আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে পর্ব -৪০ শেষ

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(40)

শীতকাল মানে ঘুম থেকে উঠতে রীতিমত কসরত করতে হয়। ঘরে ঘরে হিটার জ্বালাতে হয়। তা সত্ত্বেও হাড় কাঁপানো শীত থেকে নিস্তার নেই। কিন্তু তাও শীতকালের কাশ্মীর সুন্দর। শীতকালে প্রকৃতি এক হয় ঘুমিয়ে পড়ে না হলে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। আর সকলেই বসন্তের আগমনে দিন গোনে। কিন্তু এর সঙ্গে শীতকালে গোটা কাশ্মীর জুড়ে ঘনিয়ে আসে এক সুন্দর নীরবতা। কতকটা শান্তির বার্তা নিয়ে। আকাশে বাতাসে তখন প্রেম, ভালোবাসা আর শান্তির ছোঁয়া।এরই মাঝে কাশ্মীর প্রত্যক্ষ করে মরসুমের প্রথম তুষারপাত। যা সত্যিই নয়নাভিরাম। রাতে ঘুমিয়ে পড়ার পর সকালে উঠে দেখা যায় চারপাশের জগৎটা বদলে গেছে। প্রকৃতির এই জাদু যদি মুগ্ধ না করতে পারে, তাহলে আর কিসে মুগ্ধ হওয়া যায়?

অসম্ভব ঠান্ডার হাত থেকে রেহাই দিতে কাশ্মীরের বাড়িতে বাড়িতে একধরণের হিটার ব্যবহার করা হয় – যার পোশাকি নাম কাংড়ি। কাংড়ি আদতে একটি মাটির হাঁড়ি যার চারপাশে শরু কাঠি বাঁধা থাকে এবং ভিতরে কাঠকয়লা ভরতে হয়। কাংড়ি যখন শরীর গরম করতে সাহায্য করে তখন মনকে তরতাজা রাখতে কাশ্মীরিরা খেওয়া ও হরিস্সা সেবন করে থাকেন।

শুনশান রাতের নিস্তব্ধতায় চারিদিক বিষন্ন। সেইসাথে বিষন্ন নূরের মনও। বারকয়েক জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়ে ছুটে চলে গেলো রুফটপে। খোলা আকাশ আর চারিদিকের প্রকৃতি দেখে নিজেকে একটু স্বস্তি দানের চেষ্টায় পাশে রাখা সোফায় শরীরটা এলিয়ে দিল। পরনের সাদা শাড়ির আঁচল মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে। আদিল কোনো এক কাজে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যাওয়ায় আরোও বেশি অস্বস্তি ভীড় করেছে নূরের মাঝে। নিঃশ্বাস নিতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে মুহুর্তেই। চারিদিকের খোলা স্নিগ্ধ, শুদ্ধ বাতাসেও অক্সিজেনের অভাব পড়েছে যেনো। বিরক্তিতে নীচের দিকে তাকাতেই একদল মানুষের হইহট্টগোল চোখে পড়লো। তাদের মাঝে আছে সকালের সেই কপোত কপোতী। সাথে আরো বেশ কিছু কাপল আছে। বনফায়ারের আগুনে পাশাপাশি বসে আড্ডাতে মত্ত তারা।

ধীর পায়ে এগিয়ে কাছাকছি যেতেই সবার শোরগোলের আওয়াজে হটাৎ করেই মন ভালো হয়ে গেলো নূরের। বনফায়ারের চারিদিকে ঘিরে কয়েকজন গল্পে মত্ত। সবার দৃষ্টি সামনে বসে থাকা ব্ল্যাক শার্ট পরে হাতে গিটার নিয়ে বসে থাকা ছেলের দিকে। পিছন থেকে দেখতে বেশ পরিপাটি লাগা ছেলেটাকে দেখার আগ্রহ আর সবার কথোপকথন শুনতে এত খানিকটা এগিয়ে যেতেই ভেসে উঠলো গিটারের টুং টাং শব্দ। বিষাদের সে সূরে কি ছিলো জানা নেই তবে মুচড়ে উঠলো নূরের হৃদয়। শূন্য শূন্য অনুভূত হলো খানিকটা। উৎসুক হয়ে সেদিকে তাকাতেই শুনতে পেলো গানের ছন্দ।

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
তোমার দেখা আমার সঙ্গে
মুখোমুখি আমরা দু’জন
মাঝখানে অনেক বারণ
ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
তোমার দেখা আমার সঙ্গে
মুখোমুখি আমরা দু’জন
মাঝখানে অনেক বারণ
ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
তোমার দেখা আমার সঙ্গে

বাইরে তখন হাওয়া ঝড়ো
তুমি হয়তো অন্য কারও

বাইরে তখন হাওয়া ঝড়ো
তুমি হয়তো অন্য কারও

আরও একবার বলবো সেদিন
আরও একবার বলবো সেদিন
আজ জানে কি জিদ না কারো।

ধরো যদি চেনা গন্ধে
মেতে উঠি চেনা ছন্দে
যদি ছুঁতে চাই আবারও
জানি ছোঁয়া তবু বারণ

ধরো যদি চেনা গন্ধে
মেতে উঠি চেনা ছন্দে

চলে যাবে হাওয়া ঝড়ো
সময় ছিলো আমাদেরও

চলে যাবে হাওয়া ঝড়ো
সময় ছিলো আমাদেরও

তবু আবার বলবো সেদিন
তবু আবার বলবো সেদিন
আজ জানে কি জিদ না কারো।

থমথমে পরিবেশের স্থায়ীত্ব বাড়াতেই বুঝি অপরিচিত কারো মূখে নিজের নাম শুনলো। অচেনা মানুষদের মাঝে নিজের নাম শুনে চমকে উঠলো নূর। অপ্রীতিকর এই পরিস্থিতিতে ঠিক কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে আঙ্গুলের মাঝে শাড়ী পাকাতে পাকাতে সামনে তাকাতেই মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ে যেনো। দ্রুত গতিতে দুই কদম পিছিয়ে যায়। হাতে থাকা শাড়ির আঁচল আগেই ছেড়ে মাটিতে লুটিয়ে আছে। জ্বলতে থাকা চোখ দুটো বহু কষ্টে খোলা রেখে ঠোঁট কামড়ে ধরলো নূর। যদিও আসন্ন বিষাদের সুরে কান্না এসব বাঁধা মানতে নারাজ। সব বাধা পেরিয়ে উপচে পড়লো আঁখিকোটর থেকে। হাঁপাতে হাঁপাতে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নূর সামনের মানুষটার দিকে। যেনো একটু চোখের পলক ফেললেই তাকে হারিয়ে ফেলবে, কিন্তু সেই সুযোগ সে দেবেনা। কিছুতেই না।

টালমাটাল জ্ঞানশূন্য নূরকে দেখে হাতে রাখা গিটারটা ছুঁড়ে ফেলে দ্রুত কদমে এগিয়ে গেলো আদিত্য। হতের পিঠে দুচোখ মুছে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকলো কাঙ্খিত সেই নারীর দিকে। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। ছেলেরা নাকি পাথর সম হয়! অজস্র ব্যাথা বুকে লুকিয়ে রেখে তাদের মুখে বজায় রাখতে হয় একচিলতে মিথ্যে হাসি। ক্লান্ত, অবিশ্রান্ত, ছন্নছাড়া হয়েও একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুই ঠোঁটের মাঝে খানিকটা দূরত্ব সৃষ্টি করে হাসতে হয়। যেনো নকল আর আসলে তফাৎ করা কঠিন হয়ে পড়ে। হ্যা হাসতে হয় প্রেমিকাকে অন্যের বাহুতে দেখে, হাসতে হয় বেকার হওয়ায় চোঁখের সামনে প্রিয় মানুষটার আলোকসজ্জা দেখে। কলিজা কেটে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া যন্ত্রণায়ও নাকি তাদের কাঁদতে নেই। কাদতে নেই প্রয়োজনের অর্থিতেও। সমাজের চিরাচরিত রীতির জাল ভেদ করে কাঁদছে আদিত্য। বারংবার মুছে ফেলছে দুই গাল বেয়ে উপচে পড়া জলকণা। কিছুক্ষন আগের পরিপাটি হওয়া মানুষটা পরিণত হয়েছে অগোছালো, ব্যার্থ এক প্রেমিক রূপে। অনুভূতির সাথে চারিপাশের নিস্তব্ধতায় ক্রমে গভীর হচ্ছে। গভীর হচ্ছে নিঃশ্বাসের শব্দ। চোখের মাঝে খেলে চলেছে অজস্র অভিমানের খেলা, ভারী হচ্ছে অভিযোগের পাল্লা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here