আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে পর্ব -৩৮

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(38)

“উপস্! আদাভান আমাকে কেনো কল করছে বলতো অরুনিকা। আমি তো জানিনা ওর অরুনিকা কোথায় আছে। আমি তো শুধু জানি আমার অরুর কথা। আমার অরু ছাড়া আর বাকি কোনো মেয়ের কথা জানার আমার টো প্রয়োজন নেই।”

অরুনিকার সামনে ফোন ধরে গালে স্লাইড করতে থাকে কাব্য। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে অরুনিকার। কোনরকমে মুখ বাড়িয়ে ফোনটা ছুঁতেই হাত সরিয়ে নেয় কাব্য।

“কাব্য ভাইয়া প্লীজ আমাকে একবার কথা বলতে দাও আদাভানের সাথে। একটা বার আমাকে নিজের ভুলের জন্য মাফ চাওয়ার সুযোগটা অন্তত দাও। প্লীজ।”

“উহু ডিয়ার অরু, তা তো হচ্ছেনা। আদাভানের তোমাকে খুঁজে পাওয়ার আগেই আমরা ফুস। এমন জায়গায় চলে যাবো তোমাকে নিয়ে যে আদাভান কেনো আমার বাপও জানতে পারবেনা। আদাভান খুঁজে মরবে পুরো শহর অথচ তোমার টিকিটুকুও ওর হাতে আসবেনা। ও ভাববে আমি তোকে নিয়ে কোনো লুকানো জায়গায় যাবো কিন্তু আমি তো আছি আমার বাড়িতেই। আর একটা সিক্রেট কি বলতো, আমার বাড়ী কোনোক্রমে এসেও গেলে এই রুম পর্যন্ত কখনও পৌঁছাতে পারবেনা। কারণ আমার রুমের আন্ডারগ্রাউন্ড এই রুম। যার রাস্তা কারোরই জানা নেই।”

কাব্যের হাঁসি দেখে মুহুর্তেই রেগে লাল হয়ে গেল অরুনিকা। বর্ষার মৃত্যুর জন্য কাব্য দায়ী এটা জানার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও সহ্য হচ্ছেনা কাব্যকে। করুন চোখে পেটের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বাহিরের চাঁদনী রাতের থালার মত চাঁদ থেকে একফালি এসে মুখে পড়তেই মনে পড়ে গেলো আদাভানের সাথে কাটানো সুখের সময়গুলো। দুজনের একসাথে চন্দ্রবিলাস, ছোটোখাটো দুষ্টুমি, দুজনে একসাথে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে আম্মুর বকা শোনা, আদাভানের কেয়ার সবকিছু একে একে মনে পড়ছে। কিছুদিন যাবৎ করা নিজের ব্যাবহারের জন্য ভীষণ কান্না পাচ্ছে অরুনিকার।

“প্রাণপাখি!”

চিরপরিচিত নাম শুনে চমকে সামনে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় অরুনিকা। সামনে দাড়ানো বিধ্বস্ত আদাভানকে দেখে অনুতাপের পরিমাণ আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। চোখে চোখ মেলানোর ক্ষমতাটুকুও জুটিয়ে উঠতে পারেনা। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাতেই এগিয়ে যায় আদাভান। চেয়ারের বাঁধন খুলে সামনে দাড়াতেই জড়িয়ে ধরে অরুনিকা। কিছু বলতে যাবে তার আগেই,

“তুই! তুই এখানে কিভাবে?”

কাব্যর কথা শুনে ব্যাঙ্গাত্মক হাঁসে আদাভান। অরুনিকাকে সরিয়ে দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় কাব্যের দিকে।

“চোর যত বড়োই হোক না কেনো কিছু না কিছু ক্লু ঠিক রেখে যায়। আর তুই তো শুধু ক্লু না আমাকে পুরো ঘটনাই বলে দিলি। হা হা হা।”

“মানে? আমি কখন তোর সাথে কথা বললাম?”

“লেটস চেক ইওর ফোন।”

আদাভানের কথায় ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করতেই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় কাব্য।

“ইয়েস। তুই যেটা ভাবছিস একদম ঠিক ভাবছিস। কোনোভাবে ভুলবশত আমার ফোনটা রিসিভ হয়ে যায় আর তোর বলা সব কথাই আমি শুনে ফেলি। তারপর আর কি, চলে এলাম তোর রূমে। তোকে যতটা চালাক ভেবেছিলাম টুই ততটাও নাহ। রামছাগল একটা। সিক্রেট রূমের দরজা ঢাকতে সবসময় ভারী কিছু ইউজ করতে হয় রে পাগল। যদিও প্রথমে আমিও বলে বনে গেছিলাম। কোথায় রুম, কোথায় আমার প্রাণপাখি এসব ভেবে ভেবে কোনো কুল খুঁজে পাচ্ছিলামনা। হতাশাগ্রস্থ ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফাতে বসতে গিয়ে বুঝলাম ভীষণ হালকা এটা। সাধারণত বাড়ির ফার্নিচার কেউ এতো হালকা ইউজ করবেনা। তাই সন্দেহবশত হালকা ধাক্কা দিতেই পিছনে সরে গেলো আর নীচে পাশাপাশি সব টাইলস এর চকচকের মাঝে ওই কাঠের সাদা রংটা কেমন ফিকে লাগছিল। সন্দেহবশত হাত দিয়ে টোকা দিতেই বুঝে গেলাম এটা টাইলস না, কাঠের। ব্যাস আর কি, চলে এলাম তোর সিক্রেট রুমে আমার বউকে নিতে।”

নিজের করা ভুলের জন্য সাপের মতো ফোঁসফোঁস করছে কাব্য। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অরুনিকার হাত ধরে বেরোতে গেলে আটকে দেয় আদাভান।

“দেখ অনেক জ্বালাতন করেছিস এইকয়দিন। এবার আমার বউকে ছাড়। কতোদিন বউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানো হয়নি। আহ, এবার একটু শান্তি মত বউয়ের কোলে ঘুমাবো।”

আদাভানের আয়েশি ভঙ্গিতে বলা কথা শুনে শশব্দে হেসে ওঠে কাব্য। নিজের সাথে চেপে ধরে অরুনীকাকে।

“অরু আমার। শুধু আমার। ওর জন্মের পর থেকেই ওকে আমার নামে লিখে নিয়েছি। ভালোয় ভালো সরে যা আমাদের রাস্তা থেকে।”

“চারিদিকে তাকিয়ে দেখ একবার।”

হাই তুলতে তুলতে বলা আদাভানের কথা শুনে আশেপাশে তাকাতেই চমকে ওঠে কাব্য। রুমের চারিদিক পুলিশ ঘিরে রেখেছে। অবস্থা বেগতিক দেখে অরুনিকার দিকে করুন চাহনিতে তাকায় কাব্য। কাব্যের তাকানো দেখে সেদিকে ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে নিজের ফোনে করা কাব্যের সব দোষ স্বীকার করার ভিডিও এগিয়ে দেয় পুলিশের হাতে।

অরুনিকাকে গাড়িতে করে বাড়ির দিকে পৌঁছে দিয়ে আদাভান চলে যায় পুলিশ স্টেশনে। সব কাজ শেষে হাতে কিছু গোলাপ নিয়ে খোশমেজাজে বাড়ি ফেরে আদাভান। বাড়ীতে ঢুকে কাউকে না দেখে অবাক হয়ে যায়। পুরো বাড়ীতে সবাইকে খুঁজে খুঁজে নিজের রুমে যেতে আরও একদফা অবাক হয়ে যায়।

ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে লাইট জ্বালানোর জন্য সুইচ খুঁজতেই দরজা বন্ধ করার আওয়াজে পিছনে তাকায়। ততক্ষনে চোখ অন্ধকারে সহনীয় হয়ে হালকা হালকা বোঝা যাচ্ছে সবকিছু। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাড়ানো রমণীকে দেখে গলা শুকিয়ে যায় আদাভানের। বারান্দা থেকে আসা চাঁদের আলোয় আরোও স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে অরুনিকাকে।

আদাভানের সাদা রঙের একটা শার্ট পরে সাথে চুলগুলো উঁচু করে পনিটেল করে আবেদনময়ী ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে অরুনিকা। নিজের অজান্তেই একপা একপা করে এগিয়ে যায় আদাভান। আদাভানের এগোনোর সাথে সাথে বেড়ে চলেছে অরুনিকার হার্টবিট। নিঃশ্বাসের ওঠানামাও বেড়েছে কয়েকগুণ। দরজার পর্দা খামচে ধরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টায় মগ্ন অরুনিকাকে টান দিয়ে পিছন ঘুরিয়ে দাঁড় করে আদাভান। হাতে রাখা গোলাপগুলো এক হাতের মুঠোর মাঝে রেখে কোমর জড়িয়ে ধরে। আর একহাতে টান দিয়ে খুলে ফেলে পনিটেল। তারপর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,

“আর কতো পাগল বানাবে আমাকে? এবার তো দেখছি সোজা পাবনাতে ভর্তি হতে হবে।”

দুইহাতে আদাভানের হাত আঁকড়ে ধরে সামনে ঘরে অরুনিকা। ছলছল চোখে তাকায় আদাভানের দিকে।

“আই অ্যাম সরি। আমি সত্যি বুঝতে পরিনি এসবের পিছনে কাব্য ভাইয়া ছিল। প্রথম থেকে আপনাকে অপরাধী মনে করে যা নয় তাই ব্যবহার করেছি। আপনি কখনও একটুও প্রতিবাদ করেননি। বরং সবসময় আমার রাগগুলো ভালোবাসা দিয়ে মিটিয়ে দিয়েছেন। আপনার ভালোবাসায় আমাকে বারবার আপনার আরও কাছে আসতে বাধ্য করেছেন। বারবার আপনাকে নিয়ে কনফিউশনে ভুগতে বাধ্য করেছে। আই অ্যাম সরি। আমি অনেক খারাপ বিহেভ করেছি আপনার সাথে। আমাকে মাফ করে দিন প্লিজ। আপনি সবসময় আমাকে ভালোবেসে আগলে রেখেছেন আর আমি আপনাকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আর না। আমাকে আপনার করে নেবেন আদাভান? সারাজীবন আপনার হয়েই থাকতে চাই। আপনার এই বুকে মাথা রেখে শুরু করতে চাই প্রতিরাত্রিযাপন। ঘুম থেকে উঠে আপনার এই উষ্ণ বুকে আলতো চুমু এঁকে দিতে চাই। দিবারাত্রি শুধু আপনার আলিঙ্গনে মত্ত হয়ে চাই। দেবেন কি আমাকে সেই সুযোগ?”

“হুম দেওয়াই যায়। তবে আমিও কিন্তু একটা সুযোগ চাইবো।”

“তোমার শাড়ি……”

“বুঝেছি। ঠিক আছে আপনার কাছেই শাড়ী পড়বো। এবার কি মাফ করা যাবে?”

“হুশ। শাড়ী পরানোর না খোলার সুযোগ চাই। হা হা হা। দেবেন?”

“অসভ্য। বাবা হতে চললো একনো লুচ্চামি গেলোনা।”

“মমমানে!”

“মানে আরকি বেবী আদাভান আসতে চলেছে।”

অরুনিকাকে বুকের মাঝে চেপে ধরে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাড়িয়ে আছে আদাভান। এখন কি করা উচিৎ কিছুই মাথায় আসছেনা।

“তুমি সত্যি বলছো? আমি আমি বাবা হবো। আমাদের সন্তান তোমার এই পেটে? আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবোনা আজ আমি কতোটা খুশি। দুনিয়ার সবচেয়ে খুশি মানুষ আমি আজ। আই অ্যাম সো হ্যাপি প্রাণপাখি। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছেনা।”

“এইযে কিউটি, একদম মাম্মামকে জ্বালাতন করবেনা। যা লাগবে পাপ্পাকে বলবে। পাপ্পা সব সহ্য করতে পারে শুধু মাম্মাম এর কষ্ট পারেনা সহ্য করতে। আর শোনো, পাপ্পা এখন মাম্মামকে অনেক আদর করবে, তুমি চুপচাপ থাকবে ওকে!”

অরুনিকার পেটের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কথাগুলো বলে অরুনিকাকে কোলে তুলে নিলো আদাভান। ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে পার হলো আরও এক রজনী। বারান্দার খোলা দরজা দিয়ে উঁকি মারা চাঁদ সাক্ষী হয়ে থাকলো এক ভালোবাসার জুটির ভালোবাসার।
___________

নূরের অনেক বোঝানোর পর অবশেষে বাড়ি ফিরেছে আদিল। তবে মায়ের সাথে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেছে। নূরের প্রেগনেন্সি নিয়ে কোনরকম রিস্ক নিতে চায়না আদিল, তাই নীচের একটা ঘরে সবকিছু শিফট করে বেডে বসতেই,

“আদিল! মায়ের সাথে এমন কেনো করছেন? উনি আপনার মা। সন্তানের কতো ভুল মা মাফ করে দেয়, আর আপনি মায়ের এই ছোট্ট একটা ভুল মাফ করতে পারছেন না?”

“নূর, এমনিতেই আমি তোমার উপর অনেক আপসেট। আমাকে আর এসবে ঘাটিওনা। তবে মার একটাও মাটিতে পড়বেনা।”

“আমি বিরক্ত করছি তো আপনাকে। ঠিক আছে থাকুন আপনি। আমি অন্য রূমে গিয়ে ঘুমাবো আজ।”

নূর চলে যেতে গেলে পিছন থেকে কোলে তুলে নেয় আদিল। নূরের নাকের সাথে নাক ঘষে হালকা হেসে বলে ওঠে,

“এটুকু শরীরে এত রাগ কোথায় থাকে বলোতো? আমাদের মাঝে যায় হয়ে যাক থাকতে তো হবে তোমাকে আমার সাথেই। তোমাকে জড়িয়ে না ঘুমালে আমার ঘুম আসেনা জানোনা?”

“ছাড়ুন আমাকে। আমি এসব কোথায় ভুলবোনা আজ। অনেক খারাপ আপনি। বেবি শোন, তোর পাপা অনেকক খারাপ। একদম পাপার সাথে কথা বলবিনা। তাড়াতাড়ি চলে আয় আমরা একসাথে তোর পাপার সাথে ফাইট করবো।”

হালকা হেসে দু হাতে নূরের চোখ চেপে ধরে রূমের সাথে এটাচ পুলের কাছে নিয়ে যায় আদিল। চোখ খুলে চারিদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় নূর। পুরো পুল সাইট ছোটো ছোটো লাইট দিয়ে সাজানো, মাঝে মাঝে তাদের সুন্দর সুন্দর মুহূর্তের কিছু ছবি আটকে দেওয়া। বিস্ময়ে চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে একটা কাগজের মতো জিনিস দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় নূর। ফেরারী লাইটের তারে ক্লিপের সাথে আটকানো কাশ্মীরের এর দুটো টিকিট দেখে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় নূর। খুশিতে দৌড়ে গিয়ে আদিলের গলা জড়িয়ে ঝুলে পড়ে।

“আরে আস্তে আস্তে। বারণ করেছি না তোমাকে এই সময়ে একদম দৌড়াবেনা। তোমার পছন্দের জায়গায় নিয়ে যেতে পারি তবে একটা শর্তে, নো লাফালাফি ন ঝাপাঝাপি। আমি যেমন ভাবে বলবো সেভাবেই চলতে হবে। রাজি?”

“ডান।”

“চলো এবার ঘুমাতে যাবে। কাল সকাল সকাল বেরোতে হবে। প্যাকিং আমি করে নিয়েছি হালকাপাতলা, বাকি কিছু লাগল ওখান থেকেই কিনে নেবো।”

চলবে?
#Fiza_Siddique

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here