#আমার_আকাশে_তারা_নেই ২
#লাবিবা_আল_তাসফি
১০.
গভীর রজনী। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে ইহান। বৃষ্টিতে ভেজার কারণে শরীরের উত্তাপ বেরেছে। জলপট্টি দেওয়ায় জ্বর কিছুটা কমে এসেছে। ক্লান্ত চোখে তাকালো ইচ্ছে। এই সামান্য জ্বরে লোকটা একদম নেতিয়ে পড়েছে। মুখের গম্ভীরতা হারিয়ে গেছে। মুখটা বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। পানি ভর্তি মগটা সরিয়ে রাখলো ইচ্ছে। বাইরে এখনো ঝুম বৃষ্টি। থার্মোমিটারে আরো একবার জ্বর মেপে দেখলো। ১০০° ফারেনহাইট! ওনেকটাই নেমেছে জ্বর। ঘুম তার অক্ষি কোটরেও হানা দিয়েছে। কোনো ভাবেই তাকে উপেক্ষা করা সম্ভব হচ্ছেনা। ইচ্ছে ইহানের পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো। চোখ কেবল লেগে এহেছে এমন মুহূর্তে ইহান নড়েচড়ে উঠলো। ইচ্ছে তড়িৎ গতিতে আধশোয়া হয়ে ইহানের দিকে ঝুঁকলো। হাত দিয়ে কপাল ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করলো জ্বর বাড়ছে কিনা। চোখের পাতা মৃদু কাঁপিয়ে চোখ মেলে তাকালো ইহান। ইচ্ছেকে এভাবে ঝুঁকে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকালো। ইচ্ছে সরতে নিলে সে বাঁধা দিল। মৃদু লাল আলোতে ইচ্ছেকে ভিষণ আদুরে লাগছে। মৃদু কন্ঠে সে শুধালো,
“তোমায় ভিষণ সুন্দর লাগছে ইচ্ছেরাণী।”
ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ইহানের এমন নিভু নিভু কন্ঠে বলা কথাটা তুমুল ঝড় তুলল ইচ্ছের মনে। বাহিরের ঝড় এ ঝড়ের তুলনায় কিছুই না। স্বামীর মুখে নিজের এরূপ নাম ভিষণ মিষ্টি লাগলো। ইচ্ছে যখন এসব কল্পনায় ডুব দিচ্ছিল তখন সে অনুভব করলো একজোড়া উষ্ণ তপ্ত অধরজুগল ভিষণ ভাবে আকড়ে ধরেছে তার স্নিগ্ধ অধরকে। অনুভূতিরা উড়তে লাগলো প্রবল ভাবে। সে রাতে ভালোবাসার আরো এক নতুন অধ্যায় রচনা করল তারা।
______________
সময়গুলো এমন ভালোবাসাময় কাটছিল। কিন্তু সুখের সময় যে ক্ষণস্থায়ী। হাওয়াই মিঠাইয়ের মতোই ফুরিয়ে যায় সুখের মুহূর্ত গুলো। মাস পেরিয়ে নতুন মাস আসতে লাগলো। হঠাৎ করেই একদিন নাজমুল সাহেব জানালেন চট্টগ্রাম যেতে হবে। তার একমাত্র বোনের ছেলে নুহাশের বিয়ে। ইরার পরীক্ষা কয়েকদিন বাদে তাই সে যেতে পারবেনা। ইহান ও অনেক অজুহাত দেখালো না যাওয়ার কিন্তু ইচ্ছের জেদের কাছে হার মেনে অবশেষে রাজি হলো। বেশ ভালোই শপিং করা হলো বিয়ে উপলক্ষে। বিয়ের ঠিক দুদিন আগেই তারা চট্টগ্রাম পৌঁছালো। ইচ্ছের বেশ পছন্দ হলো জায়গাটা। প্রথমদিন ঘুমিয়েই কাটলো। অনেক টায়ার্ড কিনা! দ্বিতীয় দিন ইহানের সাথে বের হয়ে টুকটাক ঘুরে আসলো। যদিও ইচ্ছে আরো ঘুরতে চেয়েছিল কিন্তু ইহান বলেছে এবার একটুকুই থাক কিছুদিন পর ছুটিতে এসে তাকে নিয়ে পুরো চট্টগ্রাম ঘুরবে। ইহানের সকল কাজিনদের সাথে দেখা হলো। বেশ মজায় কাটলো দুটোদিন। কিন্তু ইচ্ছে লক্ষ্য করে দেখলো নুহাশ আর ইহান দুজন দুজনকে এড়িয়ে চলছে। কেউ কারো সাথে কথা বলেনা। ইচ্ছে ভাবলো একবার ইহানকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করবে কিন্তু পরক্ষণে ভাবলো তাদের ব্যাপারে নাক না গলানোই ভালো। কিন্তু সমস্যা হলো অন্য এক জায়গায়। বিয়ের দিন কোনো অগ্যত কারণে মেয়ে পক্ষ থেকে বিয়েটা ভেঙে দেওয়া হলো। গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। নুহাশের মা নাইমা বেগমের অপমানে মুখে থমথমে ভাব। আস্তে আস্তে আত্মীয় স্বজন একে একে চলে যেতে লাগলো। অগ্যতা ইচ্ছেদেরকেও এর পরেরদিন ফিরে আসতে হলো। তারপর আবারো আগের নিয়মেই সময় চলতে লাগলো। এর মাঝে ইচ্ছে ভার্সিটিতে ভর্তি হলো। নতুন ফ্রেন্ড হলো। শহরের কানাচে কানাচে ঘোরা হলো। তেমনি একদিন ক্লাস বাঙ্ক দিয়ে তারা দূরের এক রেস্টুরেন্টে খেতে যায়। ফ্রেন্ডদের সাথে তাল মিলিয়ে গল্প হাসির মাঝেই তার নজর যায় দূরের একটা টেবিলে। যেখানে ইহান বসে আছে। আ
তার সামনে একটা মেয়ে বসে আছে। ইচ্ছে অবাক হয়। ইহান এখানে কেন? কিন্তু পরক্ষণে তার মনে হয় হয়তো কোনো ক্লাইন্টের সাথে মিট করতে এসেছে হয়তো। আর মেয়েটিই হয়তো তার ক্লাইন্ট। সে ব্যাপারে সে আর গুরুত্ব দেয়নি এমনকি ইহান বাড়িতে ফিরলেও এ ব্যাপারে আর কথা হয়নি। আসলে সে চায়না ইহানকে নিয়ে কোনোরূপ সন্দেহ করতে। সন্দেহ একটা সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। এরপর থেকে বেশ কয়েকবার ইচ্ছে ইহানকে মেয়েটার সাথে দেখেছে। কখনো একসাথে রিকশায় কখনোবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। ইচ্ছে সবটা কেবল নিরবে পর্যবেক্ষণ করেছে। কিন্তু এবার রিতিমত সন্দেহ মোনে বাসা বেঁধে নিয়েছিল। ইহান আজকাল বড্ড অন্যমনষ্ক থাকে। ইচ্ছে জানতে চাইলে কথা ঘুরিয়ে নেয়। তবুও ইচ্ছে নিজেকে বোজাতে চাইতো ইহান হয়তো কাজে ব্যাস্ত তাই এমন বিহেভ করছে। কিন্তু হঠাৎ একদিন মাঝ রাতে ইহানের ফোনে কল আসে। ইচ্ছে তখন ইহানের বাহুডোরে বদ্ধ হয়ে শুয়ে ছিল। ইহান বোধহয় ভেবেছিল ইচ্ছে ঘুমিয়ে। সে ফোন হাতে বারান্দায় উঠে যায়। বারান্দা থেকে ফিসফিস কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই ইচ্ছে চোখ খুলে উঠে বসে। নিজের সন্দেহ দূর করতেই ধীর পায়ে এগিয়ে যায় বারান্দার দরজার কাছে।
–’আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না রুশা। একটু ভরসা রাখো প্লিজ।’
–’…….’
–’ডোন্ট ক্রাই রুশা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার বাচ্চাটার কথা ভেবে শান্ত হও প্লিজ।’
–’………’
–’আমি জানি ওর মা ওকে সবটা দিয়ে আগলে রখবে। তুমি কেবল ওকে পৃথিবীতে আসতে দাও।’
এতটুকুই সে শুনেছিল সেদিন। আর কিছু শোনার সাহস তার হয়নি। অন্য কারো গর্ভে ইহানের সন্তান শুনতেই দুনিয়া কেমন অন্ধকার হয়ে এসেছিল। তার প্রথম ভালবাসা! তার স্বামী! এভাবে ঠকলো সে? বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো। পাঁজরটা বুঝি ভেঙে চুরমার হলো। হৃদয় ভাঙার অনুভূতি বুঝি এমন হয়? কোনোরকম শরীরটাকে টেনে বেডে নিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো ইচ্ছে। ইহান আসলো আরো কিছুক্ষণ পর। পূর্বের মতোই খুব যত্নে বুকে টেনে নিয়েছিল। কিন্তু ইহানের স্পর্শ বিষাক্ত মনে হলো। কয়েক শত সাপ যেন একত্রে ছোবল দিল শরীরে। কি অদ্ভুত তাই না? যে মানুষটার সান্নিধ্যে সুখানুভূতি হোক আজ সেই মানুষটির স্পর্শে কেবল তিক্ততা।
ইচ্ছে চাইলেই পারতো ব্যাপারটা সকলকে জানিয়ে ইহানের থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিতে। কিন্তু সে সেটা করেনি। সমাজ কখনো ছেলেদের ভুলটি চোখে দেখে না। ঘুরে ফিরে অসহায় মেয়েটার দিকেই আঙ্গুল তুলবে। আজ সে যদি ডিভোর্স দিয়ে চলে যেত তাহলে সমাজ বলতো অন্য কোনো পুরুষে আকৃষ্ট হয়ে সংসার ছেড়েছে। কিন্তু এ অপবাদ সে কেন নিবে? ইচ্ছে এই লুকোচুরি খেলার শেষটা দেখতে চেয়েছিল। দেখতে চেয়েছিল তার প্রাণপ্রিয় স্বামীর বহুরূপ।
_______________
বর্তমান:
সকালের মৃদুমন্দ বাতাসে জানালার পর্দাটা তাল মিলিয়ে উড়ছে। নাম না জানা কিছু পাখির কলরব শোনা যাচ্ছে। শহরে কাকের কা কা শব্দ বাদে এসব সুমধুর সুর শোনা দুর্লভ। ইচ্ছে চুলগুলোকে হাত খোঁপা করে এগিয়ে গেল কাবার্ডের দিকে। নিজের কাপড় গুলো একে একে গুছিয়ে ছোট্ট ট্রলি ব্যাগটায় ভরে নিলো। এভাবে বাপের বাড়ি পড়ে থাকলেতো চলবে না। তাকে এগিয়ে যেতে হবে বহুদূর। সকল পিছুটান ছাড়িয়ে মুক্ত আকাশে গা ভাসিয়ে মেঘেদের ভ্যালায় ভাসতে হবে। নিজের থেকে আপন এ পৃথিবীতে আর কিছু নেই। নিজেকে ভালোবাসতে হবে সবটা দিয়ে। অপাত্রে ভালোবাসা দান করে কি লাভ? সেই তো কেবল দঃখ বেদনা কষ্টই গোছাতে হবে। গোছগাছ শেষ হলে গায়ে ওড়না জড়িয়ে বাহিরে বের হলো। সকালের এই সুন্দর পরিবেশে পুরো গ্রামটা ঘুরে দেখবে সে। আর কখনো যদি দেখার সুযোগ না হয়?!
মাটির রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে যেতেই খড়ের তৈরি একটা ঘর বাঁধলো। খুব শন্তর্পনে বাঁশের তৈরি সদর দরজা পেরিয়ে বাড়ির মধ্যে ডুকলো ইচ্ছে। উঠানে ছোট্ট একটা টুলে বসে চুলে বেনুনি কাটছে এক শ্যামকন্যা। ইচ্ছে পেছন থেকে হুট করে ঝাপটে ধরলো তাকে। হঠাৎ আক্রমনে চিৎকার করে উঠল তমা। তার চিৎকার শুনে ঘর থেকে তার মা ছুটে আসলেন। ইতিমধ্যে নিজের কাজে সফল হওয়ায় খিলখিল করে হেসে উঠল ইচ্ছে। প্রাণখোলা সে হাসি। বহুদিন বাদে এভাবে হাসলো মেয়েটা। এদিকে ইচ্ছেকে দেখে তমা বাকরুদ্ধ। খুশিতে চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে। কিছুটা অভিমান নিয়েই সে বলল,
–’আমাকে মনে আছে তাহলে? বিয়ের পরতো ডুমুরের ফুল হয়েছিস। এতদিন পর কিভাবে মনে পড়লো আমার কথা?’
ইচ্ছের মুখে আঁধার নেমে আসলো। বিয়ের পর একবার কি দুবার ফোনে কথা হয়েছিল তমার সাথে তার। ইহানের প্রেমে এতটাই মজেছিল যে অন্যকোনো দিকে ধ্যান ছিল না তার। কতটাই অন্ধ ছিল তার ভালোবাসা হায়!
তমা হয়তো বুঝলো ইচ্ছের অস্বস্তি তাই সে কথা ঘুরিয়ে নিল।
–’এত সকাল সকাল এলি যে? যাবি নাকি নদীর পাড়ে?’
ইচ্ছেও যেন স্বস্তি পেল। আর সময় নষ্ট না করে তমাকে সাথে বেরিয়ে পড়লো। উদ্দেশ্য খোলা নদীর পাড়।
চলবে………