#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_১
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা
বাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই সুজানার খেয়াল হলো ছাতাটা সে সাথে করে নেয়নি। রিকশা থেকে নেমে বান্ধবী মেহুলের বাড়ির পথে পা রাখতে না রাখতেই অন্তরীক্ষের ফাটলে অঝোরে বর্ষণ নেমেছে ধরণীতে। রাস্তায় থৈ থৈ করছে পানি। ফাঁকা রাস্তা। মাঝেমাঝে দু একটা গাড়ি যাচ্ছে আসছে। তারমধ্যে ব্যাগটা বুকের সাথে চেপে ছুটছে সুজানা। সে ভিজে গেলেও ব্যাগটাকে ভিজতে দেয়া যাবেনা। ত্বরিতে দৌড়ানোর কারণে পায়ে পড়া দু ফিতার জুতোটা তখন ছলাৎছলাৎ আওয়াজ তুলতে ব্যস্ত। গায়ের সেলোয়ার-কামিজ কামিজ ওড়না প্রায় ভিজে জবজবে হয়ে উঠেছে।
ঠিক তখনি বৃষ্টির সুরের সাথে পুরুষালি কন্ঠের স্বর ভেসে এল।
এক্সকিউজ মি……
সুজানা কৌতূহল নিয়ে কপাল আর চোখমুখ কুঁচকে পেছনে ফিরতেই দেখলো সাদা কালো চেইক শার্ট পরিহিত একটা ছেলে ছুটে এসে মাথার উপর ছাতা ধরলো। হাঁপাতে হাঁপাতে ইশারা করলো ছাতাটা ধরার জন্য।
যা বলা হলো সুজানা তাই করলো। ছাতাটা ধরে আগ্রহ নিয়ে চেয়ে রইলো হাঁটুতে হাত রেখে হাঁপাতে থাকা ছেলেটার দিকে।
কয়েক সেকেন্ড পার হতেই ছেলেটা নিজেকে স্বাভাবিক করে সুজানার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। এতে সুজানা জড়তা-সংকোচে নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নিয়ে দূরত্বে দাঁড়াতেই ছাতার থেকে গড়িয়ে পড়া পানিতে তার পিঠ ভিজে যাচ্ছে। ছেলেটা ছাতাটা নিয়ে নিল। গলায় অভিযোগ মিশিয়ে বলল..
আপনাকে আমি অনেক্ক্ষণ ধরে ডাকছিলাম। আপনি ফিরছিলেন না।
বলেই ছেলেটা ছাতাটা সুজানার মাথার উপর রাখলো। সুজানা ব্যাগটা আরও জোরে চেপে ধরে কিছু বলবে তখনি ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো
এই জায়গাটার নামটা বলতে পারেন ? আমি ভুলে গেছি। ড্রাইভারকে বলতে পারছিনা।
মেরিনরোড রসুইবাড়ি । এই রাস্তাটা পার হলেই মেইন রাস্তা। আমি কি এখন যেতে পারি?
ছেলেটা কেমন চুপসান চোখে তাকালো। জিরিয়ে শ্বাস ফেলে বলল…
ভিজে ভিজে যাবেন?
সুজানা ছাতার আশ্রয় থেকে বেরিয়ে বলল
আমি ইতোমধ্যে ভিজে গিয়েছি।
সুজানা দৌড়াতে দৌড়াতে কিছুদূর যেতে না যেতেই সেই কন্ঠস্বরটি আবারও বেজে উঠলো।
আপনার নামটা?
সুজানা।
_________________
দরজা খুলেই সুজানাকে ভেজা জবজবে দেখে ঈগল পাখির গালের মতো করে হা করে তাকালো মেহুল। বলল
এ কিরে তোকে ভিজে ভিজে তো আসতে বলিনি। কি আজিব!
সুজানা ঘরের ভেতর প্রবেশ করে বলল…
রিকশা থেকে নামার পরেই বৃষ্টি শুরু হলো। ছাতা নিয়ে বেরোয়নি আমি। কি একটা অবস্থা! কেন এত জরুরি তলব? তাড়াতাড়ি বল।
মেহুল তার ব্যাগ কেড়ে নিয়ে বলল
আগে চল চেঞ্জ করবি। তারপর বাকি কথা।
ঘরে নিয়ে গিয়ে সুজানাকে শাড়ি ধরিয়ে দিল মেহুল। সুজানা শাড়ি দেখে কৌতূহলী গলায় বলল…
থ্রি পিছ দে। শাড়ি কেন পড়বো?
আগে পড়। তারপর সবটা বলছি।
সুজানা বিরক্তিসূচক শব্দ করে ওয়াশরুমে চলে গেল। শাড়িটা কোনোমতে পেঁচিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বলল
এই শাড়িটা পড়িয়ে দে। আর বল কি মতলব করছিস? আন্টি আঙ্কেল কোথায়?
মেহুল হেসে শাড়ির কুঁচি ধরতে ধরতে বলল
চলে আসবে। কিছু জিনিসপত্র কিনতে মার্কেটে গেছে। তোকে কাল বললাম না ওই ছেলেটার সাথে কথাবার্তা চলছে। সো আজকে দেখা করার দিন। ছেলেটার সাথে কথাও হয়েছে। দেখা করতে আসবে বলছে। কিন্তু আমার গলায় ছুরি ধরলেও আমি এখন বিয়ে করতে পারব না সেটা তুই জানিস।
এই বৃষ্টিতে? আজ দেখা করবে?
আজ বিকেলে।
ওহ। তো আমাকে কেন ডাকলি?
এখানেই তো খেলা। দেখা আমি করব না। দেখা করবি তুই।
সুজানা এক ঝটকায় মেহুলকে ঠেলে দিল। এলোমেলো কুঁচি কোমরে গেঁথে উচ্চরবে বলল,
আমি? মাথা খারাপ? তুই আমাকে এজন্যই কাল থেকে বাড়িতে টিকতে দিচ্ছিস না?
আরেহ বুঝার চেষ্টা কর জানু। আমিও যাব। কিন্তু আমি তোর বান্ধবী হয়ে। তুই হবি মেহুল ওকে? মানে আমি চালাকি করে কিছু বলতে পারব না। সব তুই বলবি। মানে বলবি যে আমার অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে তাই আমি এই বিয়ে করতে পারব না।
সুজানা চেহারায় নিমেষেই বিরক্তি ফুঁটিয়ে বলল
সেটা তুই নিজে বলতে পারছিস না? আজিব। বিকেলেই আমার নতুন টিউশনি। প্রথম দিন মিস করা যাবেনা।
ক’টায়? আর কোথায় নিয়েছিস?
তিনটায়। সেগুন বাগিচা চিনিস? সেগুন বাগিচার দক্ষিণ পাশে দশ মিনিটের পথ। নবকুঠিরে। ছোট বাচ্চাকে পড়াতে হবে।
ও আল্লাহ সেগুন বাগিচার সামনেই তো দেখা করার কথা। আমাদের কাজ শেষ হলে তুই টিউশনিতে চলে যাবি। ভালো না? আমি লোকটাকে বলব আড়াইটার সময় দেখা করতে। কি বলিস? ভালো হবে না?
সুজানাকে চুপ থাকতে দেখে মেহুল গালদুটো টেনে ধরে বলল
আচ্ছা তোকে কি এখন আদর করতে হবে? রাজী হয়ে যা না। প্লিজ প্লিজ। এবারের মতো। আর বলব না।
সুজানা সন্দিগ্ধ গলায় বলল
তুই কি সাইফ ভাইকে….
মেহুল কথা ঘুরিয়ে বলল
বিশ্বাস কর আমি পারলে তোকে এসবে জড়াতাম না। আমি জানি তুই তোর ফ্যামিলি নিয়ে খুব টেন্সড থাকিস কিন্তু কি করব বল? আমার কিছু করার নেই।
তোকে ছবিতে দেখেনি?
পরিবারের লোকজন দেখেছে। ছেলে দেখেনি।
তোর কি মনে হয় ছেলেটাকে ওর পরিবার তোর ছবি দেখায়নি?
আমি কি জানি। ছেলেটা নিজেই তো জানতে চাইলো আমি আপনাকে চিনব কি করে? তারমানে দেখেনি। আর আমি বলেছি আমি নীল শাড়ি পড়ে যাব। মানে তুই নীল শাড়ি পড়ে যাবি।
তুই আমাকে ফাঁসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিস মেহুল।
আমার সোনা বান্ধবী এবারের মতো বাঁচা। আজীবন ঋণী থাকব জানু। না করিস না আর।
সুজানা ঝামটি মেরে বলল
সর ঢং ছাড়। আমার মাথা ঘুরছে টেনশনে। আমি যদি ধরা পড়ে যাই? মানে ফোনে কথা বললি তুই আর আমি গেলাম সামনে। গলার স্বর ভিন্ন দেখাবে না?
ধুরর অতকিছু বুঝবেনা। আর বেশি কথা বলার কি দরকার? বলবি আমার অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে আমি তাকে বিয়ে করব। আপনাকে বিয়ে করতে পারব না। আমার মা বাবাকে না বলে দেবেন। বলবেন আপনিও আমাকে বিয়ে করতে চান না। একটু রিকুয়েষ্ট করে বলবি আর কি। কথা বলে যা মনে হলো ভদ্রলোক সাদাসিধা। বুঝছিস?
বিলেত পাস করা ছেলে সাদাসিধা?
তাই তো মনে হলো। দেখ তুই অত চাপ নিস না।
সুজানা চিন্তায় পড়ে গেল। ঘন্টাখানেক পর রাহেলা বেগম আর মুফতি সাহেব বাড়িতে এসে মেহুলকে দেখে খুশি হলেন। রাহেলা বেগম রান্নাঘর থেকে চিক্কুর পেরে বললেন
সুজু এখন আর বেরোস না। খেয়েদেয়ে যাবি দুপুরে।
মেহুল উত্তর দিল..
ও যাবেনা মা।
____________________
ডুপ্লেক্স বাড়িটির বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঝড়ের প্রকোপে শান্ত, স্নিগ্ধ, কোমল প্রকৃতির বুকে মাঝেমাঝে কেঁপে উঠে ঝড়ে পড়ে জলফোঁটার ব্যাপারটা অনুভব করছিল অভিক। কান্নাশেষে মানুষ যখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে ক্রমাগত বর্ষণ শেষেও প্রকৃতি এমন কেঁপেকেঁপে উঠে। ব্যাপারটা ভীষণ সুন্দর এবং উপলব্ধির। সবার চোখে এই ছোট ছোট বিষয়গুলো ধরা দেয় না। দুটো পাখি হঠাৎ বাউকুল গাছের ডালে এসে বসলো। পালকের ভেতর ঠোঁট ঢুকিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ডানা ঝাড়ছে। পালকগুলো ইতোমধ্যে খাঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা দেখে একটুখানি হাসলো সে।
পেছন থেকে সালমা বেগমের হাঁকডাকে ঘাড় ঘুরালো।
হ্যা রে অভি। তোর কোনোকিছুতে তাড়া নেই কেন? মেয়েটা তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে না? পুরুষমানুষদের সবসময় সবকিছুতে তাড়া থাকতে হয়।
বেরোচ্ছি।
সালমা বেগম ছেলের কপাল টেনে এনে চুমু খেলেন। বললেন..
ফি আমানিল্লাহ। মেয়েটা তোর পছন্দ হবে দেখিস। আমার কথা মিলিয়ে নিস।
________________
বাতাসে হিমশীতল আবেশ আর ভেঁজা সোঁদা মাটির মিশেল গন্ধ। সারি সারি সেগুন গাছ আরও নানান জাতের গাছের শেষে বিশাল একটি দিঘী। লোকেমুখে সেটাকে লালদিঘিই বলে। অতবড় দিঘীটাতে দক্ষ হাতে বানানো কয়েকটা ছোট নৌকাও চলে। সুজানা মায়ের মুখে শুনেছে এই দিঘীতে নাকি মাঝরাত্রিরে একটা সোনার নৌকা চলে রূপোর বৈঠার সাহায্য। কারো সাড়াশব্দ পেলে আবার টুপ করে ডুব দেয় সেই নৌকা। অমাবস্যার রাতে বেশিরভাগ সেটি দেখা যায়। কি ভয়ানক!
ভাবতে ভাবতেই দিঘীর কিছুটা দূরে ফাঁকা জায়গায় বড়গাছটির তলায় গিয়ে সে দাঁড়ালো। বসার কয়েকটা জায়গা আছে সেখানে। যেখানে ইতোমধ্যে পানি আর ভেজা পাতা পড়ে লেপ্টে আছে। বসা যাবেনা। আশেপাশে মানুষের আনাগোনা বেশ বেড়েই চলেছে।
মেহুলের ফোনটা তার হাতে। লোকটা যদি না চিনে ফোন করে থাকে? সুজানার গলার স্বরের সাথে মেহুলের গলা না মিললে যদি সন্দেহ করে?
মেহুলটাও বাকিদেরকে ডাকতে গিয়ে কোথায় চলে গেল।
হাত পা রীতিমতো ঠান্ডা হয়ে আসছে সুজানার। হিমশীতল বাতাসে গায়ে লাগতেই অসম্ভব ঠান্ডা লাগছে তার। নাকে ঠান্ডা বাতাস ফুরফুর করে ঢুকে পড়ছে।
অপেক্ষার অবসান ঘটলো তখন যখন পেছন থেকে কেউ একজন গলা খাঁকারি দিল। গলার কাছে একহাত নিয়ে গিয়ে দম নিয়ে দম নিল সুজানা।
আপনি মেহুল? আমি অভিক ফারদিন।
কেমন চেনা চেনা ঠেকলো সুজামার কাছে।
মেয়েটাকে সামনে না ফিরতে দেখে অভিক ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো।
কিছুদূরে বড় বটগাছের আড়ালো দাঁড়িয়ে সুজানার সব বন্ধুরা ইশারা করলো সামনে ফিরতে।
অভিক কিছু বলার আগেই সুজানা ঘাড় ঘুরালো। সাথে সাথে অত্যধিক বিস্ময়ে দু ঠোঁটের মধ্যিখানে নিজের অজান্তেই দূরত্ব এল।
অভিকের চোখে তখন দুর্দান্ত কৌতূহল। চমৎকার হেসে বলল…
আপনি সুজানা, মেহুল নন।
ভয়ে গলা শুকিয়ে এল সুজানার।
চলবে…….
আবার নতুন করে শুরু করলাম গাইস। পাশে থাকবেন।