#আমার_আকাশে_তারা_নেই ২
#লাবিবা_আল_তাসফি
১৩.
কোনো একদিন বধূ বেশে পা রেখেছিল এই চৌধুরী বাড়িতে ইচ্ছে। ভালোবেসে আগলে নিয়েছিল সংসারকে, সংসারের প্রতিটা সদস্যকে। পুত্রবধূ না সে মেয়ে হয়ে থাকতে চেয়েছিল এই পরিবারে। শাশুড়িকে নিজের মায়ের স্থানে জায়গা দিয়েছিল। মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার যে ভিষণ লোভ তার! সেই ছোট্ট থাকতে মাকে হারিয়েছে। মায়ের মুখটাও এখন অস্পষ্ট ঝাঁপসা। সেই অস্পষ্ট মুখে শাশুড়ির মুখ বসিয়ে আপন করে নিয়েছিল তাকে। কতোইনা স্বপ্ন ছিল তার! একটা ভালোবাসার পরিবার গড়ার স্বপ্ন। আজ সে পরিবারকে, পরিবারের সদস্যগুলোকে ছেড়ে যেতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। তার যে আর পরিবার গড়া হলোনা! মাঝ সমুদ্রেই হাড়িয়ে গেছে সব। তলিয়ে গেছে অতল গভীরে।
আজ চৌধুরী বাড়ির চুলো জ্বলেনি। ইরা ভোর বেলায় এসে পৌঁছেছে। আসার পর থেকেই রুমের দরজা বন্ধ করে ঘাপটি দিয়ে বসে আছে। শারমিন বেগম তার রুমে দরজা জানালা বন্ধ করে রুম অন্ধকার করে চুপটি করে আছে। সকাল থেকে কারো খাওয়া দাওয়া হয়নি। ইহান এখনো ঘুম। বাড়িতে ঘটা এসকল কিছু তার অজানা। নাজমুল সাহেব সোফায় বসে বেশ ফুরফুরে মেজাজে খবরের কাগজ পড়ছেন। এ বাড়িতে তিনিই একমাত্র খুশি। ঘড়িতে বেলা দশটা। কপাল কুঁচকে নাজমুল সাহেব হাঁক ছাড়লেন।
‘ব্রত পালন হচ্ছে নাকি এ বাড়িতে? সকালের নাস্তা কি পাবো না?’
শারমিন বেগম শুনলেন কিন্তু রুম থেকে বের হলেন না। একইভাবে বসে রইলেন। রুশা বাচ্চাকে ফিটার খাওয়াচ্ছিল। এক ফাঁকে যেয়ে সে বাচ্চার জন্য দুধ গরম করে এনেছে। ছোট বাচ্চাটাকে তো আর না খাইয়ে রাখা যায় না। তার পেটের মধ্যে ও ইঁদুর বিড়াল যুদ্ধ করছে। কিন্তু সে নিরুপায়। এছাড়াও তার ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। খালি পেটে তো ওষুধ খাওয়া যাবেনা। কি একটা ঝামেলা! নাজমুল সাহেবের চিৎকার শুনে সে দৌড়ে বের হলো। ভয়ে ভয়ে বলল,
‘আমি নাস্তা বানাই?’
নাজমুল সাহেব একবার সেদিকে তাকিয়ে মুখ গম্ভীর করে ফেলল। কোনো উত্তর দিলো না। রুশা বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মোন খারাপ করে রুমে ফিরে গেল। শারমিন বেগমতো তাকে বকার জন্য হলেও কথা বলে কিন্তু নাজমুল সাহেব কখনোই কোনো কথা বলেন না। রুশার ভিষণ খারাপ লাগে। এমনটাতো সে চায়নি। তবুও কেন এমন হলো?
_______________
ইচ্ছে আজ হালকা গোলাপি রঙের একটা লং শার্ট,কালো প্যান্ট পড়ে মাথায় স্কার্ফ পেঁচিয়ে নিয়েছে। বিয়ের পর এই ফাস্ট এমন পোশাকে নিজেকে সাজিয়েছে সে। ঠোঁটে হালকা রঙ ছুঁইয়েছে। আয়নায় একবার পরখ করে নিলো নিজেকে। অতিরিক্ত কান্নার দরুণ চোল লালা হয়ে ফুলে আছে। এটার কি ব্যাবস্থা নেওয়া যায়? অনেক ভেবে চিন্তে কালো রোদচশমা চোখে এটে কান্নার প্রমাণ লুকিয়ে নিলো। ডান হাতে পার্স নিয়ে অন্য হাতে ছোট লাগেজটা তুলে নিলো। বের হওয়ার পূর্বে রুমটিতে আরো একবার নজর বুলাতে ভুললো না। গোলাপ গাছটিকেও বিদায় জানিয়ে দিলো। ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখলো সবাই সেখানে উপস্থিত। ইহান যেহেতু কিছু জানেনা তাই সে চুপটি করে বসেছিল। ইচ্ছেকে এখনো কেউ খেয়াল করেনি। সকালের নাস্তা প্রস্তত না হওয়ায় কিছুটা রেগে আছে ইহান। হঠাৎ সে রুশাকে বলল,
‘সকালে খেয়েছো?’
রুশা মাথা নাড়িয়ে না বলতেই চিৎকার করে উঠলো ইহান। সুন্দর মুখশ্রি লাল হয়ে উঠেছে রাগের কারণে।
‘খাওনি কেন স্টুপিড? নিজের খেয়ালটাও রাখতে শিখোনি এখনো। বাচ্চা সামলাবে কিভাবে?’
রুশা মাথা নিচু করে নিলো। ইহান রাগে ফেটে পড়ছে যেন। সবকিছুর খেয়াল কি তাকেই রাখতে হবে? কেউ কেন তাকে বুঝে না? একটু শান্তিতে থাকতে দেয় না? হতাশ হয় সে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখলো ইচ্ছে। রুশার প্রতি ইহানের এমন ডেস্পারেট স্বভাব দেখে কষ্ট পেলো খুব। এই কেয়ার গুলোতো তার জন্য ছিল। একসযয় ইহান তার জন্য এমন অস্থির হতো, রেগে যেতো। ইচ্ছেও খুব ভালোবেসে মানিয়ে নিত তাকে। তবে কেন আজ তা অন্যের হলো? ইচ্ছের আর ভাবতে মন চাইলো না। এদের নিয়ে ভাবতে আর মন চায়না। এখন থেকে কেবল নিজেকে নিয়ে ভাববে সে। নিজের জন্য বাঁচবে। টিস্যু পেপারের সাহায্যে চোখের পানিটা মুছে সামনে এগিয়ে গেলো ইচ্ছে।
‘বাবা?’
অশান্ত পরিবেশটা শিন্ত হয়ে গেল। ইহান ডাক অনুসরণ করে তাকাতেই ইচ্ছেকে দেখে শান্তি অনুভব করলো। বহুদিন বাদে মেয়েটা তার সামনে এসেছে। কিন্তু পরক্ষনেই ইচ্ছের পোশাক আর হাতের দিকে তাকাতে চোখ কুঁচকে তাকালো। নাজমুল সাহেব সোফা ছেড়ে এগিয়ে এলেন। ইচ্ছের হাত থেকে ট্রলিটা নিজ হাতে নিয়ে হাসি হাসি মুখে বললেন,
‘দেরী হচ্ছে। চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’
ইচ্ছেও হাসি মুখে মাথা নাড়ালো। শারমিন বেগম ছলছল চোখে ইচ্ছের দিকে তাকালো। অনুনয়ের সূরে বলল,
‘সিদ্ধান্তটাকি তবে বদলানো যাবে না?’
ইচ্ছের কষ্ট হলো ভিষণ। এই মানুষটাকে সে নিজের মায়ের মতো ভালোবাসে। সেই মায়ের এমন অনুনয় তার বুকে সূচের মতো বিঁধছে। মন চাইছে সকল কিছু ভুলে এই মানুষটার জন্য হলেও থেকে যেতে। মায়ের আঁচল তলে আশ্রয় পেতে। কিন্তু সে জানে এটা সম্ভব নয়। এ পৃথিবীটা দুর্বলদের জন্য অনেক কঠিন। প্রতিনিয়ত দুর্বলদের পিষে ফেলা হয়। তাই এমন আবেগী মন নিয়ে এ সমাজে সে উঠে দাঁড়াতে পারবে না। তাকে কঠোর হতে হবে। সকল পিছুটান ছেড়ে সামনে আগাতে হবে। ইচ্ছে শারমিন বেগমকে পরম ভালোবাসায় আলিঙ্গন করলো। তবে মুখে কিছু বলল না। এই মানুষটাকে কোনো রকম কথা সে দিতে পারবে না। ইরা তখনি নিচে নামলো। ইচ্ছে ইরাকেও শক্ত করে আলিঙ্গন করলো। ইরা কাঁপা কন্ঠে বলল,
‘অপ্রয়োজনীয় শিকর উপরে ফেলে তবে নিজের ভালো থাকার ব্যাবস্থা করে নিয়েছো। আমি খুব খুশি তোমার এমন সিদ্ধান্তে। ভালো থাকো তুমি। সম্ভব হলে যোগাযোগ রেখো আমখর সাথে। খুব মিস করবো তোমায়।’
প্রতিউত্তরে বেদনাদায়ক হাসি ফিরিয়ে দিলো ইচ্ছে। আসলেই কি সে ভালো থাকবে? এখান থেকে দূরে গেলে কি অনুভুতির থেকেও দূরে যাওয়ি যাবে? তবে যেন তাই হয়। এ সকল তিক্ত অনুভূতির থেকে সে মুক্তি চায়। চিরতরে মুক্তি।
ইহান অবাক হয়ে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে তার টলমলে অশ্রু। বুকের ভেতর অদৃশ্য রক্তপাত হচ্ছে। সে যতটা আহত হয়েছে তার থেকেও বেশি অবাক হয়েছে। এতবড় একটা সিদ্ধান্ত মেয়েটা একা একাই নিয়ে ফেলল? একটাবার ভাবলো না তাকে ছাড়া ইহানের কি হবে? মেয়েটা একা একা ভিনদেশে কিভাবে কাটাবে? সে তো ঠিক করে নিজের যত্নও নিতে পারে না। পরক্ষনেই ইহানের মনে পড়লো এটাতো সেই ছোট্ট ইচ্ছে না। এই ইচ্ছে সব পারে। ইহানকে ছেড়ে দূরদেশে পাড়ি জমাতেও পারে। এই ইচ্ছের হৃদয় ইহানের জন্য ব্যাকুল হয়না। এই হৃদয় কেবল ইহানকে ঘৃণা করতে জানে। ইহান কিছু বলতে চেয়েও মুখ থেকে কোনো কথা উচ্চারণ করতে পারলো না। ইচ্ছে ইহানের দিকে একটা পেপার এগিয়ে দিল। নিজেকে কঠোর খোলশের মাঝে আটকে রেখে স্পষ্ট কন্ঠে বলল,
‘আমি সাইন করে দিয়েছি। বাকিটা আপনার মর্জি।’
আর অপেক্ষা করলোনা ইচ্ছে। বড় বড় পা ফেলে সদর দরজিয় এসে দাঁড়ালো। বাহিরে বের হ ওয়ার সাহস হচ্ছেনা তার। ইহানকে কি এটাই তার শেষ দেখা? প্রশ্নটা মনে আসতেই বুক কেঁপে উঠলো। নিজেকে বোঝাতে চেয়েও ব্যর্থ হয়ে পেছনে ঘুরে ইহানের সামনে এসে দাঁড়ালো। ইহান তখন স্টাচুর মতো ডিভোর্স পেপার হাতে দাঁড়িয়ে। ইচ্ছে কোনো কথা ছাড়াই ইহানের কোমল মুখশ্রী দু হাতে তুলে ধরে বিনা সংকোচে কপালে ওষ্ঠ ছোয়ালো প্রগভীর ভাবে। ইহান চোখ বন।ধ করে নিলো। এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়লো চোখ থেকে। প্রেয়সীর থেকে পাওয়া শেষ ছোঁয়া মন ভরে অনুভব করলো। এই ছোয়াটাকে খুব মিস করবে সে।
_____________
আমেরিকার বিলাসবহুল একটি শহর ওয়াশিংটন। এটা আমেরিকার রাজধানীও বটে। জনমানব পূর্ণ এই শহরটির ছোট্ট এক ফ্লাটে জায়গা হয়েছে ইচ্ছের। স্বপ্নের শহর হলেও শহরটা তার অচেনা। হঠাৎ করে এমন এক ভিন্ন পরিবেশে এসে মানিয়ে নিতে বেশ কষ্ট হয়েছে তার। এখানের মানুষদের চলাফেরা চিন্তা ধারণা সকলকিছু অনেক বেশিই আধুনিক। যার সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে হিমশিম খেতে হয়েছে তাকে। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন নিয়েছে সে। সাথে পার্ট টাইম জব। সব মিলিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে সে। এত ব্যস্ততার মাঝেও ফেলা আসা অতীতটা বড্ড তাড়া করে তাকে।
চলবে…….
(ভুলত্রুটি মার্জনীয়। রি চেইক করা হয়নি।)