়ের হাসি দিলো। আর এইভাবে হাসাটায় রুহির সবচেয়ে বড় ভুল হলো। রুহি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সজল তার ঠোঁটে একটা গাঢ় চুমু খেলো। রুহি কয়েক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গেল। সজল তার সাথে এমনটা করতে পারে তা সে কল্পনাও করেনি। রুহির চোখ ভর্তি করে পানি এলো। জীবনের প্রথম চুমু, প্রথম আদর নিয়ে প্রতিটা মানুষের মাঝেই কিছু আবেগ থাকে। রুহির মাঝেও ছিল। আজ এই সকালে রুহির সকল আবেগ এক নিমিষে নষ্ট হয়ে গেল এবং রুহি প্রথমবারের মত জানল, সজল সিগারেট খায়। সজলের মুখে সিগারেটের কটু গন্ধ। অথচ এতদিন অনেক জিজ্ঞাসার পরেও বিষয়টা সে রুহির কাছে বেমালুম চেপে গেছে।
রুহির চোখে পানি দেখে হয়ত সজল একটু বিব্রত বোধ করল। সে রুহির একটা হাত ধরে বলল, আই অ্যাম সরি রুহি। আমি আসলে বুঝিনি আমার একটা চুমুতে তুমি এতখানি মন খারাপ করবে। তোমাকে শাড়ি পরে আজ এত সুন্দর দেখাচ্ছে যে আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।
সজল জবাবের আশায় রুহির দিকে তাকিয়ে রইল। রুহি সেই তখন থেকে ঠিক একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সজল আবারো বলল, রুহি প্লিজ। এবারের মত মাফ করে দাও। বললাম তো, এমন ভুল আর হবে না।
রুহি ঠান্ডা গলায় বলল, তুমি সিগারেট খাও?
এবার সজলের অবাক হবার পালা। সজল ভেবেছিল, রুহি বোধহয় চুমু খাবার ব্যাপারটা নিয়ে এতখানি মাইন্ড করেছে। তবে এখন তো দেখা যাচ্ছে ঘটনা ভিন্ন। সজল বুঝতে পারলো, সে আসলে চুমু খেয়ে সব দিক থেকে বিপদে পড়েছে। আজ এই চুমু খাবার কারনেই তার ধুমপানের বিষয়টা রুহির কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল।
সজল একটু হেসে বলল, মাঝে মাঝে একটু আধটু খাই। সিগারেটের খুব বেশী নেশা নেই আমার।
– সিগারেট খাবার মত আর কী কী লুকিয়েছো আমার কাছ থেকে তুমি?
সজল দুইদিকে তীব্রভাবে মাথা নাড়িয়ে বলল, না না। বিশ্বাস করো আর কোনো কিছু আমি তোমার কাছ থেকে লুকোইনি।
………………..
আশফাকের ক্লাসের প্রেজেনটেশনটা খুব ভালো মত শেষ হলো। ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা মোটামোটি ভালো করেছে। আর দুই একজনের পারফরমেন্স তো আউটস্ট্যান্ডিং। তার মধ্যে রুহি একজন। মেয়েটি যদিও প্রথমদিকে একটু নার্ভাস ছিল। আশফাকের মনে হচ্ছিল, মেয়েটির খুব মন খারাপ যা তার নার্ভাসনেসের আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে। রুহির প্রেজেনটেশনের দুই এক মিনিট যেতেই আশফাক রুহিকে থামিয়ে কিছু কারেকশন দিয়েছিল। আর এতেই যেন ম্যাজিকের মত কাজ হয়েছিল। রুহি তার সকল জড়তা কাটিয়ে উঠে খুবই সাবলীল ভাবে তার প্রেজেনটেশন সম্পূর্ণ করেছিল।
আশফাক অনেকক্ষন থেকে একাই টিচার্স রুমে বসে রয়েছে। তার সামনে বেশ কিছু কাগজপত্র এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে। আশফাক সেগুলোর দিকে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তার আসলে যাবার কোনো জায়গা নেই। দীপার সাথে দিনগুলো তার ভালো যাচ্ছে না। রোজ ঝগড়া, খিটিমিটি লেগেই আছে। ছেলেটা না থাকলে আশফাক বোধহয় বাড়িতেও ফিরত না। যে ব্যাপারগুলো প্রথমে তুচ্ছ সন্দেহ নিয়ে শুরু হয়েছিল তা এখন বড় আকার ধারন করেছে। দীপার এখন সব কিছুতেই সমস্যা। আশফাকের বেশী আদরেও সমস্যা, কম আদরেও সমস্যা। দীপাকে বেশী সময় দিলেও সমস্যা, কম সময় দিলেও সমস্যা। তার মাঝে মাঝে মনে হয় আসলে দীপারই বোধহয় তার সাথে সংসার করার কোনো ইচ্ছা নেই। সে বোধহয় অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। তাই এখন সে বিভিন্ন অজুহাতে আশফাকের সাথে ঝামেলা করছে। আশফাকের হঠাৎ করেই খুব একা লাগল। তার সব আছে তবুও কোথাও যেন কেউ নেই। আশফাক আনমনে তার সামনে পড়ে থাকা কাগজগুলো নিয়ে নাড়াচড়া করল। হঠাৎ করেই একটা কাগজের উপর তার চোখ পড়ল। এটা দুই সপ্তাহ আগে রুহি তার কাছে জমা দিয়েছিল। এই কাগজে রুহি তার ক্লাসে উপস্থিত থাকতে না পারার কারন ব্যাখ্যা করেছে। আশফাক এক দৃষ্টিতে কাগজটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টি কাগজে লেখা কোনো ইংলিশ হরফের উপর ছিল না, তার দৃষ্টি ছিল কাগজে লেখা রুহির ফোন নম্বরের উপর! আশফাক মোহগ্রোস্থের মত পকেট থেকে তার ফোন বের করল। তারপর ডায়াল করল রুহির নম্বর!
“চলবে”
“