আগুন ঝরার দিনে পর্ব -০৬

#আগুন_ঝরার_দিনে

#পর্ব_৬

প্রেজেন্টেশনটা খুব ভালো মত শেষ হলো। প্রেজেন্টেশনের পর রুহির মনে হলো, তার শরীরে আজ ভর করেছে যেন নরম কোমল তুলোর ডানা! সে ক্যাম্পাসের পুরোটা সময় আনন্দে ভেসে কাটালো। এই আনন্দটা যতখানি না প্রেজেন্টেশন ভালো হয়েছে সেই কারনে তার চেয়ে অনেকখানি বেশী তাকে বলা আশফাক স্যারের কথাগুলোর জন্য। প্রেজেন্টেশনের শুরুতে রুহি অনেকখানি নার্ভাস ছিল, নার্ভাসনেসের সাথে ছিল তার প্রচন্ড রকমের মন খারাপ। সকালে সজলের এমন ব্যবহার এবং এরপর সজলের সাথে তার যাচ্ছেতাই রকমের কথা কাটাকাটি, ঝগড়া সব মিলিয়ে রুহি প্রচন্ড বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছিল। সকালে ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর তার হৃদয়ে যে কোমল ভাবটা ছিল সজলের সাথে সেই ঘটনাটার পরে তার বিন্দুমাত্র কিছু অবশিষ্ট ছিল না। এমনকি ঝগড়ার রেশ ধরে সে সজলের সাথে তার ক্যাম্পাস পর্যন্ত আসেনি। নিজে একটা সি এন জি নিয়ে চলে এসেছিল।

প্রেজেন্টেশনের পর বিকেল পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে আনন্দে ভাসতে ভাসতেই রুহির সময়টা কেটে গেল। এর মাঝে সজল কয়েকবার ফোন দিয়েছিল। সে ফোন ধরেনি। বরং সজল যে কোনো মুহুর্তে ক্যাম্পাসে চলে আসতে পারে এবং রুহি তাকে প্রাণপনে এড়াতে চাচ্ছে বলেই সে ক্লাসের বন্ধুদের সাথে ক্যাম্পাসের পাশে একটা রেষ্টুরেন্টে চলে এলো। আর সেখানে সবাই মিলে আড্ডা দেয়ার মাঝেই ফোনটা এলো। রুহি অবাক হয়ে দেখল আশফাক স্যার তাকে ফোন করেছে। বিকেল পাঁচটা বাজে। এই সময় কোনোভাবেই আশফাক স্যারের তাকে ফোন করার কথা নয়। রুহি বন্ধুদের দিকে আড়চোখে তাকাল। সবাই যে যার মত গল্প নিয়ে ব্যস্ত। রুহির দিকে কারো মোনোযোগ নেই। রুহি তবুও সবার সামনে ফোনটা ধরল না। বন্ধুদের কাছে থেকে আড়ালে এসে সে ফোনটা রিসিভ করল।

রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভরাট একটা কন্ঠস্বর। আজ সেই কন্ঠে যেন এক রাশ আকুলতা ঝরে পড়ছে। কোনো ভুমিকা নেই, কোনো দ্বিধা নেই, রুহিকে অবলীলায় সেই কন্ঠস্বর বলল, কোথায় তুমি? আমার খুব একা লাগছে। একটু আসবে?

রুহি এতটুকু অবাক হলো না। সে এই কথাগুলোর মাঝে কোনো অস্বাভাবিকতাও টের পেল না। যেন এমনটা হবারই কথা ছিল। আশফাক স্যার তাকে যে কোনো সময় ডাকবেন, সে সব কাজ ফেলে, বন্ধুদের ফেলে তার কাছে ছুটে যাবে এটাই যেন স্বাভাবিক। রুহি ঘোর লাগা গলায় বলল, আসছি, আমি আসছি।

রুহি বন্ধুদের কাছ থেকে যত সহজে ছাড়া পাবে ভেবেছিল এত সহজে ছাড়া পেল না। রুহি চলে যাবে একথা শুনতেই সুমি চোখ ছোট করে বলল, হঠাৎ করে কোথায় যাচ্ছিস তুই? তুই না বললি আজ সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকবি। তোর নাকি খুব মন খারাপ। বাড়ি থেকে বের হবার সময় বলে এসেছিস আজ বাড়ি ফিরতে তোর দেরী হবে।

রুহি নরম গলায় বলল, হুম বলেছিলাম তো। তবে হুট করেই মাথাটা ধরে গেলো। এখন বাসায় না ফিরলে পরে মাথা ধরাটা আরো বেড়ে যাবে।

সুমি বলল, সজল তোকে নিতে আসছে বুঝি?

– না, না। সজল আসবে কেন! আমি নিজেই চলে যাব।

রুহি আর সুমির সাথে বেশী কথা বাড়াল না। তাকে কোনোরকম কথা বলার সুযোগও সে দিল না। রুহি রেস্টুরেন্ট থেকে তড়িঘরি করে বেরিয়ে গেল।

আশফাক স্যার তাকে ফোনে জানিয়েছেন, সে রেস্টুরেন্ট থেকে একটু দূরে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুহি পায়ে পায়ে গাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আশফাক স্যার গাড়ির মধ্যেই বসে ছিলেন। রুহিকে দেখা মাত্রই তিনি গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন।

নরম গলায় বললেন, কোথায় যাবে?

রুহি হাতঘড়িতে দেখল বিকেল সারে পাঁচটা বাজে। হাতে এখনো কিছুটা সময় আছে। সাতটার দিকে বাড়ির দিকে রওনা দিলেই হবে। তবে রুহি মুখে কিছু বলল না। চুপচাপ একই ভাবে আশফাকের সামনে দাঁড়িয়ে রইল।

আশফাক বোধহয় রুহির মনের কথাটা বুঝতে পারলো। রুহির দিকে তাকিয়ে বলল, গাড়িতে ওঠো। তোমাকে সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে যাব।

তাদের দুজনের সুন্দর সেই জায়গাটায় যাওয়া হলো না। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম। অফিস শেষে সবাই বাড়ি ফিরছে। রাস্তায় গাড়িগুলো যেন নড়ছেই না। আশফাক অনেক কষ্টে গাড়ি নিয়ে টি এস সির দিকে এগুলো। সেখানেও প্রচন্ড ভীড়! দুজনের কেউই গাড়ি থেকে নামার সাহস করলো না। ইতিমধ্যে সন্ধ্যাও নেমে এসেছে। রুহি যদি এখনো বাড়ির দিকে রওনা দেয় তবুও জ্যাম ঠেলে বাড়ি পৌঁছাতে তার রাত নয়টার মত বেজে যাবে। আশফাক রুহির বাড়ির দিকে গাড়ি নিয়ে এগুলো। গাড়ির মাঝে দুজনের কথা হলো খুব কম। আশফাককে খুব সাবধানে ড্রাইভিং করতে হচ্ছে। ঢাকার রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় মেজাজ ধরে রাখা খুব মুশকিল। তাই স্বাভাবিক ভাবেই আশফাকের বেশী কথা বলার উপায় নেই। রুহিও চুপচাপ বসে রইল। এমনিতেই সে বেশ শান্ত স্বভাবের মেয়ে। আশফাকের সামনে এলে তার শান্ত ভাবটা অনেকখানি বেড়ে যায়। তবুও রুহি যেন অনেকক্ষণ ভাবনার পর বলার মত কথা খুঁজে পেল।

সে নরম গলায় বলল, হঠাৎ ফোন করে ডাকলেন যে। জরুরী কোনো কথা ছিল কি?

আশফাক রুহির কথা শুনে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল, বাব্বাঃ। এত ভাবনার পর এই কথা খুঁজে পেলে। ভালো, খুব ভালো।

– বারে! আপনি আমাকে ডেকেছেন কেন এটা জিজ্ঞেস করা আমার অপরাধ হয়ে গেল।

– আমি আবার এমন কিছু বললাম কখন!

– তাহলে বলুন আমাকে ডেকেছেন কেন।

– তার আগে তুমি বলো আমি ডাকলাম আর তুমি বন্ধুদের ফেলে আমার কাছে চলে এলে কেন? অন্য কেউ ডাকলে তুমি নিশ্চয় এই সময় এইভাবে বন্ধুদের ফেলে চলে আসতে না?

– না আসতাম না।

– তবে? কেন এলে তুমি?

রুহি মাথা নিচু করে বলল, জানি না। আমি সত্যি জানি না

আশফাক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমিও জানি না রুহি। তোমাকে কেন ডেকেছি আমি নিজেও জানি না। তবে এটুকু জানি, আজকের পর তোমাকে আমি বার বার ডাকব। এরপরেও তোমাকে ডাকার কারন আমি তোমার সামনে হয়ত ব্যাখ্যা করতে পারব না। তবে এটাও জানি, আমি ডাকলে তুমি আসবে। আর এর কারন তুমি নিজেও হয়ত কখনো আমার সামনে ব্যাখ্যা করতে পারবে না।

আশফাক রুহির দিকে তাকালো। সে হয়ত রুহির কাছ থেকে কোনো জবাবের প্রত্যাশ্যা করছে। তবে রুহি কোনো জবাব দিল না। কারন সব কথার জবাব হয় না। কিছু কথা বুঝে নিতে হয়। কিছু কথা হৃদয় দিয়ে অনূভুব করেও নিতে হয়। তা না হলে এত সুন্দর সুন্দর সব কবিতার জন্ম হত না! এত চমৎকার চমৎকার সব গল্পও তৈরি হত না! রুহি কিছু না বলে একই ভাবে আশফাকের দিকে তাকিয়ে রইল।

“চলবে”

“আমার লেখা পড়তে ভালো লাগলে ২০২৩ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত আমার থ্রিলার উপন্যাস “ত্ন” বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। রকমারি, বুকমার্ক, প্রজ্ঞা, ধী ছাড়াও বিভিন্ন অনলাইন বুকশপে বইটি পাওয়া যাচ্ছে। ধন্যবাদ সবাইকে। “

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here